“লকডাউন আমাদের শেষ করে দিয়েছে,” বললেন আব্দুল মাজিদ ভাট। “আমার দোকানে শেষবার পর্যটকের পা পড়েছিল সেই মার্চ মাসে।”

শ্রীনগরের ডাল লেকে তিনটে দোকান চালান ভাট – চামড়ার জিনিস আর স্থানীয় হস্তশিল্পের। জুন মাসে লকডাউন শিথিল হওয়ার পরেও কোনও খদ্দের আসেনি দোকানে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পর থেকে যে কঠোর মন্দা শুরু হয়েছিল তার প্রায় একবছর হতে চলল।

পর্যটনের ওপর উভয়ের প্রভাবই সাংঘাতিক। ভাটের মতো অনেকেই তাঁদের রোজগারের জন্য পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।

ছয়-সাত মাস সব বন্ধ থাকার পর যেই না পর্যটনের মরশুম শুরু হচ্ছিল, ওমনি এই করোনা লকডাউন শুরু হয়ে গেল, বললেন ৬২ বছর বয়সী ভাট, ডাল লেকের বাটাপোরা কালান অঞ্চলের বাসিন্দা এবং এই অঞ্চলের সম্মানিত বয়স্ক ব্যক্তি। লেকসাইড পর্যটক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিও তিনি। তাঁর আন্দাজ অনুযায়ী এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ৭০।

শ্রীনগরের আরও অনেকে যাঁরা এই লেকের পর্যটন অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল তাঁদের মুখেও শোনা যাচ্ছে একই কথা – হলুদ রঙের নৌকো ট্যাক্সির চালক শিকারাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, দোকানের মালিক – গত ১২ মাস এঁদের কাছে অন্তত পর্যটন পুস্তিকায় দেখতে পাওয়া ছবির মতো ডাল লেকের চিত্র ছিল না। (দেখুন: শ্রীনগরের শিকারা - নিথর জলে ক্ষতির ঘন ছায়া ) ।

এঁদের মধ্যে রয়েছেন ২৭ বছর বয়সী, নেহরু পার্কের বাসিন্দা হাফসা ভাট যে করোনা ভাইরাস লকডাউন শুরু হওয়ার আগে বাড়ি থেকে একটা ছোটো ব্যবসা শুরু করেছিল। জম্মু ও কাশ্মীর এন্ট্রেপ্রেনিওরশিপ ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট থেকে ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর শ্রীনগরের একটা স্কুলের শিক্ষক হাফসা এই ইন্সটিটিউট থেকেই স্বল্প সুদে ৪ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছিলেন। “আমি জামা কাপড়ের স্টক কিনেছিলাম। লকডাউন যখন ঘোষণা হল তখন আমি সেই স্টকের মাত্র ১০–২০% বিক্রি করতে পেরেছিলাম। এখন আমার ধারের কিস্তি মেটাতে খুব অসুবিধে হচ্ছে,” তিনি জানান।

'Just when the tourist season was to start after that shutdown, this lockdown started', says Majid Bhat, president of the Lakeside Tourist Traders Association
PHOTO • Adil Rashid
'Just when the tourist season was to start after that shutdown, this lockdown started', says Majid Bhat, president of the Lakeside Tourist Traders Association
PHOTO • Adil Rashid

'যেই না পর্যটনের মরশুম শুরু হচ্ছিল, ওমনি এই লকডাউন শুরু হয়ে গেল,' জানালেন লেকসাইড পর্যটক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাজিদ ভাট

ডাল লেকের ১৮ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলের অনেকগুলি দ্বীপের মধ্যে একটি হল নেহরু পার্ক। সেই নেহরু পার্ক অঞ্চলেরই আরেক বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী আব্দুল রাজ্জাক দার। তিনি শ্রীনগরের ব্যুলেভার্ড রোডের পাশে একটা ঘাট থেকে শিকারা চালান। “কোনোদিন এত খারাপ অবস্থা দেখিনি,” তিনি বললেন।

“পর্যটন ব্যবসার যেটুকু ছিল, করোনা লকডাউন সেটাকে শেষ করে দিয়েছে,” তিনি যোগ করলেন। “আমরা পিছনের দিকে যাচ্ছি। গত বছরের থেকে এ বছরের অবস্থা আরও খারাপ। আমার পরিবারের ৪ জন শিকারার ওপর নির্ভরশীল। আমরা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। আগে একবারে যা খেতাম, এখন সেটাই তিনবারে খাচ্ছি। শিকারাওয়ালা না খেলে শিকারা চলবে কেমন করে?”

তাঁর পাশে বসে আছেন নেহরু পার্কের আবি কারাপোরা মহল্লার ওয়ালি মহম্মদ ভাট। বয়স ষাটের ঘরে। তিনি বললেন, “আমাদের সবার জন্য এই বছরটা খুবই দুর্ভোগের। গতবছর ৩৭০ ধারা বাতিল করার আগে একটা নির্দেশিকা দিয়ে ওরা সব পর্যটকদের বের করে দিল আর এখানে সব বন্ধ হয়ে গেল। তারপর এল করোনা ভাইরাসের লকডাউন আর সেটা আমাদের পুরো ধ্বংস করে দিয়েছে।” অল জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ট্যাক্সি শিকারা ওনার্‌স অ্যাসোসিয়েশানের সভাপতি ভাট জানাচ্ছেন যে এই সংগঠনের আওতায় রয়েছে ডাল এবং নিগীন লেকের ছোটো-বড়ো মিলিয়ে ৩৫টি ঘাট এবং ৪,০০০ জন শিকারাওয়ালা।

তাঁর হিসেব অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ হবে কোটির ঘরে। মরশুমের সবথেকে ব্যস্ত সময়ে তাঁর সমিতির একেক জন সদস্য দিনে ১৫০০–২০০০ টাকা আয় করতেন। “চার মাসের মরশুমে [এপ্রিল–মে থেকে আগস্ট–সেপ্টেম্বর] গোটা বছর চালানোর মত টাকা উপার্জন করত শিকারাওয়ালা এবং এই করোনা ভাইরাস লকডাউন সেটা কেড়ে নিয়েছে। বিয়ে হোক বা অন্য কোনো খরচ, সবই নির্ভর করত এই [পর্যটন] মরশুমের রোজগারের ওপর।”

এই মন্দার মাসগুলোতে ক্ষতির বোঝা কিছুটা কমানোর জন্য শিকারাওয়ালাদের কয়েকটি পরিবার দিন মজুরের কাজ করছে। যেমন করছেন আব্দুল রাজ্জাক দারের দুই ছেলে, দুজনেরই বয়স চল্লিশের কোঠায়। “ওরাও শিকারাওয়ালা ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি দেখার পর আমি ওদের আগাছা তোলার কাজে যোগ দিতে বললাম,” জানালেন দার।

জম্মু ও কাশ্মীরের লেক এবং জলপথ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে চলা কাজের কথা বলছেন তিনি। মরশুম অনুযায়ী আগাছা তোলার কাজ পাওয়া যায়। শিকারা যখন নিয়মিতভাবে চলে না, তখন আগাছা গজিয়ে ওঠে। আগাছা তোলার জন্য যন্ত্রও ব্যবহার করা হয়, আবার অনেক সময় স্থানীয় ঠিকাদারদের মাধ্যমে মজুরদের নিয়োগ করা হয়।

PHOTO • Adil Rashid

‘পর্যটন ব্যবসার যতটুকু বাকি ছিল, করোনা লকডাউন সেটাকে শেষ করে দিয়েছে,’ বললেন আব্দুল রাজ্জাক দার (ওপরে, বাঁদিকে)। ওয়ালি মহম্মদ ভাট (ওপরে ডানদিকে) এবং মহম্মদ শাফি শাহ (নিচে, বাঁদিকে) বলছেন যে গতবছর ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পর পর্যটকদের চলে যাওয়ার নির্দেশিকা এবং তারপর করোনা লকডাউন – দুটোই সাংঘাতিক

জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে এই কাজই করছেন ডাল লেকের নেহরু পার্কের বাসিন্দা শাব্বির আহমেদ ভাট। বয়স ৩২। গ্রীষ্মকালে চার মাস লাদাখে একটা শাল ও কাশ্মীরি হস্তশিল্পের দোকান চালাতেন শাব্বির। মাসে আয় ছিল প্রায় ৩০,০০০ টাকা। শীতকালে তিনি একই জিনিস বিক্রি করার জন্য গোয়া বা কেরল যেতেন। মার্চ মাসের ২২ তারিখ যখন লকডাউন ঘোষণা হল, তখন তাঁকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। মাসের পর মাস কোনো কাজ না থাকার পর তিনি তাঁর ভাই ২৮ বছর বয়সী শৌকত আহমেদের সঙ্গে লেকে আগাছা তোলার কাজে যুক্ত হন।

“আমরা ডাল লেকে চার চিনারির কাছ থেকে আগাছা তুলে সেটা রাস্তার ধারে নিয়ে যাই যেখান থেকে সেগুলো ট্রাক-বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয়,” বললেন শাব্বির। “একেকবারের জন্য আমাদের দেওয়া হয় দুজনের ৬০০ টাকা। তার মধ্যে ২০০ টাকা হল বড় কার্গো নৌকোর ভাড়া। আগাছা বয়ে নিয়ে কতগুলো ট্রিপ করতে পারব সেটা আমাদের ওপরেই নির্ভর করে, কিন্তু সাধারণত দুটোর বেশি করা যায় না। জল থেকে আগাছা তোলা খুব কষ্টসাধ্য কাজ। আমরা ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি, আন্দাজ ৬টা নাগাদ, আর দুপুর একটার মধ্যে ফিরে আসি। আমরা দুটো ট্রিপ করার চেষ্টা করি যাতে একটু টাকা উপার্জন হয়।”

এর আগে, বললেন শাব্বির, তিনি কখনো এরকম শারীরিক শ্রমের কাজ করেননি। তাঁর পরিবার লেকের দ্বীপগুলিতে ছড়ানো ছেটানো কিছুটা চাষের জমির মালিক। কিন্তু যে সামান্য ফসল হয় তার দেখভাল করেন তাঁর মা-বাবা এবং ভাইদের মধ্যে একজন।

“লকডাউন শুরু হওয়ার পর অনেক দিন আমরা কোনো কাজ করিনি,” বললেন শাব্বির। “যখন জীবিকা অর্জনের আর কোনো উপায় ছিল না তখন আমি ডাল লেকে এই আগাছা তোলার কাজ শুরু করলাম। এই কায়িক শ্রমের থেকে পর্যটন ব্যবসাই আমরা বেশি পছন্দ করি কারণ সারা জীবন সেই কাজই আমরা করে এসেছি। কিন্তু পর্যটন না থাকায় এটাই ছিল আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। এখন যদি সংসারের খরচ চালাতে পারি, সেটাই অনেক।”

শাব্বির বলছেন যে সংসারের খরচ অর্ধেক করে দিতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে। “আমাদের স্টক [শাল, চামড়ার ব্যাগ আর জ্যাকেট, কস্টিউম গয়না এবং অন্যান্য সামগ্রী] আমরা ব্যবহার করতে পারছি না – কেউ আমাদের দেখে কিনবে না, আর এই মুহূর্তে এটার কোনো মূল্যই নেই। তাছাড়া আমাদের অনেক দেনা আছে [বিশেষ করে ধারে কেনা স্টকের]।”

'In Dal, except tourism, we can't do much,' says Shabbir Ahmad (sitting on the right), now working on the lake’s de-weeding project with his brother Showkat Ahmad
PHOTO • Adil Rashid
'In Dal, except tourism, we can't do much,' says Shabbir Ahmad (sitting on the right), now working on the lake’s de-weeding project with his brother Showkat Ahmad
PHOTO • Adil Rashid

“ডাল লেকে পর্যটন ছাড়া, আর বেশি কিছু আমরা করতে পারি না,” বললেন শাব্বির আহমেদ (ডানদিকে) যিনি এখন তাঁর ভাই শৌকত আহমেদের (বাঁদিকে) সঙ্গে লেকে আগাছা তোলার কাজ করছেন

শাব্বির চান ডাল লেকে বসবাসকারী মানুষদের সমস্যার কথা সরকার বুঝুক। “এখানে এসে একটা সমীক্ষা করলে ওরা অসুবিধেগুলো বুঝতে পারবে। অনেক পরিবার রয়েছে যাদের হাতে কোনো কাজ নেই। বহু পরিবারে কোনো অসুস্থ সদস্য আছে বা এমন কেউ নেই যে রোজগার করতে পারবে। যদি সরকার এখানে এসে এই সব মানুষের অবস্থা থেকে তাদের রেহাই দিতে পারে, অর্থ সাহায্য করতে পারে, তাহলে সেটা খুবই স্বস্তির বিষয় হবে।”

ডাল লেকের বাসিন্দাদের সঙ্গে শ্রীনগর শহরের বাসিন্দাদের তুলনা টেনে তিনি বলছেন যে শহরে সুযোগ আরেকটু বেশি। “ডাল লেকে, পর্যটন ছাড়া, আর বেশি কিছু আমরা করতে পারি না। খুব বেশি হলে সবজি বেচতে পারি [নৌকো করে, একটা দ্বীপ মহল্লা থেকে আরেকটা দ্বীপ মহল্লায় গিয়ে]। শহরের মানুষ যেসব চাকরি পায়, আমরা সেগুলো করতে পারি না। বা ঠেলা লাগিয়ে জিনিস বিক্রি করতে পারি না। যদি আবার পর্যটন শুরু হয়, তখন আমাদের কাজ থাকবে, কিন্তু আপাতত আমরা খুবই মুশকিলের মধ্যে আছি।”

নৌকো করে গিয়ে তরকারি বেচার কাজও সহজে করা যায়নি। ২১ বছর বয়সী আন্দলীব ফায়াজ বাবা, বাটাপোরা কালানের স্নাতক স্তরের ছাত্র, বলছেন, “আমার বাবা একজন কৃষক। বাড়ি থেকে বেরোতেই পারছিলেন না বলে তিনি মাসের পর মাস রোজগার করতে পারেননি। সব তরকারি নষ্ট হল। খুব অল্পই তিনি খদ্দেরদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। এর ফলে আমাদের পরিবারে খুবই সমস্যা দেখা দেয় কারণ বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র সদস্য যিনি উপার্জন করেন।” আন্দলীবের ভাই এবং দুই বোন এখনো পড়ুয়া। তার মা বাড়ির কাজে রত। “আমাদের পুরো স্কুলের মাইনে আর আমার কলেজের মাইনেও দিতে হয়েছে। আর যদি হঠাৎ করে কিছু হয়, তাহলে আমাদের তীরে [শ্রীনগর] পৌঁছনোর জন্য গোটা লেক পার হতে হয়।”

যাঁরা শহরে থাকেন কিন্তু লেক পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের জন্যেও এই কয়েক মাস ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীনগরের শালিমার এলাকার বাসিন্দা মহম্মদ শাফি শাহ। যে ঘাটে পর্যটন মরশুমে ১৬ বছর ধরে শিকারা চালিয়ে ভালো দিনগুলিতে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা রোজগার করতেন তিনি, সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এই এলাকা। কিন্তু গতবছর থেকে শিকারাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো পর্যটক পাননি তিনি। “৩৭০ ধারা ওরা বাতিল করার পর থেকে আমাদের হাতে কোনো কাজ নেই আর করোনা ভাইরাস লকডাউনের পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে,” তিনি বললেন।

“আমি ডালেই থাকতাম, কিন্তু সরকার আমাদের সরিয়ে দিয়েছে,” যোগ করলেন তিনি। তিনি বলছেন একটা পুনর্বাসন প্রকল্পের কথা। “আমি রোজ শ্রীনগর থেকে এখানে আসি [অন্য কারো গাড়িতে]। শীতকালে আমি কাজের জন্য বাইরে গিয়ে [গোয়ার সমুদ্র সৈকতে হস্তশিল্পের সামগ্রী বেচতে] লকডাউনের পর ৫০ দিন আটকে ছিলাম আর ব্যবসাও প্রায় কিছু হচ্ছিল না। মে মাসের শেষে আমি ফিরেছি আর এক সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে থেকেছি...”

Left: Andleeb Fayaz Baba's father has been unable to sell vegetables by boat for months. Right: The houseboats have been empty this tourist season
PHOTO • Adil Rashid
Left: Andleeb Fayaz Baba's father has been unable to sell vegetables by boat for months. Right: The houseboats have been empty this tourist season
PHOTO • Adil Rashid

বাঁদিকে: অনেক মাস হয়ে গেল আন্দলীব ফায়াজের বাবা নৌকো করে সবজি বেচতে পারেননি। ডানদিকে: পর্যটনের এই মরশুমে হাউজবোটগুলো ফাঁকাই পড়ে আছে

ডাল লেকের শিকারাওয়ালারা প্রতিটি ঘাটে একটা করে ইউনিয়ন তৈরি করেছেন – এই সবগুলো অল জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ট্যাক্সি শিকারা ওনার্‌স ইউনিয়নের অংশ। একেকটি শিকারার যা উপার্জন হয় সব তাঁরা একত্রিত করেন। তারপর সমস্ত সদস্যদের মধ্যে সেই টাকা সমানভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। শাফি যে ঘাটে কাজ করেন সেখানে প্রায় ১৫টি শিকারা রয়েছে।

“যদি স্থানীয় কেউ আসে, যা প্রায় হয়ই না, আমরা শিকারায় চড়িয়ে তাদের থেকে ৪০০–৫০০ টাকা পাই। সেটা আবার এই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের ১০–১৫ জনের মধ্যে ভাগ হয়। একেকজনের ভাগে পড়ে ৫০ টাকা। তাই দিয়ে আমি কী পাব? শিকারা ছাড়া আর কোনো উপায় আমাদের নেই। সংসার চলবে কী করে? সব ভেঙে পড়বে না?”

শাফি জানালেন যে তিনি শিকারা ট্যাক্সির লাইসেন্স পর্যটন বিভাগে জমা দিয়ে এসেছিলেন কারণ তিনি শুনেছিলেন যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিকারাওয়ালাকে তিন মাসের জন্য মাসিক ১০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি কিছুই পাননি।

ব্যুলেভার্ড রোডের ওপারে, লেকের ভিতর, তাঁর ফাঁকা হাউজবোট ‘অ্যাক্রোপলিসের’ সামনের দিকে হেলান দিয়ে বসে আছেন আব্দুল রাশিদ বাদিয়ারি। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। হাতে তৈরি কাঠের দেওয়াল, নরম সোফা। ছাদে প্রথাগত খতমবন্দ ধাঁচায় খোদাই করা। এক বছরেরও বেশি কোনো পর্যটকের মুখ দেখেনি এই হাউজবোট।

“আঠেরো বছর বয়স হওয়ার পর থেকে আমি হাউজবোট চালাচ্ছি। আমার আগে আমার বাপ-ঠাকুরদা একই কাজ করতেন আর আমি ওনাদের থেকেই এই বোটটা পেয়েছি,” বললেন বাদিয়ারি। “কিন্তু আমাদের জন্য সব বন্ধ, দুটো লকডাউন হওয়ার পর থেকে কোনো খদ্দের আসেনি। আমার শেষ খদ্দের এসেছিল ৩৭০ ধারার আগে। করোনা লকডাউনে আমার বিশেষ করে কিছু হয়নি কারণ আগে থেকেই পর্যটক আসছিল না। সবেতেই ক্ষতি হয়েছে, এমনকি জিনিসটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

বাদিয়ারির পাঁচ সদস্যের পরিবার হাউজবোটে পর্যটক থাকার ভাড়ার ওপর নির্ভর করত। “আমি এক রাতের জন্য ৩০০০ টাকা নিতাম। মরশুমের সময়ে আমার বোট একদম ভর্তি থাকত। হকার আর অন্য ব্যবসায়ীরা আমার হাউজবোটের পর্যটকদের কাছে জিনিস বিক্রি করত আর শিকারাওয়ালারা আমার খদ্দেরদের লেকে ঘুরিয়ে রোজগার করত। সবাই এখন কাজ হারিয়েছে। আমার যা সঞ্চয় ছিল তার থেকে খরচ করছি আর ধারও করেছি।” বাদিয়ারির কাছে একজন কাজ কাজ করতেন – তাঁর কাজ ছিল হাউজবোটের দেখাশোনা করা। কিন্তু মাইনে দিতে না পেরে তাঁকে ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে। “ভবিষ্যতেও খুব একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আমি চাই না আমার ছেলে এই কাজ করুক,” তিনি বললেন।

'Everything is in loss, even the property is rotting away,' Abdul Rashid Badyari says, referring to his ornate houseboat
PHOTO • Adil Rashid
'Everything is in loss, even the property is rotting away,' Abdul Rashid Badyari says, referring to his ornate houseboat
PHOTO • Adil Rashid

সবেতেই ক্ষতি হয়েছে, এমনকি জিনিসটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,’ তাঁর সুসজ্জিত হাউজবোট সম্পর্কে বললেন আব্দুল রাশিদ বাদিয়ারি

এই কয়েকমাস ধরে কয়েকজন এই দুর্দশা-পীড়িত শিকারাওয়ালা এবং ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুল মাজিদ ভাট (লেকসাইড পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি)। “আমাদের সমিতির সদস্যদের আপৎকালীন ট্রাস্ট হিসেবে ৬ লাখ টাকা মতো ছিল,” তিনি বললেন। “যারা সবথেকে দুর্বল, তাদেরকে আমরা এই টাকা দিয়েছি যাতে তারা সংসারটা চালাতে পারেন।”

ভাট একেক মরশুমে ১০ জন করে কাজে নিযুক্ত করতেন। একেকজনকে মাইনে দিতেন ১০,০০০–১৫,০০০ টাকা। “প্রায় সবাইকেই ছেড়ে দিতে হয়েছে কারণ এত টাকা দিতে পারতাম না,” তিনি জানালেন। “পরিবারের সঙ্গে কথা বলে কয়েকজন যাঁরা খুবই গরিব তাঁদের রেখেছি। আমরা যা খাই ওদেরও তার থেকেই খেতে দিই। নইলে কাউকে চাকরিতে রাখা এখন আমার পক্ষে সম্ভব নয়। গত পাঁচমাসে আমি কয়েকজন স্থানীয় খদ্দেরের কাছে জিনিস বিক্রি করে ৪০০০ টাকারও কম আয় করেছি।”

ভাট বলছেন যে উনি সংসার খরচ চালাতে এবং দেনা শোধ করতে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়েছেন। “তাতেও সুদ দিতে হবে। আমার দুই ছেলে আর তিন ভাইপো আমার সঙ্গে কাজ করে [তাঁর দুই মেয়ে, একজন বাড়ির কাজকর্ম দেখেন, অন্যজন বাড়ির কাজে সাহায্য করেন]। আমার ছেলে বি কম পাশ। ওকে শারীরিক শ্রম করতে পাঠাতে আমার বিবেকে বেধেছিল কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে ওকেও যেতেই হবে।”

সরকারের পক্ষ থেকে কেউ ডাল লেকের দোকানদার আর শিকারাওয়ালাদের নিয়ে চিন্তিত নয়। “কেউ আমাদের ক্ষতির মূল্যায়ন করতে আসেনি।”, তিনি আরও বললেন, স্থানীয় বাসিন্দারা লকডাউন উঠে যাওয়ায় সাধারণত শহরের দোকানে যায়। “কিন্তু কোনো স্থানীয় বাসিন্দা ডাল লেকে কাশ্মীরি শিল্পের দোকানে আসে না। ডাল লেকের দোকানদারের ১০০ শতাংশই ক্ষতি।”

ভাট আরও বললেন যে জুলাই মাসে হস্তশিল্পের ডিরেক্টোরেট থেকে একজন আধিকারিক তাঁদের বলেছিলেন অনলাইন তাঁদের রেজিস্ট্রেশান জমা দিলে কিছু আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। “তারপর থেকে আমাদের কোনো আশা নেই, রাজ্যের থেকেও না, কেন্দ্রীয় সরকারের থেকেও না।” বহুদিন ধরে চলে আসা হরতাল আর কারফিউয়েও অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে, যোগ করলেন ভাট। “আমি আমার ছেলেমেয়েদের বলেছি যে ডাল এবং আমরা – দুয়েরই ভবিষ্যত বিবর্ণ...”

বাংলা অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য

Adil Rashid

Adil Rashid is an independent journalist based in Srinagar, Kashmir. He has previously worked with ‘Outlook’ magazine in Delhi.

Other stories by Adil Rashid
Translator : Sarbajaya Bhattacharya

Sarbajaya Bhattacharya is a Senior Assistant Editor at PARI. She is an experienced Bangla translator. Based in Kolkata, she is interested in the history of the city and travel literature.

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya