“মানুষ না মরবে ঝগড়ায় আর না বাগড়ায়

মরবে ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালায়।”

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কেবল বিজ্ঞান নয়, ভারতের মহাকাব্যগুলিও বহু আগেই জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে গেছে, বললেন দিল্লির ৭৫-বছর বয়সী কৃষক শিব শঙ্কর। তাঁর বিশ্বাস তিনি ১৬ শতাব্দীর ধ্রুপদী সাহিত্য, রামচরিতমানস ( ভিডিও দেখুন ) থেকে পদ উদ্ধৃত করছেন। শঙ্করের ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠে অসঙ্গতি আছে হয়তো এবং ঠিক ওই পঙক্তিগুলি তুলসীদাসের কাব্যে খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যমুনা নদীর প্লাবনভূমির এই কৃষকের কথাগুলি আমাদের সময়ের জন্য যথোপযুক্ত।

নগর ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্লাবনভূমির তাপমাত্রা, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ক পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন শঙ্কর, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং ওই অঞ্চলের আরও বহু কৃষক। যমুনা নদীর ১,৩৭৬ কিমির মধ্যে মাত্র ২২ কিমি দেশের রাজধানীর মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় আর ৯৭ বর্গ কিমি প্লাবনভূমির মাত্র ৬.৫ শতাংশ পড়ে দিল্লির মধ্যে। কিন্তু প্লাবনভূমির এই ক্ষুদ্র উপস্থিতিও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় বড়ো ভূমিকা পালন করে এবং রাজধানীর প্রকৃতিদত্ত তাপস্থাপক পদ্ধতি হিসাবে কাজ করে।

এই অঞ্চলে ঘটে চলা পরিবর্তনগুলিকে এখন কৃষকরা নিজেদের মতো করে লক্ষ্য করছেন। শিব শঙ্করের পুত্র বিজেন্দ্র জানালেন যে ২৫ বছর আগে অবধি এখানে সবাই সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাল্কা কম্বল ব্যবহার করা শুরু করে দিতেন। ৩৫-বছর বয়সী মানুষটি বললেন, “এখন ডিসেম্বরের আগে তো শীত শুরুই হয় না।” আগে হোলির দিনটিতে খুব গরম পড়তো। এখন হোলি উদ্‌যাপিত হয় শীতে।”

Shiv Shankar, his son Vijender Singh (left) and other cultivators describe the many changes in temperature, weather and climate affecting the Yamuna floodplains.
PHOTO • Aikantik Bag
Shiv Shankar, his son Vijender Singh (left) and other cultivators describe the many changes in temperature, weather and climate affecting the Yamuna floodplains. Vijender singh at his farm and with his wife Savitri Devi, their two sons, and Shiv Shankar
PHOTO • Aikantik Bag

শিব শঙ্কর, তাঁর পুত্র বিজেন্দ্র (বাঁয়ে) এবং অন্যান্য কৃষ করা যমুনার প্লাবনভূমির ক্ষতিসাধনকারী তাপমাত্রা, জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনগুলি বর্ণনা করেন। সস্ত্রীক বিজেন্দ্র সিং নিজের দুই পুত্র, মা সাবিত্রী দেবী ও শিব শঙ্করের সঙ্গে (ডানদিকে)

শিব শঙ্করের পরিবারের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যান্য কৃষকদের অভিজ্ঞতাও মিলে গেল। গঙ্গার শাখা নদীগুলির মধ্যে দীর্ঘতম ও আয়তনে (ঘর্ঘরা-এর পরই) দ্বিতীয় স্থান অধিকারী যমুনা নদীর দিল্লির উপকূলে বসবাসকারী কৃষকের সংখ্যা ৫,০০০ থেকে ৭,০০০। এখানে যে ২৪,০০০ একর জমিতে এখন কৃষকরা চাষ করেন তা পরিমাণে কয়েক দশক আগের তুলনায় অনেক কম বলে তাঁদের মত। এঁরা বাস করেন একটি বড়ো শহরে, কোনও দূরবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলে নয়। তাঁদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা “উন্নয়নের” চাপে নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করেন সর্বদা এঁরা। প্লাবনভূমিতে বেআইনি নির্মাণ কাজের বিরুদ্ধে জাতীয় গ্রীন ট্রাইবুনাল অভিযোগে ছেয়ে গেছে। আর এ নিয়ে মাথাব্যথা যে কেবলমাত্র কৃষকদেরই এমনটা নয়।

“প্লাবনভূমি যে ভাবে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে তাতে দিল্লিতে শীত-গ্রীষ্মে এমন চরম তাপমাত্রা হবে যে দিল্লির মানুষজন শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে,” বললেন বন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক আধিকারিক, মনোজ মিশ্র। মিশ্র, ২০০৭ সালে শুরু হওয়া যমুনা জিয়ে আভিযান আন্দোলনের (ওয়াইজেএ) নেতা। দিল্লির সাতটি পরিবেশবাদী সংগঠন ও অন্যান্য সচেতন মানুষকে একসঙ্গে এনে ওয়াইজেএ নদী ও তার ভূপ্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার লক্ষ্যে কাজ করছে। “শহরটা অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে - শহর ছেড়ে মানুষ চলে যাবে। এখানকার বাতাসের মানোন্নয়ন না হলে বিদেশী দূতাবাসগুলিও এখান থেকে সরে যাবে।”

*****

অপরদিকে প্লাবনভূমির খামখেয়ালি বৃষ্টিপাত একইসঙ্গে কৃষক এবং মৎস্যজীবীদের জীবন জেরবার করে দিচ্ছে।

যমুনা নদীর উপর নির্ভশীল মানবগোষ্ঠীগুলি এখনও বর্ষাকে স্বাগত জানায়। মৎস্যজীবীরা স্বাগত জানান কারণ বর্ষার জল নদীর জলকে পরিষ্কার করে মাছেদের বংশবৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে আর কৃষকরা এর ফলে পান জমির উপর নতুন উর্বর মাটির প্রলেপ। “বর্ষায় জমি নতুন হয়ে যায়, ফিরে পায় পুনর্জ্জীবন,” বুঝিয়ে বললেন শিব শঙ্কর। ২০০০ সাল অবধি এমনটাই হয়েছে। এখন বৃষ্টিপাত কমে গেছে। আগে জুন মাসে বর্ষা শুরু হয়ে যেত। এ বছর জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টিই হয়নি। এতে আমাদের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

নিজের জমি ঘুরিয়ে দেখাতে গিয়ে শঙ্কর বলেছিলেন, “বৃষ্টি না হলে মাটিতে লবণের (ক্ষার) পরিমাণ বেড়ে যায়।” দিল্লির পলল মাটি প্লাবনভূমির উপর দিয়ে নদীর বয়ে আনা পলি দ্বারা গঠিত। এই জমিতে বহুদিন ধরে ধান, গম, আখ ও আন্যান্য ফসল এবং শাকসবজি চাষ হয়ে আসছে। দিল্লি গ্যাজেটিয়ার অনুসারে, লারি, মিরাঠি, সোরাঠা — গর্ব করার মতো এই তিন ধরনের আখ এখানে ১৯ শতকের শেষ অবধি চাষ হত।

“বর্ষায় জমি নতুন হয়ে যায়, ফিরে পায় পুনর্জ্জীবন,” বুঝিয়ে বললেন শিব শঙ্কর।

ভিডিও দেখুন : ‘এখন গ্রামে আর একটিও বড়ো গাছ নেই’

কোল্হুতে মাড়াই করে আখের রস বের করে গুড় বানানো হত। দশ বছর আগেও আখের রস বিক্রি করার ছোটো ছোটো ঠেলাগাড়ি আর অস্থায়ী দোকানে দিল্লি ছেয়ে ছিল। “তারপর সরকার আমাদের আখের রস বিক্রি করতে নিষেধ করে দিল, ফলে চাষও বন্ধ হয়ে গেল,” বললেন শঙ্কর। ৯০-এর দশক থেকে আখের রস বিক্রির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে মামলা চলছে। “সবাই জানে আখের রস রোগ ঠেকায়, গ্রীষ্মে আমাদের শরীর শীতল রাখে,” তিনি জোর দিয়ে বললেন। “ঠাণ্ডা পানীয় প্রস্তুতকারকরা আমাদের নিষিদ্ধ করাল। ওরা মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গে দরবার করে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করিয়ে ছাড়ল।”

কখনও কখনও চরম আবহাওয়া সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলে সর্বনাশ ঘটায়। এই বছর যমুনা নদীতে বন্যার সময়ে হরিয়ানা সরকার হাথনি কুণ্ড জলাধারের জল ছাড়ল অগস্ট মাসে, ঠিক দিল্লির বর্ষার সময়ে — তাতে বহু ফসল ধ্বংস হয়ে গেল। বিজেন্দ্র আমাদের কিছু শুকিয়ে কুঁচকে যাওয়া লংকা, বেগুন আর মুলো দেখালেন, যেগুলোর এবার আর বেলা এস্টেট-এ (জাতীয় স্মারক রাজঘাট আর শান্তিবনের ঠিক পিছনে অবস্থিত) তাঁদের পাঁচ বিঘা (এক একর) জমিতে পুষ্ট হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।

রাজধানীর আবহাওয়া প্রায়-শুষ্ক অনেকদিন ধরেই। ১৯১১ সালে ব্রিটিশদের রাজধানী হওয়ার আগে এই জায়গাটা ছিল কৃষি-প্রধান পাঞ্জাব রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ — পশ্চিমে রাজস্থানের মরুভূমি, উত্তরে হিমালয় পর্বত আর পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি দিয়ে ঘেরা (এই সব অঞ্চলগুলিই জলবায়ুর পরিবর্তনে জেরবার হচ্ছে এখন)। এর মানে বর্ষার ৩-৪ মাসের আরাম বাদে অতি শীতল শীত আর নিদারুণ গরম গ্রীষ্মই এই অঞ্চলের বৈশিষ্ঠ্য।

এখন আবহাওয়া হয়ে গেছে আরও খামখেয়ালি। ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুসারে এ বছর জুন-অগস্ট মাসে দিল্লির বর্ষায় ঘাটতি ছিল ৩৮ শতাংশ। যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬৪৮.৯ মিমি সেখানে এ বছর বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৪০৪.১ মিমি। সোজা কথায় পাঁচ বছরের মধ্যে এ বছর দিল্লির বৃষ্টিপাত ছিল সর্বনিম্ন।

সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অভ ড্যামস্‌ রিভারস্‌ অ্যান্ড পিপল-এর সমন্বয়কারী, হিমাংশু ঠক্করের মতে বর্ষার ধরন বদলাচ্ছে আর বৃষ্টিপাত হচ্ছে বিক্ষিপ্ত। “বৃষ্টিপাতের পরিমাণে ঘাটতি সবসময়ে না ঘটলেও বর্ষাকালের মেয়াদ কমে যাচ্ছে। যেদিনগুলোয় বৃষ্টি পড়ে সেদিনগুলোয় ভারি বৃষ্টিপাত হয়। দিল্লি বদলে যাচ্ছে আর এর প্রভাব পড়বে যমুনা আর তার প্লাবনভূমির উপর। অভিবাসন, রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা, বায়ু দূষণ সব বেড়ে গিয়ে উত্তরপ্রদেশ পঞ্জাব সন্নিহিত অঞ্চলকে বদলে দিচ্ছে। ছোটো এলাকা জুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন আঞ্চলিক জলবায়ুকে প্রভাবিত করে।”

*****

The flooding of the Yamuna (left) this year – when Haryana released water from the Hathni Kund barrage in August – coincided with the rains in Delhi and destroyed several crops (right)
PHOTO • Shalini Singh
The flooding of the Yamuna (left) this year – when Haryana released water from the Hathni Kund barrage in August – coincided with the rains in Delhi and destroyed several crops (right)
PHOTO • Aikantik Bag

এই বছর যমুনা নদীতে বন্যার সময়ে হরিয়ানা সরকার হাথনি কু ণ্ড জলাধারের জল ছাড়ল অগস্ট মাসে , ঠিক দিল্লির বর্ষার সময়ে — তাতে বহু ফসল ধবংস হয়ে গেল।

‘যমুনা পারের মটরশুঁটি নিয়ে যাও’ - সবজি বিক্রেতাদের এই সগর্ব ঘোষণায় একদিন দিল্লির রাস্তা মুখরিত হত —১৯৮০ থেকে তা আর শোনা যায় না। ন্যারেটিভস্‌ অভ দ্য এন ভারনমেন্ট অভ দিল্লি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারল হেরিটেজ দ্বারা প্রাকাশিত) গ্রন্থে পুরোনো দিনের মানুষরা জানিয়েছেন যে দিল্লির তরমুজ স্বাদে ছিল লখনৌয়ের তরমুজের মতো। যমুনা নদীর বালিয়াড়িতে যে রসালো তরমুজ ফলত তা ওই জায়গার হাওয়া-বাতাসের উপরও নির্ভর করত। আগের তরমুজগুলি ওজনে ভারি আর সমান সমুজ রঙের (রসালো হওয়ার চিহ্ন) হত এবং ফলত বছরে একবার। চাষের ধরনে পরিবর্তন আসার সঙ্গেই এলো নতুন ধরনের বীজ। এখন তরমুজগুলি হয় ছোটো আর তার গায়ে থাকে ডোরা কাটা। নতুন বীজ ফলন বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু ফলগুলির আকার ছোটো করে দিয়েছে।

দুই দশক আগেও যে তাজা পানিফল ফেরিওয়ালারা বাড়ি-বাড়ি নিয়ে যেত, তা এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। এগুলি নাজাফগড় ঝিলের আশপাশে ফলত। ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনালের ওয়েবসাইটির মতে নাজাফগড় নালা ও দিল্লি গেট নালাতেই আছে যমুনার ৬৩ শতাংশ দূষণ। দিল্লির বহুমুখী কৃষক সমবায়ের সম্পাদক, ৮০ বছরের বলজিৎ সিং জানালেন, “পানিফল চাষ হয় ছোটো ছোটো জলা জমিতে। দিল্লিতে এই চাষ মানুষ বন্ধ করে দিয়েছেন কারণ এতে সঠিক পরিমাণ জল আর প্রচুর ধৈর্য দরকার।” রাজধানীতে এখন ধৈর্য এবং জল — দুয়েরই খুব অভাব।

কৃষকরা এখন দ্রুত ফলনশীল ফসল চাষ করতে চান বলে জানালেন বলজিৎ সিং। সুতরাং তাঁরা ঢ্যাঁড়স, মুলো, বিন, বেগুনের মতো ফসল চাষ করেন যা ২-৩ মাসে ফলন দেয় ও চাষ করা যায় বছরে ৩-৪ বার। “দুই দশক আগে নতুন ধরনের মুলোর বীজ সৃষ্টি করা হয়,” জানালেন বিজেন্দ্র। শঙ্কর বলছেন, “বিজ্ঞান অধিক ফলন সম্ভব করে তুলেছে, আগে আমরা একর প্রতি ৪০-৫০ কুইন্টাল মুলো পেতাম; এখন আমরা এর চতুর্গুণ পাই আর ফলাই বছরে তিনবার।”

Vijender’s one acre plot in Bela Estate (left), where he shows us the shrunken chillies and shrivelled brinjals (right) that will not bloom this season
PHOTO • Aikantik Bag
Vijender’s one acre plot in Bela Estate (left), where he shows us the shrunken chillies and shrivelled brinjals (right) that will not bloom this season
PHOTO • Aikantik Bag
Vijender’s one acre plot in Bela Estate (left), where he shows us the shrunken chillies and shrivelled brinjals (right) that will not bloom this season
PHOTO • Aikantik Bag

বেলা এস্টেট-এ বিজেন্দ্রর এক একর জমি তে (বাঁয়ে) তিনি আমাদের দেখালেন শুকিয়ে কুঁচকে যাওয়া লংকা আর বেগুন যা আর এবার আর পুষ্ট হবে না

ইতিমধ্যে দিল্লিতে, এমনকি প্লাবনভূমিতেও উন্নয়নের নামে কংক্রিটের নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ২০১৮-১৯ এর দিল্লির অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে ২০০০ থেকে ২০১৮-এর মধ্যে প্রতি বছর চাষের এলাকা ২ শতাংশ হারে কমেছে। বর্তমানে, শহরের ২.৫ শতাংশ মানুষ আর ২৫ শতাংশ ভৌগোলিক ক্ষেত্রকে গ্রামীণ ধরা যেতে পারে (এই হিসাব ১৯৯১ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশেরও কম)। দিল্লি উন্নয়ন নিগমের ২০২১ সালের মাস্টার প্ল্যানের লক্ষ্য সম্পূর্ণ নগরায়ন।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাব মতে - আইনি বেআইনি নির্মাণ কাজ সহ — দ্রুত নগরায়নের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে দিল্লি পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল শহর হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান ২০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দিল্লি ২০৩০-এর মধ্যে (বর্তমান জনসংখ্যা ৩৭ মিলিয়ন) টোকিও শহরকে অতিক্রম করে যাবে। নীতি আয়োগের মতে দিল্লি হবে ভারতের সেই ২১টি শহরের একটি যাদের ভূগর্ভস্ত জল ফুরিয়ে যাবে আগামী বছর।

“শহর কংক্রিটের জঙ্গল হওয়া মানে জমি সিমেন্ট বাঁধাই হয়ে যাবে, মাটি জল টানতে পারবে না, সবুজের পরিমাণ কমে যাবে... সিমেন্ট বাঁধাই জমি অধিক তাপ টানে এবং ছাড়ে।”

আবহাওয়া ও তাপমাত্রা বিষয়ক নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌-এর একটি ইন্টরঅ্যাক্টিভ টুল অনুসারে ১৯৬০ সালে, অর্থাৎ শঙ্করের বয়স যখন ছিল ১৬, তখন দিল্লিতে গড়ে ১৭৮ দিন তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকত। ২০১৯ সালে এমন উষ্ণ দিনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৫। এই শতাব্দীর শেষে দেশের রাজধানীতে বর্তমানে ছয় মাসের কিছু কম থেকে বেড়ে গিয়ে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আট মাস অবধি পৌঁছতে পারে। এতে মানুষের অবদান অনেকখানি।

Shiv Shankar and his son Praveen Kumar start the watering process on their field
PHOTO • Aikantik Bag
Shiv Shankar and his son Praveen Kumar start the watering process on their field
PHOTO • Shalini Singh

শিব শঙ্কর ও তাঁর পুত্র প্রবী ণ কুমার নিজেদের জমিতে জল দিতে শুরু করেছেন

দক্ষিণ-পশ্চিম দিল্লিতে অবস্থিত পালাম আর পূর্বে অবস্থিত প্লাবনভূমির মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলে মিশ্র জানালেন। “পালাম-এ যদি হয় ৪৫ ডিগ্রি তাহলে প্লাবনভূমিতে তাপমাত্রা হয় ৪০-৪১ ডিগ্রি।” “এই সুবৃহৎ নগরীতে প্লাবনভূমিটি আদতে এক আশীর্বাদ।”

*****

ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনালের মতে যখন যমুনার ৮০ শতাংশ দূষণই আসে দিল্লি থেকে তখন তা যদি দিল্লি ‘ছেড়ে যায়’ তাতে কী হবে — এই তিক্ততার মাঝে বিক্ষুব্ধদের স্বাভাবিক প্রশ্ন এটি। “দিল্লি টিকে আছে যমুনার কারণে, যমুনা দিল্লির উপর নির্ভরশীল নয়,” বললেন মিশ্র। দিল্লির ৬০ শতাংশের বেশি পানীয় জল আসে সেই স্থান থেকে যেখানে যমুনা উজানে পথ পরিবর্তন করে সমান্তরাল একটি খালে গিয়ে পড়ে। মৌসুমী বর্ষার দৌলতে নদীটি প্রাণ ফিরে পায়। প্রথম প্লাবন নদীকে দূষণমুক্ত করে, বন্যার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্পন্দনে শহরের ভূগর্ভস্থ জলের পুনঃপূরণ সম্ভব হয়। ৫-১০ বছর পর পর নদী এই যে পুনঃপূরণ করে তা আর কারও পক্ষেই করা সম্ভব নয়। ২০০৮, ২০১০, ও ২০১৩ সালে এখানে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির সঙ্গেই ভূগর্ভস্থ জলের পুনঃপূরণ ঘটে পরর্বতী পাঁচ বছরের জন্য। দিল্লির অধিকাংশ মানুষ এর গুরুত্ব বোঝে না।”

যথাযথ প্লাবনভূমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ — এর ফলে জল ছড়িয়ে পড়ার জায়গা পায়, ফলে তার গতিবেগ স্তিমিত হয়। এরপক্ষেই সম্ভব বন্যার অতিরিক্ত জল জমিয়ে রেখে ক্রমে তাকে ভূগর্ভে চলে যেতে সাহায্য করা। ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে শেষবার ভয়ানক বন্যা হয়েছিল — এই সময়ে যমুনার জল সরকারি বিপদসীমার ছয় ফুট উপর দিয়ে বয়েছিল, বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন লক্ষাধিক মানুষ, গৃহহারা হয়েছিলেন বহু মানুষ —তাছাড়াও বিপুল ক্ষতি হয়েছিল ফসল ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর। ২০১৩ সালে নদীর জল শেষবার বিপদসীমা অতিক্রম করেছিল। ‘যমুনা নদী প্রকল্প: নতুন দিল্লি নগর পরিবেশ কাঠামো’ (ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত)-এর মতে ক্রমাগত প্লাবনভূমির জবরদখল করার পরিণাম খুবই খুবই সাঙ্ঘাতিক হতে পারে। “১০০-বছরের মধ্যে যুগান্তকারী একটি বন্যার ঘটনা সমস্ত বাঁধ ভেঙে প্লাবনভূমির নিছু জায়গাগুলিতে নির্মিত সব কাঠামো সাফ করে পূর্ব দিল্লিকে ভাসিয়ে দেবে।”

Shiv Shankar explaining the changes in his farmland (right) he has witnessed over the years
PHOTO • Aikantik Bag
Shiv Shankar explaining the changes in his farmland (right) he has witnessed over the years
PHOTO • Aikantik Bag

নিজের জমিতে (ডান দিকে) বহু বছর ধরে ঘটে চলা পরিবর্তনগুলি শিব শঙ্কর বুঝিয়ে বলছেন

প্লাবনভূমিতে আর নির্মাণকাজের বিরুদ্ধে কৃষকরাও সাবধানবাণী উচ্চারণ করছেন। “এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে জলস্তরের উপর,” বললেন শিব শঙ্কর। “প্রতিটি বাড়ির জন্য এরা গাড়ি রাখার জায়গা বানাবে, শৌখিন গাছ লাগাবে। যদি পেয়ারা, বেদানা আম ইত্যাদি ফলের গাছ লাগাতো, তাহলে মানুষ খেতে পেত, কাজও পেত। পশু-পাখিরও আহার জুটতো।”

সরকারি তথ্য অনুসারে ১৯৯৩ থেকে ৩,১০০ কোটি টাকা যমুনা নদী পরিষ্কার করতে খরচ করা হয়েছে। “তাহলে যমুনা আজও পরিষ্কার হল না কেন,” উপহাস করলেন বলজিৎ সিং।

শহরের প্রতিটি ইঞ্চিতে নির্মাণ কাজ করা; যমুনা প্লাবনভুমির অপব্যবহার ও সেখানে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ; বিষাক্ত বর্জ্যে বিশাল নদীটি আটকে যাওয়া; জমি ব্যবহারের ধাঁচে পরিবর্তন, নতুন জাতের বীজ, নতুন কারিগরি এমন সব পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে যা এর ব্যবহারকারিদের দেখার সৌভাগ্য নাও হতে পারে; প্রাকৃতিক তাপস্থাপকতার বিনাশ; খামখেয়ালি বর্ষা ও অস্বাভাবিক বায়ু দূষণ। সব মিলিয়ে একটি মারণ যৌগ তৈরি হচ্ছে।

এই যৌগের কিছু উপাদান শঙ্কর ও তাঁর সহযোগীদের চেনা। “কতগুলি রাস্তা আর বানানো হবে?” তাঁর প্রশ্ন। যত কংক্রিট ঢালাই হবে মাটি ততই তাপ টানবে। প্রকৃতিজাত পাহাড়ও জমিকে বৃষ্টির জলে পুনরুজ্জীবিত হতে দেয়। কেবল মানুষ কংক্রিট দিয়ে যে পাহাড় বানিয়েছে তা মাটিকে প্রশ্বাস নিতে দেয় না, বর্ষার জল ধরে রেখে পুনরুজ্জীবিত হতে দেয় না। কেমন করে ফসল ফলাবেন যদি জলই না থাকে?”

পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] এই আইডিতে।

বাংলা অনুবাদ : চিলকা

Reporter : Shalini Singh

Shalini Singh is a founding trustee of the CounterMedia Trust that publishes PARI. A journalist based in Delhi, she writes on environment, gender and culture, and was a Nieman fellow for journalism at Harvard University, 2017-2018.

Other stories by Shalini Singh

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Series Editors : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka