ভর দুপুরবেলা। পুরনো একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা থেকে অবশিষ্ট ভাতটুকু চেঁছেপুঁছে খাচ্ছেন মায়া। সারাটা দিনে এটাই তাঁর একমাত্র খাবার। শিবা ও তাঁর নিজের জন্য মুসুরিডালের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না কড়াইতে।

"আমরা দিনে একবারই খাই, তবে ছেলেমেয়েদের জন্য দুইবার রাঁধতে হয়। চেষ্টা করি আমার সোনারা অন্তত যেন পেটভরে খেতে পায়," ২৩ বছর বয়সী মায়া বললেন। "মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা ওই নামমাত্র বাজার করতে পারছি," তাঁর বাঁশের তৈরি ঘরের দাওয়ায় বসে বলছিলেন বছর-পঁচিশের শিবা। সেই ঘরের দেয়াল এবং ছাদ পুরনো শাড়ি আর বস্তা দিয়ে কোনওমতে ঢাকা।

২০২০ সালের মার্চে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে মায়া ও শিবা গান্ডাডে নিজেদের এবং তাঁদের ২ থেকে ৭ বছর বয়সী চার সন্তানের পেট ভরাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন।

খোলা মাঠের নিচে তাঁদের এই অস্থায়ী বাসাটি পান্ধারিয়াচিওয়াড়ি গ্রাম থেকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বীড জেলার ওই একই নামের তালুকের অন্তর্গত তাঁদের এই বসতি থেকে পান্ধারিয়াচিওয়াড়ি গ্রামটিই নিকটতম। বর্ষা শুরু হলেই বাসার রঙিন দেয়াল ও ছাদ চুঁইয়ে জল পড়তে শুরু করে।

এই মাঠে আশ্রয় নেয়া ১৪টি পরিবার ‘মসনযোগী’ নামের একটি যাযাবর জনগোষ্ঠীর সদস্য (মহারাষ্ট্রে তাঁরা ‘ওবিসি’ হিসেবে নথিভুক্ত), পরম্পরাগতভাবে এককালে এই সম্প্রদায় ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফি বছর এই পরিবারগুলি এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

Since the lockdowns began, Maya and Shiva Gandade, who live in a cluster of huts of the Masanjogi community in Beed district, have been struggling to feed themselves and their four little children
PHOTO • Jyoti Shinoli
Since the lockdowns began, Maya and Shiva Gandade, who live in a cluster of huts of the Masanjogi community in Beed district, have been struggling to feed themselves and their four little children
PHOTO • Jyoti Shinoli

লকডাউন শুরু হবার পর থেকেই বীড জেলার মসনযোগী বসতির মায়া ও শিবা গান্ডাডেকে নিজেদের এবং চার সন্তানের পেট ভরাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে

এঁদের মধ্যে অনেকেই এখন বর্জ্য-সংগ্রহের কাজ করেন। মহিলারা সাধারণত আশপাশের গ্রাম থেকে চুল ও পুরনো জামাকাপড় সংগ্রহ করেন। পুরুষেরা আবর্জনার স্তুপ ঘেঁটে কিংবা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনেন প্লাস্টিক, লোহালক্কড়, এলুমিনিয়ামের ছাঁট ইত্যাদি। "কাবাড়ের পরিমাণ দেখে কাবাড়ি পয়সা দেয় আমাদের," জানালেন মায়া। তিনি প্লাস্টিকের বালতি ও মগের বিনিময়েও চুল ও জামাকাপড় সংগ্রহ করে থাকেন।

"ধরুন কোনো একটা জায়গায় আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য তালুকে চলে যাই," মায়া বলে চলেছিলেন, "একই জায়গায় এক বছরের বেশি থাকা হয়ে ওঠে না আমাদের।"

কিন্তু কোভিড-১৯-এর দরুন যাতায়াতের ওপর বিধিনিষেধ চালু হওয়ার পর থেকে তাঁরা আটকা পড়ে গেছেন। "২০১৯-এর নভেম্বর মাস থেকে আমরা বীডেই পড়ে আছি," জানালেন শিবা, "একখানা টেম্পো ভাড়া করার মতো পয়সাও হাতে নেই, আর মালপত্তর নিয়ে সরকারি বাসে ওঠাও তো অসম্ভব।" শৈশবে পোলিও আক্রান্ত হওয়ায় শিবা আজও ছড়ি-হাতে চলাফেরা করেন।

"কতটা বাতিল জিনিসপত্র, পুরনো কাপড়জামা আর চুল জোগাড় করতে পেরেছি, সেটার ওপর আমাদের রুজিরুটি নির্ভর করে,” বলছিলেন তিনি। যদিও মহামারির আগেও এমন কত দিনই না তাঁরা কাটিয়েছেন যখন একটা নয়াপয়সাও জোটেনি। তবে হ্যাঁ, তখনও তাঁদের যৌথ মাসিক আয় ৭০০০-৮০০০-এর কম কখনোই হত না।

আর এখন প্রায় একবছর হতে চলল, মাসে ৪০০০ টাকার বেশি আমদানিই হচ্ছে না।

আয়ের এই ঘাটতির প্রকোপ পড়েছে খাদ্যের উপর। মায়া ও শিবার কথামাফিক এককালে ছয়জন সদস্যের এই পরিবারটি খাবারদাবারের জন্য মাসে ৪০০০-৫০০০ টাকা খরচ করার মত সামর্থ্য রাখত।

Their weekly purchase of foodgrains has dropped to just one kilo of masoor dal and two kilos of rice for a family of six
PHOTO • Jyoti Shinoli
Their weekly purchase of foodgrains has dropped to just one kilo of masoor dal and two kilos of rice for a family of six
PHOTO • Jyoti Shinoli

ছ'জনের এই পরিবারটির সাপ্তাহিক খোরাক মাত্র এক কেজি মুসুরির ডাল এবং দুই কেজি চালে এসে ঠেকেছে

তাঁদের অতিমারি-পূর্ব সাপ্তাহিক খোরাকের চিত্র অনুধাবন করলে দেখা যাবে ২ কেজি ওজনের বিভিন্ন ধরনের ডাল এবং ৮ থেকে ১০ কেজি চাল থেকে নেমে তা আজ ১ কেজি সস্তা মুসুরির ডাল এবং ২ কেজি চালের জরাজীর্ণ অঙ্কে এসে দাঁড়িয়েছে। "তাছাড়াও মাসে এই ধরুন বার তিনেক ছেলেমেয়েদের জন্য মুরগি কিংবা পাঁঠার মাংস, ডিম, শাকসবজি, ফলটল ইত্যাদি কেনা তো হতোই," আঙুলের গাঁট গুণে গুণে বললেন মায়া। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে তাঁদের আহারের পরিমাণ ও গুণমান, দুই-ই তলানিতে ঠেকেছে। "এমন নয় যে আগে আমরা ভুরিভোজ করতাম, তবে হ্যাঁ, পেট ভরার ব্যবস্থা হয়ে যেত ঠিকই," জানালেন তিনি।

শিবা বলছিলেন, "সে তেল বলুন বা ডাল, আজকাল তো সবকিছুরই দাম আকাশছোঁয়া। কেমন করে টানব বলুন তো? আগের মতো রুজিরোজগারও যে নেই আর।"

এদিকে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের ২০১১-১২ সালের হাউজহোল্ড কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এই অতিমারির এক দশক আগে থেকেই ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য-খরচ ক্রমশই নিম্নমুখী ছিল — ১৯৯৩ সালে ৬৩.২ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৪৮.৬ শতাংশ। (পরবর্তী পাঁচ বছরের সমীক্ষার রিপোর্ট এখনও অবধি পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মন্ত্রক প্রকাশ করেনি)।

‘র‍্যাপিড রুরাল কমিউনিটি রেসপন্স টু কোভিড-১৯’ নামে দিল্লিভিত্তিক একটি মঞ্চের (যারা খাদ্য বিতরণের কাজও করছে) সমীক্ষা বলছে যে অতিমারির গোড়ার দিক থেকেই ক্ষুধা তার বীভৎস নখদন্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীগুলোর শরীরেই সবচেয়ে বেশি চালিয়েছে। তাদের বক্তব্য: ১২ই ডিসেম্বর, ২০২০ থেকে ৫ই জানুয়ারি, ২০২১, এই সময়কালের মধ্যে চল্লিশ শতাংশ মানুষ (১১টি রাজ্য জুড়ে তাঁরা ১১,৮০০ নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন) তাঁদের খাদ্য-খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন এবং ২৫ শতাংশ মানুষ তাঁদের খাদ্যতালিকা থেকে ক্রমশ ডিম, মাংস, শাকসবজি এবং তেলের পরিমাণ ছেঁটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।

Many Masanjogis now work as waste-collectors, at times exchanging plastic tubs and buckets for the items they pick up from households
PHOTO • Jyoti Shinoli
Many Masanjogis now work as waste-collectors, at times exchanging plastic tubs and buckets for the items they pick up from households
PHOTO • Jyoti Shinoli

মসানযোগীদের মধ্যে অনেকেই আজকাল বর্জ্য-সংগ্রহের কাজে যুক্ত। প্লাস্টিকের মগ ও বালতির বিনিময়ে তাঁরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বাতিল জিনিসপত্র, জামাকাপড় ও চুল সংগ্রহ করে থাকেন

একটা রেশনকার্ড থাকলে হয়তো মায়া ও শিবার কিছুটা সুবিধা হত। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী পরিবারের কাছে রেশনকার্ড থাকলে তারা সরকারি ভর্তুকিযুক্ত দামে মাথাপিছু প্রতি মাসে পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য কিনতে পারবে — চাল পাওয়া যাবে ৩টাকা কেজি দরে, গম ২ টাকা কেজি এবং এক টাকা কেজিতে মোটাদানার আনাজ।

"আমাদের কাছে একটাও রেশনকার্ড নেই," মায়া জানান, "আসলে আমরা কোনো একটা জায়গায় খুব বেশিদিন বসত করি না।" এই কারণেই তাঁর পরিবার এবং ওই বসতির আরো ১৪টি পরিবারের মধ্যে কেউই কোনো সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পায় না। অতএব হালেই ঘোষিত ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ অনুযায়ী অতিমারি চলাকালীন অতিরিক্ত পাঁচ কেজি শস্যও তাদের কাছে এসে পৌঁছয়নি।

“আজ একটা ব্যাপক খাদ্যসংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের পর ক্ষুধার কামড় দিন কে দিন আরোই তীব্রতর হয়ে উঠেছে,” জানাচ্ছেন ‘খাদ্যের অধিকার’ অভিযানের দিল্লি নিবাসী সদস্য দীপা সিংহ। তিনি এটাও বললেন, "অসংখ্য মানুষের কাছে রেশন কার্ড নেই, অথচ সুপ্রিমকোর্টের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নির্দেশ পাওয়ার পরও এই বিষয়ে সরকারের কোনও হেলদোল নেই।"

"আমাদের গোষ্ঠীর [মসনযোগী] অর্ধেকের চেয়ে বেশি লোকের কাছে রেশন কার্ড বলুন কিংবা অন্য কোনো পরিচয়পত্র, এসবের কিছুই নেই," জানালেন নন্দেড় নিবাসী ৪৮ বছর বয়সী লক্ষ্মণ ঘনসরওয়াড়। ‘মসনযোগী মহাসঙ্ঘ’ নামের একটি সংগঠন চালান তিনি। তাঁদের কাজ মসনযোগীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও তাঁদের দলিলপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করা। লক্ষ্মণের হিসেব অনুযায়ী মহারাষ্ট্রে মসনযোগীদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি, যাঁদের মধ্যে ৮০ শতাংশই বর্জ্য-সংগ্রহের কাজের সঙ্গে যুক্ত।

For Naresh and Suvarna Pawar, and their kids in Yavatmal (they belongs to the Phanse Pardhi community), bajri bhakris have become a rare meal item
PHOTO • Jyoti Shinoli
For Naresh and Suvarna Pawar, and their kids in Yavatmal (they belongs to the Phanse Pardhi community), bajri bhakris have become a rare meal item
PHOTO • Jyoti Shinoli

ইয়াভতমলে বসবাসকারী ফাঁসে পারধি গোষ্ঠীর নরেশ ও সুবর্ণা পাওয়ার এবং তাঁদের বাচ্চাদের কাছে বাজরার ভাখরিও ইদানীং একটি দুর্লভ খাবারে পরিণত হয়েছে

অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীগুলির অবস্থাও তথৈবচ। সুবর্ণা ও নরেশ পাওয়ার - এই দম্পতি তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে ও চার বছরের মেয়েকে নিয়ে ইয়াভতমল জেলার নেড় তালুকে বসবাস করেন। তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ২০১৯এর মে মাসে (এই প্রতিবেদনটির জন্য ফোনেও যোগাযোগ করেছিলাম)। তাঁরা ‘ফাঁসে পারধি’ যাযাবর জনগোষ্ঠীর মানুষ (‘তফশিলি জনজাতি’ হিসেবে নথিভুক্ত)। এখানে খড়ের ছাউনি দেয়া ৭০টি ঝুপড়িতে ৩৫টি পরিবার বসবাস করে, পাওয়ার দম্পতিও রয়েছেন তাঁদেরই মধ্যে। এঁদের কারো কাছেই রেশনকার্ড নেই।

২৬ বছরের সুবর্ণা প্রত্যেকদিন সাতসকালে কাছেপিঠের গ্রামগুলোতে ভিক্ষে করতে বেরিয়ে পড়েন। "আমি দরজায় দরজায় গিয়ে হাত পাতি, কিন্তু ভিক্ষে করাও অত সহজ নয় এখন," তিনি বলছিলেন, "আসলে গাঁয়ের লোকজন করোনার ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। অনেকেই আমাদের গাঁয়ের ভেতরে ঢুকতে পর্যন্ত দেয় না। মাত্র কয়েকজন, আমাদের অবস্থা দেখে দয়াটয়া হয় আর কি যাদের, কেবল তারাই অল্পসল্প কিছু চাল আর বাসি ভাখরি আমাদের হাতে তুলে দেয়।" (দেখুন লকডাউনে পারধিরা — প্রশ্নভিক্ষাই সার! )

সুবর্ণা যখন খাবারের খোঁজে ব্যস্ত, তখন তাঁর স্বামী নরেশ (২৮) ওই বসতিরই আরো কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে মিলে পাশের জঙ্গলে তিতির পাখি শিকার করতে বেরিয়েছেন। শিকার করা পাখি কখনও খাওয়া হয়, কখনও বা বিক্রি করে দেন তাঁরা। "শিকার টিকার করা নিষিদ্ধ তো। তাই অনেক সময় ফরেস্টের বাবুরা আমাদের ধমকধামক দিয়ে ভাগিয়ে দিন। ফলে প্রায়ই আমাদের খালি হাতেই ফিরে আসতে হয়," জানালেন নরেশ।

একেকটা দীর্ঘ দিনের শেষে, তাঁদের পাতে জোটে লোকের বাড়ি থেকে ভিক্ষে করে আনা সামান্য ভাত, সঙ্গে লঙ্কাগুঁড়ো কিংবা কালো তিলের চাটনি। কদাচিৎ তাঁদের তরিতরকারি জোটে। "তবে আমরা বললে পরে কোনও কোনও চাষি নিজের খেত থেকে আলু-বেগুন তুলে খেতে দেয় বটে," বললেন সুবর্ণা।

Suvarna begs for food now, and says: 'A few who take pity on us give some rice grains, and sometimes leftover bhakri'
PHOTO • Jyoti Shinoli

সুবর্ণাকে এখন খাবারের জন্য ভিক্ষে করে বেড়াতে হয়। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের অবস্থা দেখে দয়াটয়া হয় যাদের, কেবল তারাই অল্পসল্প কিছু চাল আর বাসি ভাখরি হাতে তুলে দেয় আমাদের'

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের ২০১১-১২ সালের ‘হাউজহোল্ড কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এই অতিমারির এক দশক আগে থেকেই ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য-খরচ ক্রমশই নিম্নমুখী হয়েছে — ১৯৯৩ সালে ৬৩.২ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৪৮.৬ শতাংশ

ন্যাশনাল কমিশন ফর ডিনোটিফায়েড নোম্যাডিক অ্যান্ড সেমি-নোম্যাডিক ট্রাইবসের কাছে পাঠানো নানান আবেদন থেকে বিশদভাবে জানা যায় যে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীগুলিকে কী কী বাস্তবিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে: "পরিচয় ও দলিলপত্র-বিষয়ক ৪৫৪টি আবেদনের মধ্যে ৩০৪টি আবেদনই মৃত্যুর প্রমাণপত্র, বিপিএল [রেশন] কার্ড এবং আধারকার্ড সংগ্রহ করার সমস্যা-সংক্রান্ত।"

সবদিক দিয়েই এই অতিমারি তাঁদের অবস্থা আরোই করুণ করে তুলেছে।

"যাঁরা সমাজের অরক্ষিত ও দুর্বলতম অংশের মানুষ (গৃহহীন, পথবাসী, হকার, রিকশাচালক, পরিযায়ী শ্রমিক ইত্যাদি), যাঁদের খাদ্যশস্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি... যাঁরা আজ অবধি রেশনকার্ড তুলতে পারেননি" — এঁদের প্রতি দেশের সমস্ত রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে ২ জুন, ২০২১তে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ করা হয়।

মহারাষ্ট্র সরকার ইতিমধ্যেই (২৬শে জানুয়ারি, ২০২০ থেকে) ‘শিব-ভোজন যোজনা’ চালু করেছে যার মাধ্যমে দশটাকার বিনিময়ে কোনও প্রমাণপত্র ছাড়াই সব্বার হাতে খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে। অতিমারি চলাকালীন এই খাবারের মূল্য প্লেট পিছু পাঁচটাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। মহারাষ্ট্র সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষার (২০২০-২১) দাবি: "যোজনার গোড়াপত্তন থেকে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ৯০৬টি শিব-ভোজন কেন্দ্র থেকে মোট ২.৮১ কোটি শিব-ভোজন থালি বিতরণ করা হয়েছে।"

তবে শিবা ও নরেশদের বসতিতে কিন্তু এই খাবারের সুগন্ধ আজও এসে পৌঁছতে পারেনি। "যাহ্ বাবা! আমরা তো এসবের কিছুই জানি না,’ হতবাক হয়ে বললেন শিবা। "যদি জানতাম তাহলে কী আর এভাবে দিনের পর দিন ভুখা পেটে পড়ে থাকতাম?" পাশ থেকে বলে উঠলেন নরেশ।

Naresh and other men from the settlement go hunting for teetar (partridge) in nearby forest areas. The birds are eaten or sold by the families
PHOTO • Jyoti Shinoli
Naresh and other men from the settlement go hunting for teetar (partridge) in nearby forest areas. The birds are eaten or sold by the families
PHOTO • Jyoti Shinoli

বসতির অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে নরেশও কাছেপিঠের জঙ্গলে তিতির পাখি শিকার করতে যান। পাখিগুলি হয় তাঁরা নিজেরাই রান্না করে খেয়ে ফেলেন, কিংবা বিক্রি করে দেন

'খাদ্যের অধিকার অভিযানের' দীপা সিংহের বক্তব্য: "পুরো বিষয়টাই আজ রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে দ্বৈরথের আকার নিয়ে নিয়েছে, এবং এই জাঁতাকলের মাঝে পিষে মরছে সাধারণ মানুষ। কোনও কোনও রাজ্য নানাভাবে চেষ্টা করে চলেছে ঠিকই, তবে কেন্দ্রের তরফ থেকে এখনও কোনও প্রকল্পের দেখা নেই।"

আজীবন সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনীর বাইরে থাকা সত্ত্বেও নরেশকে আগে কখনও শিকার করে দিন গুজরান করতে হয়নি। সুবর্ণার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই, তিনি যে বরাবরই ভিক্ষার ওপর নির্ভরশীল এমনটা ভাবা ভুল। হাজার একটা আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এর চেয়ে ‘আচ্ছে দিন’ দেখেছেন।

"সে খোঁড়াখুঁড়িই বলুন কিংবা রাস্তাঘাট বানানোর কাজ, নর্দমা সাফাই থেকে ফুল বিক্রি, আমরা যখন যা কাজ পেতাম, তাই করতাম," জানালেন নরেশ। মুম্বই, নাগপুর, পুণের মতো শহরে বছরের অর্ধেকটা সময় (ডিসেম্বর থেকে মে) কেটে যেত হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যে দিয়ে। ফ্লাইওভারের নিচে অথবা অস্থায়ী কোনও ডেরায় রাত কাটিয়ে প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ টাকা সঞ্চয় হতো তাঁদের এই ছয়মাসে।

এই টাকাটুকু দিয়ে তাঁদের বাকি ছয় মাসের শস্য, তেল ও শাকসবজির খরচ উঠে আসত। "সেটাই ছিল আমাদের রুজিরুটির প্রধান উপায়। প্রতি মাসে তখন আমরা [খোলা বাজার থেকে] ১৫-২০ কেজি চাল, ১৫ কেজি বাজরা, ২-৩ কেজি মুগডাল, এসব কিনতে পারতাম," বলছিলেন নরেশ।

নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত বটে, তবুও সুখদুঃখ মিলেমিশে তাও বা যেটুকু ভারসাম্য ছিল, সেটাও টাল খেতে শুরু করল অতিমারির আবির্ভাবে। যে মরসুমি পরিযান ছিল তাঁদের জীবনধারার চাবিকাঠি, লকডাউন আসার ফলে তা থমকে দাঁড়ায়। ফলত দিন কে দিন আরোই বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি বা শিকারের উপর নির্ভর করতে। বলছিলেন নরেশ, "সরকার তো যখন খুশি লকউাউন ঘোষণা করে দিচ্ছে, আচমকা শহরে আটকা পড়ে গেলে বিপদের শেষ থাকবে না। তার চেয়ে বরং পেটে কিল মেরে বাড়িতে বসে থাকাই ভালো। আজকাল তো আশেপাশের গাঁয়েও কাজকম্ম কিস্যু মেলে না। শহরে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাহোক একটু হাল ফিরছিল, কিন্তু এখন... সেসবও আর রইল না।"

অনুবাদ: তনুজ

Jyoti Shinoli is a Senior Reporter at the People’s Archive of Rural India; she has previously worked with news channels like ‘Mi Marathi’ and ‘Maharashtra1’.

Other stories by Jyoti Shinoli
Translator : Tanuj

Tanuj is a poet, editor, translator, and an independent publisher from Tripura. He has published seven books till date and also runs and edits a literary journal ‘Harakiri’ which has now extended itself into an independent publishing initiative.

Other stories by Tanuj