এপ্রিল মাসের হিমেল রাত। ঘড়িতে দুটো বাজে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের পুণে জেলার শিরুর তালুকের সাভিন্দানে গ্রামের মন্দিরের উল্টো দিকের খোলা মাঠে তখন রঙবেরঙের আলোয় জনাকয় মহিলা বলিউডের গানের তালে উত্তাল নেচে চলেছেন। কিন্তু লল্লন পাসোয়ান ও তাঁর সঙ্গীদের সেদিকে মন দেওয়ার সময় নেই। লাউডস্পিকার ও নাচে মাতোয়ারা উল্লসিত পুরুষদের হট্টগোল থেকে দূরে তাঁরা নিরিবিলিতে খানিক জিরিয়ে নেওয়ার জায়গা খুঁজছেন। কয়েকজন আবার সময় কাটানোর জন্য ফোনে সিনেমা দেখছেন।

“এই কাজে প্রচুর খাটনি। সারারাত জেগে কাজ করতে হয়, তবুও মালিকদের দাবি আমরা সারাক্ষণই যেন কাজ করে যাই,” লল্লন পাসোয়ান জানালেন। ( উপরে কভারচিত্র দ্রষ্টব্য ) লল্লনের বয়স এখন ১৯। ১৩ বছর বয়স থেকে ‘মঙ্গলা বানসোডে অ্যান্ড নীতিন কুমার তামাশা মণ্ডল’ নামের দলটিতে প্রায় ৩০ জন শ্রমিকদের একটি দলের সঙ্গে লল্লন কাজ করেন। দলের প্রায় সকলেই উত্তরপ্রদেশের লখনউ জেলার মাল ব্লকের মাহিলাবাদ তেহসিলের দলিত পরিবারের সদস্য। শ্রমিকদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। পারিবারিক অথবা সমাজিক সূত্রে দলের সকলেই পরস্পরের আত্মীয়।

তামাশার ভ্রাম্যমাণ দলটি এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাজ করে, আর প্রত্যেক শোয়ের জন্য মঞ্চ ও তাঁবু দাঁড় করানোর কাজ করেন এই শ্রমিকদলের সদস্যরা। লোকশিল্পের এই ঘরানাটি মহারাষ্ট্রে খুবই জনপ্রিয়। তামাশা পরিবেশিত হয় খোলা মঞ্চে। সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস জুড়ে তামাশা পরিবেশনের মরসুম চলাকালীন, বছরের আট মাস প্রতিদিন আলাদা আলাদা গ্রামে তামাশার আসর বসে, ফলে এই শ্রমিকদের অন্তত ২১০ বার তামাশার মঞ্চ তৈরি করতে হয়। মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম তামাশায় থাকে গান, নাচ, হাস্যকৌতুক ও একটি লম্বা নাটক। শিল্পীদের পাশাপাশি তামাশার সঙ্গে সম্পর্কিত বিবিধ কাজের শ্রমিক, গাড়িচালক, তারের কাজের কলাকুশলী, ম্যানেজার ও পাচকও দলের সঙ্গেই স্থান থেকে স্থানান্তরে যাত্রা করেন।

A part of the tamasha stage being erected on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade
The tamasha stage being erected on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade

এই বছরের প্রথমদিকে পশ্চিম মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার কারাভাদি গ্রামে শ্রমিকরা তামাশার তাঁবু ও মঞ্চের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত

নিজের গ্রাম আমাউয়ের এক বন্ধুর মাধ্যমে লল্লন এই কাজে ঢুকেছেন। এর আগে, লখনউ শহরে তিনি মিস্ত্রির কাজ করতেন। অবশ্য, সে কাজ নিয়মিত ছিল না, উপরন্তু আয়ও ছিল কম। ক্লাস ৫ অবধি পড়াশোনা করেছেন লল্লন, বর্তমানে তিনি গ্রামের এই দলের ‘ম্যানেজার’ হিসাবে মাসে ১০,০০০ টাকা রোজগার করেন। কাজের প্রয়োজনে অনেক সময় দলে নতুন সদস্য নিয়ে আসেন। লল্লনের কথায়, “গ্রামে গিয়ে যদি দেখি কোনও কমবয়সী ছেলে কাজ বা পড়াশোনা না করে অযথা সময় নষ্ট করছে, তাহলে তাকে আমাদের দলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য নিয়ে চলে আসি। একসঙ্গে কাজ করে নিয়মিত রোজগার করার সুযোগ বলেই একে আমরা মনে করি।”

তামাশা দলের মালিকরাও উত্তরপ্রদেশের শ্রমিক নিয়োগ করতে পছন্দ করেন। দলের ম্যানেজার, অনিল বানসোডে বললেন, “ওরা খুবই পরিশ্রমী আর কাজ ফেলে পালিয়েও যায় না।” পুণে ভিত্তিক চিত্রসাংবাদিক ও তামাশা বিষয়ে গবেষণারত সন্দেশ ভাণ্ডারে জানালেন যে, দলের মালিকদের এই পছন্দের আরেকটা সম্ভাব্য কারণ এটাও যে উত্তরপ্রদেশের শ্রমিকরা তুলনামুলকভাবে কম পারিশ্রমিকে কাজটা করেন।

লল্লন ও তাঁর সহকর্মীদের বক্তব্য, অন্যান্য কাজের তুলনায় মঞ্চ তৈরির কাজটা সবচেয়ে কঠিন। মঞ্চের সব জিনিসপত্র নিয়ে ট্রাক গ্রামে পৌঁছলে পরে শ্রমিকরা একে একে কাঠের পাত, লোহার কাঠামো, লাইট এবং সাউন্ডের যাবতীয় সরঞ্জাম নামিয়ে আনেন। লোহার কাঠামোগুলো পর পর সাজিয়ে কাঠের পাতগুলো এর উপর বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মঞ্চের ছাঁদ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের জন্য ফ্রেম দাঁড় করানো হয়। গান বাজনার সব সরঞ্জামসহ ১৫-২০ জন লোক একসঙ্গে দাঁড়াতে পারবে, এইটা মাথায় রেখে শক্তপোক্তভাবে মঞ্চ তৈরি করতে হয়। অনেক সময়ে, তামাশা চলাকালীন ঘোড়া অথবা মোটরবাইকও মঞ্চে তোলা হয়, সেসব ক্ষেত্রে যাতে বাড়তি ওজন বইতে পারে, সেটার দিকে নজর রেখে মঞ্চটিকে আরও বেশি মজবুত করা হয়।

Top left-Labourers from Aumau village, Lucknow district, UP carry planks for the tamasha stage on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra. 

Top right-Lallan Paswan from Aumau village, Lucknow district, UP playfully carries one of his friends while working on tents, on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra. 

Bottom left- Aravind Kumar carries speakers on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra. 

Bottom right- Shreeram Paswan, a labourer from Aumau village, Lucknow district, UP, during stage building time on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade

উপরে বাঁদিকে: লখনউ জেলার আমাউ গ্রাম থেকে আগত শ্রমিকরা কারাভাদি গ্রামে মঞ্চ তৈরি করবেন বলে কাঠের পাত নিয়ে চলেছেন। উপরে ডানদিকে: দলের ‘ম্যানেজার’ লল্লন খেলার ছলে এক সঙ্গীকে চাগিয়ে তুলে ধরেছেন। নিচে বাঁদিকে: অরবিন্দ কুমার বিকেলের শোয়ের জন্য চোঙা নিয়ে যাচ্ছেন। নিচে ডানদিকে: কারাভাদি গ্রামে মঞ্চ তৈরিতে ব্যস্ত শ্রীরাম পাসোয়ান

তাঁবু তৈরির দায়িত্বে থাকা আটজনের দলের নেতা, লল্লন বললেন, “মালিকদের দাবি যে তামাশা শেষ না হওয়া অবধি আমাদের দলের সবাই যেন জেগে থাকে। অবশ্য, মালিক আমাদের কাজে দখল দেন না বা কাজ যাচাইও করেন না, শুধু তাঁর প্রয়োজনগুলো আমাদের জানিয়ে দেন।” লল্লনের সগর্ব সংযোজন, “এই কাজের দ্বায়িত্ব পুরোপুরি আমাদের, আর আমরা তা মন দিয়ে করি।”

অনুষ্ঠানে উপস্থিত জনতার থেকে মঞ্চের দূরত্ব বজায় রাখার জন্য লোহার ব্যারিকেড বসানো হয়। এই কাজ করার জন্য দলের চার জন লোকের প্রয়োজন। যে সব অনুষ্ঠানে টিকিট বিক্রি করা হয়, সেগুলোতে আরো ১০-১২ জনের প্রয়োজন হয় কারণ মঞ্চের চারপাশে একটা বড়ো তাঁবু ও সেইটা অবধি যাওয়ার রাস্তাও তৈরি করা হয়। একজন থাকেন জেনারাটরের দ্বায়িত্বে, মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ অঞ্চলের অনিশ্চিত বিদ্যুৎ পরিষেবার কারণে এই কাজটা অত্যন্ত আবশ্যক।

শ্রমিকরা তামাশা দলের নিরাপত্তার দায়ভারও সামলান। ২০ বছরের সন্তরাম রাওয়াত অন্যদের মতোই আমাউ গ্রাম থেকে এসেছেন, জেনারেটরের দায়িত্ব তাঁর। অনুষ্ঠান চলাকালীন দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে উঠলে ভিড় সামাল দেওয়ার কাজে সন্তরামও হাত লাগান। গত পাঁচ বছর ধরে শোয়ের মরসুমে এই দলের সঙ্গে কর্মরত সন্তরামের কথায়, “লোকে যখন রাহুটির [মহিলাদের তাঁবু] মধ্যে ঢোকার বা তাঁবু ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে তখন তাঁদেরকে সংযত হতে অনুরোধ করি আমরা। ওদের বোঝাতে হয় এইসব না করতে। আর মাতাল লোকে উপদ্রব করলে আমরা তাদের দুই-তিন ঘা মেরে ভাগিয়ে দিই।”

Santram Rawat teaches Aravind Kumar about sound equipment on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra. Both are from Aumau village, Lucknow district, UP
PHOTO • Shatakshi Gawade

সন্তরাম রাওয়াত (বাঁদিকে) অরবিন্দ কুমারকে সাউন্ডের যন্ত্রপাতি দেখাচ্ছেন; দুজনেই উত্তরপ্রদেশের আমাউ গ্রাম থেকে এসেছেন

বিশ্রামের নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই। তামাশার অনুষ্ঠান রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আরম্ভ হয় আর চলে ভোর ৩টে অবধি। কখনও আবার ভোর ৫টাও বেজে যায়। শো শেষ হলেই তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়তে হয়। মঞ্চ, তাঁবুসহ সব সরঞ্জাম খুলে ফলে গুছিয়ে নিতে হয়। সর্বসাধারণের জন্য যে সব অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় (গ্রামের বায়না করা অনুষ্ঠান নয়) তাতে টিকিট বিক্রি হয়। সেক্ষেত্রে টিকিট ঘরটাও খুলে গুছিয়ে নিতে হয়। সব জিনিসপত্র ট্রাকে তুলে দেওয়ার পরে, শ্রমিকরাও তাতে উঠে পড়েন। চাপাচাপির মধ্যে যে যেভাবে পারেন একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ট্রাকের সঙ্গে বাসে করে সব শিল্পীরাও পরবর্তী গন্তব্য যে গ্রাম, সেখানে চলে যান। দুপুর নাগাদ গ্রামে পৌঁছে আবার তাঁবু খাটানোর পালা, যাতে শিল্পীরা তাঁবুগুলোতে বিশ্রাম ও তামাশার পোশাক পাল্টে নিতে পারেন। এই সব কাজ শেষ করার পরে শ্রমিকরা চান করে খেয়েদেয়ে অবশেষে ঘুমোতে পারেন। বিকেল ৪টে নাগাদ আবার মঞ্চ তৈরির কাজ আরম্ভ করেন।

সর্বক্ষণ চরকিবাজি করতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয়। সন্তরাম বলছিলেন, “ছেলেরা [শ্রমিকেরা] কেউ এই খাবার পছন্দ করে না। আমরা বাড়িতে গমের আটার রুটি আর ভাত খাই। এখানে ভাখরি [জোয়ার অথবা বাজরার রুটি] খেতে হয়।” লল্লনের সংযোজন, “তার উপর সবকিছুতেই চিনেবাদাম আর নারকেল দেয়। ওসব আমরা আমাদের রান্নায় মোটেই ব্যবহার করি না। কিন্তু এসব নিয়ে খুঁতখুঁত করে লাভ নেই, এটাই খেতে হবে কিনা।”

খাওয়ার সময়ের কোনও ঠিকঠিকানা নেই। “একদিন সকাল ১০টায় খাই তো আবার অন্যদিন বিকেল ৩টের আগে খাবার মেলে না। মরসুমের শেষে শরীরের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে যায়,” বললেন লল্লন। লল্লনের ভাই, ১৮ বছরের সর্বেশের কথায়, “সময়ে খাবার পেলে খেয়ে নিই। নইলে খালি পেটেই সব ওজনদার জিনিসপত্র টানাটানি করতে হয়।”

এতসব সমস্যা সত্ত্বেও, নিয়মিত আয়ের তাগিদেই সবাই তামাশার দলে কাজ করতে পছন্দ করেন। ৮ মাস ধরে দলের সঙ্গে থেকে মাসিক ৯-১০ হাজার টাকা রোজগার করা যায়। আনকোরা নতুন লোকরা অবশ্য মাসে ৫০০০ টাকার বেশি পান না।

Sarvesh Paswan from Aumau village, Lucknow district, UP works on the stage on 4 May 2018 in Karavadi village, Satara district, in western Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade

প্রায় ২৪ ঘণ্টার কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদলের সঙ্গে সর্বেশ পাসোয়ান কারাভাদি গ্রামে মঞ্চ তৈরি করে ও খুলতে সাহায্য করছেন

পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি নেই – এই কথা শুনে শুনে ক্লান্ত সর্বেশ একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন স্কুল ছেড়ে দেন। তাঁর বক্তব্য, “আমি ভাবলাম অন্যের কাছে হাত না পেতে বরঞ্চ নিজেই রোজগারের ব্যবস্থা করি।” তাঁদের বাবাও তামাশা দলে শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত আছেন, আর সবচেয়ে ছোটো ভাই এখানে জোগাড়ের কাজ করে। নিজেদের খরচার পর, ৮ মাসের শেষে পুরো পরিবার মিলে প্রায় ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবে। এই বছরের উপার্জন লল্লনের বিয়ে ও বাড়ি মেরামতির কাজে লাগানো হবে।

দৈনিক খরচা বাবদ শ্রমিকরা রোজ ৫০ টাকা পান। মাইনে থেকে এই টাকা কেটে নেওয়া হয়। এই টাকার বেশিটাই চলে যায় (দলের দেওয়া দুবেলার খাবারের পরেও) বাড়তি খাবার কিনতে। কয়েকজন এই টাকা দিয়ে তামাক বা মদও কিনে থাকেন। “আমি মদ খাই না, তবে দলে ৫-৬ জন আছে যারা খায়,” জানালেন লল্লন। তাঁর বাবাও মদের নেশা করেন। অনেকে আবার গাঁজার নেশাও করে। “আমরা খাবার-দাবার খুঁজে বের করার আগে এরা গাঁজা আর মদ খুঁজে বের করে ফেলতে পারে,” সহাস্য টিপ্পনী সর্বেশের।

তামাশা দলে যোগ দেওয়ার আরেকটা কারণ হল নতুন নতুন জায়গা দেখার মজা। “প্রত্যেকদিন আমরা আলাদা আলাদা জায়গায় যাই বলে নতুন একটা গ্রাম ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। একই জায়গায় বসে থাকলে কাজটা একঘেয়ে হয়ে যেত,” বললেন লল্লন।

Top left-Labourer Shreeram Paswan watches the tamasha on 11 May 2017 in Gogolwadi village in Pune district in Maharashtra. He is a part of the group of 30 men from Aumau village, Lucknow district, UP. 

Top right-Wireman Suraj Kumar watches the tamasha on 11 May 2017 in Gogolwadi village in Pune district in Maharashtra. 

Bottom left- Some labourers like Anil Pawra (extreme left) also double up as backup singers and dancers in the tamasha. Photo shot on 15 May 2017 in Savlaj village, Sangli district in Maharashtra. 

Bottom right- Labourers hold on to the plank that for a dancer’s performance during the tamasha on 3 May 2018 in Savindne village in Pune district, in western Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade

উপরে বাঁদিকে: পুণে জেলার গোগলওয়াড়ি গ্রামে তামাশা দেখছেন আমাউ গ্রাম থেকে আসা শ্রীরাম পাসোয়ান। উপরে ডানদিকে: তারের মিস্ত্রি সুরজকুমার গোগলওয়াড়ির শো দেখছেন। নিচে বাঁদিকে: অনিল পাওরার (বাঁদিকে শেষে) মতো কয়েকজন শ্রমিক, নেপথ্যে থেকে তামাশার গান ও নাচেও যোগ দেন (এই ছবিটি সাঙ্গলি জেলার সভলাজ গ্রামে তোলা)। নিচে ডানদিকে: ২০১৮ সালের মে মাসের এই ছবিতে পুণে জেলার সাভিন্দানে গ্রামের অনুষ্ঠানে কয়েকজন শ্রমিক এক নর্তককের ভার সামলাতে একটা কাঠের পাটাতন ধরে রয়েছেন

তামাশায় কর্মরত বহু শ্রমিকই নিজেদের পরিবারের থেকে এই কাজের কথা লুকিয়ে রাখেন। “গ্রামের লোকেদের বলেছি যে আমরা অর্কেষ্ট্রা অথবা ডিজে কোম্পানিতে কাজ করি, তার মধ্যে নাচও হয়। তামাশার কাজ ওখানকার মানুষে ভালো চোখে দেখবে না,” বললেন লল্লন। উত্তরপ্রদেশের গ্রামেও তামাশার মতো নৌটঙ্কি আঙ্গিকটি প্রচলিত আছে, কিন্তু সেইসব নাচিয়েদের সুনজরে দেখা হয় না। এই কারণেই তাঁরা নৌটঙ্কির দলগুলোর সঙ্গে কাজ করেন না। “এইখানকার মানুষজন আমাদের এই কাজটিকে সম্মান করে, উত্তরপ্রদেশে পরিস্থিতি অন্যরকম,” তাঁর সংযোজন।

মে মাসে তামাশার মরসুম শেষ হলে, শ্রমিকরা আমের মরসুমের কাজের জন্য আমাউতে ফিরে যান। ঐ অঞ্চলের আম সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয়, সর্বেশ সগর্বে জানান। সন্তরাম বললেন যে ওখানকার আমবাগানে সাত ধরনের আমের ফলন হয়।

এই সময়ে ওঁরা বিশ্রামও পান। “এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পরে আমরা বিশ্রাম করি। গ্রামে দু মাস থাকার পরেই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠি। মন ভরে আম খাই, খুব একটা কাজ থাকে না। সারাদিন খাই, ঘুমোই, ঘুরে বেড়াই – এইটাই কাজ,” জানালেন লল্লন।

দলের অন্যদের মতো, লল্লন ও সর্বেশের পরিবারের হাতেও খানিকটা জমি রয়েছে। জমিতে তাঁরা নিজেদের খোরাকির জন্য গম চাষ করেন, এছাড়া বাজারে বিক্রির জন্য আমের ফলনও হয়। লল্লন জানাচ্ছেন, “প্রায় তামাশার মাঠের সমান জমি রয়েছে আমাদের।” তাঁদের কাকা চাষের কাজ দেখেন, আর তার থেকে যা উপার্জন হয়, তার একাংশ তাঁদের বাবা পান – এর থেকে বছরে প্রায় ৬০-৭০০০০ হাজার টাকা আয় হয়। সর্বেশ ও লল্লন দিনের কয়েক ঘণ্টা আম পাড়া ও সেগুলিকে বাজারে পাঠানোর কাজ করে আবার বিশ্রাম করতে থাকেন।

The generator that powers the tamasha lights and sound. Photo shot on 15 May 2017 in Savlaj village, Sangli district in Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade
Labourers take rest while the tamasha is performed on 11 May 2017 in Gogolwadi village in Pune district in Maharashtra
PHOTO • Shatakshi Gawade

তামাশার সময় লাইট ও সাউন্ডের সরঞ্জামগুলি চালানোর জন্য যে জেনারেটর ব্যবহার করা হয়, সেটারও দেখভাল করেন এই শ্রমিকরা; এটাই দেখা যাচ্ছে সাঙ্গলি জেলার সভলাজ গ্রামের ছবিতে

“এই জমি থেকে সারা বছরের আয়ের জোগাড় করা সম্ভব হলেও গ্রামে থাকলে রোজ আমাদের অনেকটা খরচাও হয়ে যায়। এখানে একসঙ্গে থোক টাকা হাতে আসে, তাই খুচরো খরচ খুব একটা হয় না। এই টাকা দিয়ে আমরা বাড়ি বানানো, বিয়ে শাদির মতো বড়ো কাজগুলো করতে পারি যেমন…” লল্লন বলছিলেন।

গ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝেই লখনউয়ে দিনমজুরি, গ্রামে চাষের কাজ অথবা মনরেগার কাজের মতো আলগা কয়েকটা কাজ নিয়ে নেন। এইসব কাজ করে দিনে ২০০ টাকা মতো হাতে আসে। তবে রোজ কাজের জোগাড় থাকে না। “অনেক দিনই সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা অবধিও কাজ না পেয়ে এমনিই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়…” হেসে বলে ওঠেন তিনি।

লল্লন অবশ্য ঠিক করেছেন পরের বছর বিয়ে করে আর তামাশার দলে ফেরত আসবেন না। “গ্রামেই কিছু একটা কাজ খুঁজে নেব…আমি সবই পারি। জামাকাপড়ও সেলাই করতে পারি,” জানালেন তিনি। তাঁর বিএ ডিগ্রিধারী হবু বউ সেলাইয়ের কাজও করেন।

সন্তরামও এবার বাড়ি ফিরে গিয়ে বিয়ে করবেন। তিনি বললেন, “আমি গ্রামেই থেকে যাব। আমার একটা মুদিখানার দোকান খোলার ইচ্ছে। আমি এখানে চলে আসলে মা আর বউয়ের দেখাশোনা কে করবে? এতদিন বাড়িতে বউ ছিল না বলেই আমি এখানে আসতাম।”

সর্বেশও আর তামাশায় না ফিরে মুম্বই অথবা চণ্ডীগড়ের মতো কোনও বড়ো শহরে চলে যেতে চান। “শুধু থাকা খাওয়ার ঠিকঠাক ব্যবস্থা হলেই আমার চলে যাবে। বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে যে কোনও জায়গায় গিয়ে কাজ করতে আমরা রাজি…”

অনুবাদ: রুণা ভট্টাচার্য

Shatakshi Gawade

Shatakshi Gawade is an independent journalist based in Pune. She writes about the environment, rights and culture.

Other stories by Shatakshi Gawade
Translator : Runa Bhattacharjee

Runa Bhattacharjee is a translation and technology professional who has been associated with initiatives for representation of languages on digital platforms. She likes to contribute some of her spare time to translate content into Bangla.

Other stories by Runa Bhattacharjee