মাওয়াল তালুকের রাজমাচি গ্রামের রেণুকা উম্বরে বলছিলেন: "দলে দলে পর্যটকরা আসে তো এখন, গান-টান গাইবার ফুরসৎ পাই না..." এই ওভিগুলিতে তিনি এমন এক মহিলার কথা তুলে ধরেছেন যে কিনা দেশগাঁ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে শহরের পানে। মার্চ জুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছে পারি, তাই অব্যাহত থাকছে জাঁতাপেষাইয়ের গানের এই শৃঙ্খলা
অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠের মালিক রেণুকা উম্বরে। ছোটবেলায় মা আর পরবর্তীকালে স্বামীর পিসি, এঁদের থেকে অসংখ্য জাঁতাপেষাইয়ের গান শিখেছেন তিনি। ওভি গাইবার সময় কেন যে মহিলারা গলাটা খাদে নামিয়ে ফেলেন সেটা জানতে পারলাম ওঁর কাছে, আসলে জাঁতাকল ঘোরাতে ঘোরাতে গান গাওয়াটা যে বড্ডো কষ্টের। জাঁতাপেষাইয়ের অন্যান্য ওস্তাদ গাইয়েদের মত উনিও কোনও একটা বিষয়ে গান ধরার পর খান দশেক দোহার আগে সুর পরিবর্তন করেন না।
পুণে জেলার মাওয়াল তালুকে এক পাহাড়ের পাদদেশে রাজমাচি গ্রাম, রেণুকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম সে আজ ২০ বছর হতে চলল। অন্যের জমিতে আলতারঙা শামাধান (রেড মিলেট) চাষ করত তাঁর পরিবার। তবে ধানচাষ করবেন বলে তার কয়েকদিন আগেই রায়গড় জেলার খানিকটা জমি কিনেছিলেন তাঁরা। মাঝেমাঝেই সেখানে গিয়ে উঠতেন, কখনও বা হপ্তাখানেকের জন্য, কখনও বা দিনের দিন ফিরেও আসতেন। পায়ে হেঁটে পাহাড়-পর্বত না টপকালে সে জমিতে যাওয়াই যেত না।
রেণুকার স্বামীর দুই ভাইয়ের পরিবারও একসঙ্গে একই ছাদের তলায় থাকতেন, জমিতে ঘামও ঝরাতেন একসাথে, তা সত্ত্বেও এক উনুনে কিন্তু হাঁড়ি চড়ত না। রেণুকার দুই ননদও স্বামী-পরিত্যক্তা হয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন ওই বাড়িতে।
রেণুকার দুটি মেয়ে। তাঁর কথায়: "কম চেষ্টা-চরিত্তির করিনি গো একটা ছেলের জন্য। এক ওঝার কাছেও গিয়েছিলাম। কিন্তু হায়, কিসুই হল না। তবে আজ ভাবি, দুই দেওরেরই তো ছেলে আছে, আমার না হয় মেয়েই ভালো..." ১৬ বছর বয়েসে রেণুকার বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে।
রাজমাচির অন্যান্য ঘরবাড়ির মতো তাঁদের কোঠাবাড়িটিও বেশ বড়োসড়ো। এ গাঁয়ের মানুষজন নিজেরাই নিজেদের ঘরদুয়ার বানাতে ওস্তাদ, আকার প্রকার সবই পরম্পরাগত, রংবেরঙের দরজাগুলো একেকটা একেক রকমের। মুম্বই আর পুণে থেকে পর্যটকের দল রাজমাচির দুর্গ দেখতে এলে সবচাইতে বড়ো বাড়িগুলো হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। পর্যটন থেকে যাতে বেশি বেশি করে রোজগার হয়, তাই শহরের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা পাতিয়ে নিয়েছে এ গ্রামের প্রতিটি গেরস্থালি।
রেণুকা বলেছিলেন যে তিনি ভজন বা গৌলান (সাত সকালে নদীতে জল ভরতে যাওয়ার পথে এবং নদীর পাড়ে জল ভরার সময় এই ধরনের লোকসংগীত গান গ্রামীণ মহিলারা; অন্যান্য বহু গ্রামের মতো রাজমাচিতেও কলের জল মেলে না)। "কেবলমাত্র জাঁতাপেষাই আর পালা-পার্বণের গানগুলোই আমি গাই," জানিয়েছিলেন তিনি। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে সেটাও কিন্তু কমে আসছে। রেণুকার কথায়: "দলে দলে পর্যটকরা আসে তো এখন, ওনাদের দেখভাল করতে গিয়ে গান-টান গাইবার ফুরসৎ পাইনা। গান গেয়ে নিজের মনের কথা বলতে ইচ্ছে তো করে, কিন্তু আজকাল বেশিরভাগই [ওভি] ভুলে গেছি..."
এখানে প্রকাশিত ভিডিওতে তিনটি ওভি গেয়েছেন রেণুকা উম্বরে। প্রথমটিতে রয়েছে এক ডজন (কাচের) চুড়ির দাম, যেগুলি তাঁর বোনপো কিনে এনেছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ওভিতে রয়েছে এক মহিলার কথা যিনি গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন মুম্বইয়ে। দেখতে দেখতে দেশগাঁয়ের ভাষা ভুলে পুরোপুরি শহুরে মানুষ হয়ে উঠেছেন তিনি। মাছ ভাজা খাচ্ছেন বটে, কিন্তু মন পড়ে আছে গ্রামের মাঠঘাটে গজানো শাকসবজিতে – ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের জন্য বড্ডো মন-কেমন করছে তাঁর।
বারো আনা ডজনের চুড়ি গোছা ধরে
সজন সে পোলা তোর এনে দি'ছে মোরে।
মাইয়া রে মাইয়া হলি মুম্বাইয়া, দেশ ছাড়ি শহরের ঠাঁই যবে নিলি...
দেহাতের বোলচাল সবই ভুলে গেলি।
মাইয়া সে মাইয়া হ'ল মুম্বাইয়া, দ্যাখ রে মনের সাধে মাছ ভেজে খায়...
কুর্দু শাকের খোঁজে হিথা হুথা মাথা গোঁজে, আমাদের মাঠে-ঘাটে চরকি লাগায়।
বিঃ দ্রঃ অতীতে ভারতীয় মুদ্রার একটি ভাগের নাম ছিলো 'আনা'। ৪ পয়সায় এক আনা হতো আর ৬৪ পয়সায় এক টাকা। ফলত এক টাকার অর্থ ছিল ১৬ আনা। বর্তমানে ১০০ পয়সায় এক টাকা হয়। কুর্দু একধরনের শাক জাতীয় সবজি, দেখতে লম্বাটে ঘাসের মতো এবং গোলাপী রঙের ফুল ফোটে এতে।
পরিবেশিকা/গায়িকা : রেণুকা উম্বরে
গ্রাম : রাজমাচি
তালুক : মাওয়াল
জেলা : পুণে
লিঙ্গ : নারী
জাতি : মহাদেব কোলি
বয়স : ৩৭/৩৮
সন্তান : ২টি মেয়ে
পেশা : কৃষক, চাষ করেন লাল শামাধান (নাচানি/রাগি)
তারিখ : এই দোহাগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ১৫-১৬ই মার্চ
আলোকচিত্র: বার্নার্ড বেল
পোস্টার: শ্রেয়া কাত্যায়নি এবং সিঞ্চিতা মাজি
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)