নিজের খেতে ঢুকে হাঁটার গতি কমালেন নামদেও তরালে। বছর ৪৮-এর কৃষক একটু ঝুঁকে পরীক্ষা করছেন মুগ শস্যের একটা অংশ, দেখে মনে হচ্ছে কিছুতে মাড়িয়ে গেছে, খেয়েছেও কিছুটা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক হিম হিম কিন্তু মনোরম সকাল আজ; আকাশে সূর্যের আলো নরম হয়ে পড়েছে।

“হা এক প্রকারচা দুষ্কালাচ আহে [এ এক নতুন কিসিমের খরা],” কাষ্ঠস্বরে বললেন তিনি।

তরালের হতাশা আর দুশ্চিন্তার সারাংশটি এই কথায় ধরা পড়ে। পাঁচ একর জমির মালিক এই কৃষকের এখন সবচেয়ে বড়ো ভয় হল তিনমাসের হাড়ভাঙা খাটুনির পর মুগ আর অড়হর ডালের ফলন্ত শস্য তোলার আগেই না তছনছ হয়ে যায়। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাষের কাজে থেকে অনেক রকম খরা দেখেছেন তিনি — একটা আবহাওয়াভিত্তিক, যখন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়; ভৌমজলভিত্তিক, যখন মাটির নিচে জলের স্তর আশঙ্কাজনক মাত্রায় নেমে যায়; অথবা কৃষিভিত্তিক, যখন মাটিতে আর্দ্রতার অভাবজনিত কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়।

যেই না আপনি ভাববেন বাঃ এবার তো বেশ ভালো ফলন হয়েছে, অমনি এই মূর্তিমান সর্বনাশা আতঙ্ক চারপায়ে গুঁড়ি মেরে কিংবা ডানায় ভর করে হানা দেবে খেতে, আর একটু একটু করে শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকবে হাড়ভাঙা খাটনির ধন, বলে চললেন দৃশ্যতই বিক্ষুব্ধ তরালে।

“দিনের বেলায় ডাহুক, বাঁদর, আর খরগোশ; রাতের বেলা হরিণ, নীলগাই, সম্বর, শুয়োর, বাঘ,” পরপর সব জ্বলজ্যান্ত আপদের নাম বলে গেলেন তিনি।

“আমহালে পেরতা ইয়েতে সাহেব, বচাভতা ইয়েত নাহি [আমরা বীজ রুইতে পারি, ফসল রক্ষা করতে পারি না],” হতাশ গলায় বলেন তিনি। তুলো বা সয়াবিনের মতো অর্থকরী শস্যের পাশাপাশি মুগ, ভুট্টা, জোয়ার, অড়হর ইত্যাদি চাষ করেন তিনি।

Namdeo Tarale of Dhamani village in Chandrapur district likens the wild animal menace to a new kind of drought, one that arrives on four legs and flattens his crop
PHOTO • Jaideep Hardikar
Namdeo Tarale of Dhamani village in Chandrapur district likens the wild animal menace to a new kind of drought, one that arrives on four legs and flattens his crop
PHOTO • Jaideep Hardikar

চন্দ্রপুর জেলার ধামনি গ্রামের বাসিন্দা নামদেও তরালে বন্যপশুর আক্রমণকে এক নতুন রকমের খরা বলে বর্ণনা করেছেন, যা চারপায়ে আসে আর তাঁর খেত কে খেত শস্য ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে যায়

Farmer Gopal Bonde in Chaprala village says, ''When I go to bed at night, I worry I may not see my crop the next morning.'
PHOTO • Jaideep Hardikar
Bonde inspecting his farm which is ready for winter sowing
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: চাপরালা গ্রামের কৃষক গোপাল বোন্ডে বলছেন, ‘রাতে শুতে যাওয়ার সময় ভয় করে, পরদিন সকালে আর ফসল দেখতে পাব কিনা।’ ডানদিকে: শীতকালীন বপনের জন্য প্রস্তুত খেত পরিদর্শন করছেন বোন্ডে

মহারাষ্ট্রের অরণ্য এবং আকরিক-ঋদ্ধ চন্দ্রপুর জেলার ধামনি গ্রামে তরালে একাই বিক্ষুব্ধ কৃষক নন। এই জেলা তথা মহারাষ্ট্রের আরও একাধিক এলাকা জুড়ে তাড়োবা আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতরে এবং আশপাশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গ্রামের কৃষকদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে এই একই চোরা হতাশার বোধ।

চাপরালা (জনগণনা ২০১১ অনুসারে চিপরালা) গ্রামে তরালের খামার থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ৪০ বছরের গোপাল বোন্ডে একইরকম বিপর্যস্ত। সময়টা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, আর তাঁর ১০ একর জমি — যার অর্ধেকই মুগ— তা জুড়ে যে নীরব ধ্বংসলীলা চলেছে তা খালি চোখেই স্পষ্ট দেখা যায়। জায়গায় জায়গায় ফসল মুড়িয়ে সমান হয়ে গেছে, কেউ যেন চরম আক্রোশে তাদের পিষে দিয়ে, ফসল উপড়ে, সমস্ত দানা গিলে, সারা মাঠ তছনছ করে দিয়ে চলে গেছে।

“রাতে যখন শুতে যাই ভয় করে, দুশ্চিন্তা হয় হয়তো পরদিন সকালে আর ফসল দেখতে পাব না,” জানুয়ারি ২০২৩-এ এসে বলছেন বোন্ডে, আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপের প্রায় এক বছর পর। তাই রাতে অন্তত বার দুয়েক বাইকে চেপে পুরো খামার টহল দেন তিনি, সে শীতই হোক বা বর্ষা। দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের অভাব এবং ঠান্ডার কারণে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। খামারের ফসল সব তোলা হয়ে গেলে টহলদারি থামাতে পারেন তিনি, যেমন গ্রীষ্মকালটা। কিন্তু বছরের বাকি সময়ে এই রোজ রাতের টহলদারি চালিয়েই যেতে হয় তাঁকে, বিশেষ করে ফসল তোলার সময়টায়, এক শীতের সকালে বাড়ির সামনের উঠোনে চেয়ার পেতে বসে জানালেন তিনি।

বন্য পশুরা জমি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে সারাটা বছর ধরেই: শীত আর বর্ষায় যখন মাঠ সবুজে ভরা থাকে, তখন তারা সদ্যফোটা চারাগাছ মুড়িয়ে খায়। গরমকালে খেতের সবকিছু তছনছ করে খাবার খোঁজে, জলের জায়গাগুলিও রেহাই পায় না।

অতএব, বোন্ডেকে বন্যপ্রাণীদের সামলাতে হবে “রাতের বেলায় যখন তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়”, আর যদি সে প্রাণী কোনওমতে ফসল নষ্ট করে দিয়ে যায় তবে সহ্য করতে হবে “দৈনিক কয়েক হাজার টাকা”র আর্থিক ক্ষতি। চুপিচুপি আসা শিকারি বন্যপশু মেরে খেয়ে যায় গবাদি পশুদেরও। এক দশকে কমপক্ষে দুই ডজন গরু তিনি খুইয়েছেন বাঘ-চিতাবাঘের হানায়। জানাচ্ছেন, প্রতিবছর তাঁর গ্রামে বাঘের হানায় প্রাণ হারায় গড়ে ২০টি করে গবাদি পশু। হানাদারিতে আহত বা নিহত হয়েছেন বহু গ্রামবাসীও।

The thickly forested road along the northern fringes of the Tadoba Andhari Tiger Reseve has plenty of wild boars that are a menace for farmers in the area
PHOTO • Jaideep Hardikar
PHOTO • Jaideep Hardikar

তাড়োবা আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্পর ঘন জঙ্গলাকীর্ণ উত্তর সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে বুনো শুয়োরের বাস, যারা স্থানীয় চাষিদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক

মহারাষ্ট্রর বৃহত্তম আর সবচেয়ে পুরনো অভয়ারণ্যগুলির মধ্যে অন্যতম তাড়োবা-আন্ধেরি; তাড়োবা জাতীয় উদ্যান এবং আন্ধেরি জাতীয় উদ্যানকে একসঙ্গে জুড়ে চন্দ্রপুর জেলার তিনটি তেহসিল নিয়ে প্রায় ১,৭২৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত। বন্যপ্রাণ-মানুষ সংঘর্ষের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই এলাকা। জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ অধিকরণ (ন্যাশনাল টাইগার কনসার্ভেশান অথরিটি) বা NTCA-এর ২০২ ২ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালে পরিলক্ষিত আনুমানিক ১,৩৩টি বাঘের তুলনায় তাড়োবা-আন্ধেরি যার অংশ সেই মধ্য ভারতীয় পার্বত্যভূমি অঞ্চলে “বাঘের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই এবং ১,১৬১ খানা নতুন বাঘের ছবি ধরা পড়েছে।”

রাজ্য জুড়ে যে ৩১৫টিরও বেশি বাঘ আছে, তার মধ্যে শুধু তাড়োবাতেই আছে ৮২টি , বলছে NTCA-এর ২০১৮ রিপোর্ট।

এখান থেকে বিদর্ভ পর্যন্ত পরপর গ্রামে তরালে বা বোন্ডের মতো চাষিরা, যাঁদের চাষ ছাড়া জীবনধারণের আর কোনও উপায় নেই, বন্য পশুদের তাড়াতে নানা অদ্ভূত উপায় অবলম্বন করে থাকেন। তাঁরা বেড়া লাগান, কখনও-সখনও সৌর ব্যাটারি লাগানো বেড়া যাতে শক দেয়; খামার আর জঙ্গলের সীমান্তবেড়া ঢেকে রাখেন সস্তা রঙিন নাইলনের শাড়ি দিয়ে; বাজি ফাটান; কুকুরের পাল লাগান পাহারা দিতে; আর কখনও হালফ্যাশানের চিনা যন্ত্রে জোরে বাজান অন্য জন্তু-জানোয়ারের শব্দ।

কিছুতেই কিছু হয় না।

ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প এবং পর্যটনকেন্দ্র তাড়োবা-আন্ধেরির শুষ্ক, পর্ণমোচী অরণ্যভূমির বাফার এলাকার খুব কাছেই অবস্থিত বোন্ডের চাপরালা এবং তরালের ধামনি গ্রাম। সংরক্ষিত অরণ্যের কোর এলাকার উপকণ্ঠে হওয়ায় এইসব এলাকাগুলিতে প্রায়শই বন্যপ্রাণীর হানায় জেরবার হন স্থানীয় চাষিরা। বাফার এলাকায় সাধারণত মানুষের বসতি থাকে এবং তা অরণ্যের সংরক্ষিত কোর বা কেন্দ্র এলাকাকে ঘিরে থাকে; কোর এলাকায় মানুষের আসাযাওয়া নিষিদ্ধ এবং তা রাজ্যের বনদপ্তরের আওতাভুক্ত।

In Dhamani village, fields where jowar and green gram crops were devoured by wild animals.
PHOTO • Jaideep Hardikar
Here in Kholdoda village,  small farmer Vithoba Kannaka has used sarees to mark his boundary with the forest
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: ধামনি গ্রামের খেত থেকে জোয়ার আর মুগের শস্য খেয়ে গেছে বন্যপ্রাণীর দল। ডানদিকে: খোলদোদা গ্রামের ছোট চাষি বিঠোবা কন্নকা শাড়ি লাগিয়ে অরণ্যের সঙ্গে নিজের খেতের সীমানা বানিয়েছেন

Mahadev Umre, 37, is standing next to a battery-powered alarm which emits human and animal sounds to frighten raiding wild animals.
PHOTO • Jaideep Hardikar
Dami is a trained dog and can fight wild boars
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: ৩৭ বছর বয়সি মহাদেব উমরে দাঁড়িয়ে আছেন একটি ব্যাটারিচালিত অ্যালার্মের পাশে, যা বন্যজন্তুদের ভয় দেখাতে মানুষ এবং পশুর গলার স্বর নকল করে। ডানদিকে: দামি প্রশিক্ষিত কুকুর, বুনো শুয়োরদের সঙ্গে লড়তে পারে

চন্দ্রপুর-সহ ১১টি জেলা-সম্বলিত পূর্ব মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে এই সমস্যাটা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাঘ এবং অন্য বন্যজন্তুতে ভরপুর ভারতের শেষ কিছু সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে বেশ কয়েকটির ঠিকানা এই বিদর্ভ অঞ্চল। গ্রামেগঞ্জে চূড়ান্ত ঋণসমস্যা এবং কৃষক আত্মহত্যার অতিরেকের জন্যও কুখ্যাত এই অঞ্চল।

মহারাষ্ট্রের বনমন্ত্রী সুধীর মুঙ্গন্তিওয়ারের একটি বয়ান অনুযায়ী শুধু ২০২২ সালেই চন্দ্রপুর জেলায় বাঘ ও চিতাবাঘের হাতে ৫৩ জনের মৃত্যু নথিভুক্ত হয়েছে। গত দুই দশকে রাজ্যে বন্যপশু হানার বলি হয়েছেন প্রায় ২,০০০ জন — অধিকাংশই তাড়োবা-আন্ধেরি এলাকার বাসিন্দা। এই আক্রমণ মূলত আসে বাঘ, কালো ভালুক, বুনো শুয়োর এবং অন্যান্য প্রাণীদের থেকে। এখানে প্রায় ১৫-২০টি ‘সমস্যাজনক বাঘ’ বা মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া বাঘকে হত্যা করা হয়েছে; এর থেকেই প্রমাণিত হয় চন্দ্রপুরে বাঘ-মানুষ সংঘর্ষের সমস্যা কতটা ভয়াবহ। পশুর হানায় আহত মানুষের কোনও যথাযথ পরিসংখ্যান প্রদানের ব্যবস্থাও পর্যন্ত নেই।

আর শুধু পুরুষরাই তো পশুদের মোকাবিলা করেন না, সংঘর্ষের মুখে পড়তে হয় মেয়েদেরও।

“ভয়ে ভয়ে কাজ করি”, জানাচ্ছেন নাগপুর জেলার বেল্লারপার গ্রামের বছর পঞ্চাশের আদিবাসী কৃষক অর্চনাবাই গায়কোয়াড়। নিজের খেতে বহুবার বাঘ দেখেছেন তিনি। “যদি বুঝতে পারি বাঘ বা চিতাবাঘ ঘুরছে, সাধারণত আমরা খেত ছেড়ে চলে যাই,” বলছেন তিনি।

*****

“ওরা [বন্যপশু] তো আমরা খেতে প্লাস্টিক লাগালে সেই প্লাস্টিকটাই খেয়ে যাবে!”

গোন্ডিয়া, বুলঢানা, ভান্ডারা, নাগপুর, ওয়ার্ধা, ওয়াশিম এবং ইয়াবতমাল জেলাগুলিতে চাষিদের সঙ্গে সামান্য আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টাই বদলে যায় উত্তেজিত কথোপকথনে। বুনো জন্তুরা আজকাল সবুজ তুলোর গুটি পর্যন্ত খেয়ে চলে যাচ্ছে, হাহাকার করেন তাঁরা।

Madhukar Dhotare, Gulab Randhayee, and Prakash Gaikwad (seated from left to right) are small and marginal farmers from the Mana tribe in Bellarpar village of Nagpur district. This is how they must spend their nights to keep vigil against wild boars, monkeys, and other animals.
PHOTO • Jaideep Hardikar
Vasudev Narayan Bhogekar, 50, of Chandrapur district is reeling under crop losses caused by wild animals
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: নাগপুর জেলার বেল্লারপার গ্রামের মানা জনগোষ্ঠীভুক্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি মধুকর ধোতারে, গুলাব রণধায়ী, এবং প্রকাশ গায়কোয়াড় (বাঁদিক থেকে ডানদিকে বসে আছেন)। বুনো শুয়োর, বাঁদর, আর অন্যান্য জীবজন্তুর হাত থেকে ফসল বাঁচাতে এইভাবেই রাত কাটান তাঁরা। ডানদিকে: বন্যজন্তুর কারণে ফসলের লোকসানে হাবুডুবু খাচ্ছেন চন্দ্রপুর জেলার ৫০ বছর বয়সি বাসুদেব নারায়ণ ভোগেকর

“ফসল তোলার সময় রাতদিন আমরা শুধু খেতে বসে থাকি ফসল আগলে, সে যতই আমাদের প্রাণের ঝুঁকি থাক,” জানাচ্ছেন নাগপুর জেলায় তাড়োবা-আন্ধেরি সীমান্তবর্তী বেল্লারপুর গ্রামের মানা জনগোষ্ঠীভুক্ত চাষি ৫০ বছর বয়সি প্রকাশ গায়কোয়াড়।

“শরীর খারাপ হলেও আমাদের খেতেই থাকতে হবে, ফসল আগলে বসে, নইলে তোলার জন্য ফসলই থাকবে না,” বলছেন গোপাল বোন্ডের গ্রাম চাপরালার আর এক বাসিন্দা ৭৭ বছরের দাত্তুজি তাজান। “একটা সময় ছিল যখন আমি আমার খেতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম; সে দিন আর নেই; এখন সব বুনো জন্তুতে ভরে গেছে।”

গত এক দশকে তরালে আর বোন্ডে দেখেছেন কেমনভাবে গ্রামে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, কাটা হয়েছে খাল, কুয়ো খোঁড়া হয়েছে, বসেছে নলকূপ। চিরাচরিত তুলো আর সয়াবিনের পাশাপাশিই সারা বছর ধরে নানা ধরনের দুই বা তিনটি শস্য চাষ করার উপায় পেয়েছেন তাঁরা।

কিন্তু এর উল্টোদিকও আছে: পাকা ফসলে ভরা ঘন সবুজ খেত মানেই হরিণ, নীলগাই আর সম্বরের মতো তৃণভোজীদের অফুরান খাদ্যের জোগান। আর তৃণভোজীরা যখন আসে, পিছন পিছন আসে শিকারি মাংসভোজীরাও।

তরালে স্মৃতিচারণ করেন, “একদিন, মনে আছে, একদিকে বাঁদরে উৎপাত করছে, অন্যদিকে বুনো শুয়োর ঢুকে পড়েছে; মনে হচ্ছিল ওরা যেন আমার পরীক্ষা নিচ্ছে — আমায় নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে।”

২০২২ সেপ্টেম্বরের এক মেঘলা দিনে হাতে একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে বোন্ডে আমাদের নিয়ে চললেন তাঁর খেত ঘোরাতে, যেখানে এখন সয়াবিন, তুলো এবং অন্যান্য ফসলে চারা ধরছে। তাঁর বাড়ি থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে খামার, ১৫ মিনিটের রাস্তা। খেতের সীমান্তে বয়ে যাচ্ছে এক সরু নালা, ওপারে নিবিড় নিস্তব্ধ অরণ্য।

Gopal Bonde’s farms bear tell-tale pug marks of wild animals that have wandered in – rabbits, wild boar and deer
PHOTO • Jaideep Hardikar
Gopal Bonde’s farms bear tell-tale pug marks of wild animals that have wandered in – rabbits, wild boar and deer
PHOTO • Jaideep Hardikar

খরগোশ, বুনো শুয়োর, হরিণ, এমন নানা বন্যজন্তুর পায়ের ছাপে ভরা গোপাল বোন্ডের খেত

খেতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি আমাদের দেখালেন প্রায় ভেজা কালো মাটির উপর খরগোশ-সহ অন্তত এক ডজন বন্যজন্তুর পায়ের ছাপ। তারা সেখানে মলত্যাগ করেছে, ফসল খেয়েছে, সয়াবিনের গাছ ছিঁড়েছে আর সবুজ চারা গাছ উপড়ে ফেলেছে।

“আটা কা করতা, সাঙ্গা? [এবার বলুন দেখি, কী করব?],” দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বোন্ডে।

*****

কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোজেক্ট টাইগার প্রকল্পের কারণে তাড়োবার অরণ্যে বাঘ সংরক্ষণের উপর যথেষ্ট নজর দেওয়া হলেও তাতে এলাকায় আকছার নতুন হাইওয়ে, সেচের খাল, এবং নতুন খনি তৈরি হওয়া আটকায়নি। এগুলি থাবা বসিয়েছে অরণ্যের এলাকাতেও, বাস্তুহারা হয়েছেন বহু মানুষ, নষ্ট হয়েছে অরণ্যের জীববৈচিত্র।

আগে বাঘের এলাকা ছিল এমন সব অঞ্চলেও থাবা বসাচ্ছে খনি। গত দুই দশকে চন্দ্রপুর জেলার ৩০টিরও বেশি সক্রিয় সরকারি ও বেসরকারি খনির মধ্যে অন্তত দুই ডজন খোঁড়া হয়েছে এই এলাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রান্তগুলিতে।

“কয়লাখনিতে আর চন্দ্রপুর সুপার থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের ভিতরে বাঘ দেখা গেছে। মানুষ-বাঘ সংঘর্ষের ধারায় নতুন কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে এই এলাকাগুলি। আমরা ওদের বাসভূমি দখল করেছি,” বলছেন পরিবেশ ও সংরক্ষণকর্মী বান্দু ধোত্রে। বাঘের অনুমানিক সংখ্যা বিষয়ে NTCA ২০২২ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মধ্য ভারতীয় পার্বত্যভূমিতে খননকার্যের বাড়বাড়ন্ত সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় গুরুতর বাধা হয়ে উঠছে।

বৃহত্তর মধ্য ভারতীয় বনভূমির একটা অংশ তাড়োবা-আন্ধেরি, যার পাশাপাশিই আছে ইয়াবতমাল, নাগপুর ও ভান্ডারা জেলার বনাঞ্চল। “এই বনভূমিতেই মানুষ ও বাঘের সংঘর্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে,” জানাচ্ছে ২০১৮ সালের NTCA রিপোর্ট।

Namdeo Tarale with Meghraj Ladke, a farmer from Dhamani village. Ladke, 41, stopped nightly vigils after confronting a wild boar on his farm.
PHOTO • Jaideep Hardikar
Farmers in Morwa village inspect their fields and discuss widespread losses caused by tigers, black bears, wild boars, deer, nilgai and sambar
PHOTO • Jaideep Hardikar

ফোটো: নামদেও তরালে (ডানদিকে) এবং মেঘরাজ লাড়কে, ধামনি গ্রামের এক কৃষক। নিজের ক্ষেতে এক বুনো শুয়োরের সঙ্গে সরাসরি মোলাকাতের পর রাতপাহারা বন্ধ করে দিয়েছেন ৪১ বছর বয়সি মেঘরাজ। ডানদিকে: খেত পরিদর্শনে রত মোরওয়া গ্রামের চাষিরা আলোচনা করছেন বাঘ, কালো ভালুক, বুনো শুয়োর, এবং হরিণ, নীলগাই, সম্বর ইত্যাদি প্রাণীদের হামলায় অন্তহীন লোকসান নিয়ে

“জাতীয় অর্থনীতির নিরিখে দেখলে এই সমস্যাটার বিপুল আর্থিক কুফল রয়েছে, শুধু চাষিদের জন্যেই নয়, রাজ্যের সংরক্ষণ প্রচেষ্টার পক্ষেও,” বলছেন ড. মিলিন্দ ওয়াটভে, বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ এবং পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর প্রাক্তন অধ্যাপক।

সংরক্ষিত অরণ্যভূমি এবং বন্যপ্রাণের সুরক্ষার জন্য আইন আছে, কিন্তু ফসল ও গবাদি পশুর লোকসান অতিরিক্ত হারে ঘাড়ে এসে পড়ছে চাষিদেরই। ওয়াটভের বক্তব্য, ফসল নষ্ট হলে তা চাষিদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়, এবং সেই ক্ষোভ আখেরে ক্ষতি করে সংরক্ষণ প্রচেষ্টারই। গবাদি পশুর পাল থেকে অবাঞ্ছিত পশু, অর্থাৎ যেগুলি উৎপাদনহীন কিংবা বন্ধ্যা, তাদের ছেঁটে ফেলাও আইনমতে নিষিদ্ধ।

২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাড়োবা-আন্ধেরির আশপাশে পাঁচটি গ্রামের ৭৫ জন চাষিকে নিয়ে একটি ভূমি সমীক্ষা করেছিলেন ওয়াটভে। বিদর্ভ উন্নয়ন পর্ষদের তহবিলে পরিচালিত এই সমীক্ষার মাধ্যমে তিনি চাষিদের জন্য একটি প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলেন যাতে তাঁরা একযোগে বন্যজন্তুর হামলায় বার্ষিক লোকসানের পরিমাণের বিষয়ে রিপোর্ট দায়ের করতে পারেন। তাঁর অনুমানে ফসল লোকসানের পরিমাণটা শস্যবিশেষে প্রায় ৫০-১০০% — বা বছরে একরপ্রতি ২৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা।

ক্ষতিপূরণ না পেলে অনেক চাষিই শস্য চাষে খুব বেশি রকমফের আনতে চান না, কখনও কখনও জমি ফেলেও রেখে দেন।

রাজ্যের বনদপ্তর গোটা মহারাষ্ট্রে বন্যজন্তুর হামলায় ফসল নষ্ট এবং গবাদি পশু হত্যার ক্ষতিপূরণে “বছরে ৮০ কোটি টাকা” বণ্টন করে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন প্রিন্সিপল চিফ কন্সার্ভেটর অফ ফরেস্টস্‌ এবং অরণ্য বাহিনির প্রধান সুনীল লিমায়ে পারিকে এমনটাই জানিয়েছিলেন।

Badkhal says that farmers usually don’t claim compensation because the process is cumbersome
PHOTO • Jaideep Hardikar
Gopal Bonde (right) with Vitthal Badkhal (middle) who has been trying to mobilise farmers on the issue. Bonde filed compensation claims about 25 times in 2022 after wild animals damaged his farm.
PHOTO • Jaideep Hardikar

এই বিষয়ে চাষিদের একজোট করার চেষ্টা করছেন বিঠ্‌ঠল বদখল (মধ্যে), তাঁর সঙ্গে গোপাল বোন্ডে (ডানদিকে)। বুনো জন্তুতে ফসল নষ্ট করে যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণের জন্য ২০২২ সালে অন্তত ২৫ বার আবেদন করেছেন বোন্ডে। বদখল জানাচ্ছেন, চাষিরা সাধারণত ক্ষতিপূরণের আবেদন করেই না কারণ প্রক্রিয়াটা খুব জটিল

“ক্ষতিপূরণে এখন যে টাকাটা দেয় সেটা কিছুই নয়,” বলছেন বিঠ্‌ঠল বদখল, ভদ্রাবতী তালুকের সত্তরোর্ধ্ব এক অধিকারকর্মী, এই বিষয়ে চাষিদের একজোট করার চেষ্টা করছেন যিনি। “চাষিরা সাধারণত ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদনই করতে চায় না কারণ প্রক্রিয়াটা খুব জটিল আর খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো একদম দুর্বোধ্য,” ব্যাখ্যা করলেন তিনি।

কয়েক মাস আগে একটি গরু-সহ আরও গবাদি পশু খুইয়েছেন বোন্ডে। ২০২২ সালে অন্তত ২৫ বার ক্ষতিপূরণের আবেদন দাখিল করেছেন। প্রতিবার তাঁকে একটা ফর্ম পূরণ করতে হয়েছে, স্থানীয় বন এবং রাজস্ব দপ্তর আধিকারিকদের এত্তেলা দিতে হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের হাতেপায়ে ধরতে হয়েছে বাধ্যতামূলক পঞ্চনামা বা এলাকা পরিদর্শন করতে, খরচের হিসাব রাখতে হয়েছে, এবং তারপর আবেদনের কী হল জানার জন্য তাগাদা দিতে হয়েছে। ক্ষতিপূরণ কিছু যদি আসেও তাতে অনেক দেরি, আর তাঁর কথায়, “ওতে আমার সব লোকসান মিটবেও না।”

২০২২ সালের ডিসেম্বরে এক হিম হিম সকালে বোন্ডে আবার আমাদের নিয়ে চলেন নতুন রোয়া সবুজ মুগে ভরা তাঁর খেতে। বুনো শুয়োরের পাল এর মধ্যেই নরম চারাগুলো চিবিয়ে চলে গেছে, ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বোন্ডের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে গেছে একরাশ দুশ্চিন্তা।

পরের মাসগুলিতে অনেক চেষ্টায় ফসলের বেশিরভাগটাই বাঁচাতে পেরেছেন তিনি, কিছু বিক্ষিপ্ত জায়গা বাদে, যেগুলো সম্ভবত হরিণের একটা পাল এসে খেয়ে গেছিল।

জন্তুদের খাদ্য দরকার। খাদ্য দরকার বোন্ডে, তরালে এবং তাঁদের মতো অজস্র চাষি ও তাঁদের পরিবারেরও। এই দুই প্রয়োজনের সংঘাতবিন্দু হয়ে ওঠে তাঁদের ফসলের খেত।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Jaideep Hardikar

Jaideep Hardikar is a Nagpur-based journalist and writer, and a PARI core team member.

Other stories by Jaideep Hardikar
Editor : Urvashi Sarkar

Urvashi Sarkar is an independent journalist and a 2016 PARI Fellow.

Other stories by Urvashi Sarkar
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee