স্বামী আনাস শেখকে ফোন করেছিলেন রেহানা বিবি। ফোনটা গেল না। তখন বেলা সাড়ে ১০টা, ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ ছিল সেটি। রেহানা বিবিও খুব একটা ভাবেননি। দু’ঘণ্টাও হয়নি, স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। রেহানা বলছেন, ‘‘ওই সকালে ওর ঠাকুমা মারা গেছে,’’ এই খবরটাই দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন তিনি।

‘‘সৎকার করার জন্য ও বাড়ি ফিরতে পারেনি সেদিন। তাই আমাকে সৎকারের সময়ে ভিডিও কল করার কথা বলেছিল,’’ বলছিলেন ৩৩ বছরের রেহানা, পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ভগবানপুর গ্রামে তাঁর এক কামরার কুঁড়ে ঘরে বসে। আনাস ১৭০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে- উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল পর্বতে। যখন রেহানা দ্বিতীয়বার ফোন করলেন তাঁকে, ফোনটা যায়নি।

সেই সকালে রেহানার দুটো ফোনকলের মাঝে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় দুর্ঘটনা হল। নন্দা দেবী হিমবাহের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। তার ফলে অলকানন্দা, ধৌলি গঙ্গা আর ঋষি গঙ্গা জুড়ে বন্যা। বন্যায় নদীতীরের বাড়িগুলো ধুয়ে গেছে, আটকে পড়েছেন অনেকে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এই এলাকার হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর শ্রমিকরাও।

আনাস তাঁদেরই একজন। কিন্তু রেহানা এত সব জানতেন না। ফলে পরের পর ফোন করেই যাচ্ছিলেন স্বামীকে। কিছুক্ষণ বাদে অস্থির হয়ে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন তিনি, ‘‘আমি বারবার ওকে ফোন করতে থাকি। জানতাম না, আর কী করা উচিত।”

Left: Rehna Bibi with a photo of her husband, Anas Shaikh, who's been missing since the Chamoli disaster. Right: Akram Shaikh works as a lineman in Kinnaur
PHOTO • Parth M.N.
Left: Rehna Bibi with a photo of her husband, Anas Shaikh, who's been missing since the Chamoli disaster. Right: Akram Shaikh works as a lineman in Kinnaur
PHOTO • Parth M.N.

বাঁদিকে: স্বামী আনাস শেখের ছবি নিয়ে রেহানা বিবি। চামোলি দুর্ঘটনার সময় থেকে আনাস শেখ নিখোঁজ। ডানদিকে: কিন্নৌরে লাইনম্যানের কাজ করেন আক্রম শেখ

চামোলি থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে হিমাচলপ্রদেশের কিন্নৌরে আনাসের ছোটো ভাই আক্রম টিভিতে খবরটি দেখেন। বলছেন তিনি, ‘‘আমার দাদা যেখানে কাজ করত, তার থেকে বন্যাদুর্গত এলাকা দূরে নয়। আমি সবচেয়ে খারাপ কথাটাই ভাবছিলাম।”

পরের দিন ২৬ বছরের আক্রম কিন্নৌরের তাপ্রি গ্রাম থেকে বাসে করে রাইনির (রাইনি চক লতা গ্রামের কাছে) দিকে যাত্রা শুরু করেন। ওখানেই চামোলির ঋষি গঙ্গা হাইডেল প্রোজেক্ট, যেখানে আনাস কাজ করতেন। সেখানে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স বন্যায় যাঁরা বেঁচে গেছেন তাঁদের জন্য তল্লাশি চালাচ্ছিল। বলছেন আক্রম, ‘‘দাদার সঙ্গে কাজ করতেন এমন একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁদের ৫৭ জনের দলের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন। বাকিরা সকলেই মারা গেছেন।”

আক্রম চামোলি থেকে রেহানাকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু খবরটা রেহানাকে দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমার আনাসের আধার কার্ডের একটা কপি দরকার ছিল। আমি রেহানাকে সেটা পাঠাতে বলি। সঙ্গে সঙ্গে রেহানা বুঝে যান, কেন সেটা আমার দরকার। পুলিশকে দাদার সম্পর্কে জানাতে হত, যদি তাঁরা দাদার দেহ খুঁজে পান।”

৩৫ বছরের আনাস ঋষি গঙ্গা পাওয়ার প্রোজেক্টে হাই ভোল্টেজ ট্রানসমিশন লাইনে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করতেন। মালদার কালিয়াচক ৩ ব্লকে তাঁর গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষের মতোই, কুড়ি বছর বয়স থেকে তিনি কাজের জন্য দেশান্তরি হয়েছেন। প্রতিবছর কয়েক দিনের জন্য বাড়ি ফিরতেন। তিনি যখন নিখোঁজ হলেন, তার আগে তেরো মাসে মাত্র একবারের জন্য ভগবানপুরে নিজের বাড়ি ফিরেছিলেন।

আক্রম জানান, পাওয়ার প্ল্যান্টে লাইনম্যানের কাজ হল ইলেকট্রিক টাওয়ার বসানো, তার সব ঠিক আছে নাকি দেখা, ফল্ট হলে ঠিক করা। আক্রমও একই কাজ করেন। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কুড়ি বছর বয়সে কাজের সন্ধানে গ্রাম ছাড়েন তিনিও। বলছেন তিনি, ‘‘আমরা কাজ করতে করতেই শিখেছি।” কিন্নৌরে যে হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করেন তিনি, সেখানে তাঁর বেতন মাসে ১৮ হাজার টাকা।

Rehna wants to support her children's studies by taking up a job
PHOTO • Parth M.N.

রেহানা জীবিকার সন্ধান করছেন যাতে সন্তানদের পড়াশোনা চালাতে পারেন

বহু বছর ধরেই ভগবানপুর গ্রামের পুরুষরা হিমাচলপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে পাওয়ার প্রোজেক্টে কাজ করার জন্য চলে যান গ্রাম ছেড়ে। ৫৩ বছরের আখিমুদ্দিন প্রথম লাইনম্যান হিসেবে কাজে গিয়েছিলেন ২৫ বছর আগে। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি হিমাচলপ্রদেশে ছিলাম। যখন শুরু করেছিলাম, তখন দিনে আড়াই টাকা পেতাম। যা পারতাম রোজগার করতাম, কিছু রেখে বাকিটা বাড়িতে পাঠাতাম যাতে পরিবার বাঁচতে পারে।” তাঁদের সময় থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে যে যোগাযোগের সুত্র তৈরি হল, তাতে আনাস ও আক্রামের পক্ষে তাঁদের দেখানো পথে কাজ পাওয়া সহজ হয়েছিল।

কিন্তু তাঁদের সকলের কাজেই যেটা আছে, তা হল বিপদ। আক্রম তাঁর বহু সহকর্মীকে ইলেকট্রিক শকে আহত হতে বা মারা যেতে দেখেছেন। ‘‘এটা বিপদের, ভয়ের। আমাদের সুরক্ষা বলতে তেমন কিছুই নেই। যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও বিপদ হতে পারে।” যেমন এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা যা তার দাদাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। (আনাস এখনও নিখোঁজ। তাঁর দেহ পাওয়া যায়নি।) আক্রমের কথায়, ‘‘কিন্তু আমাদের আর কোনও উপায় নেই। বাঁচতে গেলে রোজগার তো করতেই হবে। মালদায় কোনও কাজ নেই। আমাদের এখান থেকে বেরোতেই হয়।”

গোটা দেশের দরিদ্রতম জেলাগুলির একটি মালদা। গ্রামীণ জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশের জমি নেই, মজুরির উপর তাঁরা নির্ভরশীল। মালদার এক বরিষ্ঠ সাংবাদিক শুভ্র মৈত্র জানালেন, ‘‘চাষই এই জেলায় কাজের মূল উৎস। জমি যাদের আছে তাদের অধিকাংশেরই জোত খুব ছোটো অথবা তাঁরা প্রান্তিক কৃষক। ফি বছর বন্যায় বেশিরভাগ জমিই জলের তলায় চলে যায়। ফলে চাষি এবং খেতমজুরদের জন্য চাষের কাজে কোনই লাভ নেই।” তিনি আরও বললেন, জেলায় কোনও শিল্প নেই, ফলে এখানকার মানুষ বাধ্য হয়েই জীবিকার সন্ধানে রাজ্যের বাইরে চলে যান।

২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা প্রকাশিত, ‘দ্য ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে শ্রমিকদের পরিযানের কারণ। সেখানে উল্লেখ করা আছে, জলের অসম বণ্টন এবং চাষের জন্য প্রতিকূল জলবায়ু এলাকার খেতমজুরদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার সঙ্গে মন্থর নগরায়ন, শিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থানের অভাব, গ্রামাঞ্চলে শুধুমাত্র মরসুমি কাজের ফলে গড় মজুরিতে কমতি ইত্যাদি কারণে প্রান্তিক শ্রমিকদের কাজের জন্য দূর দেশে যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোভিড ১৯ সংক্রমণের ঘটনা বেড়ে চলার সময়েও ৩৭ বছরের নীরজ মণ্ডল আর একটু ভালো রোজগারের আশায় মালদা থেকে দিল্লি পাড়ি দেন। মালদার মানিকচক ব্লকে ভুতনি দিয়ারায় (নদীচরের দ্বীপ) তাঁর স্ত্রী ও দুই কিশোর সন্তানকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলছেন, ‘‘মাস্ক পরো, আর জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো। ২০২০-র লকডাউনের পর প্রায় কোনও কাজই ছিল না। সরকার যা দিয়েছে, তাতেই কোনও মতে চালিয়েছি। কিন্তু হাতে কোনও টাকা ছিল না। মালদা জেলায় কাজ খুব কম।”

তিনি বলছিলেন মালদায় যেখানে দৈনিক মজুরি ২০০ টাকা, সেখানে দিল্লিতে মজুরি ৫০০ - ৫৫০ টাকা। ‘‘আপনি বেশি জমাতে পারবেন, বাড়িতে পাঠাতে পারবেন। পরিবারকে ছেড়ে থাকতে অবশ্যই কষ্ট হয়। কিন্তু কেউ তো আর ইচ্ছে করে বাড়ি ছাড়ে না।”

Left: Niraj Mondol waiting to board the train to Delhi. Right: Gulnur Bibi says that her husband often doesn't find work in Maldah town
PHOTO • Parth M.N.
Left: Niraj Mondol waiting to board the train to Delhi. Right: Gulnur Bibi says that her husband often doesn't find work in Maldah town
PHOTO • Parth M.N.

বাঁদিকে: নীরজ মণ্ডল দিল্লির ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছেন। ডানদিকে: গুলনুর বিবি বলছেন, তাঁর স্বামী মালদা টাউনে প্রায় কখনওই কাজ পান না

তখন পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট শুরু হতে মাত্র কয়েকদিন বাকি ছিল। কিন্তু ভোট দিতে না পারায় দুঃখ নেই নীরজের। তিনি বলছেন, ‘‘বাস্তবে তো কিছুই বদলায় না। যতদূর আমি মনে করতে পারি, আমাদের গ্রাম থেকে চিরকালই পুরুষরা বাইরে কাজ করতে গেছে। সেটা আটকানোর জন্য কর্মসংস্থান করার জন্য কী করা হয়েছে? যারা মালদায় কাজ করেন, কোনও মতে টিকে থাকে শুধু।”

গুলনুর বিবির স্বামী জানেন, বিষয়টা আসলে কেমন। ৩৫ বছরের নিজমিল শেখ ভগবানপুরের সেই কতিপয় মানুষগুলোর একজন যিনি গ্রাম ছেড়ে যাননি। ভগবানপুরে ১৭ হাজার ৪০০ জনের বাস (আদমশুমারি ২০১১)। গ্রামে পরিবারটির ৫ একর জমি আছে, কিন্তু নিজমিল সেখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মালদা টাউনে একটি নির্মাণক্ষেত্রে কাজ করেন। তিরিশ বছরের গুলনুর বলেন, ‘‘দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মতো আয় হয়। কিন্তু কাজ সবসময় মেলে না। বেশিরভাগ সময়েই উনি খালি হাতে বাড়ি ফেরেন।”

সম্প্রতি গুলনুরের একটা অপারেশন হয়েছে। তাতে খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের জমির কিছুটা বিক্রি করতে হয়েছে। কোনও দরকার মেটানোর জন্য আমাদের কাছে টাকা নেই। কেমন করে ছেলেমেয়েদের পড়াব?” গুলনুর ও নিজমিলের তিন মেয়ে, দুই ছেলে। তাদের বয়স ৬ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।

আনাস নিখোঁজ হওয়ার আগে পর্যন্ত সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে রেহানাকে ভাবতে হয়নি। তাঁদের মেয়ে নাসরীবার বয়স ১৬, ছেলে নসীবের বয়স ১৫। তাদের বাবা যা টাকা পাঠাতেন, তাতেই তাদের পড়াশোনার সংস্থান হয়ে যেত। রেহানা বলছেন, ‘‘ও নিজের জন্য প্রায় কিছুই রাখত না। দিন মজুরি দিয়ে শুরু করেছিল, সম্প্রতি পার্মানেন্ট হয়েছিল। আমাদের তাকে নিয়ে কত গর্ব ছিল।”

চামোলির দুর্ঘটনার পরে দুইমাস কেটে গেছে, কিন্তু আনাসের না থাকাটা এখনও মেনে নিতে পারছেন না বলে জানালেন রেহানা। নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় এখনও পায়নি পরিবারটি। রেহানা এতদিন বাড়িতে থেকে গৃহকর্ম সামলাতেন। এখন তিনি গ্রামে অঙ্গনওয়াড়ি বা স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ নেওয়ার কথা ভাবছেন। বিলক্ষণ জানেন তিনি তাঁর একটা চাকরি লাগবে,  আর লাগবে প্রশিক্ষণও। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চাই না, কোনও ভাবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ব্যাহত হোক, তার জন্য যা করতে হয়, আমি করব।”

বাংলা অনুবাদ : রূপসা

Parth M.N.

Parth M.N. is a 2017 PARI Fellow and an independent journalist reporting for various news websites. He loves cricket and travelling.

Other stories by Parth M.N.
Translator : Rupsa

Rupsa is a journalist in Kolkata. She is interested in issues related to labour, migration and communalism. She loves reading and travelling.

Other stories by Rupsa