মহিলাদের মূল দলটায় অধিকাংশের বয়স ষাটের কোঠায় - হাতে কুঠার আর কুড়ুল। তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর জেলার তিরুভায়ুর ব্লকের কিলত্তিরুপ্পানতুরুত্তি গ্রামে পৌঁছে যে এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হবে, তা আমরা মোটেই ভাবিনি।
মে মাসের একটা ভ্যাপসা, গরম দিনে, তাঞ্জাভুর শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটার অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেশের বিকাশের একটা অন্য ছবি দেখতে পেলাম। এই মহিলারা যেখানে কাজ করছেন সেটা মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি অ্যাক্ট, মনরেগা-এর অন্তর্ভুক্ত কর্মক্ষেত্র। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই বয়সজনিত কারণে দুর্বল এবং ক্লান্ত। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অথবা দলিত জনগোষ্ঠীর এই মহিলারা সবাই হয় ভূমিহীন অথবা প্রান্তিক চাষি পরিবার থেকে এসেছেন। এই মহিলারা ছাড়াও দলে কয়েকজন বয়স্ক পুরুষও আছেন।
স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য তথা দলনেত্রী জে. অনন্তী (৪২) আমাদের জানালেন, “এই দলে প্রায় শ’ খানেক মহিলা কাজ করেন।”
ওঁদের কাজ করার কোনও ছবি অবশ্য আমার কাছে নেই। আমাদের দেখেই তাঁরা কাজ থামিয়ে দিলেন। আমাকে আর আমার সঙ্গীকে দেখে যখন ভিড় করে দাঁড়ালেন, তখন বুঝলাম আমাদের দেখে সবাই সরকারি আমলা ভেবেছেন। সবাই নিজেদের পাওনা টাকা দাবি করছেন।
২-৩ মাস হয়ে গেল রাজ্য সরকার তাঁদের টাকা মেটায়নি। কয়েকজন জানালেন তাঁদের বকেয়া পাওনা যোগ করলে পরিমাণ দাঁড়ায় দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। এর কারণ স্বরূপ আমাদের জানালেন কেন্দ্র সরকার মনরেগা তহবিলের টাকা রাজ্যে পাঠাতে দেরি করে। তাছাড়াও এর জন্য খানিক দায়ী ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী জে. জয়ললিতার মৃত্যু পরবর্তী তামিলনাড়ু রাজ্যের টালমাটাল অবস্থা।
এক সময়ের উর্বর কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলের খরায় বিপর্যস্ত কয়েকশো গ্রামের মধ্যে কিলত্তিরুপ্পানতুরুত্তি একটা।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এই অঞ্চলে যে বৃষ্টি নামে এবছর কাবেরী বদ্বীপে এখনও তার দেখা মেলেনি। ২০১৬ সালে বৃষ্টিপাতে ঘাটতি ধরা পড়ে, তারপর অক্টোবর ডিসেম্বর মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা বর্ষাতেও তাই। রাতারাতি ফলন পড়ে যায়, আর সেই সঙ্গে কাজ আর রোজগারও অমিল হয়ে ওঠে।
অনন্তী জানালেন, গ্রামের বেশিরভাগ যুবক-যুবতীই ভদ্রস্থ মজুরির কাজ খুঁজতে হয় তাঞ্জাভুর টাউন, না হলে কোয়েম্বাটোর, তিরুপ্পুর, বা চেন্নাই চলে গেছেন। বৃষ্টি না হলে, ওরা ফিরবে না। তাঁর কথায়, “এবছর খেতি থেকে কোনও রোজগার হয়নি [২০১৬-১৭]; বয়স্ক মহিলাদের বেঁচেবর্তে থাকার জন্য কাজ তো করতেই হবে। এ বড়ো কঠিন সময়।”
আপনি কি কাজ করেন? আমরা জানতে চাইলে অনন্তী বললেন, এলাকায় স্থানীয় পরবের আগে আগে (গ্রামের) সড়ক পরিষ্কার করে চওড়া করার কাজ করেন। এই বয়স্ক মহিলারা কেন কাজ করছেন? তাঁর উত্তর, “এই খরার সময়ে সকলেই কাজ করছে।”
ওই মহিলারাই আমাদের জানালেন, গত দুটো বছর চাষের জন্য খুব-ই খারাপ ছিল। খাল আর নদীগুলোয় সেচের জন্য জল ছিল না, তেমন বৃষ্টি হয়নি। পাতকুয়াগুলো পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়ায় পুরো কৃষি ব্যবস্থা একবারে ধ্বসে গেল।
জনৈক মহিলা বললেন, “এখন একমাত্র ভরসা এই ১০০ দিনের কাজ। আমাদের হাতে কোনও টাকা নেই।” তামিলনাড়ু সরকার মনরেগা প্রকল্পে কর্মদিন ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ দিন করলেও, এই এলাকায় লোকে এখনও ১০০ দিনের কাজই বলেন।
৬২ বছরের মানিক্কাভেল্লি, বয়সের তুলনায় আরও বয়স্ক ঠেকে তাঁকে, বললেন, “আমার ছেলেপুলেরা সব বাইরে চলে গেছে, আমি রয়ে গেছি।” রয়ে গেছেন হাতে গোনা সেইসব কমবয়সি মহিলাও যাঁদের বাচ্চারা নিতান্তই ছোটো।
অনন্তী জানালেন, ১৫০ দিনের কাজ করে প্রতি কর্মীর দিনে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। কিন্তু সেই টাকা আসতে বড্ড দেরি হয়। “দু’মাস হল লোকজন মজুরি পায়নি,” তাঁর অভিযোগ।
কাবেরী নদীর বদ্বীপ আর অববাহিকা জুড়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, সর্বত্রই আমরা দেখলাম বয়স্ক মহিলা ও পুরুষরা মনরেগার কাজ আঁকড়ে ধরে খরার সঙ্গে যুঝছেন।
একটি জমিহীন পরিবারের প্রৌঢ়া পুষ্পভল্লি বললেন, “এই দিয়ে তেমন কিছুই হবে না, কিন্তু আর কিছুই নেই যখন, তখন যা পাচ্ছি তা-ই সই।”
জমিওয়ালা লোকজনেরই যদি এই দুর্দশা হয়, তাহলে যাঁদের জমি নেই তাঁদের অবস্থা কতটা খারাপ তা আমরা কল্পনা কি করতে পারছি?
আরও পড়ুন:
দুর্দশা আর মৃত্যুর দ্বীপ
তামিলনাড়ুর কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী খরার ফলে ইতিমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একাধিক চাষির মৃত্যু হয়েছে। রাজ্য সরকার কৃষিক্ষেত্রে চলতে থাকা দুর্দশাকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে নাকচ করে দিলেও, বহু চাষি পরিবার-ই ভিন্ন কথা বলছে
জীবন-মৃত্যুর মাঝে অনন্ত এক খরা
তামিলনাড়ুর তায়ানুর গ্রামের কৃষকদের সংকট খরাকেও ছাপিয়ে গেছে: বদ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কৃষি দুর্দশার জেরে মৃত্যু হয়েছে বহু কৃষকের, আত্মহত্যা করেছেন আরও বহু কৃষক
অনুবাদ: অংশুপর্ণা মুস্তাফী