“তিন আর দুইয়ে কত হয়?” জিজ্ঞাসা করলেন প্রতিভা হিলিম। তাঁর সামনে বসে দশজন বাচ্চার একটি দল, বয়স সাত থেকে নয়ের মধ্যে। তারা উত্তর দিল না। তিনি চকবোর্ডে লিখলেন, তারপর ফিরে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাত ও মাথা নাড়িয়ে ইশায় ওদের বলতে বললেন, “পাঁচ।”

প্রতিভা রাবারের সোল যুক্ত চামড়া ও স্টিলের স্টাম্প রক্ষকে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন, এগুলি তাঁর দুই হাঁটুর সঙ্গে লাগানো আছে। একটি চকের টুকরো তাঁর কনুইয়ের কাছে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো।

এখন ‘স্কুল’ চলছে, আর তা চলছে পালঘর জেলার ১,৩৭৮ জন বাসিন্দা বিশিষ্ট কারহে গ্রামে হিলিম পরিবারের তিন কামরার সিমেন্টের ঘরে। এই বছরের ২০শে জুলাই থেকে মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার বিক্রমগড় তালুকের এই গ্রামের তিরিশটি আদিবাসী বাচ্চাকে এইখানেই প্রতিভা ইংরিজি, ইতিহাস, মারাঠি এবং অঙ্ক শেখাচ্ছেন। পড়ুয়ারা সকাল দশটা থেকে একটার মধ্যে বিভিন্ন ব্যাচে আসে, সঙ্গে আনে এই গ্রামের দুটি জেলা পরিষদ স্কুল থেকে দেওয়া পাঠ্যবই।

প্রতিভা জানালেন, “অপারেশানের পর থেকে সামান্য কাজ করতেও অনেকটা সময় লেগে যায়।” পড়ুয়াদের একজন তাঁর হাতের উপরিভাগে ভেলক্রো দিয়ে চক আটকাতে সাহায্য করে। “এইভাবে লেখাটাও বেশ কষ্টকর।”

ওয়ারলি আদিবাসী সমাজের প্রতিভা হিলিম গত বছরের আগে অবধিও এই অঞ্চলের জেলা পরিষদ স্কুলে দীর্ঘ ২৮ বছর শিক্ষকতা করছেন। কুড়ি বছর বয়সে বিয়ের পর, তিনি ভিওয়ান্ডি শহরে চলে আসেন, এখানেই তাঁর স্বামী পাণ্ডুরং হিলিম কাজ করতেন। ভিওয়ান্ডি শহরটি কারহে থেকে প্রায়ে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাঁর স্বামী, ৫০, এখন রাজ্য সেচ দপ্তরের একজন সিনিয়ার ক্লার্ক। ২০১৫ সালে যখন তাঁর স্বামীর ভিওয়ান্ডির কাছাকাছি থানে জেলার কালবা নগরে বদলি হল, তখন তিনি সেখান থেকেই ভিওয়ান্ডি যাতায়াত করতেন যাতে শিক্ষকতার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।

২০১৯ সালের জুন মাসে নতুন একটি জেলা পরিষদ স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। মাসে একবার করে তিনি কারহে গ্রামে হিলিমদের পারিবারিক বাড়িতে যেতেন। একবার সেইখানে গিয়েই তাঁর শরীরে সমস্যা শুরু হয়। সেই মাসেই ৫০ বছর বয়সী প্রতিভার গ্যাংগ্রিন ধরা পড়ে। এটা এমন একটা রোগ যেটা মানুষের দেহে টিস্যু (কলা) মরে যেতে থাকলে দেখা দেয়। এই উপসর্গটি সাধারণত কোনও অন্তর্নিহিত অসুখ, আঘাত অথবা সংক্রামক রোগের জেরে রক্ত সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেখা দেয়।

এর ঠিক পরেই তাঁর কনুই ও হাঁটুর নিচ থেকে দুই হাত এবং দুই পা অস্ত্রোপচার করে বাদ দিয়ে দিতে হয়।

PHOTO • Shraddha Agarwal

কারহে গ্রামে, প্রতিভা হিলিমের বাড়িতে ‘স্কুল’ চলছে। প্রতিভা স্টাম্প রক্ষকে ভর করে হাঁটাচলা করেন ও কনুইয়ে স্ট্র্যাপ দিয়ে লাগানো চকের সাহায্যে বোর্ডে লেখেন

প্রতিভা বললেন, “আমি কোনোদিন ভাবিনি আমার সঙ্গে এরকমটা হবে। কারহেতে থাকাকালীন হঠাৎ আমার জ্বর আসে। তারিখটা ১৬ জুন, ২০১৯, সন্ধ্যা আটটা বাজে। আমি প্যারাসিটামল খেলাম এই ভেবে যে তাড়াতাড়ি জ্বর নেমে যাবে। কিন্তু পরদিন সকালে আমার শরীরটা আরও খারাপ হতে লাগল। তখন আমার ছেলে আর স্বামী মিলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমার অবশ্য এসব কিছুই মনে নেই। আমি সারাদিন অচৈতন্য অবস্থায় ছিলাম।”

১৭ জুন সকালে, তাঁকে গাড়ি করে ১২০ কিলোমিটার দূরে কালবার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। “সেখানকার ডাক্তাররা আমার স্বামীকে জানান যে আমার অবস্থা গুরুতর এবং আমাকে তৎক্ষণাৎ থানের কোনও বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।” সেইদিনই তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে থানে নিয়ে যান।

“যখন আমার জ্ঞান ফেরে, তখন আমি বুঝতে পারি আমি হাসপাতালে আছি। ডাক্তার আমাকে জানান যে আমার ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন খেতে কাজ করার সময় আমার কিছু হয়েছিল কি না। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। আমরা সপ্তাহের শেষে বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলে জমিতে কাজ করি। বাবার বয়স হয়েছে, তাই আমরা হাতেহাতে সাহায্য করি চাষের জমিতে ধান বুনতে।” কারহে গ্রামে পাণ্ডুরঙের বাবার চার একর জমিতে ধান, জোয়ার, অড়হর, বিউলি চাষ করেন তাঁরা। “তবে অনিয়মিত বর্ষার কারণে আমরা খেতে বিশেষ কাজ করতাম না,” প্রতিভা আমাদের জানান।

১৯শে জুন, থানের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় প্রতিভা লক্ষ্য করেন তাঁর হাত-পা কালো হয়ে যাচ্ছে। “ডাক্তাররা যখন আমাকে বলেন যে সম্ভবত খেতে কোনো পোকা কামড়েছে, তাঁদের কথা বিশ্বাস করিনি। আমার জ্বর ক্রমশই বাড়তে থাকে আর আমার শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। আমার দুই পায়ে ও ডান হাতে জ্বালা শুরু হয়। প্রথমদিকে ডাক্তাররা বলেন আমি ভালো হয়ে যাব, কিন্তু ঠিক পরদিন রাত্রেই আমার হাত-পা বরফের মতো হিমশীতল হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে উঠি। তারপর ১৯ দিন ধরে চিৎকার করতে থাকি। হাতের থেকে আমার পায়ে বেশি জ্বালাযন্ত্রণা ছিল।”

তিনদিন পরে, প্রতিভার গ্যাংগ্রিন ধরা পরে। “প্রথমদিকে ডাক্তাররাও বুঝতে পারেননি কেমনভাবে গ্যাংগ্রিন হল। ওঁরা অনেক পরীক্ষা করলেন। আমার জ্বরও কমছিল না এবং আমি অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম। পায়ে জ্বালা ও ব্যথায় আমি চিৎকার করছিলাম। এক সপ্তাহ পরেও তাঁরা বলছিলেন যে আমি ভালো হয়ে যাব কারণ আমার বাঁ হাতের তিনটি আঙ্গুলে তখনও সার ছিল। আমার স্বামীর জন্য এটা বড়ো ধাক্কা ছিল। কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। আমার ছেলেই সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছিল।”

'When the doctors first told me about the operation I went into shock... Since then, every small task takes longer to complete. Even writing with this chalk is difficult'
PHOTO • Shraddha Agarwal
'When the doctors first told me about the operation I went into shock... Since then, every small task takes longer to complete. Even writing with this chalk is difficult'
PHOTO • Shraddha Agarwal

‘যখন ডাক্তাররা প্রথমবার অপারেশনের কথা বলেছিলেন, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম...তখন থেকেই আমার ছোটো ছোটো কাজ করতেও অনেক সময় লাগে। এইভাবে চক দিয়ে লেখাটা খুবই কষ্টকর’

প্রতিভার সাতাশ বছরের ছেলে সুমিত, পেশায় বাস্তু প্রযুক্তিবিদ। মায়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর অফিসের থেকে লম্বা ছুটি না পাওয়ায়, মুম্বইয়ে তাঁর নির্মাণ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন। “আমার অপারেশনের সব সিদ্ধান্ত ও-ই নেয়, যাবতীয় কাগজপত্রে ও-ই সই করে। আমাকে খাওয়ানো, স্নান করানো, সবই আমার ছেলে করেছিল,” প্রতিভার মনে পড়ে।

গত বছর জুন মাসের শেষে, থানের হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রতিভার ডান হাতটা কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সুমিত প্রতিভার হাতের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে বললেন, “ওই অপারেশনটা ভালো হয়নি। মায়ের ডান হাতটায় ওরা মোটেই ভালো করে অপারেশন করেনি। একটা হাতের জন্য ওরা সাড়ে তিন লাখ টাকা নিল, কিন্তু কাজটা ঠিক করে করেনি। মা সারাক্ষণ ব্যথায় কেঁদে উঠতেন। বাবা বললেন এই হাসপাতালে আর চিকিৎসা করানো আমাদের সাধ্যের বাইরে।”

অগস্ট মাসে ভিওয়ান্ডির জেলা স্কুল থেকে প্রতিভাকে তিন মাসের বেতন দেওয়া হয়েছিল খরচ চালানোর জন্য। সেই সময় প্রতিভা কেটেকুটে হাতে চল্লিশ হাজার টাকা পেতেন। “থানের হাসপাতালে আমাদের প্রচুর অর্থব্যয় হয়। কুড়ি দিনের জন্য প্রায় তেরো লাখ টাকা বিল করে। আমার ভাই আমাদের কিছু টাকা ধার দিয়েছিল আর আমার স্কুলের বন্ধুরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাদের শেষ সম্বলটুকুও ফুরিয়ে যায়। আমার স্বামীও লোন নেন।”

১২ই জুলাই নাগাদ, নিজেদের সামর্থ্যের বাইরে যথাসাধ্য খরচ করার পর, প্রতিভার পরিবার তাঁকে দক্ষিণ মুম্বইয়ের সরকারি জে জে হাসপাতালে ভর্তি করে, সেখানে তিনি আরও এক মাস ছিলেন। প্রতিভার মনে পড়ে, “জে জে গিয়েও আমি পায়ের যন্ত্রণায় ছটফট করতাম, আমার পায়ে কেউ হাত দিলে, চিৎকার করে উঠতাম। নয়দিন খেতে পারিনি, ঘুমোতে পারিনি ব্যথার কষ্টে। ডাক্তাররা দু-তিনদিন পর্যবেক্ষণ করে অপারেশন করার মনস্থির করেন।”

১৫ জুলাই পাঁচ ঘণ্টার অস্ত্রপচারের পর, তাঁর দেহের বাকি তিনটি অঙ্গ – দুটি পা এবং বাঁ হাতটি বাদ দেওয়া হয়।

“ডাক্তাররা যখন আমাকে অপারেশনের কথা বলেন, আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হতাশ হয়ে পড়ি, ভাবছিলাম আমি আর কোনোদিন স্কুলে গিয়ে পড়াতে পারব না। আমাকে বাড়িতে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে হবে। কোনোদিন আর রান্না করতে পারব না ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ি। তবে আমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুরা প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসত। তারা আমাকে ক্রমাগত সাহস দিয়ে গেছে। ডাক্তাররা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে কৃত্রিম অঙ্গের সাহায্যে আমি স্কুলের কাজে ফিরে যেতে পারব এবং আগের মতো সবকিছুই করতে পারব। পুরো ব্যাপারটা তাঁদের জন্য খানিক সহজ হয়েছিল। একথা সত্যি যে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু আমার বাবা-মাও আমাকে অনেক সাহস দিয়েছিলেন। আমার অপারেশনের পরে আমাকে তাঁরা প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। তাঁদের কাছে আমি আজীবন ঋণী থাকব।”

Pratibha Hilim with her son Sumeet and daughter Madhuri, who says, 'We tell her we are there for you. We children will become your arms and legs'
PHOTO • Shraddha Agarwal
Pratibha Hilim with her son Sumeet and daughter Madhuri, who says, 'We tell her we are there for you. We children will become your arms and legs'
PHOTO • Shraddha Agarwal

ছেলে সুমিত ও মেয়ে মাধুরীর সঙ্গে প্রতিভা হিলিম। মাধুরী বললেন, ‘মাকে বলেছিলাম যে আমরা তোমার পাশে আছি। তোমার সন্তানেরাই তোমার হাত আর পা’

১১ই অগস্ট ২০১৯, জে জে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রতিভা তাঁর মায়ের বাড়ি গিয়ে থাকতে শুরু করেন। কৃষিজীবী তথা গৃহিণী, প্রতিভার মা, সুনিতা ওয়াঘের বয়স ৬৫। প্রতিভার মাতাপিতার পালঘরের জহর তালুকের চালাওাড় গ্রামে ছয় একর জমিজমা আছে যেখানে তাঁরা ধান, জোয়ার, বাজরার চাষ করেন। প্রতিভার ৭৫ বছরের বাবা অরবিন্দ ওয়াঘ এখনও কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে কাজ করেন। প্রতিভা মার্চ ২০২০ অবধি চালাওাড়ে ছিলেন, এরপর লকডাউনের কারণে ওঁর পরিবারকে কারহে গ্রামে ফিরে আসতে হয়। (এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিভার স্বামীও কারহেতে ফিরে আসেন যাতে উনি সবার সঙ্গে গ্রামে থাকতে পারেন, এবং জহর তালুকের সেচবিভাগের অফিসে মোটরবাইকে যাতায়াত করছেন।)

অপারেশন পরবর্তী পরীক্ষা ও চেক-আপের জন্য বিগত এক বছরে প্রতিভাকে নিজের ছেলের সঙ্গে তিন-চারবার জে জে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। প্রতিভা ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত দক্ষিণ মুম্বইয়ের হাজি আলিতে অবস্থিত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনে প্রি-প্রস্থেটিক ফিজিওথেরাপি শুরু করেন। ওখানকার ডাক্তাররা প্রতিভাকে অপেক্ষা করতে বলেন যতদিন না তাঁর ডান হাতের ক্ষতটা সেরে ওঠে। সেন্টরটি চালাওাড় থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, সুমিত প্রতিভাকে একদিন অন্তর গাড়িতে করে নিয়ে আসতেন সেখানে, একদিকের রাস্তায় লেগে যেত পাক্কা চার ঘণ্টা। প্রতিভা মনে করে জানালেন যে অখান থেকে তাঁকে ডান হাতের ক্ষত সারার পর থেরাপিতে আসতে বলা হয়। “আমার ডান হাতে রোজই বেশ যন্ত্রণা হত। মেয়ে মাধুরী বাড়ির সব কাজ করত, আজও সে নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দেয়। আমি স্ট্র্যাপ দিয়ে চামচ লাগিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু চামচটা পড়ে যায়।”

প্রতিভার ছোটো মেয়ে মাধুরীর বয়স ২৫, সাওয়ান্তওয়াড়ি তালুকের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশোনা করছেন। জুলাই ২০১৯ সালে যখন তাঁর মা জে জে হাসপাতালে ভর্তি, তখন তাঁর পরীক্ষা চলছিল বলে সেইসময়ে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারেননি। তাঁর কথায়, “কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদে মা দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন। মা যাতে এই লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য আমি সবসময় মায়ের পাশে থাকব। এক-একদিন মা খুব কেঁদে ওঠেন তাঁর অবস্থার কথা ভেবে। এতবছর ধরে মা আমাদের জন্যে করে গেছেন, এবার আমাদের পালা। আমরা মাকে ভরসা দিয়ে বলি যে আমরা তোমার পাশেই আছি। তোমার সন্তানেরাই তোমার হাত আর পা,” বললেন মাধুরী। প্রতিভার বড়ো মেয়ে প্রণালী দারোঠে, ২৯, বিবাহিতা এবং তার এক বছরের ছেলে আছে, তিনি জেলার কৃষি দফতরে সহকারী কৃষি আধিকারিকের পদে কর্মরত।

প্রতিভা এবং তাঁর পরিবার এখন অধীর আগ্রহে তাঁর কৃত্রিম অঙ্গের অপেক্ষা করছেন। হাজি আলির সেন্টর থেকে এগুলি দেওয়া হবে, তারাই স্টাম্প রক্ষক দিয়েছে। প্রতিভা বললেন, “আমি মার্চ মাসেই আমার কৃত্রিম অঙ্গ পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমার মাপ অনুযায়ী তাঁরা সব তৈরি করে রেখেছেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু মেসেজ করে জানালেন যে লকডাউনের কারণে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। সেন্টর খোলার পর, আমাকে আবার কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহারের শিক্ষা দেওয়া হবে, এবং তার পরে ওঁরা সেগুলো আমার শরীরে লাগিয়ে দেবেন।”

Some of Pratibha's students: 'Their parents are really poor. How will they get a phone for online education?' she asks. 'School has always been my whole world. Being with kids also helps me feel like I am normal again'
PHOTO • Shraddha Agarwal

প্রতিভার কয়েকজন পড়ুয়া: ‘ওরা সব গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। অনলাইনে পড়াশোনার জন্য ফোন পাবে কোথা থেকে?’ প্রতিভার প্রশ্ন। ‘আমার সারা দুনিয়া জুড়ে আছে আমার শিক্ষকতা। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকলে নিজেকে স্বাভাবিক মনে হয় আগের মতো’

জানুয়ারি মাস থেকে প্রতিভা হাঁটুতে প্যাড লাগিয়ে হাঁটছেন। “কৃত্রিম অঙ্গ পরার পর যাতে আমার হাঁটতে সুবিধা হয়, সেই জন্য সেন্টর থেকে আমাকে এটা দিয়েছে, এটা ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে। প্রথমদিকে এগুলো পরে খুব ব্যথা করত, এক মাস লেগেছিল এগুলো পরে হাঁটা অভ্যাস করতে।” রিহ্যাব সেন্টর প্রতিভাকে কৃত্রিম অঙ্গ পরে নতুন করে বসা, দাঁড়ানো, চলাফেরা করা, হাত-পা নাড়ানো শিখিয়েছে, তার সঙ্গে যোগাসন এবং অন্যান্য ব্যায়াম শিখিয়েছে মাংসপেশি মজবুত করার জন্য। হাতে ভেলক্রো স্ট্র্যাপ লাগিয়ে চক, পেন, চামচের মতো জিনিস ধরার কৌশলও শিখিয়েছে।

গতবছর তাঁর অঙ্গবিচ্ছেদ হওয়ার পর প্রতিভার শিক্ষক জীবনে একটা বিরতি পড়েছে। আর এর কিছুদিন পরেই কোভিড লকডাউন হয়। প্রতিভা বুঝতে পারেন যে গ্রামের বাচ্চাদের লকডাউনে পড়াশোনা করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। তিনি দেখতেন ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথবা মাঠে কাজ করছে। “ওরা গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। অনলাইনে পড়াশোনা বুঝতে পারে না। তাছাড়া অনলাইনে পড়াশোনার জন্য ফোন পাবেই বা কোথা থেকে?”

প্রতিভা তাই ঠিক করলেন বাচ্চাদের নিখরচায়ে পড়াবেন। “এখানকার আদিবাসী বাচ্চাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। কোনোমতে দুবেলা ভাত জোটে কিনা তার ঠিক নেই। কেউ না খেয়ে খালি পেটে আসলে, আমার মেয়ে ওদের জন্য রান্না করে দেয়। সাধারণত আমরা ওদের কলা দিই, কিন্তু বিশেষ দিনে আমরা ওদের চকলেট আর ফারসান (চানাচুর) দিই।”

“কিন্তু অনেকেই ফসল কাটার সময় আসা বন্ধ করে দেয়। ওদের বাবামায়েরা ওদের খেতে নিয়ে যায়। অথবা বাড়িতে থেকে ছোটো ভাইবোনেদের দেখভাল করতে হয়। আমার পা থাকলে আমি এই গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িতে গিয়ে গিয়ে তাদের সন্তানদের আমার কাছে পড়াশোনা করতে পাঠাতে বলতাম।”

২০২০ সালের অগস্ট মাসে প্রতিভা ভিওয়ান্ডির জেলা পরিষদ স্কুল থেকে কারহের স্কুলে বদলির আবেদন করেন। যদিও উনি এখনও চাকুরিরতা, কিন্তু অগস্ট ২০১৯ অবধি বেতন পাওয়ার পর থেকে তিনি অবৈতনিক অবকাশে আছেন। “স্কুল খোলা অবধি আমি বাড়িতেই বাচ্চাদের পড়াব।” প্রতিভা আশা করছেন তাঁর কৃত্রিম অঙ্গ তাঁকে আবার কাজকর্ম শুরু করতে মদত জোগাবে।

“আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমি স্কুলে গিয়ে পড়াতে চাই। আমি নিজের কাজ নিজেই করতে চাই। আমার সমগ্র জগৎ জুড়ে আছে আমার শিক্ষকতার কাজ। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকলে নিজেকে আবার স্বাভাবিক মনে হয়,” সোফা থেকে উঠতে উঠতে প্রতিভা বলেন। আমাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে চান তিনি, কিন্তু হাঁটুর প্যাডগুলো লাগানো নেই। ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় পড়ে যেতে যেতে আবার নিজেকে সামলে নিলেন, কিন্ত দাঁড়াতে না পারায় তাঁর মুখ বিষণ্ণতায় ভরে উঠল। সোফায় বসে আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বললেন, “পরের বার আসলে কিন্ত আমাদের সঙ্গেই খেয়ে যেতে হবে।”

অনুবাদ: ঈশানী সেনগুপ্ত

Shraddha Agarwal

Shraddha Agarwal is a Reporter and Content Editor at the People’s Archive of Rural India.

Other stories by Shraddha Agarwal
Translator : Ishani Sengupta

Ishani Sengupta has a day job as a lawyer, and outside of it, seeks to find out the meaning of life, universe and everything.

Other stories by Ishani Sengupta