১৮ বছর বয়সে প্রথমবার যখন বক্ষ হ্রাস করার অস্ত্রোপচার করাতে হরিয়ানার রোহতকের এক সরকারি জেলা হাসপাতালে যান সুমিত (নাম পরিবর্তিত), তাঁকে বলা হয়েছিল আগুনে পোড়া রোগী হিসেবে ভর্তি হতে হবে।

জন্মসূত্রে প্রাপ্ত শরীর বদলে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের শরীরে রূপান্তরিত হতে চাইলে ভারতের রূপান্তরকামী মানুষদের যে অজস্র জটিল ডাক্তারি তথা আইনি লাল ফিতের ফাঁসের ভিতর দিয়ে যেতে হয় তা থেকে মুক্তি পেতে হলে এই মিথ্যেটুকু বলতেই হবে সুমিতকে। এবং তার পরেও কোনও লাভ হবে না।

আরও আট বছর ধরে অজস্র দলিল-দস্তাবেজ, অনন্ত মনোরোগ মূল্যায়ন, ডাক্তারের পর ডাক্তার, এক লক্ষেরও বেশি অর্থব্যয় – যার একাংশ ধার নিয়ে, পারিবারিক অশান্তি, এবং এত সব কিছুর মধ্যেও নিজের স্তন নিয়ে অস্বস্তি অপরিবর্তিত থাকা এবং তা বদলের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার পর, অবশেষে রোহতক থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে হিসারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলতি ভাষায় ‘টপ সার্জারি’ হিসেবে পরিচিত অস্ত্রোপচার করাতে সফল হন সুমিত।

দেড় বছর পরেও হাঁটার সময় কাঁধ ঝুলে যায় অধুনা ২৬ বছরের সুমিতের; অস্ত্রোপচারের আগে থেকে রয়ে যাওয়া একটা অভ্যাস এটা, সেই সময়কার যখন তাঁর স্তনযুগল তাঁর কাছে প্রবল অস্বস্তি এবং লজ্জার কারণ ছিল।

সুমিতের মতো জন্মসূত্রে চিহ্নিত লিঙ্গের থেকে আলাদা কোনও লিঙ্গের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন কতজন ভারতীয়, সে বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। ২০১৭ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত এক সমীক্ষায় ভারতে রূপান্তরকামী মানুষের সংখ্যা ৪.৮৮ লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৪ সালের ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (নালসা) বনাম ভারত যুক্তরাষ্ট্র মামলায় এক ঐতিহাসিক রায়ে “তৃতীয় লিঙ্গ”-কে স্বীকৃতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট, একইসঙ্গে তাঁদের আত্ম-নির্দিষ্ট পরিচিতির অধিকারও স্বীকার করে নেওয়া হয়। শীর্ষ আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয় রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে। পাঁচ বছর পর, ২০১৯ সালের রূপান্তরকামী ব্যক্তিবর্গ (অধিকার রক্ষা) আইনে আবারও জোর দিয়ে বলা হয় যে রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচার, হরমোন থেরাপি, এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো জরুরি এবং সর্বাঙ্গীণ পরিষেবা প্রদান করা সরকারেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

PHOTO • Ekta Sonawane

জন্মের সময়ে নারী হিসেবে চিহ্নিত সুমিতের জন্ম হয় হরিয়ানার রোহতক জেলায়। সুমিতের মনে পড়ে, তিন বছর বয়সেও ফ্রক পরতে অস্বস্তি এবং উদ্বেগ বোধ হত তাঁর

এইসব আইনি পরিবর্তনের আগে বহু রূপান্তরকামী মানুষই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে (একে লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচার বলা হয়) লিঙ্গপরিচয় বদলে নেওয়ার সুযোগ পাননি কোনওদিন – যার মধ্যে মুখমণ্ডলের অস্ত্রোপচার, এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ বা নিম্নাঙ্গের অস্ত্রোপচার থাকতে পারে।

সুমিতও তাঁদের মধ্যে একজন। দীর্ঘ আট বছর ধরে এইধরনের অস্ত্রোপচার তাঁর কাছে অধরা ছিল; ২০১৯ সালের পরেও বেশ কিছুদিন এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

হরিয়ানার রোহতক জেলার এক দলিত পরিবারের সন্তান সুমিত অল্প বয়স থেকেই ছোটো তিন ভাইবোনকে বাবা-মায়ের মতো করে মানুষ করেছেন। সুমিতের বাবা পরিবারের প্রথম সরকারি চাকুরে, তিনি বেশিরভাগ সময়েই দূরে থাকতেন। বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। দাদু-ঠাকুমা দিনমজুরি করতেন; সুমিত যখন খুব ছোটো দু’জনেই মারা যান। সংসারের যে পাহাড়প্রমাণ দায়িত্ব সুমিতের ঘাড়ে এসে পড়েছিল সেটাকে লোকে বাড়ির বড়ো মেয়ে হিসেবে তাঁর স্বাভাবিক দায়িত্ব হিসেবেই দেখত। কিন্তু সেটা সুমিতের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে কোনওদিন খাপ খায়নি। “আমি এই সব দায়িত্ব পালন করেছি পুরুষ হিসেবে,” বলছেন তিনি।

সুমিতের যখন মাত্র তিন বছর বয়স, তখন থেকেই ফ্রক পরতে উদ্বেগ এবং অস্বস্তি হত, মনে পড়ে তাঁর। হরিয়ানায় খেলার একটা মজবুত পরিসর ছিল বলে তাও কিছুটা স্বস্তি মিলত; মেয়েদের পক্ষে এ রাজ্যে পুরুষালি বা লিঙ্গচিহ্নবর্জিত পোশাক পরা অনেকটাই স্বাভাবিক। “ছোটোবেলায় যা ইচ্ছে হত তাই পরতাম। [ঊর্ধ্বাঙ্গের] অস্ত্রোপচারের আগেই আমি পুরুষ হিসেবে জীবনযাপন করতে শুরু করেছি,” বলছেন সুমিত। কিন্তু তাও একটা অস্বস্তি থেকেই গেছিল।

বছর ১৩ বয়স থেকে ভিতরে ভিতরে তিনি নিজেকে যেভাবে দেখেন – ছেলে হিসেবে – তার সঙ্গে নিজের শরীরকে মিলিয়ে নেওয়ার একটা প্রবল তাগিদ দেখা দেয় সুমিতের মধ্যে। “আমার গড়ন রোগাপাতলা, বুকে বিশেষ মাংসও ছিল না। কিন্তু আমায় চরম অস্বস্তিতে ফেলতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল,” বলছেন তিনি। এই অস্বস্তিটুকু ছাড়া সুমিতের হাতের কাছে আর কোনও তথ্য ছিল না যা দিয়ে তিনি এই জেন্ডার ডিসফোরিয়া বা জৈবিক লিঙ্গ এবং অনুভূত লিঙ্গপরিচয় না মেলার কারণে তৈরি হওয়া অস্বস্তির ব্যাখ্যা করতে পারেন।

সাহায্যের হাত বাড়ান এক বন্ধু।

সুমিত তখন পরিবারের সঙ্গে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, এবং বাড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর। সেই বন্ধুর ইন্টারনেট ছিল, এবং তিনিই সুমিতকে সাহায্য করেন স্তনের যে অস্ত্রোপচার সুমিত করাতে চাইছিলেন সে সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে। ধীরে ধীরে স্কুলের অন্যান্য রূপান্তরকামী ছেলেদের সঙ্গেও আলাপ হয় সুমিতের, যারা কম-বেশি সবাই ডিসফোরিয়ার শিকার। গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। আগামী কয়েকবছরে কিশোর সুমিত অনলাইনে এবং বন্ধুদের থেকে এই বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারেন, এবং অবশেষে সাহসে ভর করে একদিন হাজির হন হাসপাতালে।

সালটা ২০১৪। ১৮ বছরের সুমিত সদ্য বাড়ির কাছেই একটি মেয়েদের স্কুল থেকে ১২ ক্লাস পাশ করেছেন। বাবা কাজে বেরিয়েছিলেন, মাও বাড়িতে ছিলেন না। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না, পাশে দাঁড়ানোরও কেউ ছিল না সেদিন। একাই হেঁটে হেঁটে রোহতক জেলা হাসপাতালে গিয়ে আমতা আমতা করে স্তন বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার সম্পর্কে জানতে চান তিনি।

PHOTO • Ekta Sonawane

রূপান্তরকামী পুরুষদের জন্য বিকল্প আরও কম। তাঁদের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচার করতে গেলে একাধিক সুদক্ষ ডাক্তারের প্রয়োজন – স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, মূত্ররোগ বিশেষজ্ঞ, প্লাস্টিক সার্জন প্রমুখ

যে উত্তর তিনি পেলেন, সেটা অনেক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।

তাঁকে বলা হল, স্তন বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার তিনি করাতে পারেন বটে, কিন্তু সেটা শুধু আগুনে পোড়া রোগী হিসেবে। সরকারি হাসপাতালগুলিতে যেসব অস্ত্রোপচারে প্লাস্টিক সার্জারি দরকার হয় সেগুলিকে বার্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘুরিয়ে আনা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়; পথ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও এটা করা হয়। কিন্তু সুমিতকে বলা হয়েছিল সরাসরি কাগজকলমে মিথ্যা বলে হাসপাতালে পুড়ে যাওয়া রোগী হিসেবে ভর্তি হতে, এবং সেখানে তিনি আসলে যে অস্ত্রোপচারটি করাতে চান তার কোনও উল্লেখ থাকবে না। তাঁকে এটাও বলা হয়েছিল যে এটা করাতে কোনও টাকাপয়সা লাগবে না – কিন্তু সরকারি হাসপাতালে স্তন বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার বা পুড়ে যাওয়া-সংক্রান্ত অস্ত্রোপচারের টাকা মকুব করার কোনও নিয়ম নেই।

হাসপাতালের কথায় সুমিত ভরসা পেয়েছিলেন অনেকটাই। কিন্তু আগামী প্রায় দেড় বছর ধরে হাসপাতালে যাতায়াত করতে করতে তিনি বুঝতে পারেন এই চিকিৎসার একটা গোপন খরচ আছে – সেটা মানসিক।

“[ওখানকার] ডাক্তাররা ভীষণ নাক শিঁটকোতেন। বলতেন আমার মাথা খারাপ, জিজ্ঞেস করতেন, ‘অস্ত্রোপচার করানোর কী দরকার?’ বলতেন ‘এইভাবেই তো যে কোনও মেয়ের সঙ্গে থেকে যেতে পারো।’ ছয়-সাত জন মিলে আমায় একসঙ্গে সওয়াল করতেন, আমার ভীষণ ভয় করত,” মনে করছেন সুমিত।

“মনে পড়ে, ৫০০-৭০০টা প্রশ্নসমেত ফর্ম ভরতে হয়েছে অন্তত দু-তিন বার।” প্রশ্নের বিষয় ছিল রোগীর চিকিৎসা এবং পারিবারিক ইতিহাস, মানসিক অবস্থা, কোনও ধরনের মাদকাসক্তি আছে কিনা, থাকলে কী ধরনের ইত্যাদি। কিন্তু কিশোর সুমিতের কাছে এইসব তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার ফিকির বলেই মনে হয়েছিল। “ওঁরা এটুকু মানতে রাজি ছিলেন না যে আমি আমার শরীরে খুশি নই, তাই আমার ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচার দরকার,” বলছেন সুমিত।

সহমর্মিতার অভাব ছাড়াও ভারতের রূপান্তরকামী মানুষদের কাছে একটা অন্যতম বাধা ছিল – এবং এখনও অনেকটাই আছে – লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচারগুলির জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দক্ষতার অভাব।

পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরের অস্ত্রোপচারে মূলত দুটি বড়ো অস্ত্রোপচার হয় (স্তন এবং যোনি বসানো – ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট এবং ভ্যাজিনোপ্লাস্টি)। কিন্তু নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটা অনেক বেশি জটিল এবং এক্ষেত্রে সাতটি বড়োসড়ো অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। এর প্রথমটি হল ঊর্ধ্বাঙ্গ বা ‘টপ’ সার্জারি যেখানে স্তন বাদ দেওয়া এবং বুকের অংশ পুনর্নির্মাণ করা হয়।

“আমি যখন ছাত্র ছিলাম [২০১২ নাগাদ] তখন [ডাক্তারি] পাঠ্যক্রমে এইধরনের অস্ত্রোপচারের উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। প্লাস্টিক সার্জারির পাঠ্যক্রমে শিশ্ন পুনর্গঠন অস্ত্রোপচারের কিছু উল্লেখ ছিল, [কিন্তু] মূলত আঘাত বা দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে। এখন সময় বদলে গেছে,” বলছেন ড. ভীম সিং নন্দা, নয়াদিল্লির স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি দপ্তরের উপ-প্রধান।

PHOTO • Ekta Sonawane

২০১৯ সালের রূপান্তরকামী ব্যক্তিবর্গ আইন ডাক্তারি পাঠ্যক্রমের পুনর্মূল্যায়ন এবং রূপান্তরকামী মানুষদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণার উপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু তারপর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেলেও সরকারের তরফে ভারতের রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচার সহজলভ্য এবং সস্তা করার কোনও বড়ো মাত্রার উদ্যোগ দেখা যায়নি

২০১৯ রূপান্তরকামী ব্যক্তিবর্গ আইন এক্ষেত্রে একটা ঐতিহাসিক মাইলফলক, যা ডাক্তারি পাঠ্যক্রমের পুনর্মূল্যায়ন এবং রূপান্তরকামী মানুষদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণার উপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু তারপর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেলেও সরকারের তরফে ভারতের রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচার সহজলভ্য এবং সস্তা করার কোনও বড়ো মাত্রার উদ্যোগ দেখা যায়নি। সরকারি হাসপাতালগুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচার থেকে দূরেই থেকেছে।

রূপান্তরকামী পুরুষদের জন্য বিকল্প আরও কম। তাঁদের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-রূপান্তর অস্ত্রোপচার করতে গেলে একাধিক সুদক্ষ ডাক্তারের প্রয়োজন – স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, মূত্ররোগ বিশেষজ্ঞ, প্লাস্টিক সার্জন প্রমুখ। “এই ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং দক্ষতা আছে এমন শল্যচিকিৎসকের সংখ্যা খুব কম, আর সরকারি হাসপাতালগুলোতে তো আরোই কম,” বলছেন তেলেঙ্গানা হিজরা ইন্টারসেক্স ট্রান্সজেন্ডার সমিতির সদস্য রূপান্তরকামী পুরুষ কার্তিক বিট্টু কোন্ডিয়া।

রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার হালও তথৈবচ। রোজকার জীবনের নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্সেলিং যে কোনও লিঙ্গ-স্বীকৃতি প্রক্রিয়া শুরু আগে একটি আইনি শর্তও বটে। এই অস্ত্রোপচারের জন্য যোগ্যতা প্রমাণ করতে কোনও মনোচিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের থেকে লিঙ্গ পরিচয়-সংক্রান্ত অসুস্থতার মানপত্র জোগাড় করতে হয় রূপান্তরকামী মানুষদের। মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে সচেতন ও সজ্ঞান সম্মতি, নির্বাচিত লিঙ্গপরিচয়ে জীবনধারণের সময়কাল, লিঙ্গ ডিসফোরিয়ার মাত্রা, বয়সজনিত প্রমাণপত্র, এবং রূপান্তরকামী ব্যক্তি মানসিকভাবে প্রকৃতিস্থ প্রমাণ করার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা। মনোচিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সপ্তাহে একবার করে কমপক্ষে একটি সেশন থেকে সর্বোচ্চ চারটি সেশন পর্যন্ত লাগতে পারে এই প্রক্রিয়ায়।

২০১৪ সালের সুপ্রিম কোর্ট রায়ের এক দশক পরে ভারতের রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর সবাই মনে করেন যে সহমর্মী মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ভীষণ জরুরি – সে দৈনন্দিন জীবনের মোকাবিলার জন্যই হোক কী লিঙ্গ রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য। কিন্তু যা দরকার তার কণামাত্রও কাজ হয়নি।

“জেলা হাসপাতালে আমার ঊর্ধ্বাঙ্গ অস্ত্রোপচারের জন্য কাউন্সেলিং চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে,” জানালেন সুমিত। অবশেষে ২০১৬ সালের কোনও একটা সময়ে তিনি যাওয়া বন্ধ করে দেন। “একটা সময়ের পর স্রেফ ক্লান্তি চলে আসে।”

তাঁর ক্লান্তি জয় করে নেয় নিজের লিঙ্গ পরিচিতির স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। সুমিত স্থির করেন, এবার তিনি নিজেই গবেষণা শুরু করবেন – তাঁর অনুভূতি, এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আর কে কে যায়, লিঙ্গ-স্বীকৃতি অস্ত্রোপচারে ঠিক কী কী হয়, এবং ভারতে কোথায় সেটা তিনি করাতে পারেন – এইসব বিষয়ে।

এই সবকিছুই চলে গোপনে, যেহেতু তিনি তখনও বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন। মেহেন্দি শিল্পী এবং দর্জি হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি, এবং উপার্জন থেকে একটু একটু করে টাকা জমাতে শুরু করেন অস্ত্রোপচারের জন্য।

PHOTO • Ekta Sonawane
PHOTO • Ekta Sonawane

তিনটে চাকরি করেও দিন গুজরান করা কঠিন সুমিতের। নিয়মিত কাজ পান না, আর এখনও ৯০,০০০ টাকার ঋণশোধ করা বাকি

২০২২ সালে সুমিত আর একবার চেষ্টা করেন, ১০০ কিলোমিটার উজিয়ে রোহতক থেকে হরিয়ানার হিসার জেলায় যান আর এক রূপান্তরকামী পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে। যে বেসরকারি মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখান তিনি দুই সেশনে কাউন্সেলিং শেষ করেন, ২৩০০ টাকা ফি নেন, এবং সুমিতকে জানান তিনি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচার করাতে পারবেন।

হিসারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চার দিন ভর্তি ছিলেন, অস্ত্রোপচার এবং থাকা মিলিয়ে খরচ পড়ে প্রায় এক লক্ষ টাকা। “ডাক্তার এবং অন্য কর্মীরা অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করেছিলেন। সরকারি হাসপাতালে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার থেকে এটা একদম আলাদা ছিল।”

কিন্তু এই আনন্দ নেহাতই ক্ষণস্থায়ী ছিল।

রোহতকের মতো ছোটো শহরে ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচার প্রায় সমকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সামিল। সুমিতের গুপ্তকথা আর গোপন ছিল না, আর তাঁর পরিবার সেটা মেনে নিতে পারেনি। অস্ত্রোপচারের দিন কয়েক পর বাড়ি ফিরে সুমিত দেখেন তাঁর জিনিসপত্র সব বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। “আমার পরিবার আমায় স্রেফ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে, কোনওরকম আর্থিক বা মানসিক সাহায্য ছাড়াই। আমার অবস্থা নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না।” ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচারের পরেও আইনিভাবে সুমিত একজন নারীই ছিলেন, কিন্তু সম্পত্তির বাঁটোয়ারা নিয়ে নানান কথা হতে শুরু করে। “কেউ কেউ এটাও বলতে শুরু করে যে আমার চাকরি নেওয়া উচিত, পুরুষের কর্তব্য পালন করা উচিত।”

অস্ত্রোপচারের পর রোগীদের বলা হয় কয়েকমাস বিশ্রামে থাকতে, সম্ভব হলে হাসপাতালের কাছাকাছি থাকতে যাতে কোনও জটিলতা দেখা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এতে রূপান্তরকামী মানুষদের উপর আর্থিক এবং পরিকাঠামোগত বোঝা আরও বাড়ে, বিশেষ করে যাঁরা গরিব এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। প্রতিবার হিসার যেতে-আসতে সুমিতের ৭০০ টাকা আর তিন ঘণ্টা ব্যয় হত। অন্তত দশ বার এটা করতে হয়েছে তাঁকে।

ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচারের পর বাইন্ডার বা আঁটোসাঁটো পোশাক দিয়ে বুক বেঁধে রাখতে বলা হয়। “ভারতের মতো গরম দেশে, যেখানে বেশিরভাগ রোগীর বাড়িতে এসি থাকে না, বেশিরভাগ লোকে শীতকালে অস্ত্রোপচার করাতে হয়,” বলছেন ড. ভীম সিং নন্দা। ঘামের কারণে অস্ত্রোপচারের সেলাইতে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে।

সুমিতের অস্ত্রোপচার এবং তারপর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ঘটেছিল মে মাসের প্রখর গরমে। “[পরের কিছু সপ্তাহ] ভীষণ যন্ত্রণায় ছিলাম, মনে হত কেউ যেন হাড় খুলে নিয়েছে। বাইন্ডারের কারণে চলাফেরায় খুব অসুবিধা হত,” মনে করছেন সুমিত। “রূপান্তরকামী পরিচয় না লুকিয়ে একটা বাড়ি ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পর পর ছয় জন বাড়িওয়ালা না করে দিল। অস্ত্রোপচারের পর এক মাসও বিশ্রাম নিতে পারিনি,” বলছেন সুমিত। সার্জারির নয় দিন পর এবং বাবা-মা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চার দিন পর সুমিত অবশেষে দুই কামরার একটা বাড়ি ভাড়া নিতে সক্ষম হন নিজের লিঙ্গপরিচয় না লুকিয়ে।

সুমিত এখন মেহেন্দি শিল্পী, দর্জির কাজের পাশাপাশি একটা চায়ের দোকানে সহকারীর কাজ এবং রোহতকে কায়িক শ্রমনির্ভর নানা কাজ করেন। মাসের শেষে ৫-৭০০০ টাকা মতো যে আয় হয় তাতে দিন চলে কোনওমতে, বেশিরভাগটাই চলে যায় ভাড়া, খাবার খরচ, গ্যাস আর বিজলির বিল এবং ঋণ শোধ করতে।

ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচার করাতে যে এক লক্ষ টাকা সুমিত খরচ করেছিলেন তার মধ্যে ৩০,০০০ টাকা এসেছিল ২০১৬-২০২২ সালের সঞ্চয় থেকে; বাকি ৭০,০০০ টাকা কিছু বন্ধুবান্ধব এবং বিভিন্ন মহাজনের থেকে ৫% সুদের হারে ধার করেছিলেন।

PHOTO • Ekta Sonawane
PHOTO • Ekta Sonawane

বাঁদিকে: টপ সার্জারি বা ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচার করানোর জন্য টাকা জমাতে মেহেন্দি শিল্পী এবং দর্জি হিসেবে কাজ করতেন সুমিত। ডানদিকে: বাড়িতে মেহেন্দির নকশা অনুশীলন করছেন সুমিত

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সুমিতের ৯০,০০০ টাকা দেনা রয়েছে, প্রতি মাসে ৪,০০০ টাকা করে সুদ জমে। “যেটুকু টাকা আয় করি তাতে বাঁচব কেমন করে, আর ধারই বা শুধব কেমন করে, বুঝে পাই না। নিয়মিত কাজও পাই না,” হিসেব করে বলেন সুমিত। রূপান্তরের জন্য তাঁর প্রায় এক দশকের এই দুর্গম, একাকী, এবং প্রবল খরচসাপেক্ষ যাত্রা ছাপ ফেলেছে তাঁর শরীরে। বাসা বেঁধেছে নিদ্রাহীনতা আর মানসিক উদ্বেগ। “আজকাল দমবন্ধ হয়ে আসে। যখনই বাড়িতে একা থাকি, ভীষণ ভয় করে, একা লাগে। আগে এরকম ছিলাম না।”

বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার বছরখানেক পর আবার তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছে তাঁর পরিবার। মাঝেমাঝে অর্থসাহায্যও আসে, যদি সুমিত চান।

সুমিত খোলাখুলি নিজেকে রূপান্তরকামী পুরুষ হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন না এখনও – ভারতে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সেটা এখনও বিলাসিতা, দলিতের কাছে তো বটেই। তাঁর ভয় করে কেউ ধরে ফেলবে, তাঁকে ‘আসল পুরুষ’ বলে মানতে চাইবে না। স্তন না থাকায় খুচরো-খাচরা কায়িক শ্রমের কাজ নিতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য প্রকাশ্য পুরুষালি চিহ্ন তাঁর নেই, যেমন গোঁফদাড়ি, বা গভীর কণ্ঠস্বর – যে কারণে প্রায়ই অন্য লোকে তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখে। সন্দেহের উদ্রেক করে তাঁর জন্মগত নামও, যা এখনও আইনিভাবে পরিবর্তন করতে পারেননি তিনি।

হরমোন প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার জন্য এখনও প্রস্তুত নন তিনি; পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে দ্বিধা আছে তাঁর। “তবে আর্থিকভাবে একটু স্থিরতা হলে করে নেব,” জানালেন সুমিত।

এক পা এক পা করে এগোনোই ভালো, মনে করেন তিনি।

ঊর্ধ্বাঙ্গের অস্ত্রোপচারের ছয় মাস পর কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকে রূপান্তরকামী পুরুষ হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন সুমিত, যা থেকে একটা জাতীয় স্তরে স্বীকৃত রূপান্তরকামী মানপত্র এবং পরিচয়পত্রও পাওয়া যায়। সুমিতের কাছে বর্তমানে প্রাপ্য সুযোগসুবিধার মধ্যে অন্যতম হল স্মাইল বা সাপোর্ট ফর মার্জিনালাইজড ইন্ডিভিজুয়ালস ফর লাইভলিহুড অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজ নামে একটি যোজনা। ভারতের আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্যবিমা যোজনার অধীনে রূপান্তরকামী মানুষদের লিঙ্গ-স্বীকৃতি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয় এই যোজনা।

“পুরোপুরি রূপান্তরিত হতে আর কী কী সার্জারি লাগবে আমি এখনও জানি না,” বলছেন সুমিত। “ধীরে ধীরে সব করব। সব নথিপত্রে নামও বদলে নেব। এ তো সবে শুরু।”

এই প্রতিবেদনটি একটি সর্বভারতীয় সাংবাদিকতা প্রকল্পের অংশ যেখানে ভারতে যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক হিংসার শিকার মানুষদের যথাযথ যত্ন ও সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সামাজিক, প্রশাসনিক, এবং কাঠামোগত বাধাগুলির উপর আলোকপাত করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস, ইন্ডিয়া’র সহায়তাপ্রাপ্ত একটি উদ্যোগ।

গোপনীয়তা বজায় রাখতে যাঁরা হিংসার শিকার তথা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম বদলে দেওয়া হয়েছে।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Ekta Sonawane

Ekta Sonawane is an independent journalist. She writes and reports at the intersection of caste, class and gender.

Other stories by Ekta Sonawane
Editor : Pallavi Prasad

Pallavi Prasad is a Mumbai-based independent journalist, a Young India Fellow and a graduate in English Literature from Lady Shri Ram College. She writes on gender, culture and health.

Other stories by Pallavi Prasad
Series Editor : Anubha Bhonsle

Anubha Bhonsle is a 2015 PARI fellow, an independent journalist, an ICFJ Knight Fellow, and the author of 'Mother, Where’s My Country?', a book about the troubled history of Manipur and the impact of the Armed Forces Special Powers Act.

Other stories by Anubha Bhonsle
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee