দিন নেই, রাত নেই, শস্য পিষে আটা বানিয়েই চলেছে নারী, মগজ ও পে শি র যুগপৎ প্রয়োগে সে জাঁতাকলে খুঁজে ফিরছে তাঁর পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি – এই উপলব্ধিকে ঘিরেই পাঁচটি চমৎকার ওভি গেয়েছেন সাবিত্রা উভে

জাঁতা পেষাইয়ের গানের প্রকল্পে ২৩টি গান প্রদান করেছিলেন যিনি, সেই সাবিত্রা উভে থাকতেন পুণে জেলার মুলশি তালুকে। পেশায় ক্ষুদ্রচাষি, মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ছোট্টো একটা কুঁড়েঘর, ঘর তো নয় বরং মাটি দিয়ে গাঁথা ইটের সারি কেবল। জিএসপির আদি দলটি ১৯৯৬ সালে যখন তাঁর গানগুলি রেকর্ড করে তখন তিনি বলেছিলেন যে এই ওভিগুলি তিনি তাঁর মায়ের থেকে শিখেছেন। ২০১৭ সালে পারির নতুন জিএসপির দল কোলাভাডে গ্রামের খাড়াকওয়াড়ি জনপদে তাঁর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে যে তিনি আর নেই, মারা গেছেন ২০০৩ সালে। জিএসপির এই কিস্তিটিতে রইল তাঁর পাঁচখানা ওভি। ছন্দে ছন্দে বর্ণিত রয়েছে পাথরের জাঁতাকলে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, কেমনভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় নারীজীবন।

দৃঢ় কণ্ঠে সাবিত্রাবাই এই ওভিগুলির মধ্যে দিয়ে যে বক্তব্যগুলি রেখেছিলেন সেগুলি খানিক এইরকম:

দিনান্ত শস্য গুঁড়ো করতে করতে হাড়মাস কয়লা হয়ে যায় রোজ। শরীর তো নয়, যেন নিষ্পলক আঙার... এমন আঙার যে ঠাণ্ডা একবাটি দুধ রাখলে তা চোখের পলকে উথলে উঠবে। কাজটা আদৌ কঠিন কি না এ প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন। এই যে আঁচলটা দিয়ে মাথা, কাঁধ, মাজা, সব ঢেকে রেখেছি না? ঘামে ভিজে সেটা ন্যাতা হয়ে যায়, কাজটা ঠিক এতটাই কঠিন। ব্লাউজ থেকে টপটপিয়ে ঝরতে থাকে ঘাম, নোংরা জমে তাতে। একফোঁটা... দুইফোঁটা... হাজার ফোঁটা... ঠিক যেভাবে বিন্দু বিন্দু করে বুড়িয়ে গিয়েছিল আমার মা।

Left:  A haldi-kumkum function with Savitrabai Ubhe and others from her village (file photo). Right: Savitrabai receiving flowers at the event
PHOTO • Courtesy: Savitrabai Ubhe
Left:  A haldi-kumkum function with Savitrabai Ubhe and others from her village (file photo). Right: Savitrabai receiving flowers at the event
PHOTO • Courtesy: Savitrabai Ubhe

বাঁদিকে: অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে একজনের গায়ে হলুদে র অনুষ্ঠানে গিয়েছেন সাবিত্রাবাই উভে ডানদিকে: সেখানে ফুল দিয়ে সম্বর্ধ না জানানো হচ্ছে সাবিত্রাবাইকে

"মিহি করে গুঁড়ো কর তো দেখি," আমার উল্টোদিকে জাঁতাকল নিয়ে যে যুবতীটি বসে আছে তাকে বললাম, "গাঁয়ের সেরেস্তায় খাবার পাঠাতে হবে তো আজ। ক'দিনের মধ্যেই ছেলে আমার উকিলের কাজ শুরু করবে সেখানে।"

যত্ন করে হাতে ধরে তালিম দিয়েছে মা আমাকে। একমুঠি গমের দানা থেকে কেমন করে দেড় মুঠো আটা বানাতে হয়, সে কায়দা আমি জানি। নয়তো পরিবার আমার সুখের মুখ দেখতো কেমনে? জাঁতার ঠাকরুন কেন যে আমার কপালে এই জাঁতাকলটা বেঁধেছিল তা ভেবে পাই না। দিন নেই, রাত নেই, জাঁতা পিষেই যাই, পিষেই যাই – হয়তো সে কারণেই। কিন্তু যতই পিষে মরি না কেন, বস্তা দেড়েক আনাজ তবু বাকি থেকেই যায়।

একদিকে হাড়ভাঙা খাটনি, অন্যদিকে সংসারের হাল ধরার মুনসিয়ানা, এই দুইয়ে মিলেই পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি ধরা থাকে নারীর হাতে – তাঁর অন্তিম ওভিতে এই চিত্রটিই তুলে ধরেছেন সাবিত্রাবাই। 'জাঁতার ঠাকরুন' বলতে তিনি সংসারের কর্ত্রীর কথা বোঝাতে চেয়েছেন, যিনি দেবী লক্ষ্মীর মতো তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছেন আশীর্বাদ স্বরূপ জাঁতাকল – তিনি আর কেউ নন - গায়িকার মনিব কিংবা শাশুড়ি, অথবা তাঁর নিজের মা।

সাবিত্রা উভের ক ণ্ঠে পাঁচটি ওভি শুনুন


জাঁতা চলে ঘড়ঘড়, ঘেমেনেয়ে সার...আঁচল কাঁচুলি ভিজে হ'ল একাকার,
ঠাণ্ডা দুধের বাটি উনুনের নামে...কাঁচলা আঁচল জ্বলে অবেলার ঘামে।

খসখসে জনারের থমথমে জাঁতা...ঘামেই করেছে স্নান ব্লাউজের হাতা,
জলকে চলি রে সই, গুটিগুটি রোজ...বুড়িয়ে যাওয়ার দেশে মায়েরা নিখোঁজ।

জাঁতাখানি তুলে ধর, মিহি করে গুঁড়া কর, হুই সে আপিসে যাবে ভাকরির দিস্তা,
আদুরে আমার ছেলে ক'দিনে উকিল হলে একা হাতে সামলাবে গাঁয়ের সেরেস্তা।

সই রে একটু দাঁড়া, মিহি করে কর গুঁড়া, একটি গেরাস বেড়ে হবে দেড়খান,
মায়ের আঁচল ধরে, শিখেছি যতন করে, গরিবের সংসারে জাঁতা ভগবান।

বল্ দেখি ঠাকরুন জাঁতাখানি ওই...আমার কপালে কেন বেঁধেছিলি সই?
ঘামঝরা কাকভোরে ঢেঁকিছাঁটা যম...বস্তা দেড়েক তবু পড়ে আছে গম।


PHOTO • Courtesy: Savitrabai Ubhe

পরিবেশক/গায়িকা: সাবিত্রাবাই উভে

জনপদ: খাড়াকওয়াড়ি

গ্রাম: কোলাভাডে

তালুক: মুলশি

জেলা: পুণে

জাতি: মারাঠা

তারিখ: ১৯৯৬ সালের পয়লা জুন এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল

পোস্টার: উর্জা

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

নমিতা ওয়াইকার লেখক, অনুবাদক এবং পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া, পারির নির্বাহী সম্পাদক। ২০১৮ সালে তাঁর ‘দ্য লং মার্চ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে।

Other stories by নমিতা ওয়াইকার
PARI GSP Team

পারি গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্ট টিম: আশা ওগালে (অনুবাদ); বার্নার্ড বেল (ডিজিটাইজেশন, ডেটাবেস নির্মাণ, রূপায়ণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ); জিতেন্দ্র মেইদ (প্রতিলিপি এবং অনুবাদ সহায়ক); নমিতা ওয়াইকার (প্রকল্প প্রধান এবং কিউরেশন); রজনী খলাদকর (ডেটা এন্ট্রি)

Other stories by PARI GSP Team
Translator : Joshua Bodhinetra

জশুয়া বোধিনেত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল করেছেন। বর্তমানে অনুবাদ সহায়ক হিসেবে জশুয়া পারি'র সঙ্গে কর্মরত। কবি, শিল্পলেখক, শিল্প সমালোচক তথা সমাজ কর্মী ইত্যাদি নানান ভূমিকায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

Other stories by Joshua Bodhinetra