সুনীল গুপ্ত বাড়ি বসে কাজ করতে পারেন না অথচ তাঁর ‘অফিস’ গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া, দীর্ঘ লকডাউনের কারণে বিগত ১৫ মাস যাবৎ নাগালের বাইরে।

“এটাই আমাদের অফিস। এখন আমরা যাব কোথায়,” দক্ষিণ মুম্বইয়ের এই সৌধ চত্বরের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি প্রশ্ন করলেন।

লকডাউনের আগে অবধি সুনীল এই জনপ্রিয় পর্যটনস্থলে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা অবধি অপেক্ষা করতেন। পর্যটকরা চেকপয়েন্ট ছাড়িয়ে সৌধের দিকে অগ্রসর হওয়া মাত্র তিনি এবং অন্যান্য আলোকচিত্রীরা নিজেদের অ্যালবাম নিয়ে তাঁদের স্বাগত জানিয়ে অনুরোধ করতেন, “এক মিনিটে গোটা পরিবারের ছবি” অথবা “মাত্র ৩০ টাকায় একটা ছবি তুলিয়ে যান।”

এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে কোভিড-১৯ অতিমারির নতুন ধাক্কার পর মুম্বইয়ে নতুন বিধিনিষেধ বলবৎ হওয়ার ফলে এখন তাঁদের হাতে কাজ নেই বললেই চলে। “সকাল বেলায় এখানে এসে দেখি নাকের ডগায় ‘প্রবেশ নিষেধ ঝুলছে,” এপ্রিলের মাঝামাঝি, ৩৯ বছর বয়সী সুনীল আমাকে বলেছিলেন। “এমনিতেই আমাদের রোজগার করতে প্রাণান্তকর অবস্থা তার উপর এখন তো আয় পুরোপুরি শূন্য। এই লোকসান সামলানোর ক্ষমতা আমার নেই।”

Sunil Gupta: 'We were already struggling and now we are going into negative [income]. I don’t have the capacity to bear any further losses'
PHOTO • Aakanksha
Sunil Gupta: 'We were already struggling and now we are going into negative [income]. I don’t have the capacity to bear any further losses'
PHOTO • Aakanksha

সুনীল গুপ্ত: ‘এমনিতেই আমাদের রোজগার করতে প্রাণান্তকর অবস্থা, তার উপর এখন তো আয় পুরোপুরি শূন্য। এই লোকসান সামলানোর ক্ষমতা আমার নেই’

যখন কাজ ছিল তখন সুনীল ও অন্যান্য আলোকচিত্রীরা কাজে আসতেন কাজের নির্দিষ্ট পোশাকে - দস্তুরমতো ইস্ত্রি করা সাদা জামা, কালো প্যান্ট আর কালো জুতো পরে। প্রত্যেকের গলায় ঝুলত একটা ক্যামেরা আর পিঠে থাকত একটা ব্যাগ। কারো কারো ব্যাগের সঙ্গেই ঝুলত রংবেরঙের রোদ চশমা কারণ অনেক পর্যটক কায়দার রোদচশমা পরে ছবি তুলতে পছন্দ করেন। সৌধের সামনে হাসি-মুখ পর্যটকদের ছবিওয়ালা অ্যালবাম থাকে তাঁদের হাতে।

“এখন দেখবেন পর্যটকের চেয়ে সংখ্যায় আমরাই (আলোকচিত্রী) বেশি।” মার্চ ২০২০ সালের প্রথম লকডাউনের আগে, তাঁদের অনুমান, গেটওয়ে এলাকায় ৩০০ জন আলোকচিত্রী কাজ করতেন। সংখ্যাটা কমতে কমতে এখন ১০০ হয়েছে, অনেকেই চলে গেছেন অন্য কাজের খোঁজে আর বাকিরা ফিরে গেছেন নিজেদের শহর অথবা গ্রামে।

গত বছর অগস্ট মাসে সুনীল আবার কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর কথায়, “নিদেন পক্ষে একজন খদ্দেরের অপেক্ষায় রাত দিন এমনকি বর্ষা মাথায় করে অপেক্ষা করে থাকতাম। (নভেম্বর মাসে) দিওয়ালির সময় আমার বাচ্চাদের জন্য এক বাক্স মিষ্টি অবধি কেনার পয়সা ছিল না আমার।” অবশ্য তিনি এ কথাও বললেন যে উৎসবের দিনেই তাঁর ‘ভাগ্য খুলে গেল’ আর তিনি শেষমেষ ১৩০ টাকা আয় করেন ওইদিনই। সেইসময় কিছু কিছু মানুষজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে আলোকচিত্রীদের অর্থসাহায্য করেছেন, আবার কখনও কখনও নানান প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রেশন দেওয়া হয়েছে।

২০০৮ সালে কাজ করতে শুরু করার পর থেকে সুনীলের আয় এমনিতেই ক্রমাগত কমছিল ক্যামেরা লাগানো স্মার্টফোন আর সেলফির চল হওয়ার কারণে — দিনে ৪০০-১,০০০ টাকা (অথবা প্রধান প্রধান উৎসবের সময়ে জনা দশেকের মধ্যে কাজ করে ১,৫০০ টাকা) থেকে মোটামুটি দিনের আয় ২০০-৪০০ টাকায় নেমে এসেছিল।

It's become harder and harder to convince potential customers, though some agree to be clicked and want to pose – and the photographer earns Rs. 30 per print
PHOTO • Aakanksha
It's become harder and harder to convince potential customers, though some agree to be clicked and want to pose – and the photographer earns Rs. 30 per print
PHOTO • Aakanksha

যদিও কেউ কেউ রাজি হয়ে যান কায়দা করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তবু আজকাল খদ্দেরকে ছবি তুলতে রাজি করানোটাই কঠিন হয়ে গেছে — ছবি পিছু আলোকচিত্রীদের আয় থাকে ৩০ টাকা

“বউনিটুকুও না হওয়া আমাদের আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই আমাদের ব্যবসায় মন্দা চলছে। কিন্তু এটা (উপার্জন-শূন্য দিন) এখনকার মতো এতো ঘন ঘন হত না,” বললেন সুনীল, তিনি থাকেন দক্ষিণ মুম্বইয়ের কফে পারেড নামের একটি বস্তি অঞ্চলে, স্ত্রী সিন্ধু ও তিন বাচ্চাকে নিয়ে — সিন্ধু মূলত গৃহস্থালির দেখভাল করলেও কখনো কখনো সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে খানিক আয় করেন।

উত্তরপ্রদেশের ফরসারা খুর্দ গ্রাম থেকে ১৯৯১ সালে নিজের মামার সঙ্গে সুনীল এই শহরে আসেন। পরিবারটি অন্যান্য অনগ্রসর জাতিভুক্ত (ওবিসি) কাণ্ডু সম্প্রদায়ের। মউ জেলার ওই গ্রামে তাঁর বাবা হলুদ, গরম মশলা ইত্যাদি বিক্রি করতেন। “আমি আর আমার মামা গেটওয়েতে ঠেলা গাড়ি লাগিয়ে ভেলপুরি বা পপকর্ন, আইসক্রিম, লেবু জল যা হোক কিছু বিক্রি করতাম। আমরা কয়েকজন ফটোগ্রাফারকে কাজ করতে দেখতাম, সেই থেকেই আমার আগ্রহ হল এই কাজে,” সুনীল জানালেন।

তারপর বেশ কিছুদিন ধরে টাকা জমিয়ে, পরিবার পরিজনের কাছে ধার করে সুনীল নিকটস্থ বোরা বাজার থেকে দ্বিতীয়বার হাত বদল হওয়া একটি একেবারে সাধারণ এসএলআর ক্যামেরা আর প্রিন্টার কেনেন ২০০৮ সালে। (২০১৯-এ তিনি আবার ধার করেই একটু দামি, নিকন ডি৭২০০ মডেলের ক্যামেরা কেনেন; সেই ধার তিনি এখনও শোধ করে চলেছেন)।

এই প্রিন্টার সঙ্গে নিয়ে ঘোরা যায় বলে খদ্দেরকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি ছাপিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে, আর এতে ব্যবসায় রমরমা হবে এই আশায় সুনীল প্রথম ক্যামেরাটি কিনেছিলেন। কিন্তু ততদিনে স্মার্ট ফোন হাতে হাতে ঘুরতে শুরু করল আর সুনীলের তোলা ছবির চাহিদাও জোর ধাক্কা খেলো। বিগত একদশকে কোন নতুন আলোকচিত্রী আর এই কাজে আসেননি, তিনি শেষ ব্যাচের ফটোগ্রাফারদের একজন।

'Now no one looks at us, it’s as if we don’t exist', says Gangaram Choudhary. Left: Sheltering from the harsh sun, along with a fellow photographer, under a monument plaque during a long work day some months ago – while visitors at the Gateway click photos on their smartphones
PHOTO • Aakanksha
'Now no one looks at us, it’s as if we don’t exist', says Gangaram Choudhary. Left: Sheltering from the harsh sun, along with a fellow photographer, under a monument plaque during a long work day some months ago – while visitors at the Gateway click photos on their smartphones
PHOTO • Aakanksha

‘আমাদের দিকে কেউ তাকায়ও না, যেন আমাদের কোনও অস্তিত্বই নেই,’ বললেন গঙ্গারাম চৌধুরি। বাঁদিকে: রোদের তাপ থেকে বাঁচতে সৌধের একটি ফলকের নিচে আরেক আলোকচিত্রীর সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি আর পর্যটকরা তখন গেটওয়ের কাছে নিজের নিজের স্মার্টফোনে ছবি তুলতে ব্যস্ত

স্মার্টফোনের সমগে পাল্লা দিতে এখন পোর্টেবল প্রিন্টার ছাড়াও আলোকচিত্রীরা সঙ্গে রাখেন ইউএসবি যন্ত্র যাতে ছবি তুলে তা তৎক্ষণাৎ গ্রাহকের ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া যায় — এই পরিষেবা বাবদ তাঁরা ১৫ টাকা করে নেন। কেউ কেউ ৩০ টাকার ছবি আর ফোনে পাঠানো ছবি দুটোই চায়।

সুনীল কাজ শুরু করার আগে, পূর্ববর্তী প্রজন্মের আলোকচিত্রীরা পোলারয়েড ব্যবহার করতেন। কিন্তু এই ছবি ছাপানো ব্যয়বহুল ও সংরক্ষণ কঠিন বলে তিনি জানালেন। যখন পয়েন্ট অ্যান্ড শ্যুট পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হল, তখন ছবি তাঁরা গ্রাহককে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিতেন।

কয়েক দশক আগে স্বল্প সময়ের জন্য যে আলোকচিত্রীরা গেটওয়েতে পোলারয়েড ব্যবহার করেছিলেন তাঁদেরই একজন গঙ্গারাম চৌধুরি। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন তিনি, “একটা সময় ছিল যখন মানুষ আমাদের কাছে এসে ছবি তুলে দিতে বলতেন। এখন আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না, যেন আমাদের কোনও অস্তিত্বই নেই।”

বিহারের মধুবনী জেলার দুমরি গ্রাম থেকে মুম্বই এসে যখন গঙ্গারাম কাজ করতে শুরু করেন তখন তিনি কিশোর। অন্যান্য অনগ্রসর জাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত কেওয়াত সম্প্রদায়ের মানুষ তিনি। তিনি কলকাতায় আসেন প্রথমে, তাঁর বাবা সেখানে রিকশা চালাতেন। এক রাঁধুনীর সহায়ক হিসাবে তিনি ৫০ টাকা মাস মাইনেতে কাজ করতেন। এক বছরের মধ্যে তাঁর নিয়োগকর্তা তাঁকে মুম্বইয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন কাজে।

Tools of the trade: The photographers lug around 6-7 kilos – camera, printer, albums, packets of paper; some hang colourful sunglasses on their shirts to attract tourists who like to get their photos clicked wearing stylish shades
PHOTO • Aakanksha
Tools of the trade: The photographers lug around 6-7 kilos – camera, printer, albums, packets of paper; some hang colourful sunglasses on their shirts to attract tourists who like to get their photos clicked wearing stylish shades
PHOTO • Aakanksha

ব্যবসার সাজসরঞ্জাম: আলোকচিত্রীরা ক্যামেরা, ছবি ছাপার প্রিন্টার মেশিন, অ্যালবাম, কাগজের গোছা মিলিয়ে ৬-৭ কিলো ওজন ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়ান; যে সব পর্যটক কায়দা করে রঙিন চশমা পরে ছবি তুলতে চান তাঁদের আকর্ষণ করার জন্য কেউ কেউ আবার নিজের জামার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন রংবেরঙের রোদ চশমা

এর কিছুদিন পর গঙ্গারামের দেখা হয়ে যায় তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে, তিনি গেটওয়ে এলাকায় ছবি তুলতেন। “ভাবলাম আমিও একটু চেষ্টা করে দেখি এই কাজ পারি কিনা,” বললেন ৫০ পেরোনো গঙ্গারাম। তাঁর মনে আছে, তখন (১৯৮০-এর দশকে) ওই সৌধের চারদিকে মাত্র ১০-১৫ জন আলোকচিত্রী ছিলেন। কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী, সামান্য অর্থের বিনিময় নিজেদের অতিরিক্ত পোলারয়েড বা পয়েন্ট অ্যান্ড শ্যুট ছবি তোলার ক্যামেরা ধার দিতেন নবাগতদের। গঙ্গারাম অ্যালবাম ধরা, খদ্দের ডেকে আনা ইত্যাদি কাজ করতেন। কিছুদিন পর তাঁকে ক্যামেরা দেওয়া হল। তখন গ্রাহকদের কাছ থেকে যে ২০ টাকা নেওয়া হত তার থেকে ২ কি ৩ টাকা তিনি রাখতেন। তিনি আর কয়েকজনের সঙ্গে রাতে কোলাবার ফুটপাথে ঘুমাতেন আর সারা দিন ছবি তোলার জন্য খদ্দের খুঁজে বেড়াতেন।

“ওই বয়সে নানা জায়গা ঘুরে হাতে কাঁচা টাকা পাওয়ার এক আলাদা উত্তেজনা থাকে,” হাসি মুখে বললেন গঙ্গারাম। “প্রথম দিকে আমার তোলা ছবি খুব ভালো হত না, কিন্তু কাজ করতে করতেই শেখা হয়ে যায়।”

ফিল্মের প্রতিটি রোল ছিল মহার্য্য — ৩৬টা ছবির একটা রীলের দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা। বার বার তো আর ছবি তুলে যাও‍য়া যায় না। তাই প্রতিটি ছবি খুব সাবধানে ভাবনা চিন্তা করে তুলতে হত — এখনকার মতো যতো খুশি (ডিজিটাল) ছবি তোলা যেত না,” বললেন গঙ্গারাম। তাঁর মনে পড়ে, ফ্ল্যাশ আলো না থাকলে তাঁরা সন্ধে হয়ে গেলে আর ছবি তুলতে পারতেন না।

ওই অঞ্চলের ছোটোছোটো দোকান বা স্টুডিও থেকে ছবি ছাপিয়ে আনতে আনতে একদিন লেগে যেত — একটা রীল ধুতে ১৫ টাকা আর ৪*৫ ইঞ্চি একটা রঙিন ছবি ছাপাতে লাগতো ১.৫০ টাকা।

To try and compete with smartphones, some photographers carry a USB devise to transfer the photos from their camera to the customer’s phone
PHOTO • Aakanksha
To try and compete with smartphones, some photographers carry a USB devise to transfer the photos from their camera to the customer’s phone
PHOTO • Aakanksha

স্মার্টফোনের সঙ্গে পাল্লা দিতে আলোকচিত্রীদের কেউ কেউ এখন নিজেদের সঙ্গে রাখেন ইউএসবি যন্ত্র যাতে ছবি তুলে সরাসরি খদ্দেরের ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া যায়

“কিন্তু এখন আমাদের এই সব বয়ে বেড়াতে হয় টিকে থাকার তাগিদে,” গঙ্গারামও একই কথা বললেন। আলোকচিত্রীরা ক্যামেরা, ছবি ছাপার যন্ত্র, অ্যালবাম, কাগজের গোছা (এক প্যাকেটের দাম ১১০ টাকা আর তার উপর আছে ছাপার কালির দাম) মিলিয়ে ৬-৭ কিলো ওজন ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়ান। “খদ্দেরকে ছবি তুলতে রাজি করানোর জন্য আমরা সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি।” গৃহকর্ত্রী স্ত্রী কুসুম আর তিন বাচ্চার পরিবার নিয়ে নরিমান পয়েন্টের বস্তি এলাকার বাসিন্দা গঙ্গারাম আরও বলছিলেন, “আমার পিঠে খুব ব্যথা করে।”

গঙ্গারাম যখন প্রথম কাজ করতে শুরু করেন তখন বাইরে থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকরা মুম্বই দর্শন ট্যুরের সময়ে এখান থেকে আলোকচিত্রীদের সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র যেতেন ছবি তোলাতে। পরে এই আলোকচিত্রীরা সেইসব ছবি ক্যুরিয়ার করে খদ্দেরদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। ছবিগুলো আবছা উঠে থাকলে টাকা ফেরত তো দিতেনই, সেই সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা চিরকুট খামে ভরে পাঠাতেন।

“সবটাই ছিল আস্থার উপর নির্ভর। সে ছিল সত্যিই সুসময়। কত শত রাজ্য থেকে মানুষ আসতেন, তুলে দেওয়া ছবিটি ছিল তাঁদের কাছে অমূল্য। স্মৃতিচিহ্ন বাবদ তাঁরা ছবিগুলো বাড়ি নিয়ে গিয়ে পরিবারের সবাইকে দেখাতেন। আমাদের তথা আমাদের ছবি তোলার দক্ষতার উপর তাঁদের আস্থা ছিল। ‘আমাদের বৈশিষ্ট্য ছিল এমন কায়দায় ছবি তুলবো যে মনে হবে আপনি গেটওয়ে বা তাজ হোটেলের চূড়োটি নিজের হাতে স্পর্শ করেছেন’ বলছিলেন গঙ্গারাম।

অবশ্য এমন ভালো সময়েও যে সমস্যা ছিল না তা নয়। তাঁর মনে পড়ে, কোনও গ্রাহক চটে গিয়ে অভিযোগ জানালে বা গেটওয়েতে ফিরে এসে তাঁদের ঠকানো হয়েছে বা তাঁরা ছবি পাননি বললে আলোকচিত্রীদের ডাক পড়ত কোলাবা থানায়। গঙ্গারাম জানালেন, “তারপর থেকে ক্রমে আমরা স্থানীয় ডাকঘর থেকে ছাপ মারিয়ে একটা খাতা প্রমাণ হিসাবে নিয়ে ঘুরতে শুরু করলাম।”

আবার এমনও হতো যে ছবির প্রিন্ট নেওয়ার মতো টাকা নেই কোনও গ্রাহকের কাছে। সেক্ষেত্রে আলোকচিত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে ডাক মারফৎ টাকা পাওয়ার অপেক্ষা করতেন।

'Our speciality was clicking photos in such a way that in the image it looks like you are touching [the top of] Gateway or the Taj Hotel'
PHOTO • Aakanksha
'Our speciality was clicking photos in such a way that in the image it looks like you are touching [the top of] Gateway or the Taj Hotel'
PHOTO • Sunil Gupta

‘আমাদের বৈশিষ্ট্য ছিল যে এমন কায়দায় ছবি তুলবো যে মনে হবে আপনি গেটওয়ে বা তাজ হোটেলের চূড়োটি নিজের হাতে স্পর্শ করেছেন’

গঙ্গারামের মনে আছে, ২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর জঙ্গি হানার পর কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল কিন্তু ক্রমে আবার চাহিদা বাড়তেও শুরু করে। “মানুষ কেবল (গেটওয়ের বিপরীতে) তাজ হোটেল ও আর ওবেরয় হোটেলের (জঙ্গি আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি স্থান) পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে আসত। ইমারতগুলোও কতই না গল্প বলে,” তিনি বললেন।

গেটওয়ে থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে, নরিমন পয়েন্টে ওবেরয় হোটেলের সামনে ফুটপাথে ছবি তোলেন বৈজনাথ চৌধুরি — জঙ্গি হানার প্রেক্ষিতে কয়েক বছর ধরে মানুষের ছবি তোলার একই অভিজ্ঞতা তাঁরও আছে। এখন বয়স প্রায় ৫৭, বৈজনাথ ছবি তুলছেন চার দশক ধরে, যদিও তাঁর বহু বন্ধুই অন্যান্য পেশা খুঁজে নিয়েছেন।

১৫ বছর বয়সে বিহারের মধুবনী জেলার দুমরি গ্রাম থেকে ১৫ বছর বয়সে বৈজনাথ তাঁর কাকার সঙ্গে মুম্বই এসে কোলাবার ফুটপাথে দূরবিন বিক্রি করতে শুরু করেন — পেশায় খেতমজুর মা-বাবা থেকে যান গ্রামেই।

গঙ্গারামের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, বৈজনাথও কাজ শুরু করেছিলেন পোলারয়েড ক্যামেরায় তারপর ক্রমে হাতে তুলে নেন পয়েন্ট অ্যান্ড শ্যুট ক্যামেরা। তিনি এবং আরও কয়েকজন আলোকচিত্রী তাজ হোটেলের কাছে একজন দোকানদারের কাছে নিজেদের ক্যামেরা গচ্ছিত রেখে নিজেরা রাতে ফুটপাথেই ঘুমাতেন।

Baijnath Choudhary, who works at Narmian Point and Marine Drive, says: 'Today I see anyone and everyone doing photography. But I have sharpened my skills over years standing here every single day clicking photos'
PHOTO • Aakanksha
Baijnath Choudhary, who works at Narmian Point and Marine Drive, says: 'Today I see anyone and everyone doing photography. But I have sharpened my skills over years standing here every single day clicking photos'
PHOTO • Aakanksha

নরিমন পয়েন্ট ও মেরিন ড্রাইভে কর্মরত বৈজনাথ চৌধুরি বললেন, ‘এখন তো দেখি যে কেউ ছবি তোলে। কিন্তু আমি এখানে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে ছবি তুলে হাত পাকিয়েছি’

দিনে ৬-৮ জন গ্রাহক পেলে বৈজনাথ শুরুর দিকে আয় করতেন ১০০-২০০ টাকা। ক্রমে তা বেড়ে হয় ৩০০-৯০০ টাকা, কিন্তু স্মার্টফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে তা নেমে দিনে ১০০-৩০০ টাকায় দাঁড়ায়। আর লকডাউন হওয়ার পর দিনে ১০০ টাকা, কখনও ৩০ টাকা, আবার কোনও দিন একেবারেই আয়-শূন্য অবস্থা দাঁড়ায় বলে তিনি জানালেন।

২০০৯ অবধি তিনি উত্তর মুম্বইয়ের সান্টাক্রুজ অঞ্চলের পানশালাগুলিতেও ছবি তুলতেন, ছবি পিছু ৫০ টাকার বিনিময়ে। “সকাল ৯টা থেকে ১০টা আমি এখানে (নরিমান পয়েন্ট) দৌড়ে বেড়াতাম। আর রাতে খাওয়ার পর যেতাম ক্লাবে,” বলছিলেন বৈজনাথ, যাঁর ৩১ বছর বয়সী বড়ো ছেলে বিজয়ও গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় ছবি তোলেন।

বৈজনাথ সহ অন্যান্য আলোকচিত্রীরা জানালেন যে কাজ করতে কোনও অনুমতিপত্র লাগে না কিন্তু ২০১৪ থেকে মুম্বই পোর্ট ট্রাস্ট এবং মুম্বই পর্যটন উন্নয়ন নিগম তাঁদের পরিচয়পত্র দিয়েছে। তাঁদের নির্দিষ্ট পোশাক বিধি মেনে চলতে হয় এবং সৌধটির কাছে বেওয়ারিশ কোনও ব্যাগ পড়ে থাকলে সে বিষয়ে সাবধান হতে হয় আর মহিলাদের হেনস্থা হতে দেখলে তা রিপোর্ট করতে হয় (এই প্রতিবেদক বিষয়টি যাচাই করতে পারেননি)।

এর আগে পুলিশ অথবা পৌর নিগম তাঁদের কাজে বাধা দিত, জরিমানা করত। নিজেদের সমস্যার মোকাবিলা করতে বৈজনাথ ও গঙ্গারামের মনে আছে যে সমস্ত আলোকচিত্রীরা মিলে একটি কল্যাণ সমিতি স্থাপন করেছিলেন ১৯৯০ সালে। “আমরা আমাদের কাজের স্বীকৃতি চেয়ে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলাম,” বললেন বৈজনাথ। তাঁর মনে আছে যে ২০০১ সালে তাঁরা আজাদ ময়দানে তাঁদের কাজে অন্যায়ভাবে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদ করে দীর্ঘতর সময় কাজের করার অনুমতি দাবি করেন। ২০০০ সালে তাঁরা গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া আলোকচিত্রী সঙ্ঘ গড়ে তুলে স্থানীয় বিধায়কের সঙ্গে নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সাক্ষাৎ করেন। এইসব কথা জানালেন বৈজনাথ। এই সব প্রয়াসের ফলে পুলিশ ও পৌর নিগমের হাত থেকে খানিক রেহাই পেয়ে তাঁরা নিজেদের কাজের পরিসর বাড়াতে সক্ষম হন।

A few photographers have started working again from mid-June – they are still not allowed inside the monument complex, and stand outside soliciting customers
PHOTO • Aakanksha
A few photographers have started working again from mid-June – they are still not allowed inside the monument complex, and stand outside soliciting customers
PHOTO • Aakanksha

কয়েকজন আলোকচিত্রী জুনের মাঝামাঝি থেকে আবার কাজ করতে শুরু করেছেন - সৌধ এলাকার ভিতর যাওয়ার অনুমতি তাঁরা এখনও পাননি, বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁরা খদ্দের ধরার চেষ্টা চালিয়ে যান

আগে তাঁদের কাজের কদর ছিল — সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে বৈজনাথের মন উদাস হয়। তাঁর কথায়, “এখন তো দেখি যে কেউ ছবি তোলে। আমি এখানে দাঁড়িয়ে লাগাতার ছবি তুলে হাত পাকিয়েছি। আমরা একবারে ছবি তুলি আর তোমরা ছোটোরা একটা ঠিকঠাক ছবি তুলতে না জানি কতবার ক্লিক করো, তারপরেও আবার তাকে আরও নিখুঁত করার (সম্পাদনা করে) ব্যাপার আছে।” একদল মানুষকে হেঁটে যেতে দেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিনি এইসব বলছিলেন। পথচারীদের রাজি করাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁদের কোনও আগ্রহই নেই। একজন আবার নিজের পকেট থেকে ফোন বার করে সেলফি তুলতে শুরু করে দিলেন।

এদিকে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় সুনীল ও আর কয়েকজন নিজেদের ‘দপ্তরে’ যেতে শুরু করেছেন জুনের মাঝামাঝি থেকে — সৌধ এলাকার ভিতর এখনও তাঁদের যেতে দেওয়া হয় না, ফলে তাজ হোটেল চত্বরে দাঁড়িয়ে তাঁরা খদ্দের ধরার চেষ্টা চালিয়ে যান। সুনীল বলছিলেন, “বৃষ্টিতে আমাদের অবস্থা দেখার মতো হয়। ক্যামেরা, প্রিন্টার, কাগজ — সব বাঁচাতে হয়। এসব ছাড়া আমরা আবার একটা ছাতাও রাখি। যাবতীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে নিজেদের সামলে একেবারে নিখুঁত ছবি তুলতে হয়।”

স্মার্টফোনে সেলফির ধাক্কা আর লকডাউনের মাঝে ‘এক মিনিটে গোটা পরিবারের ছবি’ তোলাতে চায় এমন মানুষের সংখ্যা এখন এতটাই কম যে নিজেদের রোজগার সামাল দেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

সুনীলের ব্যাগে তাঁর সন্তানদের ইস্কুলের মাইনের বিলবই থাকে (কোলাবার একটা বেসরকারি বিদ্যালয়ে তারা পড়ে)। “আমি ইস্কুলে বলেই চলেছি আমাকে মাইনে জমা দেওয়ার জন্য একটু বাড়তি সময় দিতে,” তিনি বললেন। সুনীল গতবছর একটা ছোটো ফোন কিনেছেন যাতে তাঁর বাচ্চারা স্মার্টফোনে অনলাইন পড়াশুনা করতে পারে। তাঁর কথায়, “আমাদের জীবন তো পার হয়ে গেল। অন্তত ওদের যেন আমার মতো রোদে পুড়তে না হয়। ওরা যেন একটা এসি লাগানো অফিসে চাকরি করে। আমি এই আশাতেই প্রতিদিন থাকি যে কোনও মানুষের স্মৃতি ধরে দেওয়ার বিনিময়ে আমার বাচ্চাদের জীবনটা একটু সুন্দর করে তুলতে পারব।”

অনুবাদ: চিলকা

Aakanksha

Aakanksha is a reporter and photographer with the People’s Archive of Rural India. A Content Editor with the Education Team, she trains students in rural areas to document things around them.

Other stories by Aakanksha
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka