বীড জেলার
মাজালগাঁওয়ের দুই মা ও তাঁদের কন্যাদ্বয়ের কণ্ঠে বুদ্ধবন্দনার সুর। এই গানগুলির
মাধ্যমে ফুটে ওঠে জনসাধারণের জীবনে তথাগতের মহতি ভূমিকা, ফুটে ওঠে কীভাবে তাঁর
শিক্ষার আলোয় পথ খুঁজে পায় শতসহস্র মানুষ
আজ ২৬এ মে,
অর্থাৎ বুদ্ধপূর্ণিমা। তবে গৌতম বুদ্ধের জন্মবার্ষিকী এইবছর ধুমধাম করে পালন করা
যায়নি। "চারিদিকে যেভাবে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে বড়ো করে কোনও কিছুই উদযাপন
করা সম্ভব নয়," বললেন মহারাষ্ট্রের বীড জেলার সাভারগাঁও গ্রামের ৭৫ বছরের
রাধা বোরহাডে।
“আমারা সবাই
নিজের বাড়িতেই প্রার্থনা করবো আর বাচ্চাদের জন্য পায়েস বানাব।” কোভিড-১৯ অতিমারির
জন্য ২০২০ সালে বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপিত হয়নি, এবছরও হল না, দুঃখভরা কণ্ঠে আমাদের
ফোন করে জানালেন রাধাবাই।
২০১৭ সালের
এপ্রিলে পারির সদস্যদের দলটি যখন জাঁতা পেষাইয়ের গান প্রকল্পের গায়িকাদের সঙ্গে
দেখা করতে বীডের মাজালগাঁও তালুকে যায় তখন আমাদের পাঠানো হয় সাভারগাঁওয়ে
রাধাবাইয়ের কাছে। এই গ্রামটি ওই একই তালুকে মাজালগাঁও থেকে ১২ কিমি দূরে অবস্থিত।
জাঁতা পেষাইয়ের গানের প্রকল্পের আদি দল রাধাবাইয়ের কিছু গান রেকর্ড করেছিল, পরে
তা পারি আলাদা করে প্রকাশ করে। তাঁর কিছু ওভি প্রকাশিত হয়
‘আমাদের
ভীমবাবার জন্য লক্ষ গানও কম’
নামক প্রতিবেদনটিতে। ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের
কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শিক্ষা, ঐক্য এবং দলিতের আত্মগরিমা, এই ওভিগুলি
মূলত তারই গুণকীর্তন।
বাবাসাহেব প্রণীত নবযান বৌদ্ধবাদ দলিত সমাজকে দিয়েছে বর্ণাশ্রম প্রসূত অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্র, তাই " মাজালগাঁওয়ের গান, মহৌয়ের স্মৃতি " নামের প্রতিবেদনটিতে রাধাবাই তথা নববৌদ্ধ জাতির (এককালে যাঁরা হিন্দু সমাজে অচ্ছুৎ ছিলেন) অন্যান্য গায়িকারা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। " কৃতজ্ঞতার গান, উদযাপনের মন্ত্র " নামক প্রতিবেদনে রাধাবাইয়ের গানে ফুটে উঠেছে গৌতম বুদ্ধের মহতি বাণীর কথা, তার সঙ্গে সঙ্গে এও বিধৃত হয়েছে যে কেমন করে বৌদ্ধধর্মের মধ্যে দিয়ে দলিত সমাজ অস্পৃশ্যতার শৃঙ্খল ভেঙে চুরমার করে নিজের উন্নতি সাধনের পন্থা খুঁজে পেয়েছিল।
আমরা ওভি
গায়িকাদ্বয় কমল সালভে (রাধাবাইয়ের কন্যা) ও রঙ্গু পটভারের সঙ্গে দেখা করতে
মাজালগাঁওয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তাঁরা গ্রামে ছিলেন না, গিয়েছিলেন নিজেদের
আত্মীয়ের বাড়িতে। রঙ্গুবাইয়ের মা পার্বতী ভাদার্গের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করা সম্ভব
হয়ে ওঠেনি কারণ তিনি তার কয়েকবছর আগেই মারা গিয়েছিলেন।
সাভারগাঁও থেকে আনুমানিক ৭ কিমি দূরে অবস্থিত ভটওয়াড়গাঁও গ্রাম, সেখানকার বাসিন্দা কমলবাইয়ের বয়স ষাটের কোঠায়। তিনি আমাদের বললেন, "হ্যাঁ, বুদ্ধকে নিয়ে কয়েকটা জাঁতা পেষাইয়ের গান আমি গেয়েছিলাম বহু বছর আগে, তবে সেসব আমার মনে নেই বিশেষ। আমার মা সব জানেন।"
জাঁতা পেষাইয়ের গানের প্রকল্পের এই কিস্তিতে আমরা ওভির দুটি গুচ্ছ প্রকাশ করছি। প্রথমটিতে বুদ্ধের প্রতি অর্ঘ্যরূপে আছে পাঁচটি গান যেগুলি গেয়েছেন রাধাবাই, কমলবাই এবং রঙ্গুবাই। দ্বিতীয় গুচ্ছটিতে পার্বতীবাই গেয়েছেন ৯টি বুদ্ধবন্দনার দোহা। আকারে দৈনন্দিন জীবনে বুদ্ধের যে স্থান, ভোরবেলায় নিদ্রাভঙ্গের সময় থেকে মানুষের যে নিবিড় বুদ্ধযাপন, সেটাই তুলে ধরছে এই ওভিগুলি। পারি’র জাঁতা পেষাইয়ের গান প্রকল্পের আদি দলটি এই সবকটি গানই মাজালগাঁওয়ে এসে ১৯৯৬ সালে রেকর্ড করেছিল।
উপরোক্ত তিনজন গীতিকারের রচিত ও গাওয়া দোহার প্রথম গুচ্ছে কথক বলছেন যে তিনি নিজের জীবন সমর্পণ করেছেন বুদ্ধের পায়ে। বৌদ্ধধর্মের যে ত্রিরত্ন – বুদ্ধ, ধম্ম (তথাগত প্রণীত শিক্ষা) ও সংঘ (বুদ্ধের অনুসরণকারীদের যৌথ সম্প্রদায়) – তার প্রতি নিজের জীবনকে অঞ্জলি হিসেবে তিনি সঁপে দিচ্ছেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে আজীবন সসম্মানে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবেন এবং পঞ্চশীলের নিয়ম মেনে চলবেন। পঞ্চশীল হল তথাগত প্রণীত পাঁচটি নৈতিক উপলব্ধি যা অন্যের ক্ষতিসাধন থেকে আমাদের বিরত থাকতে শেখায়।
কথক অষ্টশীল পন্থা মেনে চলার ও মহামঙ্গল গাথা অধ্যয়ন করার শপথও নিচ্ছেন। অষ্টশীল মার্গ আদতে বৌদ্ধধর্মের প্রাণবিন্দু যা সামগ্রিকরূপে নৈতিক কর্মজীবনের উপদেশ দেয় এবং মহামঙ্গল গাথা একটি দার্শনিক সূত্র যা মানুষকে তার কামনা ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষা দেয়। শেষ দোহায় গায়িকা নরসিংহ বা নৃসিংহ গাথার কথা স্মরণে আনছেন এবং বুদ্ধের পায়ে নতজানু হয়ে "শতকোটি গড়" করছেন।
প্রথম
সে দোহা মোর ধম্ম বেলায়,
বুদ্ধে আরতি বাঁধে
সংঘবীণায়।
ত্রিশরণে বাঁধি গান, পাঁচটি
শীলের দান, শরীরে শরীর মুছে রাখি জামানত,
দ্বিতীয় এ দোহা মোর,
নিঃশ্বাসে ঘনঘোর, ইজ্জতে অনশনে নিয়েছি শপথ।
পঞ্চশীলার পায়ে দোহার
নূপুর,
তিনতালে আটশীলে দূর বহুদূর।
চৌকানি পাঁচালির মহামঙ্গল —
জলছড়া মননে, ষড়রিপু দমনে,
বুদ্ধে পেয়েছি সখী প্রেমের আগল।
নৃসিংহ ব্রত আজ পঞ্চমা ঝড়,
শাক্য শ্রমণে মোর শতকোটি
গড়।
আজ প্রায় ১০ বছর হতে চলল পার্বতী ভাদার্গে প্রয়াত হয়েছেন। এখানে প্রকাশিত ওভির দ্বিতীয় গুচ্ছটি তাঁরই গাওয়া। তাঁর কন্যা রঙ্গুবাইয়ের বয়স সত্তরের কোঠায়, আমরা তাঁর থেকে জানতে পারলাম যে জাঁতা পেষাইয়ের গান গাওয়াটা পার্বতীবাইয়ের কাছে নেশার মতো ছিল। "মা আমাকে সারাক্ষণ বলতেন, 'তুই আমার সঙ্গে গাইতে পারিস তো, এটা গলার জন্য ভালো তো বটেই, তাছাড়া আমার সমস্ত গান তুই মনেও রাখতে পারবি'।"
"তবে আমি বিয়ের পর খুবই অল্প সময়ের জন্য জাঁতাটা ব্যবহার করেছিলাম জোয়ার বা গম ভেঙে আটা বানানোর জন্য," ফোনে বলছিলেন রঙ্গুবাই। বছর পঁচিশ আগে মাজালগাঁওয়ে যন্ত্রচালিত চাকির ব্যবহার শুরু হয়, আর তারপর থেকে বাড়িতে বাড়িতে হাতে ঘোরানো জাঁতা ব্যবহার লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে গান গাওয়াও ক্রমশ বন্ধ হয়ে গেছে।
এই নয় খানি ওভির প্রথমটিতে গায়িকা শোনাচ্ছেন ভোরবেলায় তাঁর দিন শুরুর গল্প। তাঁর ঘরকন্নার দৈনন্দিন কাজের পথপ্রদর্শক সম্রাটপুত্র গৌতম। এই দোহার অন্তর্নিহিত অর্থ এটাই যে বুদ্ধের হাত ধরে মানুষজন ক্রমশ অন্ধকার থেকে আলোর পথে এসেছে। পরবর্তী গানগুলিতে গীতিকার জানাচ্ছেন যে তথাগতের নাম ও তাঁর বাণী মানুষের জীবন মাধুর্যে পরিপূর্ণ করে তোলে; কথকের মনে হয় যেন তিনি পুনর্জন্ম লাভ করেছেন।
রোজ সকালবেলা কথক তাঁর আঙিনায় ঝাঁট দেওয়ার সময় রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেন বুদ্ধের উপস্থিতি। জল আর দুধ ছিটিয়ে উঠোন নিকনোর সময় তাঁর মনে হয় তিনি যেন শাক্যমুনির আপন ভগিনী কিংবা ভাইঝি। বৌদ্ধধর্মকে হৃদয়ে স্থাপন করা যেন তথাগতের আপন গৃহে বসবাস করার সমতুল।
জন্ম সে
নিয়েছিল মহারাজসিক,
আজ তাই কাকভোরে, প্রভুর
আঙুল ধরে, পিরীতি সমুদ্দুরে হইবো নাবিক।
সখী এই সাতসকালে — বুদ্ধের নাম না নিলে —
কি করে বা ভাঙবো রে বল,
পায়ের শিকল, এই ধরাতল, পরশ-মেদুর হায়?
তথাগত মিছরি সে ধম্মশিরায়,
তাহার নামেই জরা পথকে
হারায়।
তথাগত মিছরি সে ঠোঁটের
কোনায়
নাচিছে ভ্রমরা তব নামের
কৃপায়।
বুঝলি রে সই, উঠান জুড়োই,
একঠায়ে অহনায়,
দেখিনু দাঁড়ায়ে বুদ্ধ
রয়েছে, সাথে মোর স্বামী হায়।
বুঝলি রে সই, উঠান জুড়োই
আহ্লাদে ইশরাকে,
দেখিনু দাঁড়ায়ে বুদ্ধ
রয়েছে আমাদের সিঁথিডাকে।
বুঝলি রে বোন, আঙিনা আপন,
গৌতমে রাখে মান,
মন্দিরে তার সাতটি রাজার
দুধসাদা কলতান।
বুঝলি রে সই, দুয়ার নিকোই,
ঝুমকো জলের ছড়া,
তথাগত ওই শাক্যসিংহ আমি
তাঁর সহোদরা।
তথাগত ওই শাক্যপুষ্প, ভাইঝি রে আমি তাঁর।
পরিবেশিকা/গায়িকা : রাধা বোরহাডে, কমল সালভে, রঙ্গু পোটভরে, পার্বতী ভার্দাগে
গ্রাম : মাজালগাঁও
জনপদ : ভীম নগর
তালুক : মাজালগাঁও
জেলা : বীড
জাতি : নববৌদ্ধ
পেশা : রাধা বোরহাডে আগে কৃষিশ্রমিক ছিলেন, এখন তিনি সাভারগাঁওয়ে ছোট্ট একটি মুদিখানা চালান। কমল সালভে গৃহস্থালি সামলান। রঙ্গু পোটভরে বেশ কয়েক বছর নিজেদের পারিবারিক জমিতেই কাজ করতেন। পার্বতী ভার্দাগে ছিলেন একজন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক।
তারিখ : এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ২রা এপ্রিল।
পোস্টার : উর্জা
সহায়তার জন্য মাজালগাঁওয়ের রাজরত্ন সালভে ও বিনয় পোটভরের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ।হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন।
অনুবাদ - জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)