অগস্ট ২০২০, দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়ে মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছিলেন আঞ্জানি যাদব। তারপর থেকে আর একটিবারের জন্যও শ্বশুরবাড়িতে পা রাখেননি। দুই সন্তানের সঙ্গে বিহারের গয়া জেলার বোধগয়া ব্লকের বাক্রাউর গ্রামে নিজের বাপের বাড়িতেই থাকেন আঞ্জানি (৩১)। আধা ঘন্টার দূরত্বে তাঁর বর যেখানে থাকেন সেই গ্রামের নামটা তিনি একটিবারের জন্যও মুখে আনলেন না।

"বাচ্চাটা হয়েছিল ওই সরকারি হাসপাতালটায়, দিন দুই কাটতে না কাটতেই আমার জা বলে কিনা বাড়ি ফিরে রান্নাবান্না ঝাড়পোঁছ সবকিছু করতে হবে। বলল যে ওর নিজের যখন বাচ্চা হয়েছিল, তারপর বাড়ি ফিরেই সমস্ত কাজকম্ম সামলাত। ডেলিভারির সময় আমার কত রক্ত পড়েছিল জানেন? এমনকি বাচ্চাটা হওয়ার আগেই নার্স বলে দিয়েছিল, আমার শরীরে নাকি রক্ত নেই বললেই চলে [গুরুতর রক্তাল্পতা], তাই বেশি করে ফলমূল শাকসবজি এসব খেতে হবে। শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকলে আমার অবস্থাটা যে কী দাঁড়াতো সেটা বুঝতেই পেরেছিলাম।"

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস-৫) জানাচ্ছে যে গত পাঁচ বছরে দেশের অধিকাংশ রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শিশু ও মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে।

আঞ্জানি জানালেন যে তাঁর স্বামী সুখীরাম (৩২) গুজরাতের সুরাতে একটি কাপড়ের কোম্পানিতে কাজ করেন। "বাচ্চাটা হওয়ার সময় ওর আসার কথা ছিল, কিন্তু ওর কোম্পানি জানিয়ে দেয় যে দুদিনের বেশি কামাই করলে চাকরিটা চলে যাবে। সে রুজিরুটিই বলুন বা শরীরস্বাস্থ্য আর মনমেজাজ, করোনা এসে আমাদের মতন গরিবদের জীবন ছারখার করে দিয়েছে। শেষমেশ তাই সবকিছু আমি নিজেই একাহাতে সামলেছিলাম।"

"ওকে ছাড়া দিন দিন অবস্থাটা ভয়াবহ হয়ে উঠছিল, কোনওমতে পালিয়ে বেঁচেছি শেষটায়। সদ্য সদ্য মা হয়েছি, এ অবস্থায় সেবাযত্ন তো দূরের কথা, বাড়ির কাজকম্ম থেকে শুরু করে বাচ্চাটার দেখভাল, সব আমাকে একা হাতে সামলাতে হত," পারি-কে জানিয়েছিলেন তিনি। এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মহিলার মতো আঞ্জানির শরীরে আজও বাসা বেঁধে রয়েছে রক্তাল্পতা।

এনএফএইচএস-৫ বলছে যে বিহারের প্রায় ৬৪ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতার শিকার।

কোভিড-১৯ অতিমারির প্রসঙ্গে ২০২০ সালের বিশ্ব পুষ্টি প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে: "প্রজননক্ষম মহিলাদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে [ভারতবর্ষ] একটা পা-ও এগোতে পারেনি...১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে আজ প্রায় ৫১.২ শতাংশ এই রোগের শিকার।"

PHOTO • Jigyasa Mishra

গতবছর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হওয়ার পর থেকে নিজের মা-বাবার কাছেই রয়েছেন আঞ্জানি যাদব। একে তো সাহায্য বা সেবাশুশ্রুষা দুটোর একটাও মেলে না শ্বশুরবাড়িতে, তার উপর স্বামী থাকেন দূরে

কাছেই একটা গ্রামে আজ বছর ছয়েক আগে বিয়ে হয়েছিল আঞ্জানির, তারপর ভারতবর্ষের আর পাঁচজন বিবাহিত মহিলার মতো তিনিও শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ওঠেন। শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ভাসুর, তাঁদের স্ত্রী এবং বাচ্চাকাচ্চা – সবাইকে নিয়ে ছিল তাঁর একান্নবর্তী সংসার। ক্লাস এইটের পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি আঞ্জানির, তাঁর স্বামী অবশ্য ক্লাস ১২-এর গণ্ডি টপকাতে পেরেছিলেন।

এনএফএইচএস-৫ বলছে বিহারের ১৫-১৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজননক্ষমতার হার ৭৭ শতাংশ। এ রাজ্যের ২৫ শতাংশেরও বেশি মহিলার বডি মাস ইন্ডেক্স (বিএমআই, অর্থাৎ উচ্চতা এবং ওজনের অনুপাত) স্বাভাবিকের থেকে কম। উপরন্তু ১৫-৪৯ বছর বয়সী গর্ভবতীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশেরও বেশি মহিলা রক্তাল্পতার শিকার।

বাক্রাউরের বাড়িতে মা, ছোটো ভাই, ভাই-বৌ এবং তাঁদের দুই সন্তানের সঙ্গেই থাকেন আঞ্জানি। ভাই অভিষেক (২৮) গয়া শহরে ডেলিভারি ম্যানের কাজ করেন। তাঁদের মা পেশায় গৃহশ্রমিক। "মাস গেলে সব মিলিয়ে হাজার পনেরো রোজগার হয় আমাদের। আমি যে এখানে থাকছি, এই ব্যাপারে কেউ আপত্তি করেনি বটে, তবে নিজেকে কেমন যেন উটকো বোঝার মতো মনে হয়," জানালেন তিনি।

আঞ্জানি বলছিলেন: "আমার বর সুরাতে এক-কামরার একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে তিন সহকর্মীর সঙ্গে। কবে যে টাকাপয়সা জমিয়ে নিজের জন্য একটা আলাদা বাড়ি নেবে, আর কবে যে সবাই একসঙ্গে থাকতে পারব [সুরাতে], সেই আশাতেই দিন গুনছি।"

*****

"আসুন, আপনাকে আমার এক সইয়ের কাছে নিয়ে যাই, আমার মতোই হাল ওর, শাশুড়ির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে বেচারি," এই বলে তিনি আমাকে গুড়িয়ার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, আদতে গুড়িয়ার বরের বাড়ি। এই ২৯ বছর বয়সী মহিলা চার সন্তানের মা। সবার ছোটোটি ছেলে, তবে যতক্ষণ না আরেকটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিচ্ছেন ততক্ষণ শাশুড়ি তাঁকে বন্ধ্যাত্বকরণ করাতে দেবেন না বলে বদ্ধপরিকর। নিজের পদবি প্রকাশে অনিচ্ছুক গুড়িয়া একটি দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত।

এনএফএইচএস-৫ জানাচ্ছে যে গত পাঁচ বছরে দেশের অধিকাংশ রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শিশু ও মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে

"তিন-তিনটে মেয়ে হওয়ার পর শাশুড়ি বলল যে একটা নাতি তার চাই-ই চাই। কপালজোরে একটা ছেলে হলও বটে, ভাবলাম যে এবার বুঝি জীবনটা একটু সহজ হবে। কিন্তু সে এবার গোঁ ধরেছে যে তিনটে নাতনির সঙ্গে দুটো নাতি না হলে চলবে না। কিছুতেই আমাকে আপারেশন করাতে দিচ্ছে না," পারি-কে জানিয়েছিলেন গুড়িয়া।

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী শিশু লিঙ্গ অনুপাতের (চাইল্ড সেক্স রেশিও) নিরিখে বিহারের জেলাগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে গয়া। ০-৬ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সমগ্র বিহারে যে গড় অনুপাতটি ৯৩৫, গয়া জেলায় সেটি ৯৬০।

টিন আর অ্যাবেস্টস দিয়ে ঢাকা মাটির দু-কামরার ঘরে থাকেন গুড়িয়া। বাড়িতে কোনও শৌচাগার নেই। অপরিসর এই বাড়িটি স্বামী শিবসাগর, তাঁর মা এবং গুড়িয়ার চার ছেলেমেয়ের মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁই। স্থানীয় একটি ধাবায় সহকারীর কাজ করেন শিবসাগর।

একে তো সতেরো বছর হতে না হতেই বিয়ে হয়ে গেছে, তার উপর স্কুলে যাওয়ার সুযোগটাও পাননি কখনও গুড়িয়া। "পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড়ো আমি, ইস্কুলে পাঠানোর মতো টাকাপয়সা ছিল না মা-বাবার," আমাদের জানিয়েছিলেন তিনি, "তবে আমার ছোটো দুটো বোন আর আমাদের সব্বার ছোটো ভাই কিন্তু ইস্কুলে পড়েছে।"

গুড়িয়াদের বাড়ির প্রধান কামরাটা থেকে বেরোতেই একটা চার ফুটের রাস্তা পড়বে, তার উল্টোদেকেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পড়শির বাড়ি। বইয়ে ঠাসা দুটো স্কুল ব্যাগ ঝুলছে দেওয়ালে, "এগুলো আমাদের বড়ো মেয়ে দুটোর। বছর ঘুরে গেল, এসব ছুঁয়েও দেখেনি কেউ।" ১০ বছরের খুসবু আর ৮ বছরের বর্ষার পড়াশোনার যে কী পরিমাণে ক্ষতি হচ্ছে তা বলে বোঝানো মুশকিল। কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে সেই যখন প্রথমবার লকডাউন শুরু হয়েছিল সারাটা দেশজুড়ে, তারপর থেকে স্কুল-টুল সব বন্ধ হয়েই পড়ে আছে।

PHOTO • Jigyasa Mishra

আরেকটি নাতির জন্য গোঁ ধরে বসে আছেন গুড়িয়ার শাশুড়ি, তাই তিনি বৌমাকে বন্ধ্যাত্বকরণ করাতে দিচ্ছেন না

"আর কিছু হোক না হোক, আমার বাচ্চাদুটো দিনে একবার অন্তত মিড-ডে মিলে পেটভরে খেতে তো পেত। এখন ওই কোনওমতে কুড়িয়ে বাড়িয়ে যেটুকু জুটছে সেটা খেয়েই বেঁচে আছি," দুঃখ করছিলেন গুড়িয়া।

স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে টান পড়েছে পেটে। একে তো বড়ো দুই মেয়ের কপালে মি-ডে মিল আর জোটে না, তার উপর বাড়িতেও অন্ন বাড়ন্ত। আঞ্জানির পরিবারের মতো গুড়িয়াদেরও একই দশা, কর্মসংস্থান বা খাদ্যসুরক্ষা, দুটোর একটাও নেই। সাত-সাতটি মানুষের এই পরিবারটির রোজগার বলতে মাস গেলে যে ৯,০০০ টাকাটা গুড়িয়ার বর হাতে পান, উপরন্তু সেটারও কোনও নিশ্চয়তা নেই।

২০২০ সালের বিশ্ব পুষ্টি প্রতিবেদন অনুযায়ী: "অসুরক্ষিত অর্থনীতির কোঠায় যেসব শ্রমিকেরা রয়েছেন, সামাজিক সুরক্ষা, উচ্চমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং উৎপাদনশীল সম্পদ না থাকায় তাঁদের বিশেষভাবে বিপন্ন অবস্থা। লকডাউনের কারণে রুজিরোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, ফলত তাঁরা নিজেদের এবং পরিবারের মানুষজনের জন্য খাদ্যসংস্থান করতে পারছেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা হয় অনশন করে দিন কাটাচ্ছেন, কিংবা তুলনামূলক ভাবে কম পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছেন।"

উপরোক্ত ওই প্রতিবেদনটি যে ভয়াবহ ছবিটা তুলে ধরেছে, তার সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে গুড়িয়ার পরিবারের অবস্থা। একে তো অনটন-অনশন, তার উপর দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ার দরুন হাজার একটা সামাজিক লাঞ্ছনা। না আছে তাঁর স্বামীর কাজের কোনও নিশ্চয়তা, না রয়েছে হাতের নাগালে কোনও রকমের কোন স্বাস্থ্য পরিষেবা।

*****

সূর্য ডুবে গেলেও বোধগয়া ব্লকের মুসহর টোলার (জনবসতি কিংবা কলোনি) জীবন কিন্তু থমকে দাঁড়ায় না। রাজ্যের তফশিলি জাতিসমূহের যে তালিকাটি রয়েছে, তার একেবারে শেষের পংক্তিতে থাকা দলিত এই গোষ্ঠীর মহিলারা দিনান্তে সারাদিনের খাটাখাটনির শেষে একসঙ্গে জড়ো হন, মেতে ওঠেন গল্পগুজবে, আদর করে বাচ্চাদের এবং একে অপরের চুল থেকে উকুন বেছে দেন।

উপচে ওঠা নর্দমায় ঘেরা অপরিসর একটি গলি, দুদিকে সারি সারি ঝুপড়ি, নিজের নিজের দোরগোড়ায় বসে আছেন মহিলারা। "কেন? জানেন না বুঝি সব্বাই ঠিক কেমন ভাবে মুসহর টোলার বর্ণনা করে? কুকুর, শুয়োর, এসবের সঙ্গেই নাকি আমরা গাদাগাদি করে থাকতে ভালোবাসি," বেশ শ্লেষের সঙ্গেই বললেন মালা দেবী (৩২), পনেরো বছর হতে না হতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তারপর থেকে আজ অবধি এই কলোনিতেই বসবাস করছেন।

গয়ার সদর শহরে একটি ডাক্তারখানায় সাফাইকর্মীর কাজ করেন তাঁর স্বামী লল্লন আদিবাসী (৪০)। মালা দেবী জানালেন যে নাসবন্দির (টিউবাল লাইগেশন) কোনও সুযোগই তিনি পাননি কখনও, আজ তাঁর মনে হয় যে চার-চারটে বাচ্চার বদলে শুধু একটি হলেই বোধহয় ভালো হত।

সন্তানদের মধ্যে কেবলমাত্র বড়ো ছেলে শম্ভুরই (১৬) নাম আছে স্কুলের খাতায় – ক্লাস নাইনে। "ক্লাস থ্রিয়ের পর মেয়েদের আর পড়াতে পারলাম না। ছয়জন মানুষের সংসার, রোজগার বলতে ওই ৫,৫০০ টাকা যেটা লল্লন হাতে পায়। আপনার কি সত্যিই মনে হয় যে ওটুকু দিয়ে সবরকমের চাহিদা মেটানো যায়?" জিজ্ঞেস করলেন তিনি। শম্ভু ছাড়া তাঁর ছোটোটিও পুত্রসন্তান, আর মাঝের দুজন মেয়ে।

PHOTO • Jigyasa Mishra

মালা দেবী জানালেন যে নাসবন্দির কোনও সুযোগই তিনি পাননি কখনও, আজ তাঁর মনে হয় যে চার-চারটে বাচ্চার বদলে শুধু একটি হলেই বোধহয় ভালো হত

তবে এখানেও সেই এক গল্প, টোলার বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে তাও বা যে কয়জন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেত, তারাও আজ অসহায়। ফলত মিড-ডে মিলও হাতছাড়া হয়ে গেছে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে খিদে। একদা যখন দিনকাল এতটাও খারাপ ছিল না, তখনও কিন্তু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ গুটিকয়েক বাচ্চা বাদে আর কেউ পেত না। সামাজিক কুসংস্কার, বর্ণবাদী বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক অনটনের কারণে মুসহর জনজাতির বাচ্চারা, বিশেষ করে মেয়েরা, অন্যান্য জনজাতির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বয়েসে এবং অতিরিক্ত হারে পড়াশোনা করা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

২০১১ সালের জনগণনা বলছে যে বিহারে প্রায় ২৭ লক্ষ ২০ হাজার মুসহর জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। জনসংখ্যা অনুযায়ী দুসাধ ও চামারদের পর মুসহররাই তৃতীয় বৃহত্তম তফশিলি জাতি। এ রাজ্যের ১ কোটি ৬৫ লক্ষ ৭০ হাজার দলিতদের মধ্যে প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ মুসহর – তবে বিহারের ১০ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের (২০১১) মধ্যে মুসহররা মোটে ২.৬ শতাংশ।

২০১৮ সালে প্রকাশিত অক্সফ্যামের (OXFAM) একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে: "মুসহরদের মধ্যে ৯৬.৩ শতাংশ ভূমিহীন এবং তাঁদের মধ্যে ৯২.৫ শতাংশ খেতমজুর। বর্ণ হিন্দুসমাজে মুসহররা আজও অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত এবং তাঁদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার মোটে ৯.৮ শতাংশ, অর্থাৎ এ রাজ্যের দলিত জনজাতিগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। এ সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ১-২ শতাংশ।"

বাস্তবের নির্মম পরিহাস যে গৌতম বুদ্ধের পরম জ্ঞানলাভের পুণ্যভূমি বোধগয়ায় স্বাক্ষরতার এমন নিদারুণ অবস্থা।

"শুধু বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করা আর তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে আমাদের, কিন্তু একটা টাকাকড়ি না থাকলে সেগুলোই বা কেমন করে করি বলুন তো?" গতরাতের একবাটি বাসি ভাত ছোটো ছেলের হাতে তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন মালা। "তোর জন্য এটাই আছে শুধু, খেতে হলে খা, নয়তো ভুখা মর," তিনি যে আদতে কতটা অসহায় সেটা স্পষ্টত ফুটে উঠছিল তাঁর রাগত উক্তিতে।

PHOTO • Jigyasa Mishra
PHOTO • Jigyasa Mishra

বাঁদিকে: স্বামীকে হারানোর পর থেকে দেওরের ভরসাতেই বেঁচে আছেন শিবানী। ডানদিকে: বোধগয়ার মুসহর মহল্লা, সন্ধ্যা নামলে এখানকার মহিলারা বাড়ির বাইরে অপরিসর গলিতেই সময় কাটান একসঙ্গে

২৯ বছরের শিবানী আদিবাসীও এই গোষ্ঠীর মানুষ। ফুসফুসের ক্যান্সারে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে দুই সন্তানের সঙ্গে তিনি স্বামীর বাড়িতেই থাকেন, পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা আট। রুজিরুটির কোনও স্থিরতা নেই তাঁর, ফলত দেওরের ভরসাতেই বেঁচে আছেন তিনি। "কোন মুখে আমার বা আমার বাচ্চাদের জন্য দেওরকে আলাদা করে সবজি, দুধ বা ফলটল এনে দিতে বলি বলুন দেখি? সদয় হয়ে যেটুকু খেতে দেয়, সেটাতেই ধন্য হই। বেশিরভাগ দিনই মাড়ভাত (নুন দেওয়া ফ্যান-ভাত) খেয়ে বেঁচে আছি আমরা," পারিকে জানালেন শিবানী।

অক্সফ্যামের সেই রিপোর্টটি বলছে, "বিহারের মুসহর সম্প্রদায়ভুক্ত প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার…"

বিহারের গ্রামাঞ্চলে যে অসংখ্য দলিত মহিলারা রয়েছেন, তাঁদের অবস্থার সঙ্গে মালা বা শিবানীর পরিস্থিতির পার্থক্য কিছু থেকে থাকলেও সেটা নেহাতই মাত্রাগত।

বিহারের তফশিলি জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশই গ্রামনিবাসী। এ রাজ্যের জেলাগুলির মধ্যে গয়াতেই সর্বাধিক (৩০.৩৯%) দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। সরকারি পরিচয় অনুযায়ী মুসহরেরা 'মহাদলিত' – অর্থাৎ তফশিলি জাতিসমূহের মধ্যে যেগুলি দরিদ্রতম।

আঞ্জানি, গুড়িয়া, মালা এবং শিবানী এঁরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত থেকে উঠে আসা মানুষ। তবে একটা কথা তাঁদের প্রত্যেকের জন্যই সমানভাবে খাটে – কারোরই নিজেদের শরীর, স্বাস্থ্য তথা জীবনের উপর সামান্য নিয়ন্ত্রণটুকুও নেই। মাত্রাগত তফাত থাকলেও, এঁরা সকলেই নিদারুণ ক্ষুধার সঙ্গে যুঝছেন প্রতিনিয়ত। শেষ সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর কেটে গেছে মাসের পর মাস, তাও রক্তাল্পতার সঙ্গে আজও লড়ে চলেছেন আঞ্জানি। বন্ধ্যাত্বকরণের ব্যাপারে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছেন গুড়িয়া। বেঁচে থাকাটাই যেখানে একটা সংগ্রাম, সেখানে সুদিনের কথা ভাবাটাও যেন পাপ। তাই মালা আর শিবানী ভুলেও ওসব স্বপ্ন-টপ্ন দেখেন না আর।

গোপনীয়তা বজায় রাখতে এই প্রতিবেদনে কিছু মানুষ ও জায়গার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।

ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশান থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে জিজ্ঞাসা মিশ্র জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Jigyasa Mishra

جِگیاسا مشرا اترپردیش کے چترکوٹ میں مقیم ایک آزاد صحافی ہیں۔ وہ بنیادی طور سے دیہی امور، فن و ثقافت پر مبنی رپورٹنگ کرتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Jigyasa Mishra
Illustration : Priyanka Borar

پرینکا بورار نئے میڈیا کی ایک آرٹسٹ ہیں جو معنی اور اظہار کی نئی شکلوں کو تلاش کرنے کے لیے تکنیک کا تجربہ کر رہی ہیں۔ وہ سیکھنے اور کھیلنے کے لیے تجربات کو ڈیزائن کرتی ہیں، باہم مربوط میڈیا کے ساتھ ہاتھ آزماتی ہیں، اور روایتی قلم اور کاغذ کے ساتھ بھی آسانی محسوس کرتی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Priyanka Borar

پی سائی ناتھ ’پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا‘ کے بانی ایڈیٹر ہیں۔ وہ کئی دہائیوں تک دیہی ہندوستان کے رپورٹر رہے اور Everybody Loves a Good Drought اور The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom کے مصنف ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز پی۔ سائی ناتھ
Series Editor : Sharmila Joshi

شرمیلا جوشی پیپلز آرکائیو آف رورل انڈیا کی سابق ایڈیٹوریل چیف ہیں، ساتھ ہی وہ ایک قلم کار، محقق اور عارضی ٹیچر بھی ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز شرمیلا جوشی
Translator : Joshua Bodhinetra

جوشوا بودھی نیتر نے جادوپور یونیورسٹی، کولکاتا سے تقابلی ادب میں ایم فل کیا ہے۔ وہ ایک شاعر، ناقد اور مصنف، سماجی کارکن ہیں اور پاری کے لیے بطور مترجم کام کرتے ہیں۔

کے ذریعہ دیگر اسٹوریز Joshua Bodhinetra