“কাড়ালিলে রাজভ তিমিঙ্গিলম আন্নেঙ্কিলুম জ্ঞাম্মালে, মীণপানিক্কারে রাজভ মাতিয়ান্ন [মহাসাগরের রাজা শুশুক হলেও আমাদের রাজা, মৎস্যজীবীদের রাজা কিন্তু খয়রা]।”

কেরালার ভাদাকারা শহরের চোম্বল ফিশারি বন্দরে মাছ তোলা-পাড়ার (লোডার) কাজ করেন বাবু (নাম পরিবর্তিত)। বেশ কয়েক দশক ধরে এই কাজটি — মূলত খয়রা মাছ (সার্ডিনেল্লা লঙ্গিসেপস্ বা ইন্ডিয়ান অয়েল সার্ডিন) খালাসের কাজ করে আসছেন তিনি।

সকাল সাতটা নাগাদ জাহাজঘাটায় পৌঁছে যান বাবু। গিয়েই কাজের জন্য আলাদা করে রাখা জামাকাপড় পরে নেন — নীল মুন্ডু (ধুতি), গেঞ্জি (টি-শার্ট) ও একজোড়া হাওয়াই চপ্পল। তারপর হাঁটুজল ঠেলে সাগরের দিকে হেঁটে যান এই ৪৯ বছর বয়সি লোডার, লক্ষ্য সারি সারি নৌকা। “পানিতে বড্ড গন্ধ, তাই আমাদের প্রত্যেকেই [তোলা-পাড়ার কাজ করেন যাঁরা] কাজের জন্য আলাদা চপ্পল আর পোশাক মজুত রাখি,” জানালেন তিনি। ভরসন্ধেবেলা যখন বন্দর নিঝুম হয়ে আসে, তখন বাড়ির দিকে রওনা দেন।

হিমশীতল এক ডিসেম্বরের দিন বাবুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই প্রতিবেদক। সবে মাত্র কাজে এসেছেন, কিন্তু ইতিমধ্যেই জাহাজঘাটা জমজমাট। মাছ চুরি করার ধান্দায় নৌকায় রাখা বাঁশের ঝুড়ি ঘিরে লম্ফঝম্প করছে লম্বাটে গ্রীবাযুক্ত সাদা সাদা পেলিকান। মাছ-বোঝাই জাল নামানো আছে মাটির উপর। দরদামের হাঁকডাকে বন্দর সরগরম।

PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.
PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.

চোম্বাল মৎস্য বন্দরে মাছ খালাসির কাজ করেন বাবু। তাঁর আন্দাজ, এখানে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ২০০ জন বিক্রেতা, দালাল ও লোডার

ব্যস্ত বন্দরে আসা-যাওয়া করছে নানান সাইজের নৌকা। অসংখ্য ক্রেতা, বিক্রেতা, দালাল ও লোডার মিলিয়ে নরক গুলজার। বাবুর মতো মজুরেরা প্রথমে নৌকা থেকে মাছ নামান জাহাজঘাটায়, তারপর সে মাছ বোঝাই করেন অপেক্ষারত টেম্পোগাড়িতে। তাঁর আন্দাজ, শ-দুয়েক মানুষ কাজ করেন এখানে।

ফি দিন, সক্কাল সক্কাল বন্দরে পৌঁছেই তাঁর যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম একখান লম্বা কাঠবাদাম গাছের ছায়ায় গিয়ে রাখেন বাবু — কমলা রঙের প্লাস্টিকের ক্রেট (ঝুড়ি), পানির বোতল, চপ্পল ও তেরুভা। এই তেরুভা বস্তুটি আদতে বিড়ে, প্লাস্টিকের পরত ঢাকা চ্যাপ্টা গোলাকার একটি কাপড় বা দড়ির বান্ডিল। মাথার উপরে এটি রেখে তার উপর মাছ-বোঝাই ঝুড়ি চাপান তিনি।

আজকে যে নৌকাটি থেকে তিনি মাছ সংগ্রহ করছেন, তার চাইতে ছোটো নৌকা এই বন্দরে খুব কমই আছে। চারজন চাপতে পারে এতে, ইঞ্জিনটা খোলের বাইরে লাগানো (আউটবোর্ড)। ট্রলার নৌকার সঙ্গে কাজ করেন না বাবু, কারণ বাণিজ্যিক ট্রলারগুলি সাধারণত নিজেরাই লোডার নিযুক্ত করে থাকেন। “এই ধরনের জেলেরা বড়ো বড়ো নৌকায় চেপে সাগরে পাড়ি দেন, ফেরেন এক সপ্তাহ বা তারও পর। নৌকাগুলো সরাসরি জাহাজঘাটায় ভিড়তে পারে না, তাই বেশ খানিকটা দূরে থাকে (নোঙর ফেলে)। তারপর এই ছোটো ছোটো নৌকাগুলোয় মাছ চাপিয়ে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন,” তিনি বললেন।

মাল নামের এক প্রকার ক্ষুদ্র জালের সাহায্যে নিজের ঝুড়িতে খয়রা মাছ ভরছিলেন বাবু। হাঁটা লাগালাম বন্দরের পানে, ঝুড়ির ছোট্ট-ছোট্ট ফুটো দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরতে লাগল জল। “এই মাসে [ডিসেম্বর ২০২২] বিশাল একখান খয়রার ঝাঁক ধরা পড়েছে,” জানালেন তিনি। একেক ঝুড়ি মাছ বয়ে ৪০ টাকা জোটে তাঁর, টাকাটা হয় নৌকার মালিক কিংবা সেই দালালরা দেন যাঁরা মাছ-টাছ কিনে স্থানীয় বাজারহাটে গিয়ে বেচেন।

PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.
PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.

ট্রলার নয়, এমনতর নৌকা থেকে বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে মূলত অয়েল সার্ডিন বা খয়রা মাছ (ডানদিকে) খালাসের কাজ করছেন বাবু

“দিনে কটা করে ঝুড়ি বইছি সেটা বলা মুশকিল, কারণ সেটা নির্ভর করছে কতটা মাছ ধরা পড়ছে তার উপর,” জানালেন তিনি। তবে একেকদিন এমনও যায় যেদিন ২,০০০ টাকা অবধি রোজগার হয় তাঁর, “বন্দরে ব্যাপক পরিমাণে খয়রা মাছ ঢুকলে তবেই অতটা ইনকাম হয়।”

*****

কিশোর বয়স থেকেই মাছের কারবারে আছেন বাবু। গোড়ার দিকের বছরগুলোয় মাছ ধরে দিন গুজরান হত, তারপর ধীরে ধীরে জাহাজঘাটায় মাল খালাসের কাজ শুরু করেন। কালিকট বা কোঝিকোড় জেলা সংলগ্ন আরব সাগর থেকে নৌকা এসে বন্দরে ভিড়লেই আরম্ভ হয় তাঁর চোমাড়ু পানি কিংবা লোডিংয়ের দিনমজুরি।

জালে-ওঠা খয়রা মাছের পরিমাণে কেমন করে অনিশ্চয়তা জেঁকে বসেছে, বিগত এক দশক ধরে তারই সাক্ষী আছেন বাবু।

“জালে যখন অল্প অল্প [অয়েল] সার্ডিন ওঠে, তখন [তোলা-পাড়ার] কামকাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে চেষ্টা করি,” বললেন তিনি, “যখন দেখি যে বন্দরে একের পর পর ফাঁকা নৌকা ভিড়ছে, তখন বুঝে যাই যে এবার কাজ-টাজ সব নিজেদের ভিতর ভাগ-বাঁটোয়ারা করার পালা, যাতে প্রত্যেকের ঝুলিতে অন্তত খানিকটা করে মজুরি জোটে।”

PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.
PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.

প্লাস্টিকের ঝুড়ি ও তেরুভা অর্থাৎ বিড়ে ব্যবহার করেন লোডাররা। তেরুভা বস্তুটি প্লাস্টিকের পরত ঢাকা চ্যাপ্টামতন গোলাকার একটি কাপড় বা দড়ির বান্ডিল

PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.
PHOTO • Mufeena Nasrin M. K.

লোডাররা এই সরঞ্জামটির সাহায্যে নৌকা (বাঁদিকে) থেকে মাছ তোলেন, তারপর সে মাছ জাহাজঘাটায় নিয়ে আসেন তাঁরা

মা, স্ত্রী, ও দুটি ছেলে নিয়ে বাবুর সংসার, তাঁর একার রোজগারেই সংসার চলে। বাবুর কথায় বেশ ভালোভাবেই টের পেলাম, জালে খাপছাড়া ভাবে মাছ উঠছে বলে কেমন জেরবার হয়ে উঠেছেন বন্দরে কর্মরত দিনমজুরেরা।

কোচির কেন্দ্রীয় সামুদ্রিক মৎস্যপালন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সিএমএফআরআই) প্রকাশিত মেরিন ফিশ ল্যান্ডিং ইন ইন্ডিয়া ২০২১-এ বলা হয়েছে: ১৯৯৫ সালের পর থেকে কেরালায় সবচেয়ে কম পরিমাণে খয়রা মাছ ধরা পড়েছিল ২০২১ সালে — মোটে ৩,২৯৭ টন। সিএমএফআরআই-এর একজন বিজ্ঞানী আমাদের বললেন, “আমরা লক্ষ্য করেছি, গত দশ বছরে অয়েল সার্ডিন মাছ আর আগের মতো জালে উঠছে না, সুতরাং এমনটা হতেই পারে যে এই মাছের ঝাঁক আস্তে আস্তে কেরালা উপকূল থেকে সরে যাচ্ছে।” ঠিক কোন কারণগুলো এইজন্য দায়ী সেটাও জেনেছিলাম নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই গবেষকের থেকে: জলবায়ু পরিবর্তন, খয়রা মাছের চক্রাকার বৃদ্ধিহার, লা নিনোর প্রভাব ও প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা জেলিফিশের সংখ্যা।

মৎস্যপালন পরিসংখ্যান হ্যান্ডবুক ২০২০ -এ লেখা আছে যে ভারতের পশ্চিম উপকূলে যতগুলি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে, তাদের মধ্যে কেরালাতেই সবচাইতে বেশি খয়রা ধরা পড়েছিল — ০.৪৫ লাখ টন।

কেরালায় অসংখ্য প্রজাতির মাছ মেলে, কিন্তু খয়রার চেয়ে সুলভ, পুষ্টিকর এবং সস্তা মাছ তেমন নেই বললেই চলে — জানালেন বাবু। এককালে এই মাছ শুকিয়ে শুঁটকিও হত। তবে তিনি এটাও দেখেছেন যে পোল্ট্রি-খাদ্য ও মাছের তেল বানানোর জন্য দিন দিন বেশি পরিমাণে খয়রা চালান করা হচ্ছে ম্যাঙ্গালোর ও তার আশেপাশের প্রক্রিয়াকরণ কারখানায়। “জালে অন্যান্য মাছের চাইতে খয়রাই বেশি ওঠে এখানে, তাই আমরাও বেশি বেশি করে ঝুড়ি ভরতে পারি।”

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Student Reporter : Mufeena Nasrin M. K.

Mufeena Nasrin M. K. is a final year MA Development student at Azim Premji University, Bengaluru.

Other stories by Mufeena Nasrin M. K.
Editor : Riya Behl

Riya Behl is Senior Assistant Editor at People’s Archive of Rural India (PARI). As a multimedia journalist, she writes on gender and education. Riya also works closely with students who report for PARI, and with educators to bring PARI stories into the classroom.

Other stories by Riya Behl
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra