আজ বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মবার্ষিকীতে পারি গ্রাইন্ডমিল সংগস্-এর দুটি গুচ্ছ উপস্থাপন করছে। বীড জেলার মাজালগাঁও গ্রামের ওয়ালহাবাই তাখনকর ও রাধাবাই বোরহাডের গাওয়া এই গানগুলি বাবাসাহেবকে ঘিরে তাঁদের গর্ব ও ভালবাসার, সমৃদ্ধি ও আনন্দের। ডঃ আম্বেদকর এবং জাতপাতের সমস্যা ঘিরে বাঁধা এই গানগুলি এপ্রিল কিস্তির দোহা-গুচ্ছের অন্তর্গত

এপ্রিলের গোড়ার দিকে আমরা মাজালগাঁওয়ে ওয়ালহাবাই তাখনকরের বাড়িতে যাই। উনি অতি কষ্টে আধো আধো মনে করার চেষ্টা করেন সেইসব গান যেগুলো উনি ২১ বছর আগে, ১৯৯৬ সালে গেয়েছিলেন যখন গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্টের টিম তাঁর কাছে প্রথমবার গিয়েছিল। তিনি বললেন হয়তো জাঁতাটা ঘোরাতে ঘোরাতে সেই ভুলে যাওয়া সুরগুলি আবার মনে পড়ে যেতে পারে।

তাই তাঁর বৌমা প্লেটভর্তি গমের দানা নিয়ে এসে পুরনো একটি জাঁতাকে সাজিয়ে দেন – দুটি পাথর, একটার উপরে আরেকটা, মধ্যিখানে কাঠের একটা মোটাসোটা হাতল। ওয়ালহাবাই চাকীর সামনে বসে তাতে একমুঠো গম ঢেলে পেষাই করা শুরু করেন – আর এই বৃত্তাকার ছন্দের সঙ্গে সঙ্গে একটি একটি করে পুরনো সুর ফিরে আসতে থাকে।

তাঁর কিছু ওভি – জাঁতা পেষাইয়ের গান – এখানে উপস্থাপনা করা হয়েছে, সঙ্গে আছে রাধাবাই বোরহাডের কিছু গানও। এই গানে ফুটে ওঠে ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার যখন তাঁদের গান রেকর্ড করা হয়েছিল তখন ওয়ালহাবাই আর রাধাবাই দুজনেই ভীম নগরে থাকতেন (রাধাবাই এখন ওই একই তালুকের সাভারগাঁও গ্রামে থাকেন)।

মাজলগাঁও তালুকের একই নামের গ্রামটির অন্তর্গত ভীম নগর জনপদে মূলত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন। জাঁতা পেষাইয়ের গানের প্রকল্পের নিরিখে এই জনপদটি একটি স্বর্ণখনির চেয়ে কম কিছু নয়, বাবাসাহেব আম্বেদকরকে ঘিরে বাঁধা অজস্র ওভি এখান থেকে পাওয়া গেছে। সর্বজনবন্দিত রাষ্ট্রনায়ক বাবাসাহেব ছিলেন দলিত, মথিত ও লাঞ্ছিত জনসমাজের একনিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং স্বাধীন ভারতের সংবিধানের রূপকার। ১৪ই এপ্রিল তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পারি এই গোটা মাস জুড়ে ডঃ আম্বেদকর এবং বর্ণাশ্রমের সমস্যাকে ঘিরে রচিত জাঁতা পেষাইয়ের দোহাগুলি প্রকাশ করতে থাকবে।

ভিডিওটি দেখুন: বিস্মৃত সুর ফিরে পাওয়ার আশায় ওয়ালহাবাই তাখনকর তাঁর জাঁতাকলটি ঘোরাচ্ছেন

এখানে প্রকাশিত প্রথম অডিও ক্লিপটিতে ওয়ালহাবাই এবং রাধাবাই ৬টি দোহা গেয়েছেন। প্রথমটিতে আমরা দেখতে পাই ভীমরাজা ঔরঙ্গাবাদ স্টেশনে একটি সোনার গ্লাসে জল পান করছেন, যেই গ্লাসটি রুপোর ছোবড়া দিয়ে মাজা হচ্ছে। এই দোহাটিতে “সোনা” ও “রুপো” সেই অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির রূপক যা শুধুমাত্র যুক্তিমূলক শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব – ঠিক যে কথাটা বাবাসাহেব জোর গলায় বারবার বলতেন।

দ্বিতীয় ওভিটি শুরু হচ্ছে চন্দ্রমল্লিকা ও চামেলির উপমা দিয়ে (ফুলগুলি সৌন্দর্যের প্রতীক), কিন্তু শেষ হচ্ছে ঔরঙ্গাবাদ কলেজে ভীমরাজের প্রতি যে অবমাননা হয়েছিল তার উল্লেখের মধ্যে দিয়ে (যা ওয়ালহাবাই আর রাধাবাইয়ের মূল গানে মারাঠি ভাষায় “অশুভ দৃষ্টি” হিসেবে বর্ণিত আছে)।

তৃতীয় দোহাটিতে গায়িকা ইঙ্গিত করছেন ভীমরাজার পকেটে থাকা সোনার কলমের দিকে, সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলছেন যে দেশের সমবেত কণ্ঠে আজ একটি নতুন অভিবাদন আছে – “জয় ভীম”। কলমটি ডঃ আম্বেদকরের পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা ও অগ্রগামী ভূমিকার প্রতীক।

চতুর্থ ওভিটি ভীমরাওয়ের আগমনকে নিয়ে। এখানে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটিই বাণী – প্রত্যেকটি বাচ্চাকে যেন স্কুলে ভর্তি করা হয়। সম্ভবত ছন্দের প্রবাহকে বজায় রাখতে এখানে বাবাসাহেবের সজ্জিত ছাতার উল্লেখ করা হয়েছে।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ ওভিতে আমরা দেখতে পাই যে গীতিকার অত্যন্ত আনন্দিত কারণ বাবাসাহেব তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর বাড়িতে এসেছেন। গীতিকার তাঁর পড়শি মহিলাদের অনুরোধ করছেন তাঁরা যেন দুধ আর চিনি এনে বাবাসাহেবের আগমনকে উদযাপন করেন। ভীমরাওকে গায়িকা তাঁর সহোদর ভাই হিসেবে দেখছেন। এই যে প্রতিবেশীদেরকে দুধ আর চিনি আনতে অনুরোধ করা, এটা প্রমাণ করে যে এ ওভির রচয়িতা এই মহিলারা হতদরিদ্র সমাজের প্রতিনিধি, যেখানে দুধ আর চিনি সহজলভ্য তো নয়ই, বরং সেসব খুবই কষ্টার্জিত মহার্ঘ্য বস্তু।

শোনো গো সই, অশরীর জুড়োই, হেথা সোনার পেয়ালাতে রুপো নিকোই,
ঔরঙ্গাবাদ, যেন জল নিষাদ, যেথা তৃষ্ণ ভীমরাজা মেটালো সাধ।

এসো লো সই, দুটি গল্প কই, শেষে চন্দ্রমল্লিকা চামেলি হই।
ঔরঙ্গাবাদ, গোনে কার প্রমাদ? সেথা কলেজে ভীমরাজা, মিছে বিবাদ।

মোরা ভীমরাজার, আছে পকেটে তাঁর স্মৃতি সোনালি পেনসিলে রাত জাগার,

তাই দ্যাখো গো সই, তাঁর পকেটে ওই, আজও কলমে “জয় ভীম”-এ দেশ কুড়োই।

এসেছে ভীম, রাঙা চন্দ্রহিম, তার ছাতায় জাফরানি বনকালিম,

সে যে ডাক পাঠায় মোর ক্লান্ত গাঁয় যেন সৃজনে সব শিশু নেয় তালিম।

এসেছে ভীম, দোলে নীল ছাতিম, ঢালি পিরিচে দুধরঙা মন আদিম।

ওহে পড়শি মোর, খোলো আঁজলা দোর, দেখো জঠরে তথাগত ঝরে অঝোর।

ওহে পড়শি ঝিনি, এনো দুমুঠো চিনি, আজি ভীম সে গুরুভাই আসিবে জানি।

নহে ভীম সুদূর, বাঁধি চাকীতে সুর, খুঁজি মিছরি ভরা গানে রাতসিঁদুর।

PHOTO • Samyukta Shastri

দ্বিতীয় অডিও ক্লিপে রাধাবাই ৫টি ওভি গেয়েছেন। প্রথম দোহায় বলা হচ্ছে যে রমাবাইয়ের পরিবার দিল্লি থেকে বহুদূরে থাকতেন এবং তাঁর ও বাবাসাহেবের বিয়েতে তত্ত্ব ছিল নীলরঙের বস্ত্র। (বি: দ্র: রমাবাই ছিলেন ডঃ আম্বেদকরের প্রথমা স্ত্রী, এবং নীল রংটি দলিত বা বহুজন সমাজের আত্মগরিমার প্রতীক; আম্বেদকরের অনুসরণকারী মানুষজন এই রংকে তাঁদের বিদ্রোহের সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।)

দ্বিতীয় দোহাটিতে গীতিকার জিজ্ঞেস করছেন যে দিল্লিতে এমন কোন জিনিসটা দেখা যাচ্ছে যার রং নীল। এ প্রশ্নের উত্তর উনি নিজেই দিচ্ছেন – একটি নীলরঙের পৈঠানি শাড়ি পরে রমাবাই দাঁড়িয়ে আছেন ভীমরাওয়ের পাশে।

তৃতীয় ওভিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কীভাবে আম্বেদকর দম্পতির একটি আলোকচিত্র প্রাণোজ্জ্বল হয়ে উঠছে রমাবায়ের সৌন্দর্যে। চতুর্থ ওভিটিতে ভীম দিল্লি গিয়ে সমস্ত দলিত মানুষজনের সঙ্গে দেখা করছেন।

তৃতীয় ও চতুর্থ ওভিটিতে সম্ভবত ছান্দিক প্রবাহের জন্য চারটি এবং আটটি কাচের বয়ামের কথা উল্লেখ করা আছে। সর্বশেষ দোহাটিতে গায়িকা জানাচ্ছেন যে তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন। কী ছিল সেই স্বপ্নে? তিনি দেখেছেন দিল্লির দরবারে ভীম ভারতবর্ষের সংবিধান রচনা করছেন।

মেয়ে তাঁর রমাবাই, শোন্ সখীবর, দিল্লি সুদূর হোথা বেঁধেছিল ঘর।
তত্ত্বে সাজায়েছিল দেশরঙা নীল, ভীমরাজা সেই নীলে হল অনাবিল।

নীল নীল ওরা কারা বল্ দেখি সই দিল্লিরই মসনদে যায় দেখা ওই?
দিল্লি নগরী সখী কাঁচের বয়াম, এক নয়, দুটি নয়, চার চার ধাম।

আটটি কাচের শিশি দিল্লিরই বুকে সনাতনী শয়তানি দেশের অসুখে।
স্বপ্ন দেখেছি আমি, জানিস রে সই, খিদের খোয়াবদানে তথাগত হই।

দিল্লিরই দরবারে ভীমরাজা মোর সংবিধানের দেহে বাঁধিয়াছে ডোর।
দাঁড়ায়ে রয়েছে রমা, ভীমের দুলারি, পরনে বিজুলি তার পৈঠানি শাড়ি।

দেওয়ালে ওই যে ফটো ভীম গুরুভাই, তাহাতে সোহাগ ঢালে ঋতু রমাবাই।
অছুৎয়ের মান রাখে তাই রাজা ভীম, করুণার নবযানে সাহস অসীম।

PHOTO • Namita Waikar ,  Samyukta Shastri

পারফর্মার/গায়িকা: ওয়ালহাবাই তাখনকর, রাধাবাই বোরহাডে

গ্রাম: মাজালগাঁও

জনপদ: ভীম নগর

তালুক: মাজালগাঁও

জেলা: বীড

জাত: নব বৌদ্ধ (নিও-বুদ্ধিস্ট)

তারিখ: ১৯৯৬ সালের ২রা এপ্রিল এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল। এই ভিডিওটি তোলা হয় যখন আমরা আবার মাজালগাঁওয়ে যাই গায়িকাদ্বয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ২০১৭ সালের ২রা এপ্রিল।

পোস্টার: শ্রেয়া কাত্যায়নী

অনুবাদ - শুভঙ্কর দাস (জশুয়া বোধিনেত্র)

Namita Waikar is a writer, translator and Managing Editor at the People's Archive of Rural India. She is the author of the novel 'The Long March', published in 2018.

Other stories by Namita Waikar
PARI GSP Team

PARI Grindmill Songs Project Team: Asha Ogale (translation); Bernard Bel (digitisation, database design, development and maintenance); Jitendra Maid (transcription, translation assistance); Namita Waikar (project lead and curation); Rajani Khaladkar (data entry).

Other stories by PARI GSP Team
Photos and Video : Samyukta Shastri

Samyukta Shastri is an independent journalist, designer and entrepreneur. She is a trustee of the CounterMediaTrust that runs PARI, and was Content Coordinator at PARI till June 2019.

Other stories by Samyukta Shastri
Editor and Series Editor : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra is the Content Manager of PARIBhasha, the Indian languages programme at People's Archive of Rural India (PARI). He has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata and is a multilingual poet, translator, art critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra