শস্য পেষাই ঘিরে আটটি ওভি গেয়েছেন সাবিত্রা উভে তথা অন্যান্য আরও কয়েকজন। ওদিকে ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে দুঃখে দিন কাটছে এক বোনের, জীবন যদিও থেমে নেই

আঁখির কোনায় ঝাপসা নোনায় খেত কুড়ানির বোন,
কোমর বেঁধে ঝগড়া সেধে কাঁদছে ভাইয়ের মন।

প্রথম ওভিটিতে গায়িকার মনে পড়ছে এক ভাইবোনের ঝগড়াঝাঁটির কথা। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, চারিপাশের জলা-জঙ্গল, কেবল এরাই সাক্ষী। এটা কি নিছকই ছোটবেলার মন কষাকষি? নাকি প্রাপ্তবয়সের বৈষয়িক কোন্দল, যেখানে পারিবারিক জমিজমা নিয়ে মারামারি চলতেই থাকে? বোনের দুটি চোখ ভরে গেছে জলে; তবে সে মনে মনে জানে, তার চোখে জল দেখলে ভাইও কষ্ট পাবে।

জাঁতাপেষাইয়ের গান প্রকল্পের এই কিস্তিটির জন্য উদ্দাত্ত কণ্ঠে আটটি ওভি গেয়েছেন পুণের মুলশি তালুকের খাড়াকওয়াড়ি জনপদের সাবিত্রা উভে, তারা উভে এবং মুক্তা উভে। শুরুতেই গুনগুনিয়ে ওঠে গালার সুর, এটি হয় তাঁরা নিজেরাই বাঁধেন কিংবা ধার করেন লাভণী, গৌলান তথা অভঙ্গের মত প্রচলিত লোকসংগীতের ধারাগুলি থেকে। সাধারণত এই সুরটি গুনগুন করে গাওয়া হয় মূল ওভির বন্দিশ রূপে। তবে মাঝেমাঝে কথা বসিয়েও নেন তাঁরা, তখন দোহার ফাঁকে ফাঁকে এটি ব্যবহৃত হয় ধুয়ো হিসেবে। তিন পংক্তির এই ধুয়োটিতে বর্ণিত হয়েছে এক বোন তার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার ফলে কেমন করে কষ্ট পাচ্ছে নিরন্তর। ওভির এই গুচ্ছটির কেন্দ্রে যে ভাব, সেটিকে চমৎকার সাজিয়ে নিয়েছে এই ধুয়ো:

সই রে পাগলপারা,
কেড়ে নে ফুলের তোড়া
খালি হাতে ওই ছোঁড়া যাক ফিরে যাক না!

বোনের মানভঞ্জন করতে হবে, তাই একগোছা ফুল এনেছে ভাই, তবে বোন এতই রেগে গেছে যে সে তার সখীদের বলছে ফুলটুল সব কেড়ে নিয়ে ভাইকে ভাগিয়ে দিতে। মনে তো হচ্ছে না যে মেয়েটি আদৌ আর কোনওদিন তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে। তবে এমনটাও হতে পারে যে ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো তার কাছে কিচ্ছুটি নেই। কারণ ধুয়োর আক্ষরিক অর্থ অতিক্রম করলে আস্তে আস্তে ফুটে উঠবে বোনের নিদারুণ বাস্তব: "আমার আর কীই বা আছে? যা আছে সবই তো তোর, আমি যে চির অভাগিনী।" ভাইবোনের মিঠেকড়া সম্পর্ক, আর আমাদের এই পিতৃতাতান্ত্রিক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করা নারী ও পুরুষের মাঝে আর্থসামাজিক বৈষম্য, এই দুইয়ে মিলে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।

PHOTO • Courtesy: CCRSS.org
PHOTO • Courtesy: CCRSS.org

মহিলারা একসাথে বসে শস্য পেষাই করছেন একটি পাথরের জাঁতাকলে। বহুকাল আগে এই ছবিটি তুলেছিল জিএসপির আদি দলটি

আজকের মতো শেষ হয়ে গেছে জাঁতাপেষাই, এই কথাগুলি দিয়েই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ওভি থেকে শেষ অবধি প্রতিটি দোহা। হয়তো বা এমনটা বারবার বললে সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটাখাটনির কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। কাজের শেষে নারী তাঁর জাঁতাকলটি ঢেকে রাখেন, তাঁর সাতরাজার ধন এই অমূল্য বস্তুটির দেখভালের দ্বায়িত্ব নেয় চন্দ্র-সূর্য।

কাজের ফাঁকে হঠাৎই চোখে পড়ে যে তাঁর ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়। ছেলে যে তাঁর কতটা গর্বের, সেটা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে এই পংক্তিটিতে: "বাঘের মতন মোর সে খোকন, চুপটি এসেছে"। "গমগুঁড়ানির হাতে/ লাগলো যে রঙ সোনার বরণ" – সুখী পরিবারের জাঁতাকলটি কীভাবে এক নারীর হাতে অফুরন্ত সমৃদ্ধির উৎস হয়ে ওঠে এ কথাটাই ফুটে উঠেছে এখানে।

হঠাৎই গায়িকার চোখে পড়ে যে তাঁর ছেলে চন্দনে লিপ্ত কপালে কালচে আবির মাখছে, এদিকে সদ্য গুঁড়ো করা আটায় উপচে পড়ছে কুলো। পন্ধরপুরের দেবতা বিট্ঠলের যারা ভক্ত, তাদের মধ্যে আবির ও চন্দন মাখার এই প্রথাটি বেশ জনপ্রিয়। গায়িকার মনে হচ্ছে যে তাঁর ছেলে বুঝি বিট্ঠলের রূপ ধারণ করেছে। ওদিকে দৈব আশীর্বাদ স্বরূপ তাঁর কুলো ভরে উঠেছে সুগন্ধী কেয়াফুলে।

শস্য পেষাই শেষ হলেই তাঁর মনে হয় যেন স্বয়ং লক্ষ্মী এসে ভর করেছেন তাঁর ক্লান্ত জাঁতাকলে। দেবতার বরে তাঁর পরিবার যেন সুখের মুখ দেখে, এই উপমাটি সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। ওদিকে চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর দেওর সারাবণা, তাকে দেখামাত্র গায়িকা তড়িঘড়ি আঁচল টেনে নেন মাথায়, এ হেন ঘোমটা দেওয়ার প্রথাটি আজও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জনজাতির মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত। বিশেষ করে যাঁরা বিবাহিত, তাঁদের কাছে এটি সম্ভ্রমের প্রতীক।

শেষ দোহা অবধি গানের ধুয়োটি ঘুরেফিরে আসে, যেন ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার ফলে বোনের মন থেকে দুঃখের রেশ আর কাটতেই চাইছে না।

সাবিত্রা উভে, তারা উভে এবং মুক্তা উভের কণ্ঠে আটটি ওভি শুনুন


আঁখির কোনায় ঝাপসা নোনায় খেত কুড়ানির বোন,
কোমর বেঁধে ঝগড়া সেধে কাঁদছে ভাইয়ের মন।

জাঁতার তালে দিন ফুরালে রাত ঝুমঝুম অন্দরে
ক্লান্ত ঢেঁকি রাখবো ঢাকি, সুয্যি সোহাগ চন্দরে।

জল ঝাড়ু সই জাঁতার কুলোয়, দুয়ার গোড়ায় কে?
বাঘের মতন মোর সে খোকন, চুপটি এসেছে।

দিনের শেষে জাঁতার দেশে গমগুঁড়ানির হাতে
লাগলো যে রঙ সোনার বরণ সাতরাজা মোর পাতে।

কানায় কানায় উড়কি আটায় উঁচকপালির ঝুপসি কথায়
চন্দনে ওই গুলাল শুকোয়, আয় রে রঘু আয়।

সাঁঝনি জাঁতার শেষে ক্যাওড়া ফুলের বেশে সাতরঙা কুলো মোর নাচে আজীবন...
বিঠু বিঠু ডাক ছাড়ি, ভিটে তার পন্ধরি, হয়েছে ডাগর সে তো খোকারই মতন।

ঢেঁকিছাঁটা বায়না, খ্যামা দিনু, আর না...চান্দেরি ঘুঙটের বাসি অভিমান –
এসো গো মা লক্ষ্মী, জাঁতাভাঙা দুখ্যি, ফুলকি আটার বানে ভেসেছে উঠান।

কাঁধের শাড়ি মাথায় ভারি, হায় জাঁতাকল শেষে –
সারাবণা মোর পাগলা দেওর, চৌকাঠে রয় এসে।

গানের ধুয়ো:

সই রে পাগলপারা,
কেড়ে নে ফুলের তোড়া
খালি হাতে ওই ছোঁড়া যাক ফিরে যাক না!


PHOTO • Courtesy: Savitrabai Ubhe
PHOTO • Patrick Faucher
PHOTO • Samyukta Shastri

সাবিত্রা উভে, তারা উভে এবং মুক্তা উভে

পরিবেশক/গায়িকা : সাবিত্রা উভে, তারা উভে, মুক্তা উভে

জনপদ : খাড়াকওয়াড়ি

গ্রাম : কোলাভাডে

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : মারাঠা

তারিখ : ১৯৯৬ সালের ১লা জুন এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল

পোস্টার: উর্জা

সাবিত্রা উভের কণ্ঠে শুনুন জাঁতার তালে দিন গুজরানের গান।

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

نمیتا وائکر ایک مصنفہ، مترجم اور پاری کی منیجنگ ایڈیٹر ہیں۔ ان کا ناول، دی لانگ مارچ، ۲۰۱۸ میں شائع ہو چکا ہے۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز نمیتا وائکر
PARI GSP Team

پاری ’چکی کے گانے کا پروجیکٹ‘ کی ٹیم: آشا اوگالے (ترجمہ)؛ برنارڈ بیل (ڈجیٹائزیشن، ڈیٹا بیس ڈیزائن، ڈیولپمنٹ اور مینٹیننس)؛ جتیندر میڈ (ٹرانس کرپشن، ترجمہ میں تعاون)؛ نمیتا وائکر (پروجیکٹ لیڈ اور کیوریشن)؛ رجنی کھلدکر (ڈیٹا انٹری)

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز PARI GSP Team
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا (پاری) کے ہندوستانی زبانوں کے پروگرام، پاری بھاشا کے کانٹینٹ مینیجر ہیں۔ انہوں نے کولکاتا کی جادوپور یونیورسٹی سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک کثیر لسانی شاعر، ترجمہ نگار، فن کے ناقد اور سماجی کارکن ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra