জনসমাগম দেখলে মনে হতেই পারে যেন সচিন তেন্ডুলকর ক্রীড়া-জীবনের শেষ টেস্ট খেলতে নেমেছেন। টানা ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেও খেলা শুরুর পাঁচ ঘণ্টা আগে থেকেই লাখ দুয়েক মানুষকে জড়ো হতে দেখলে যে কেউ হয়তো সেটাই ভাববে। কুন্ডল শহরের হিসাবে কিন্তু এই সংখ্যাটা “গড়ের চেয়ে কম”। মহারাষ্ট্রের জনপ্রিয়তম খেলার প্রধান প্রতিযোগিতাগুলোর একটা প্রতিবছর কুন্ডলেই অনুষ্ঠিত হয়। আর না, খেলা বলতে এখানে ক্রিকেট না, হচ্ছে কুস্তির কথা। কুস্তির মতো আর কোনও খেলাই বোধহয় গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের, বিশেষত পশ্চিম মহারাষ্ট্রের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে এতটা অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত নয়। কৃষির উপর কুস্তির নির্ভরশীলতাটা এমন পর্যায়ে যে গত বছর জলসংকটের সময়ে কুন্ডলের প্রতিযোগিতা বাতিল পর্যন্ত করে দিতে হয়।

“এই খরার মধ্যে তিন লাখ লোকের জন্য জলের ব্যবস্থা করার কথাটা একবার কল্পনা করুন তো,” জনৈক উদ্যোক্তার বক্তব্য।

মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ এলাকায় কুস্তি দাঁড়িয়ে আছে খেলা, রাজনীতি আর সংস্কৃতির সংযোগস্থলে। শহরে কুস্তি যে নেই এমনটা নয়। কিন্তু কুস্তিগিরদের সবাই উঠে আসেন গ্রাম থেকেই। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন কুস্তি আকাদেমি ঘুরে দ্য হিন্দু প্রদত্ত সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুযায়ী, এইসব কুস্তিগিরদের বেশিরভাগই দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান।

পশ্চাদপসারণ

বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই মহারাষ্ট্রের কৃষি সংকটের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কুস্তি। গত বছরের খরা, এই বছরের গোড়ার দিকের জলসংকট সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। “শুখা আমাদের বড্ড ক্ষতি করেছিল,” কোলহাপুর শহরে নিজের কুস্তির তালিমে (আকাদেমিতে) বসে জানালেন মহারাষ্ট্রের অন্যতম সেরা কুস্তিগির আপ্পাসাহেব কদম। “বেশিরভাগ স্থানীয় প্রতিযোগিতা বাতিল হয়ে গেছিল।” আর যেগুলো বাতিল হয়নি, সেখানে পুরস্কারমূল্য কমে গিয়েছিল। “বহু ছাত্র তালিম ছেড়ে দেয়, তাদের পরিবার সন্তানদের জন্য যে বিনিয়োগ করেছিল তারও লোকসান হয়।” এই মরসুমে অতিবৃষ্টির জন্য হয়তো একই ঘটনা পুনরায় ঘটতে চলেছে।

ছোটোখাটো টুর্নামেন্ট জিতলে পুরস্কার হিসাবে অনেকসময়েই ট্র্যাক্টর পাওয়া যায়। সাংলি জেলার কুন্ডলে আয়োজিত বিশাল কুস্তি প্রতিযোগিতার দুজন আয়োজক বালাসাহেব লাড আর অরুণা লাড জানালেন যে প্রতিযোগিতাগুলোয় অনেক সময়েই বিভিন্ন কোম্পানি টাকা বিনিয়োগ করে। “তবে প্রতি পঁচিশ লাখ পিছু পনেরো লাখই আসে সাধারণ শেতকরির (চাষির) থেকেই। তাদের পরিস্থিতি খারাপ হলে, কুস্তিরও হাল খারাপ হয়।”

সচ্ছল জীবনের চাবিকাঠি

গ্রামের গরিব মানুষের কাছে কুস্তি দারিদ্র্য ছেড়ে বেরিয়ে আসার, সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তির একটা পথ। কোলহাপুরে কদম বলেছিলেন, “তাদের (কুস্তিগিরদের) শতকরা নব্বই ভাগই গরিব কৃষক পরিবারের থেকে আসে। আর বাকিরা খেতমজুর, ছুতোর ইত্যাদি পরিবারের সন্তান। কেউই শিক্ষিত শ্রেণির নয়। কুস্তি আদতে একটা আবেগ। খুব বেশি হলে এদের মধ্যে পাঁচ শতাংশ পালোয়ান উচ্চস্তরে পৌঁছায়।”

কুস্তিগির হয়ে ওঠার এই উৎসাহ থেকেই বহু বাচ্চা ছেলে কদমের তালিমে দু-তিনটে ছোটো ঘরে ভাগাভাগি করে থাকে, দল বেঁধে নিজেদের রান্নাবান্না করে। তালিমের অনুশীলন সকালবেলা পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা অবধি চলে। অনেকেই তার আগে ভোর চারটের সময় দৌড়াতে যায়। সকালের অনুশীলন শেষ হলে কমবয়সি যারা, তারা সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি ইশকুল করে। ইশকুল শেষ হবার আধ ঘণ্টা পরে আবার অনুশীলন শুরু হয়, চলে সন্ধে সাড়ে আটটা অবধি। রোজকার জীবনে চরম নিয়মানুবর্তিতাই প্রত্যাশিত। “উঠতি ক্রিকেটাররা হয়তো বছরে চার মাস অনুশীলনে করে। কুস্তির জন্য দশ বছরের তালিমও যথেষ্ট নয়।”

কৃষক, কৃষিশ্রমিকরা তালিমে এসে গুরুদের কাছে তাঁদের ছেলেপিলেদের পালোয়ানির শিক্ষা দেবার জন্য অনুনয় বিনয় করেন। ভোর ছটা সবে হয়েছে কি না, নিজের আকাদেমিতে বসে তিরাশি বছরের গণপতরাও অন্ধালকর ইতিমধ্যেই ব্যস্ত কুস্তি শেখাতে হয়ে পড়েছেন। শিক্ষার্থীদের বয়স আট বছর থেকে শুরু। অন্ধালকর নিজে এশিয়াডে সোনাজয়ী এবং অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী প্রাক্তন কুস্তিগির। তিনি বয়সে অপেক্ষাকৃত বড়ো ছাত্রদের মহড়ার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে রাখতে কমবয়সি ছাত্রদের কুস্তির প্যাঁচ আর পাঁয়তারা বোঝাচ্ছেন। কখনও সখনও চেঁচিয়ে নির্দেশ দিয়ে ওঠেন বা ছাত্রদের বকাঝকা করে ওঠেন। মাঝেমধ্যেই বসার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কমবয়সি শিক্ষার্থীদের পাশে নিয়ে মহড়ার একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ান, মহড়ারত ছাত্রদের প্যাঁচের কৌশল ব্যাখ্যা করেন, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন।

“কুস্তি কৃষি অর্থনীতির মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। অথচ সেই অর্থনীতিই আজ ঠুনকো,” অন্ধালকর বললেন। “তালিমগুলোর মাইনে যৎসামান্য - হয়তো মাসে একশো দুশো টাকা।” অন্ধালকর নিজেও তালিমের মাইনে থেকে যা উপার্জন করেন, তার থেকে অনেক বেশি পান রাজ্যজুড়ে নানা অনুষ্ঠানে “প্রধান অতিথি” হিসাবে যোগদান করে। সবচেয়ে গরিব ছাত্রদের থেকে তিনি কোনও টাকাই নেন না। “তবু ডায়েটের বিশাল খরচ তো নিজেদেরকেই বইতে হয়।”

PHOTO • P. Sainath

অমিল সরকারি সহায়তা

বহু প্রথম সারির পালোয়ান তৈরি করা সত্ত্বেও এবং বিভিন্ন ফেডারেশনের মাথায় বড়ো বড়ো রাজনৈতিক নেতারা বসে থাকার পরেও কুস্তির গুরুরা সরকারের থেকে প্রায় কোনও সাহায্যই পাননি। গোটা পশ্চিম মহারাষ্ট্র জুড়েই এই অভিযোগ যে পঞ্জাব হরিয়ানায় কুস্তিগিররা অনেক বেশি মর্যাদা পান।

কুস্তিগিরদের ডায়েটের খরচ অনেক, পুণে শহরে নিজের তালিমে বসে প্রাক্তন এশিয়াড, কমনওয়েলথ এবং জাতীয় পদকজয়ী বর্ণময় ব্যক্তিত্ব কাকা পাওয়ার জানালেন। বয়সে বড়ো যারা, তাদের রোজ চারশো গ্রাম বাদাম, চার লিটার খাঁটি দুধ, পাঁচশ গ্রাম ঘি, বেশ কয়েকটা ডিম, ফল, আর শাকসবজি প্রয়োজন। এর বাইরেও সপ্তাহে তিনদিন খাসির মাংস চাই। “সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় দিনে সাতশো টাকা, কমবয়সিদের ক্ষেত্রে মোটামুটি পাঁচশো।”

গরিব কৃষক পরিবারগুলির জন্য এটা বিশাল একটা বিনিয়োগ, “তবে মাঝেসাঝে গ্রামের মানুষজন সাহায্য করে।” কয়েক বছরের মধ্যে কমবয়সিরা হয়তো মহড়াপিছু দু হাজার টাকা পাবে, যাদের বয়স বেশি তারা হাজার পাঁচেক। পালোয়ান উন্নতি করতে থাকলে টাকার পরিমাণও বাড়তে থাকে। মেলা, উৎসব উপলক্ষ্যে লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়। কুস্তির অনেক মহড়াও আয়োজিত হয়। কখনও কখনও উঠতি কুস্তিগিরদের জন্যে দর্শকরা টাকাও দেন। আর কিছু কিছু প্রতিযোগিতা এমনও আছে যেখানে সবচেয়ে ভালো কুস্তিগিররা কুড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাজা অবধি জিতে ফেলতে পারে, আপ্পাসাহেব কদম জানান।

এই বছরের শুরুতে বহু প্রতিযোগিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় সচিন জামদার বা যোগেশ বোম্বালের মতো প্রথম সারির তরুণ পালোয়ানরা বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। প্রতিভাবান সন্তোষ সুতার জানাচ্ছেন যে, “কোলহাপুরের তালিম ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এই সাংলি জেলার আটপাডি গ্রামে আমার পরিবারের কাছে আমাকে ফিরে আসতে হয়।”

ম্যাটের উপরে কুস্তির চল খেলার সাবেক ধরনটাকেই পাল্টে দিচ্ছে। “ভারতীয় কুস্তিগিরদের জন্ম মাটি থেকে, ম্যাট থেকে নয়,” বক্তব্য কুস্তির দুনিয়ায় প্রবাদপ্রতিম অন্ধালকরের। শয়ে শয়ে গ্রামে বহুজনের শ্রমলব্ধ অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কুস্তির জন্য কাদামাটি তৈরি হয়। মাটির সঙ্গে দই, চুনজল, ঘি আর হলুদ মেশাতে হয়। শেষ উপাদানটির দরকার পড়ে তার ঔষধিগুণের জন্য, কুস্তিগিরদের চোটের উপশমের জন্য। (কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাটির মিশ্রণের সঙ্গে কিঞ্চিৎ মাংসসের কিমাও যোগ করা হয়।)

হকির সমান্তরালে

কুস্তির সাধারণ আকারের ম্যাটের মাপ চল্লিশ ফুট বাই চল্লিশ ফুট, তার দাম পড়ে প্রায় সাত লাখ টাকা। এই আকারের ম্যাট তো দূরস্থান, গ্রামের গড়পড়তা তালিমগুলো এর থেকেও ছোটো আকারের ম্যাট কেনারও সামর্থ্য রাখে না। রক্ষণশীল যাঁরা, তাঁরা বলেন যে সবাই ম্যাট ব্যবহার করতে গেলে বেশিরভাগ স্থানীয় প্রতিযোগিতাই বন্ধ হয়ে যাবে। কারও কারও মতে ম্যাটের ব্যবহার, “হকির ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রোটার্ফ যা করেছে, কুস্তির ক্ষেত্রেও তাই-ই করবে। স্থানীয় জনসমাজের তা (অ্যাস্ট্রোটার্ফ) কেনার সামর্থ্য ছিল না, আর তার ফলে ভারত আর পাকিস্তান খেলার উপর নিজেদের আধিপত্য হারিয়ে ফেলে।” ম্যাটের উপরে কুস্তি চলে দ্রুতগতিতে। মহড়া কয়েক মিনিটেই শেষ হয়ে যায়। অথচ মাটির ময়দানে মহড়া চলতে পারে পঁচিশ মিনিট অবধি। “পার্থক্যটা নাটকীয়তার দিক থেকে যতটা, ততটাই সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আর খেলা হিসাবেও,” অন্ধালকার বলেছিলেন।

গত বছর আটপাডিতে সমস্ত কুস্তির প্রতিযোগিতা বাতিল হয়ে গেছিল। সেই আটপাডি গ্রামে শিক্ষক নামদেও শ্রীরং বাদারের গলা থেকে হতাশা ঝরে পড়ল, “অবিরাম জলসংকটের ফলে প্রতি মরসুমে আরও বেশি বেশি লোক কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছে। কৃষির মৃত্যু হলে, কুস্তিরও মৃত্যু হবে।”

এই প্রতিবেদনটি দ্য হিন্দু তে ২০১৩ সালের ৩০শে অক্টোবর প্রথম প্রকাশিত হয়।

অনুবাদ: শাশ্বত গাঙ্গুলী

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Shashwata Ganguly

Shashwata Ganguly, originally from Budge Budge, West Bengal is currently based in Germany. An astrophysicist by training, he likes to imagine himself as a writer of fiction. He is enthusiastic about literature and translation.

Other stories by Shashwata Ganguly