“কে জিতল কে হারল তাতে কী আসে যায়? বা আইপিএল চলছে নাকি বিশ্বকাপ?”

যে দেশে ক্রিকেট খেলা প্রায় ধর্মের নামান্তর, সেখানে মদনের প্রশ্নটা ধর্মনিন্দার সমান।

তবে তার পরেই তিনি বলছেন, “ কোই ভি জিতে, হামে কাম মিল জাতা হ্যায় [যেই জিতুক, আমরা কাজ পাই]।”  ৫১ বছর বয়সি মদন ক্রিকেট বল তৈরি করেন, মীরাট শহরে ক্রিকেটের সুবিখ্যাত চকচকে লাল ও সাদা বল তৈরির একাধিক কারখানা আছে তাঁর।

মার্চ মাস এখন, আর এই মুহূর্তে তাঁকে ঘিরে আছে প্রায় ১০০টি বাক্স, প্রতিটির ভিতরে ছয়টি চামড়ার বল, পুরুষ ক্রিকেটের ভরভরতি ম্যাচ নির্ঘণ্টে জায়গা করে নিতে প্রস্তুত। মরসুমের প্রথম বলটি খেলা হবে মার্চের শেষে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল), যা দুই মাস ধরে চলবে। তারপর জুনে আসবে আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা। তারপর অক্টোবর ও নভেম্বরে ভারতের মাটিতে হতে চলেছে ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বকাপ।

“সিরিজের কোন স্তরে বলটা ব্যবহার হবে, সেই বল দিয়ে কে খেলবে, কতগুলো ওভার সেই বলে খেলা হবে, এই সবই নির্ভর করে [বলের] গুণমানের উপর,” জানাচ্ছেন মদন।

Madan (left) at his cricket-ball-making unit in Shobhapur slum of Meerut district.
PHOTO • Shruti Sharma
Dharam Singh (right) is the most experienced craftsperson at Madan’s unit. Most of the artisans are Jatavs and follow Dr. Ambedkar
PHOTO • Shruti Sharma

মীরাট জেলার শোভাপুর বস্তিতে তাঁর ক্রিকেট বল কারখানায় মদন (বাঁদিকে)। মদনের কারখানায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ কারিগর হলেন ধরম সিং (ডানদিকে)। এখানকার অধিকাংশ কারিগর জাতে জাটভ এবং ড. আম্বেদকরের অনুগামী

“বড়ো টুর্নামেন্ট থাকলে খুচরো আর পাইকারি ক্রীড়াসামগ্রীর ব্যবসায়ীরা অনেক আগে থেকেই আমাদের যোগাযোগ করে,” এই খেলা নিয়ে সারা দেশের মাতামাতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন তিনি। “ঠিক মাস দুই আগে থেকে বিপুলভাবে চাহিদা বেড়ে যায়, আর বড়ো শহরের দোকানগুলো ঠিক সময়ের জন্য আগেভাগেই বলের জোগান প্রস্তুত রাখতে চায়।” বলের দাম ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩,৫০০ টাকা অবধিও উঠতে পারে; পুরোটাই নির্ভর করছে বলে কে খেলছে আর তার উপর কত টাকার বাজি চড়ছে তার উপর।

মুম্বই, আহমেদাবাদ, বরোদা, জয়পুর, বেঙ্গালুরু এবং পুণের বিভিন্ন ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, ডিস্ট্রিবিউটর এবং খুচরো ব্যবসায়ীদের থেকে সরাসরি অর্ডার আসে মদনের কাছে। তাঁর কারখানায় তৈরি বল সাধারণত নিচু স্তরের ক্রিকেটে ব্যবহার হয়, ম্যাচ এবং অনুশীলনের জন্য।

এই মুহূর্তে আমরা আছি তাঁর কর্মশালায়, যেখানে গোলচে ঢালের পর্দাওয়ালা টিভিতে একটা ক্রিকেট ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার চলছে। স্ক্রিনের মুখ ঘোরানো আটজন কারিগরের নীরব দর্শকমণ্ডলীর দিকে। তবে তাঁদের শুধু শোনারই উপায় আছে, কারণ চোখ নিবদ্ধ হাতের কাজের দিকে: “ হামে অভি বিলকুল ফুরসত নেহি হ্যায় [আমাদের হাতে এখন একদম সময় নেই] , ” জানালেন মদন।

লোহার জাঁতির উপর ঝুঁকে পড়ে চামড়া সেলাইয়ের একঘেয়ে কাজ করে চলেছেন তাঁরা, ৬০০টি মাঝারি মানের দুই-খণ্ডের (টু-পিস) ক্রিকেট বলের একটি অর্ডারের জন্য। ক্রেতা জম্মু-কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বাসিন্দা, ডেলিভারি চাই তিন দিনের মধ্যে।

চালানের জন্য প্রস্তুত একটি চকচকে লাল বল হাতে তুলে নেন মদন। “একটা বল তৈরিতে তিনটে জিনিস লাগে। বাইরের খোলসের জন্য ফিটকিরিতে মজানো চামড়া, কর্ক দিয়ে তৈরি ভিতরের গোলা, আর সেলাইয়ের জন্য সুতির সুতো।” এই সবই মীরাট জেলায় পাওয়া যায়, আর, “ক্রেতা ঠিক কী গুণমানের জিনিস চাইছেন তা জানিয়ে দিলে আমরা সেইমতো চামড়া আর কর্ক কিনি।”

Women are rarely formally employed here, and Samantara comes in to work only when Madan’s unit gets big orders. She is grounding alum crystals that will be used to process leather hides (on the right). These hides are soaked for three days in water mixed with baking soda, alum, and salt to make them soft and amenable to colour
PHOTO • Shruti Sharma
These hides are soaked for three days in water mixed with baking soda, alum, and salt to make them soft and amenable to colour
PHOTO • Shruti Sharma

এই ক্ষেত্রে পুরোদস্তুর মহিলাকর্মী বিরল, সমনতারা সাধারণত তখনই আসেন যখন মদনের কারখানায় বড়ো কোনও বায়না ঢোকে। তিনি এখানে ফিটকিরি গুঁড়ো করছেন যা পরে চামড়া প্রক্রিয়াকরণে লাগবে (ডানদিকে)। এই চামড়াগুলোকে তিন দিন ধরে বেকিং সোডা, ফিটকিরি আর নুন মেশানো জলে চুবিয়ে রাখা হয় যাতে সেগুলো নরম হয় আর রং ধরানোর উপযোগী হয়ে ওঠে

Workers dye the leather red (left) and make cricket balls using two or four pieces of leather.
PHOTO • Shruti Sharma
Sachin, 35, (right) cuts the leather in circles for two-piece balls
PHOTO • Shruti Sharma

কর্মীরা চামড়ায় লাল রং করেন (বাঁদিকে) এবং এরকম দুই থেকে চারটি চামড়ার টুকরো নিয়ে এক-একটি ক্রিকেট বল বানানো হয়। টু-পিস বল তৈরির জন্য গোল গোল করে চামড়া কাটছেন ৩৫ বছর বয়সি সচীন (ডানদিকে)

জেলা শিল্প প্রসার এবং উদ্যোগপতি উন্নয়ন কেন্দ্র বা ডিআইপিইডিসি-র হিসাব অনুসারে মীরাটে ৩৪৭টি ক্রিকেট বল তৈরির কারখানা আছে। এর মধ্যে শিল্পকেন্দ্র বা জোনে অবস্থিত বড় কারখানা যেমন আছে, তেমনই আছে মীরাট জেলার নানা শহুরে ও গ্রাম্য বসতি এলাকার ভিতরে গড়ে ওঠা ছোটো ছোটো উৎপাদন কেন্দ্র।

এই হিসেবে যা ধরা পড়ে না তা হল অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন এবং অসংগঠিত কারখানা, এবং বসতবাড়ির ভিতরে অবস্থিত ছোটো কর্মশালা যেখানে গোটা একটা বল তৈরি থেকে শুরু করে শুধু কোনও একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার কাজও হয়। এর মধ্যে অন্যতম মীরাট জেলার জাঙ্গেঠি, গাগৌল এবং ভবনপুরের মতো গ্রাম। “ আজ গাঁও কে বিনা বিলকুল পূর্তি নেহি হোগি মীরাট মে [আজ এই গ্রামগুলো না থাকলে মীরাটে কোনও ক্রিকেট বলের জোগানই থাকবে না],” বলছেন মদন।

“গ্রাম এবং শহরের ছোটোবড়ো কারখানাগুলিতে কাজ করা কারিগরদের অধিকাংশই জাটভ জাতির, যেহেতু ক্রিকেট বল চামড়া দিয়ে তৈরি হয় , ” ব্যাখ্যা তাঁর। ১৯০৪ সালের জেলা গ্যাজেটিয়ার জানাচ্ছে, মীরাটের চামড়া শিল্পে যুক্ত সর্ববৃহৎ সামাজিক গোষ্ঠী হল এই জাটভ বা চামার জনগোষ্ঠী (উত্তরপ্রদেশে তফসিলি জাতি হিসেবে নথিভুক্ত)। “চামড়া যখন ক্রিকেট বলের আকারে আসে তখন সেটা নিয়ে লোকের অসুবিধা নেই, যত সমস্যা চামড়া নিয়ে কাজ করায়,” যোগ করলেন তিনি।

শোভাপুর, একমাত্র যে এলাকায় কাঁচা চামড়া ফিটকিরি দিয়ে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, সেখানেও তাঁদের একটি পারিবারিক ট্যানারি আছে (পড়ুন: খরা পিচেও ব্যাটিং চালিয়ে যাচ্ছেন মীরাটের চর্মকারেরা) । “ফিটকিরি-প্রক্রিয়াজাত চামড়ার চাহিদা যেভাবে বাড়ছিল, তাতে আমার মনে হয়েছিল যে ক্রিকেট বলের চাহিদা অন্তত কখনও পড়তির দিকে যাবে না,” বলছেন তিনি।  এই সম্ভাবনাময় বাজার দেখেই আজ থেকে ২০ বছর আগে মেসার্স বি. ডি. অ্যান্ড সনস্‌ খুলে বসেন তিনি - এলাকার দুটি ক্রিকেট বলের কারখানার মধ্যে একটি।

মদন জানাচ্ছেন, একটা গোটা বল তৈরিতে ঠিক কত ঘন্টা সময় যায় তা হিসেব করা কঠিন; প্রক্রিয়ার অনেকগুলি ধাপ আছে যেগুলো আলাদা আলাদা কারিগর সম্পন্ন করেন, আর তাছাড়া চামড়ার গুণমান এবং কোন ঋতুতে কাজ হচ্ছে তার উপরেও অনেকটা নির্ভর করে যায়। “ দো হফতে লগতে হ্যায় এক গেন্দ কো তৈয়ার হোনে মে কম সে কম [একটা বল তৈরি হতে অন্তত সপ্তাহ দুয়েক তো লেগেই যায়],” বলছেন তিনি।

মদনের কারখানায় কর্মীরা প্রথমে চামড়াকে ফিটকিরি দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করেন, তাতে লাল রং ধরান, রোদে শুকোতে দেন, শুকিয়ে গেলে ডালডা বা পশুর চর্বি মাখান পুরোটায়, আর শেষে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে চামড়াটাকে দমাদ্দম পেটান যাতে সেটা একদম নরম হয়ে যায়। “সাদা বলের জন্য রং ধরানোর দরকার পড়ে না কারণ ফিটকিরি প্রক্রিয়াকরণের পর চামড়া এমনিতেই সাদা হয়ে যায়। ওগুলোকে নরম করার জন্য গরুর দুধে তৈরি দই মাখানো হয়,” জানালেন মদন।

Left: Heat-pressed hemispheres for two-piece balls are left to dry in the sun.
PHOTO • Shruti Sharma
Right: Dharam uses a machine to stitch two parallel layers of seam on each of these hemispheres. Unlike a handstitched seam in the case of a four-piece ball, a machine-stitched seam is purely decorative
PHOTO • Shruti Sharma

বাঁদিকে: তাপ দিয়ে বাঁকানো টু-পিস বলের দুটি গোলার্ধ রোদে শুকানো হচ্ছে। ডানদিকে: যন্ত্র দিয়ে প্রতিটি গোলার্ধে দুটি করে সমান্তরাল সেলাই দিচ্ছেন ধরম। চার-পিস বলে হাতে করে এই সেলাই দেওয়া হয় আটকানোর প্রয়োজনে, কিন্তু টু-পিস বলে এই মেশিন-সেলাইয়ের সিম একেবারেই আলঙ্কারিক

Left: Dharam puts lacquer on finished balls to protect the leather from wearing out.
PHOTO • Shruti Sharma
Right: Gold and silver foil-stamped cricket balls at a sports goods retail shop in Dhobi Talao, Mumbai. These have been made in different ball-making units in Meerut
PHOTO • Shruti Sharma

বাঁদিকে: তৈরি হয়ে যাওয়া বলের উপর বার্নিশ চাপাচ্ছেন ধরম যাতে চামড়া ক্ষয়ে না যায়। ডানদিকে: মুম্বইয়ের ধোবি তালাও অঞ্চলের এক ক্রীড়াসামগ্রীর দোকানে সাজিয়ে রাখা সোনা ও রুপোর পাত দিয়ে স্ট্যাম্প করা ক্রিকেট বল। এই সব বল মীরাটের নানা বল কারখানায় বানানো

লাইন সে কাম হোভে হ্যায় অউর এক কারিগর এক হি কাম করে হ্যায় [এই কাজগুলো পরপর ক্রমানুসারে করতে হয়, আর এক-একজন কারিগর একটাই কাজ করে],” ব্যাখ্যা করলেন তিনি। নির্দিষ্ট কারিগর এবার এই চামড়াকে হয় দুটি গোল টুকরোয় নয়তো চারটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি টুকরোয় কাটেন। ক্রিকেট বল সাধারণত দুটি বা চারটি চামড়ার টুকরো দিয়ে তৈরি হয়।

“এই টুকরোগুলোর পুরুত্ব এবং শিরার গড়ন একরকম হওয়া চাই,” জানালেন মদন। “ ইস ওয়াক্ত ছাঁটনে মে গলতি হো গয়ি তো সমঝো কি গেন্দ ডিশেপ হোগা হি [এই ধাপে যদি চামড়া কাটায় এতটুকু ভুল থেকে যায় তবে বল বিকৃতি হবেই হবে],” আরও বললেন তিনি।

বল তৈরির শ্রমসাধ্য কাজের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষতা লাগে হাতে করে চামড়া সেলাই করার কাজে, যাতে ব্যবহার হয় দুই প্রান্তে কাঠির মতো শক্ত শুয়োরের রোঁয়া লাগানো সুতির সুতো। “ছুঁচের বদলে রোঁয়া ব্যবহার হয় কারণ এগুলো শক্তপোক্ত, নমনীয়, এবং চামড়া ছিঁড়ে দেওয়ার মতো তীক্ষ্ণ নয়,” জানালেন মদন। “তাছাড়া এগুলো লম্বা, ধরাও সহজ, আর সেলাই যে করছে তার আঙুলে বিঁধে যাওয়ারও ভয় থাকে না।”

লেকিন সির্ফ ইসি চিজ কে ওয়াজহ সে হামারে মুসলমান ভাই ইয়ে কাম নেহি কর সকতে। উনকো সুয়ার সে দিক্কত হোতি হ্যায় না [কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণেই আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা এই কাজে নামতে পারেন না; ওঁদের শুয়োরে সমস্যা হয়, না?],” আরও যোগ করেন তিনি।

“একটা চার-পিস বল তৈরিতে যে তিন ধরনের সেলাই দিতে হয় তাতে হাত পাকাতে অনেক বছর লাগে,” জানাচ্ছেন মদন সিং, মদনের কারখানার সবচেয়ে অভিজ্ঞ বল কারিগর। ৫০ বছর বয়সি এই কারিগর এখন জম্মু-কাশ্মীরের সেই ক্রেতার অর্ডারি বলগুলিতে ভার্নিশ লাগাচ্ছেন। তিনি জানালেন, “একজন কারিগর যখন এক ধরনের সেলাই থেকে আরেকধরনের সেলাইতে যায়, পিস প্রতি মজুরিও সেই সঙ্গে বাড়ে।” প্রতিটা সেলাইয়ের পদ্ধতি আলাদা, আর কাজও আলাদা।

Sunil (left) beats a roll of processed leather with a hammer to make it pliable, a step locals call melli maarna
PHOTO • Shruti Sharma
For four-piece balls, leather is cut (right) into oval pieces that will make four quarters of a ball
PHOTO • Shruti Sharma

সুনীল (বাঁদিকে) একটা প্রক্রিয়াজাত চামড়ার রোলের উপর হাতুড়ি দিয়ে মারছেন চামড়াটাকে নমনীয় করার জন্য; এই ধাপকে স্থানীয় ভাষায় বলে মেল্লি মারনা। চার-পিস বলের জন্য চামড়া কাটা হয় (ডানদিকে) অর্ধচন্দ্রাকারে; চারটি টুকরো হল বলের চার ভাগ

Left: Monu joins two oval pieces to make a cup or hemisphere and then makes holes using a tool called aar .
PHOTO • Shruti Sharma
Right: Vikramjeet reinforces the inside of the hemispheres with thinner, oval pieces, a process known as astar lagana . The machine on his right is used for seam-pressing, and the one on his left is the golai (rounding) machine
PHOTO • Shruti Sharma

বাঁদিকে: মনু দুটি অর্ধচন্দ্রাকার টুকরো জুড়ে একটা কাপ বা গোলার্ধ তৈরি করেন, তারপর তার ধার দিয়ে আড় নামের একটি যন্ত্র দিয়ে গর্ত করেন। ডানদিকে: বিক্রমজিৎ গোলার্ধের ভিতরদিকে কম পুরু অর্ধচন্দ্রাকার চামড়া আটকাচ্ছেন বলকে পোক্ত করার জন্য; এই ধাপকে বলা হয় আস্তর লাগানো। তাঁর ডানদিকের যন্ত্রটি সিম বা সেলাই বসানোতে ব্যবহার করা হয়, আর বাঁদিকেরটি হল গোলাই বা গোলাকার দেওয়ার মেশিন

প্রথমে দুটি অর্ধাচন্দ্রাকার চামড়ার টুকরো ভিতর দিকে সেলাই দিয়ে একটা কাপ বা গোলার্ধ বানানো হয়; স্থানীয় ভাষায় এই ধাপকে বলে পিস জুড়াই । এই প্রথম সেলাই সাধারণত কোনও শিক্ষানবিশ করে, প্রতি গোলার্ধের জন্য সে পায় সাত টাকা ৫০ পয়সা। “পিস জুড়াই-এর পর গোলার্ধগুলিকে কম পুরু চামড়া দিয়ে পোক্ত করা হয়; একে বলে লাপ্পে,” ব্যাখ্যা করলেন ধরম। এই জোড় দেওয়া চামড়ার গোলার্ধগুলিকে এবার গোলাই মেশিন দিয়ে ছাঁচে বসিয়ে নিখুঁত গোলাকার দেওয়া হয়।

মাঝখানে গোলাকার একটি কর্ক রেখে তার উপরে দুটি গোলার্ধ চাপিয়ে দুই দিক থেকে সমান্তরাল সেলাই দিয়ে চামড়া দুটি জুড়ে একটা বল তৈরি করছেন কর্মীরা। এই ধাপটিকে বলে কাপ জুড়াই। কাপ জুড়াইয়ের মজুরি ১৭-১৯ টাকা মতো হয়। টু-পিস বলেও এই হাতে সেলাই দিয়ে কাপ জুড়াই হয়।

“এই দ্বিতীয় সেলাই শেষ হলে তবেই আমরা ‘গেন্দ’ বা বল শব্দটা ব্যবহার করি,” বলছেন ধরম, “পেহলি বার চমড়া এক গেন্দ কা আকার লেতা হ্যায় [এই ধাপেই প্রথম চামড়া বলের আকার নেয়]।”

ধরম বল তৈরি শিখেছেন ৩৫ বছর আগে, সূরয কুণ্ড রোডের একটি কারখানায়, যেখানে ১৯৫০-এর দশকে প্রথম ক্রীড়াসামগ্রী তৈরি করা শুরু হয়। ক্রীড়াসামগ্রী তৈরির শিল্প এখানে মূলত শুরু হয়েছিল দেশভাগের পর শিয়ালকোট (অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত) থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের হাত ধরে, যাঁদের মীরাটের সূরয কুণ্ড রোড এবং ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকার আশপাশের স্পোর্টস কলোনিগুলিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। “মীরাটের আশপাশের গ্রাম থেকে লোকে শহরে গিয়ে এই কাজ শিখে গ্রামে ফেরত আনল।”

চার-পিস বলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল তৃতীয় সেলাই। বলের উপর সুচারুভাবে চারটি সমান্তরাল সেলাইয়ের রেখা (গেন্দ সিলাই) দিতে হয়। “সবচেয়ে ভালো বলগুলোতে প্রায় ৮০টা করে সেলাই থাকে,” জানালেন তিনি। কতগুলো সেলাই পড়ছে তার সংখ্যার উপর ভিত্তি করে একজন কারিগর বল প্রতি ৩৫-৫০ টাকা রোজগার করেন। টু-পিস বলের ক্ষেত্রে এই সিম মেশিনে সেলাই হয়।

Bharat Bhushan using an aar to make insertions through the leather that protrudes between the two hemispheres, held together by an iron clamp. He places a rounded cork between the two cups and attaches pig bristles by their roots to the ends of a metre-long cotton thread for the second stage of stitching. He then inserts the two pig bristles through the same holes from opposite directions to stitch the cups into a ball
PHOTO • Shruti Sharma
Bharat Bhushan using an aar to make insertions through the leather that protrudes between the two hemispheres, held together by an iron clamp. He places a rounded cork between the two cups and attaches pig bristles by their roots to the ends of a metre-long cotton thread for the second stage of stitching. He then inserts the two pig bristles through the same holes from opposite directions to stitch the cups into a ball
PHOTO • Shruti Sharma

লোহার পাত দিয়ে আটকানো দুই গোলার্ধের ভিতর থেকে উঁচিয়ে থাকা চামড়ার উপর আড় দিয়ে গর্ত করছেন ভারত ভূষণ। দুই কাপের মধ্যে একটি গোলাকার কর্ক বসিয়ে তিনি এক মিটার লম্বা একটি সুতোর দুই প্রান্তে দুটি শুয়োরের রোঁয়ার গোড়া আটকে নেন, দ্বিতীয় সেলাইয়ের জন্য। তারপর একই গর্তের দুই দিক দিয়ে দুটি রোঁয়া ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে কাপদুটিকে একটি বলের আকারে সেলাই করেন

A karigar only moves to seam stitching after years of mastering the other routines.
PHOTO • Shruti Sharma
Pappan, 45, (left) must estimate correctly where to poke holes and space them accurately. It takes 80 stitches to makes holes for the best quality balls, and it can take a karigar more than 30 minutes to stitch four parallel rows of seam
PHOTO • Shruti Sharma

আগের সেলাইগুলি বহু বছর ধরে অনুশীলন করার পরেই কোনও কারিগর সিম সেলাইয়ে হাত দেন। ৪৫ বছর বয়সি পাপ্পনকে (বাঁদিকে) একদম নিখুঁত হিসেব করতে হয় যে কোথায় এবং কত দূরে দূরে গর্ত করতে হবে। সবচেয়ে ভালো গুণমানের বলের জন্য ৮০টা সেলাইয়ের গর্ত করতে হয়, আর তাতে চারটি সমান্তরাল সিম সেলাই দিতে একজন কারিগরের আধ ঘন্টারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে

স্পিনার হো ইয়া ফাস্ট বোলার, দোনো সিম কে সাহারে হি গেন্দ ফেঁকতে হ্যায় [স্পিনার হোক বা ফাস্ট বোলার, দুজনেই বল করার সময় সিমের সাহায্য নেয়],” বলছেন ধরম। সিম সেলাই হয়ে গেলে সিমের বেরিয়ে থাকা অংশটি হাত দিয়ে চেপে চেপে বসানো হয়, তারপর বার্নিশ আর স্ট্যাম্প লাগানো। “খিলাড়ি ক্যা পেহেচানতে হ্যায়? সির্ফ চমকতি হুয়ি গেন্দ, সোনে কি মুহর কে সাথ [খেলোয়াড় কী দেখে? শুধু একটা চকমকে বল, সোনার স্ট্যাম্প লাগানো]।”

ক্রিকেট বল কি এক খাস বাত বতাইয়ে [আপনিই বলুন, ক্রিকেট বলে এমন কী অসাধারণ ব্যাপার আছে?]” প্রশ্ন করেন মদন।

“খেলাটাই তো আসল, যাতে এখন নতুন নতুন ফরম্যাট এসেছে,” বলছেন তিনি, “ লেকিন বনানেওয়ালা অউর বনানে কি তকনিক, তরিকা অউর চিজে বিলকুল নেহি বদলিঁ [কিন্তু বল কারিগর, আর সেই বল বানানোর কায়দা, কানুন আর উপদান কিছুই বদলায়নি]।”

এক দিনে গড়ে ২০০টি বল বানাতে পারেন মদনের কারিগররা। একটা বা এক ব্যাচ বল বানাতে প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে যায়। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ থেকে তৈরি বলে পৌঁছতে “অন্তত ১১ কারিগরের দক্ষতা লাগে, ঠিক যেমন ১১ জন ক্রিকেটারে একটা দল হয়,” বলতে বলতে নিজের তুলনা শুনে নিজেই হেসে ফেলেন মদন।

পর খেল কা অসলি কারিগর তো খিলাড়ি কি হোভে হ্যায় [কিন্তু খেলার আসল খেলোয়াড় তো যে খেলছে সেই],” বলে ওঠেন মদন।

এই প্রতিবেদনে অমূল্য সহায়তার জন্য এই প্রতিবেদক ভারত ভূষণের কাছে কৃতজ্ঞ।

এই প্রতিবেদন মৃণালিনী মুখার্জী ফাউন্ডেশন (এমএমএফ) দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Shruti Sharma

Shruti Sharma is a MMF-PARI fellow (2022-23). She is working towards a PhD on the social history of sports goods manufacturing in India, at the Centre for Studies in Social Sciences, Calcutta.

Other stories by Shruti Sharma
Editor : Riya Behl

Riya Behl is Senior Assistant Editor at People’s Archive of Rural India (PARI). As a multimedia journalist, she writes on gender and education. Riya also works closely with students who report for PARI, and with educators to bring PARI stories into the classroom.

Other stories by Riya Behl
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee