রক্তে ভেজা স্ট্রেচারটা দেখার পর শ্রীকৃষ্ণ বাজপেয়ী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর জেলায় নিজের বাড়ির বাইরে, ফেব্রুয়ারি মাসের এক প্রবল শীতের দুপুরে আগুন পোয়াতে পোয়াতে স্মৃতিচারণ করছিলেন ৭০ বছরের এই কৃষক, “সন্তান প্রসব যে খুব সহজ হবে না সে কথা জানিয়ে আমাদের আগেই সাবধান করা হয়েছিল। গ্রামের আশাকর্মী আমার বউমার গর্ভাবস্থাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে আগেই চিহ্নিত করে রেখেছিলেন।”

এসব ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের কথা বটে, তবু শ্রীকৃষ্ণের মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা। “(বন্যার) জল তখন সবে নেমেছে কিন্তু তাতে রাস্তাঘাট এমন ভেঙেচুরে গেছিল যে অ্যাম্বুল্যান্স আমাদের বাড়ি অবধি আসতেই পারল না,” তিনি জানালেন। তাঁদের পাড়া, টান্ডা খুর্দ লহরপুর ব্লকের অন্তর্গত হওয়ায় সেটি শারদা ও ঘর্ঘরা নদীর খুবই কাছে। এই গ্রামগুলি প্রায়শই আচমকা বন্যার প্রকোপে পড়ে বলে এখানে জরুরি পরিস্থিতিতে যানবাহনের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে যায়।

টান্ডা খুর্দ থেকে সীতাপুরের জেলা হাসপাতাল, ২৪ কিলোমিটার এমনিতেই যে কোনও প্রসূতি মায়ের পক্ষে দীর্ঘ পথ — তার উপর এর মধ্যে প্রথম পাঁচ কিলোমিটার পিছল পথ যদি অতিক্রম করতে হয় একটি দুইচাকার বাহনে তাহলে সেই একই পথ অনন্ত মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর কথায়, “কিন্তু আমাদের তা-ই করতে হয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স ধরার জন্য। গোলমাল অবশ্য দেখা দিতে শুরু করে আমরা জেলা হাসপাতালে পৌঁছাবার পর থেকেই।”

শিশুকন্যা জন্ম দেওয়ার পর থেকে মমতার রক্তপাত আর থামছিলই না। শ্রীকৃষ্ণ বললেন তিনি আশায় বুক বাঁধার চেষ্টা করছিলেন। “ঘটনা তো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। জানাই তো ছিল যে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিতেই পারে। কিন্তু ভেবেছিলাম ডাক্তাররা ওকে বাঁচাতে পারবেন।”

কিন্তু যখন তাঁকে স্ট্রেচারে করে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, শ্রীকৃষ্ণ আর স্ট্রেচারের উপরের সাদা চাদরটা দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি বলছিলেন, “চাদরের উপর এত রক্ত ছিল যে আমার শরীর গুলিয়ে উঠছিল। ডাক্তাররা আমাদের রক্তের ব্যবস্থা করতে বললেন। আমরা কিন্তু যথেষ্ট তাড়াতাড়িই রক্তের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম, ব্লাড-ব্যাঙ্ক থেকে আমারা ফেরার আগেই মমতা মারা যায়।”

ওর বয়স ছিল মাত্র ২৫।

Srikrishna Bajpayee says his daughter-in-law Mamata's pregnancy was marked as 'high-risk', “but we thought the doctors would save her”
PHOTO • Parth M.N.

শ্রীকৃষ্ণ বাজপেয়ী জানালেন যে তাঁর পুত্রবধূর প্রসব ‘ঝুঁকি-পূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হলেও 'ভেবেছিলাম ওকে ডাক্তাররা বাঁচাতে পারবেন'

মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে করা একটি স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে মমতার ওজন মাত্র ৪৩ কিলো। প্রয়োজনের চেয়ে অত্যধিক কম ওজন হওয়া ছাড়াও মমতার শরীরে প্রোটিনের অভাব ছিল এবং রক্তকণিকা ছিল ৮গ্রাম/ডিএল, অর্থাৎ গুরুতর রক্তাল্পতার সীমায় (প্রসূতি মায়েদের রক্তকণিকা থাকা উচিত ১১গ্রাম/ডিএল বা তার চেয়েও বেশি)।

জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৯-২১ ( এনএফএইছএস-৫ ) অনুসারে উত্তরপ্রদেশে, বিশেষত নারী ও শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। ১৫—৪৯ বছরের নারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি সেখানে রক্তাল্পতায় ভোগেন।

পুষ্টির অভাব এই রক্তাল্পতার সবচেয়ে বড়ো কারণ। পৃথিবীতে অর্ধেক রক্তাল্পতার কারণ আয়রনের অভাবজাত, কিন্তু ফোলেট (ভিটামিন বি৯) ও ভিটামিনি বি১২-এর অভাবও রক্তাল্পতার কারণ হতে পারে; তাছাড়াও কারণ হিসাবে কাজ করতে পারে কোনও সংক্রামক রোগ ও বংশগতি।

এনএফএইচএস-৫-এর তথ্য বলছে উত্তরপ্রদেশে, মাত্র ২২.৩ শতাংশ মা গর্ভাবস্থায় অন্তত ১০০ দিন আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সম্পূরক হিসাবে গ্রহণ করেন। ২০১৯-২১ সালে জাতীয় গড় ছিল এর প্রায় দ্বিগুণ — ৪৪.১ শতাংশ। কিন্তু সীতাপুরে এই সম্পূরক গ্রহণ করেছেন মাত্র ১৮ শতাংশ জন।

মা ও শিশুর ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার ফল সুদূরপ্রসারী। এর অন্যান্য প্রভাবের মধ্যে আছে অকাল-প্রসব ও কম ওজনের শিশুর জন্ম। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রসবকালীন মৃত্যু, মাতৃ-মৃত্যু ও মৃত শিশুর জন্ম হওয়ার সঙ্গে রক্তাল্পতার প্রত্যক্ষ যোগ আছে।

২০১৯-২১ সালে, ভারতে মাতৃমৃত্যুর (এমএমআর) অনুপাত ছিল ১০০,০০০ জাতক পিছু ১০৩ জন মৃত মা। ওই একই সময় উত্তরপ্রদেশের এমএমআর ছিল ১৬৭। ২০১৯ সালে রাজ্যে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ১,০০০ জন পিছু ৪১ জন , জাতীয় হার, ৩০-এর তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি।

Srikrishna and his wife, Kanti, keeping warm by the fire. They mostly eat khichdi or dal rice as they have had to cut down on vegetables
PHOTO • Parth M.N.

শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রী কান্তি আগুন পোয়াচ্ছেন। তরিতরকারি কিনতে না পারার কারণে ওঁরা সাধারণত খিচুড়ি বা ডাল ভাত খেয়ে থাকেন

মমতার মৃত্যুতেই যে বাজপেয়ি পরিবারের যাতনার ইতি হয়েছিল, তা নয়। তাঁর শিশুকন্যাটিও ২৫ দিনের মাথায় মারা যায়। শ্রীকৃষ্ণ বাজপেয়ী বলছিলেন, “একটা শোক থেকে বেরোবার আগেই আমাদের উপর নেমে এল আরেক আঘাত। আমরা বাকহারা হয়ে গেছিলাম।”

মমতা ও তাঁর শিশুটি অতিমারির ছয়মাস আগে কয়েকদিনের ব্যবধানে মারা যায়। এর উপর কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশব্যাপী জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বলতর হয়ে যায়, এবং এর ফলে মাতৃ-স্বাস্থ্য সূচকে দেখা দেয় আরও অবনতি।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা তথ্য সূত্র থেকে নেওয়া তথ্য পরীক্ষা করে পপুলেশন ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে যে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে জুনের তুলনায় ২০২০ সালের ওই একই সময়ে মায়েদের প্রসব-পরবর্তী যত্ন পৌঁছে দিতে তাঁদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে, ২৭ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। প্রসব-পূর্ববর্তী যত্নের ক্ষেত্রে ঘাটতি ২২ শতাংশ। “মাতৃ-স্বাস্থ্য পরিষেবায় ব্যাঘাত, স্বাস্থ্য পরিষেবা চাওয়ার প্রবণতায় ঘাটতি, পরিষেবা প্রদানকারীদের থেকে রোগ সংক্রমণের ভয় ইত্যাদি কারণে প্রসূতিদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং এর ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা আরই খারাপ হয়ে পড়ে,” পিএফআই, একটি বার্তায় জানাচ্ছে।

পাপ্পু ও তাঁর পরিবার অতিমারির ফলাফল হাতেনাতে ভোগ করেছেন।

কোভিড-১৯ অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কা যখন তুঙ্গে, পাপ্পুর স্ত্রী তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। ২০২১ সালের জুন মাসের এক বিকেলে তিনি হাঁপ অনুভব করেন, যা নাকি রক্তাল্পতার লক্ষণ, তারপর তিনি জ্ঞান হারান। “সে সময় বাড়িতে কেউ হাজির ছিল না,” জানালেন ৩২ বছরের পাপ্পু। “আমি বেরিয়েছিলাম কাজের খোঁজে আর আমার মা-ও তখন ঘরে ছিল না।”

পাপ্পুর মা, ৭০ বছর বয়সী মালতী জানালেন যে সরিতাকে সেদিন সকালেও দিব্যি দেখাচ্ছিল। “দুপুরে ও বাচ্চাদের জন্য খিচুড়িও রান্না করল।”

Pappu could not get to the hospital in time with Sarita, his pregnant wife, because of the lockdown.
PHOTO • Parth M.N.
His mother Malati and daughter Rani
PHOTO • Parth M.N.

বাঁদিকে: লকডাউনের কারণে পাপ্পু তাঁর স্ত্রী সরিতাকে নিয়ে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেননি। ডানদিকে: ওঁর মা মালতী ও কন্যা রানি

কিন্তু সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখেন ২০ বছর বয়সী সরিতাকে কেমন ফ্যাকাসে আর দুর্বল দেখাচ্ছে। “ও সহজে নিঃশ্বাস নিতেই পারছিল না।” সেই কারণে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বারাণসী জেলার বরাগাঁও ব্লকে তাঁদের গ্রাম দল্লিপুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভাদোহি যাওয়ার জন্য একটি অটোরিকশা ভাড়া করেন। “এখানকার (বরাগাঁও) কোনও হাসপাতালে জায়গা ছিল না, আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তো কোনও সুবিধাই নেই,” তিনি জানালেন। “ভাবলাম আমাদের কোনও বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়া উচিত যেখানে গেলে হয়তো ঠিকমতো চিকিৎসা পাওয়া যাবে।”

দক্ষতার অভাবে ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্যব্যবস্থা অতিমারি পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারায় সারা বিশ্বে বিরূপ অবস্থায় পড়েছে মাতৃ-স্বাস্থ্য। ১৭টি দেশে থেকে অবস্থার পরিবর্তন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে দ্য লান্সেট ২০২১ সালে মাতৃত্ব, ভ্রূণ, ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর অতিমারির প্রভাব নিয়ে বলেছে, “এর ফলে মা ও শিশুর এমন মৃত্যু ঘটেছে যা এড়ানো যেত। স্বল্প-সম্পদ বিন্যাসে, বহু দশক ধরে অর্থ ব্যয় করে মা ও শিশু মৃত্যুর হারে যে হ্রাস ঘটানো সম্ভম হয়েছিল তা জারি রাখতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার ছিল।”

কিন্তু গর্ভবতী মায়েদের জন্য রাজ্য জরুরি ভিত্তিতে আদতে কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি।

হাসপাতালে পৌঁছবার আগে অটো-রিকশাতেই সরিতার মৃত্যু হয়। “লকডাউনের কারণে পথে আমাদের ক্রমাগত দেরি হয়ে যাচ্ছিল,” জানালেন পাপ্পু। “পথে অনেকগুলি চেকপয়েন্ট থাকায় বারে বারে যানবাহন দাঁড় করাতে হচ্ছিল।”

পাপ্পু যখন বুঝতে পারলেন যে সরিতা মারা গেছেন তখন স্ত্রীকে হারাবার শোকের চেয়েও পুলিশের ভয়টাই যেন তাঁকে বেশি করে চেপে ধরল। মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছেন জানলে পুলিশ কী বলবে এই ভেবে তিনি অটো চালককে গ্রামে ফিরে যেতে বলেন। তাঁর কথায়, “চেকপয়েন্ট দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমি খুব সাবধানে দেহটিকে খাড়া করে বসিয়ে রাখছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে কোনও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি বা আমাদের কেউ আটকায়নি।”

শেষকৃত্যের জন্য মালতী আর পাপ্পু মৃতদেহটি কাছের একটি শ্মশানে নিয়ে যান। এই কাজের জন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে তাঁদের ২,০০০ টাকা ধার করতে হয়েছিল। “আমি একটি ইটভাটায় কাজ করতাম কিন্তু লকডাউনে সেটাও বন্ধ হয়ে যায় (মার্চ ২০২০),” বললেন পাপ্পু। তিনি উত্তরপ্রদেশের প্রান্তিকতম তফসিলি জাতির অন্যতম, মুসহর সম্প্রদায়ের সদস্য।

Pappu weaves carpets to earn an income now. He stopped working at brick kilns after Sarita's death to stay home and take care of the children
PHOTO • Parth M.N.
Pappu weaves carpets to earn an income now. He stopped working at brick kilns after Sarita's death to stay home and take care of the children
PHOTO • Parth M.N.

সরিতার মৃত্যুর পর থেকে পাপ্পু ইটভাটার কাজ ছেড়ে জীবিকার জন্য গালিচা বোন শুরু করেছেন যাতে বাড়িতে থেকে ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনা করতে পারেন

লকডাউনের আগে ইটভাটার কাজ থেকে তিনি মাসে ৬,০০০ টাকা আয় করতেন। “ইটভাটা এখন খুলেছে কিন্তু আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে আমি ওই কাজ করা ছেড়ে দিয়েছি। আগের মতো আর অত বেশি বাইরে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকার দরকার হয় এখন,” জানালেন তিনি।

গালিচা বোনাটাই তাঁর নতুন জীবিকা হয়েছে — এই কাজে তিনি যখন ক্রমে হাত পাকান ওঁর দুই সন্তান, জ্যোতি আর রানি চেয়ে থাকে বাবার দিকে। “সবে কয়েকমাস আগে আমি এই কাজ শুরু করেছি,” জানালেন তিনি। “দেখা যাক কেমন দাঁড়ায়। এর ফলে আমি বাচ্চাদের সঙ্গে বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতে পারি। আমার মায়ের অনেক বয়স হয়েছে, উনি আর বাচ্চাদের দেখাশুনা করতে পারেন না। সারিতা বেঁচে থাকতে ও আর মা মিলে ওদের দেখাশুনা করত। ওর পেটে বাচ্চা আসার পর কী করব আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। ওকে একা ফেলে যাওয়া আমাদের উচিত হয়নি।”

মানবাধিকারের উপর বারাণসী কেন্দ্রিক একটি গণ-নজরদারী কমিটির এক কর্মী, মঙ্গলা রাজভর, জানালেন যে কোভিড-১৯-এর সময় থেকেই বরাগাঁও ব্লকে প্রসূতি-স্বাস্থ্য আরও বেশি অবহেলার শিকার হয়েছে। “এই ব্লকের বহুজন রক্তাল্পতায় ভোগেন। তাঁদের অতিরিক্ত বিশ্রাম ও যত্ন দরকার হয়,” বললেন রাজভর, তিনি বরাগাঁওয়ের স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। “কিন্তু দারিদ্রের কারণে বাড়ির পুরুষরা বাধ্য হন অন্যত্র কাজের খঁজে চলে যেতে। ফলে মহিলারা খেত আর বাড়ি - দুই যায়গাতেই কাজ সামলান।”

এই মহিলাদের খাদ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন দরাকার হলেও তাঁরা গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে পাওয়া খাদ্য সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই রান্না করে উঠতে পারেন না কারণ বাইরে থেকে আনাজপাতি কেনার ক্ষমতা তাঁদের নেই। “উন্নত স্বাস্থ্যপরিষেবা গ্রহণ করার সাধ্য তাঁদের নেই। অসুবিধায় ভরা তাঁদের জীবন।”

টান্ডা খুর্দের আশা-কর্মী, আরতি দেবী জানালেন সেখানে বহু মহিলার ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং তাঁরা রক্তাল্পতায় ভোগেন, আর তার ফলেই প্রসবকালে দেখা দেয় বিভিন্ন জটিলতা। তাঁর কথায়, “এখানে মানুষ তো কেবল ডাল ভাত খেয়ে থাকে। পুষ্টির অভাব লেগেই থাকে সবার। খাদ্য তালিকায় তরিতরকারি প্রায় থাকেই না। কারও হাতে যথেষ্ট টাকা-পয়সা নেই।”

শ্রীকৃষ্ণের ৫৫ বছর বয়সী স্ত্রী কান্তি জানালেন যে কৃষি থেকে আয় এখন নিম্নমুখী। “আমাদের মাত্র দুই একর জমি আছে আর তাতেই আমরা ধান আর গম চাষ করি।”

Priya with her infant daughter. Her pregnancy was risky too, but she made it through
PHOTO • Parth M.N.

শিশুকন্যা সমেত প্রিয়া। তাঁর গর্ভাবস্থাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু কোনও রকমে বেঁচে যান তিনি

কৃষির উপর নির্ভরতা কমাতে কান্তির ৩৩ বছরের পুত্র তথা মমতার স্বামী বিজয় সীতাপুরে কাজ নিয়েছিলেন। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রকোপে কাজ তাঁর চলে গেলেও সেই কাজ তিনি ফিরে পান ২০২১ সালে। কান্তি জানালেন, “ওর বেতন ৫,০০০ টাকা। লকডাউনের আগে আমরা এতেই চালিয়ে নিতাম। তবে সবজি কেনা আমাদের বন্ধই রাখতে হত। লকডাউনের আগেও এতে ডাল ভাতের বেশি কিছু জোটানো মুশকিল ছিল। কোভিডের পর থেকে আমরা আর চেষ্টাও করি না।”

একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে ২০২০ সালে কোভিড-১৯-এর কারণে আয়ে ঘাটতির ফলে সারা ভারতে, ৮৪ শতাংশ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির উপর।

রাজভর ও আরতি দেবী মনে করেন যে ক্রমশ বেড়ে চলা দারিদ্র, অপ্রতুল মাতৃ-স্বাস্থ্য পরিষেবা, অনিয়মিত লৌহঘটিত ও ফলিক অ্যাসিড সম্পূরক গ্রহণ ইত্যাদি কারণে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার সংখ্যা কমানোর কাজটিকে কঠিনতর করে তুলেছে। এই কথা বেশি প্রযোজ্য, গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে, কারণ জনস্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া সেখানে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।

মমতার মৃত্যুর দেড় বছরের মাথায় বিজয় আবার বিয়ে করেন। ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রিয়া ২০২১ সালের গোড়ায় সন্তানসম্ভবা হন। তাঁরও শরীরে রক্তাল্পতা ছিল এবং তাঁর গর্ভাবস্থাকেও অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নভেম্বর ২০২১ নাগাদ যখন তাঁর প্রসবকাল আসন্ন তখন টান্ডা খুর্দে বন্যার জল সবে নেমেছে।

মমতাকে যেদিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেদিনটির সঙ্গে অদ্ভুত মিল দেখে শ্রীকৃষ্ণের অস্বাস্তি লাগে। কিন্তু এবারের বন্যার অবস্থা ততটা খারাপ ছিল না বলে অ্যাম্বুল্যান্স বাড়ির দরজা অবধি আসতে পারে। প্রিয়াকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাঁর পরিবার। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান এবং একটি সুস্থ কন্যা সন্তানের জন্ম দেন — ওর নাম স্বস্তিকা। এইবারের পরিস্থিতি তাঁদের অনুকূল ছিল।

ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে পার্থ এম. এন. জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।

অনুবাদ: চিলকা

Parth M.N.

Parth M.N. is a 2017 PARI Fellow and an independent journalist reporting for various news websites. He loves cricket and travelling.

Other stories by Parth M.N.
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka