সস্তা উদ্ভাবনীর দারুণ একটা নিদর্শন হিসেবে এটাকে দেখাই যেতে পারে। অবশ্য, ৬৫ বছর বয়সি নারায়ণ দেশাই সরাসরিই বলছেন, এইটা আদতে তাঁর শিল্পকলার ‘মৃত্যু’। ‘এটা’ বলতে যার কথা বলা হচ্ছে তা হল সানাইয়ের নির্মাণে নতুন কিছু উপাদান আর কৌশলের প্রয়োগ, যা তিনি বাজারের কঠোর বাস্তব তথা তাঁর শিল্পে এক গভীর অস্তিত্বসংকটের কারণে একরকম বাধ্য হয়েই করছেন।

সানাই একধরনের শুষির যন্ত্র, অর্থাৎ হাওয়াচালিত বাদ্যযন্ত্র। বিবাহ অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ, এবং নানা স্থানীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে বাজানো হয়ে থাকে।

দুই বছর আগে পর্যন্তও দেশাইয়ের বানানো প্রতিটি সানাইয়ের শেষ প্রান্তে লাগানো থাকত পিতলের একটি ঘণ্টা। সাবেকি হস্তনির্মিত সানাইতে এই চওড়া মুখের ঘণ্টা – মারাঠিতে যাকে বলে ভাটি – তার কাজ ছিল সানাইয়ের কাঠনির্মিত অংশটি থেকে নির্গত সুরকে আরও তীক্ষ্ণ ও শ্রুতিমধুর করে তোলা। সত্তরের দশকে, তাঁর কর্মজীবনের মধ্যগগনে নারায়ণের কাছে সব সময়েই অন্তত এক ডজন পিতলের ঘণ্টা মজুত থাকত, কর্ণাটকের বেলাগাভি জেলার চিকোডি গঞ্জ থেকে কিনে আনা।

অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে হাত পাকানো নির্মাণকলায় আজ বদল আনতে বাধ্য হয়েছেন তিনি, মূলত দুটি কারণে: পিতলের ঘণ্টার ক্রমবর্ধমান দাম, আর একইসঙ্গে সানাই বানাতে যে দাম লাগে তা দিতে ক্রেতাদের অনীহা।

“লোকে চায় আমি এক-একটা সানাই ৩০০-৪০০ টাকায় দিয়ে দিই,” জানাচ্ছেন তিনি। এই দাবি যে কতটা অবাস্তব তা বোঝাতে পিতলের ঘণ্টার বর্তমান বাজারদর জানালেন তিনি – কমবেশি ৫০০ টাকা। প্রচুর প্রচুর সম্ভাব্য ক্রেতা হারানোর পর নারায়ণ এর এক সমাধান বার করেন। “গ্রামের মেলা থেকে প্লাস্টিকের ভেঁপু কিনি, শেষ অংশটা [যা অনেকটা সানাইয়ের ছড়ানো ঘণ্টার মতোই দেখতে] কেটে নিয়ে সেই অংশগুলোকে সানাইয়ের পিতলের ঘণ্টার জায়গায় বসিয়ে দিই।”

“স্বরের উপর তো প্রভাব পড়েই, কিন্তু আজকাল লোকে ওটাই চায়,” হতাশা ঝরে পড়ে তাঁর কণ্ঠে। সমঝদার ক্রেতাদের তিনি আজকাল বলেন ভাটি আলাদা করে কিনে দিতে। প্লাস্টিকের ভাটি কিনতে লাগে মাত্র ১০ টাকা, কিন্তু নিজের শিল্পের সঙ্গে আপোষ করার যে ভার তাঁর বিবেকে জমা হয় তা টাকার হিসেবের বাইরে।

Narayan shows the plastic trumpet (left), which he now uses as a replacement for the brass bell (right) fitted at the farther end of the shehnai
PHOTO • Sanket Jain
Narayan shows the plastic trumpet (left), which he now uses as a replacement for the brass bell (right) fitted at the farther end of the shehnai
PHOTO • Sanket Jain

নারায়ণ হাতে নিয়ে দেখাচ্ছে প্লাস্টিকের ভেঁপু (বাঁদিকে), যা তিনি আজকাল ব্যবহার করেন সানাইয়ের শেষপ্রান্তে লাগানোর সাবেকি পিতলের ঘণ্টার (ডানদিকে) পরিবর্তে

তবে তিনি এটাও স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, এই সমাধান খুঁজে না পেলে উত্তর কর্ণাটকের মহারাষ্ট্র সীমান্ত লাগোয়া ৮,৩৪৬ জনসংখ্যার (আদমসুমারি ২০১১) ছোট্ট মানকাপুর গ্রামে সানাই নির্মাণের শিল্প চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে যেত।

জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে এসেছেন বেলগাভি এবং নিকটবর্তী মহারাষ্ট্রের নানা গ্রামে যে কোনও মঙ্গল অনুষ্ঠান, যেমন বিয়েশাদি কিংবা কুস্তির ম্যাচে সবসময়েই সানাই বাজানো হয়। “আজও আমাদের কুস্তি ম্যাচে ডাকা হয়,” গর্বভরে জানালেন তিনি। “এই প্রথা আজও বদলায়নি। সানাই বাজানোর লোক না থাকলে লড়াই শুরুই হবে না।”

ষাট দশকের শেষ তথা সত্তরের শুরুর দিকে তাঁর বাবা তুকারাম যখন সানাই বানাতেন, দূর-দূরান্ত থেকে সানাইয়ের অর্ডার আসত, সে মাসে ১৫টা তো হবেই। ৫০ বছর পেরিয়ে আজ নারায়ণের কাছে মাসে মেরেকেটে দুটো বায়না আসে। “বাজারে এখন এর অর্ধেক দামে সস্তার জিনিস পাওয়া যায়,” জানালেন তিনি।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে সানাই নিয়ে উৎসাহ না থাকাও চাহিদা কমার একটা বড়ো কারণ। এর জন্য অরকেস্ট্রা, ব্যান্ড মিউজিক, এবং ইলেকট্রনিক সংগীতের জনপ্রিয়তাকে দায়ী করছেন তিনি। তাঁর নিজের আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে মানকাপুরে সানাই বাজিয়ে বলতে একমাত্র তাঁর ২৭ বছর বয়সি ভাইপো অর্জুন জাভির। মানকাপুরে নারায়ণই একমাত্র শিল্পী যিনি সানাই ও বাঁশি দুইই বানাতে পারেন।

*****

নারায়ণ কোনওদিন স্কুলে যাননি। বাবা আর পিতামহ দাত্তুবার সঙ্গে গ্রামের মেলায় যেতে যেতেই সানাই নির্মাণে হাতেখড়ি তাঁর। সেসময়ে বেলগাভি জেলার সবচেয়ে প্রতিভাধর সানাইবাদকদের একজন ছিলেন দাত্তুবা। “ওঁরা সানাই বাজাতেন, আর আমি নাচ করতাম,” বছর ১২ বয়সে পারিবারিক পেশায় প্রবেশের কথা স্মৃতিচারণ করতে করতে বললেন তিনি। “ছোট্টবেলায় বাদ্যযন্ত্র ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়, ওটা কীভাবে চলে। আমারও সেই একই আগ্রহ ছিল,” বলছেন তিনি। নিজে নিজে সানাই ও বাঁশি বাজাতেও শিখেছিলেন তিনি। “বাদ্যযন্ত্র বাজাতে না জানলে তা বানাবো কী করে?” হেসে বলেন তিনি।

Some of the tools that Narayan uses to make a shehnai
PHOTO • Sanket Jain

নারায়ণের সানাই বানানোর নানা যন্ত্রপাতি

Narayan inspecting whether the jibhali ( reed) he crafted produces the right tones
PHOTO • Sanket Jain

সদ্য বানানো জিভলি (বাঁশির মুখ) দিয়ে ঠিক ঠিক স্বর বেরোচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করছেন নারায়ণ

নারায়ণের যখন ১৮ বছর বয়স, ছেলের হাতে নিজের কলা ও ঐতিহ্যের ভার দিয়ে পরলোক গমন করেন নারায়ণের বাবা। পরবর্তীকালে তাঁর শ্বশুর তথা মানকাপুরের আর এক দক্ষ সানাই এবং বাঁশিনির্মাতা প্রয়াত আনন্দ কেঙ্গরের কাছেও শিক্ষানবিশি করেন তিনি।

নারায়ণের পরিবার হোলার জাতিভুক্ত। তফসিলভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর হোলাররা পরম্পরাগতভাবে সানাই ও দাফড়া (খঞ্জনি) বাদক হিসেবে খ্যাত; দেশাই পরিবারের মতো কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের কাজেও আছেন। তবে এই শিল্পের পরিসর একান্তই পুরুষকেন্দ্রিক। “প্রথম থেকেই আমাদের গ্রামে শুধু পুরুষেরাই সানাই বানানোর কাজে থেকেছে,” জানাচ্ছেন নারায়ণ। তাঁর মা প্রয়াত তারাবাই ছিলেন খেতমজুর; বছরের যে ছয় মাস বাড়ির পুরুষরা বিয়ে এবং কুস্তির ম্যাচে সানাই বাজানোর জন্য ঘুরে বেড়াতেন, সে সময় পুরো পরিবারের হাল ধরে রাখতেন তিনিই।

ভাগ্য যখন সুপ্রসন্ন ছিল তখন প্রতি বছর প্রায় ৫০টি আলাদা আলাদা গ্রামের যাত্রায় সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে যেতেন, স্মৃতিচারণ করছেন নারায়ণ। “দক্ষিণে গোয়ায় যেতাম, তারপর [কর্ণাটকে] বেলগাভি আর [মহারাষ্ট্রে] সাংলি ও কোলাপুরের নানা গ্রাম ঘুরতাম,” জানাচ্ছেন তিনি।

সানাইয়ের চাহিদা যতই পড়ে যাক, নারায়ণ এখনও তাঁর এক-কামরার ঘরের লাগোয়া আত ফুট বাই আট ফুটের কর্মশালাটিতে দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটান; তাঁকে ঘিরে থাকে সেগুন, খয়ের, দেবদারু কাঠের মনোহর সুবাস। “এখানে বসে থাকতে ভালো লাগে কারণ শৈশবের কথা মনে পড়ে,” বললেন তিনি। আখ আর শালু বা জোয়ারের খড়ে তৈরি দেওয়ালে সাতপুরনো দুর্গাঠাকুর আর হনুমানের পোস্টার ঝোলে। কর্মশালার ঠিক মাঝখানে একটি উম্বর বা ডুমুর গাছ টিনের চাল ভেদ করে উপরে উঠে গেছে।

গত পাঁচ দশক ধরে এইখানে বসেই তিনি নিজের হাতে বানিয়েছেন ৫০০০টিরও বেশি সানাই, ৩০,০০০ ঘণ্টারও বেশি কাটিয়েছেন নিজের শিল্পদক্ষতায় শান দিয়ে দিয়ে। কর্মজীবনের শুরুর দিকে একটা সানাই বানাতে ছয় ঘণ্টা লেগে যেত তাঁর, আজ চার ঘণ্টাতেই কার্য সমাধা হয়। তাঁর মস্তিষ্কে এবং হাতের স্পর্শে ধরা আছে সানাই নির্মাণের প্রতিটি খুঁটিনাটি স্মৃতি। “ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সানাই বানাতে পারি আমি,” আমাদের চোখের সামনে একটি সানাই বানিয়ে দেখাতে দেখাতে বললেন তিনি

After collecting all the raw materials, the first step is to cut a sagwan (teak wood) log with an aari (saw)
PHOTO • Sanket Jain

সব কাঁচামাল জড়ো করার পর প্রথম ধাপ হল একটা সেগুনের গুঁড়িকে আড়ি বা করাত দিয়ে কাটা

Left: After cutting a wood log, Narayan chisels the wooden surface and shapes it into a conical reed.
PHOTO • Sanket Jain
Right: Narayan uses a shard of glass to chisel the wood to achieve the required smoothness
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: কাঠ কাটার পর নারায়ণ কুঁদে কুঁদে সেটাকে একটা ফাঁপা চোঙার আকার দেন। ডানদিকে: কাচের টুকরো দিয়ে ঘসে ঘসে কাঠ মসৃণ করা হচ্ছে

প্রথমে একটা সেগুনকাঠের গুঁড়িকে আড়ি (করাত) দিয়ে কাটেন। আগেকার দিনে উঁচুদরের খয়ের, চন্দন আর শিশুকাঠ ব্যবহার করতেন, তাতে স্বরও আসত ভালো। “আজ থেকে তিন দশক আগেও মানকাপুর আর আশপাশের গাঁয়ে এইসব গাছ অনেক বেশি ছিল। এখন এগুলো বিরল,” জানালেন তিনি। এক ঘনফুট খয়ের কাঠ দিয়ে অন্তত পাঁচটা সানাই তৈরি হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে র‍্যাঁদা দিয়ে কাঠের গায়ে কুঁদে কুঁদে অতিরিক্ত অংশ বাদ দেন তিনি। “এইখানে একটা ভুল হলেই স্বরগুলো ঠিকঠাক ধরবে না,” জানালেন তিনি।

তবে শুধু র‍্যাঁদা দিয়ে কাঙ্খিত মসৃণতা আনতে পারলেন না নারায়ণ। এদিক ওদিক দেখে একটা সাদা রঙের বস্তা টেনে নিয়ে তার থেকে বার করলেন একটা কাচের বোতল। মাটিতে আছাড় দিয়ে বোতলটাকে ভেঙে সাবধানে কাচের একটা টুকরো তুলে নিয়ে আবার কাঠে হাত লাগালেন; নিজের জোড়াতাপ্পি ফন্দিতে নিজেই হাসছেন।

এর পরের ধাপ হল কুঁদে বার করা ফাঁপা চোঙাটির দুই প্রান্তে ছিদ্র করা মারাঠিতে গিরমিট নামে পরিচিত একধরনের লোহার দণ্ড ব্যবহার করে। এখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মহারাষ্ট্রের ইচলকরঞ্জি থেকে ২৫০ টাকায় কিনে আনা স্মার্টফোন আকারের একটা শানপাথর বা স্থানীয় ভাষায় ইমরি দিয়ে লোহার দণ্ডগুলিতে শান দেন তিনি। জানালেন, ধাতব জিনিসপত্র সব তিনি নিজেই বানিয়ে নেন, কারণ সবকিছু কিনতে গেলে পড়তায় পোষাবে না। এবার গিরমিট দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে চোঙার এপাশ-ওপাশ ফুঁড়ে দেন তিনি। সামান্য ভুলচুক হলেই তাঁর আঙুলে গেঁথে যাবে, কিন্তু নারায়ণ নির্বিকার। সদ্য তৈরি হওয়া ছিদ্রের ভেতর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে নেন তিনি। সন্তুষ্ট হয়ে এবার হাত লাগান সবচেয়ে কঠিন কাজটিতে – সাত স্বরের সাত ছিদ্র মাপমতো বসানো।

“এক মিলিমিটারও এদিক-ওদিক হলে স্বর বিকৃত হয়ে যাবে,” বলে যোগ করলেন, “একবার হয়ে গেলে ভুল শোধরানোর আর উপায় নেই।” এটা এড়াতে বৈদ্যুতিক তাঁতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাকুর উপর তিনি স্বর ছিদ্রগুলির মকশো করেন। তারপর মাটির চুল অর্থাৎ চুল্লিতে তিনটি ১৭ সেন্টিমিটার লম্বা লোহার রড গরম করতে দেন। “ড্রিলিং মেশিন কেনার সামর্থ্য নেই আমার। তাই এই সাবেক পদ্ধতিই ব্যবহার করি।” এই দণ্ড নিয়ে কাজ করতে শেখা সহজ হয়নি; বহুবার হাত পুড়েছে। তবে “ছেঁড়া-পোড়া আমাদের অভ্যেস আছে,” দ্রুতগতিতে পর্যায়ক্রমে রড গরম করা আর স্বরছিদ্র তৈরি করার ফাঁকে বলেন তিনি।

এই গোটা প্রক্রিয়াটায় প্রায় ৫০ মিনিট লাগে, প্রচুর ধোঁয়াও বেরোয় যার জেরে কাশির দমক ওঠে বারবার। কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যেও হাত থামে না তাঁর। “এটা তাড়াতাড়ি করতে হয়; নইলে রডগুলো ঠান্ডা হয়ে যায়, আর সেগুলোকে গরম করতে গেলে আরও বেশি ধোঁয়া বেরোয়।”

স্বরের ছিদ্রগুলি করা হয়ে গেলে সানাইটিকে জলে ধুয়ে নেন তিনি। “এই কাঠ জলে নষ্ট হয় না। আমি যে সানাই বানাই, তা অন্তত ২০ বছর চলে,” সগর্বে বললেন তিনি।

Narayan uses an iron rod to drill holes as he can't afford a drilling machine. It takes him around 50 minutes and has caused third-degree burns in the past
PHOTO • Sanket Jain
Narayan uses an iron rod to drill holes as he can't afford a drilling machine. It takes him around 50 minutes and has caused third-degree burns in the past
PHOTO • Sanket Jain

ড্রিলিং মেশিন কেনার সামর্থ্য নেই, তাই লোহার রড দিয়ে ছিদ্র করেন নারায়ণ। পুরো প্রক্রিয়াটায় সময় লাগে প্রায় ৫০ মিনিট, এবং এই কাজ করতে গিয়ে অতীতে তৃতীয় ডিগ্রির ছ্যাঁকাও খেয়েছেন তিনি

Narayan marks the reference for tone holes on a plastic pirn used in power looms to ensure no mistakes are made while drilling the holes. 'Even a one-millimetre error produces a distorted pitch,' he says
PHOTO • Sanket Jain
Narayan marks the reference for tone holes on a plastic pirn used in power looms to ensure no mistakes are made while drilling the holes. 'Even a one-millimetre error produces a distorted pitch,' he says
PHOTO • Sanket Jain

বৈদ্যুতিক তাঁতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাকুতে স্বরছিদ্রগুলির মকশো করেন নারায়ণ, যাতে ছিদ্র করার সময় কোনও ভুলচুক না হয়। ‘এক মিলিমিটারও এদিক-ওদিক হলে স্বর বিকৃত হয়ে যাবে,’ বলছেন তিনি

এবার সানাইয়ের জিভলি বা মুখ তৈরিতে হাত লাগান নারায়ণ। এটা তৈরিতে মারাঠিতে তাড়াচা পান নামে পরিচিত একধরনের চিরহরিত বেত ব্যবহার করেন তিনি। বেতের ঝাড়টিকে আগে ২০-২৫ দিন ধরে শুকোতে হয়, তারপর তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে ভালো বেতগুলি বেছে বেছে সেগুলিকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা লম্বা নলে ভাগ করা হয়। বেলগাভির আদি গ্রামে এই বেত কেনেন তিনি, দাম পড়ে ডজন প্রতি ৫০ টাকা। “ভালো পান [বেত] খুঁজে পাওয়া এখনও বেশ কঠিন,” জানালেন তিনি।

অতি যত্নে বেতের নলটিকে দুইবার মুড়ে নেন, তারপর আধ ঘণ্টার জন্য সেটিকে জলে ভিজিয়ে রাখেন। সানাইতে এই নলের ভাঁজ করা দুটি মুখই কেঁপে কেঁপে পরস্পরের অভিঘাতে বার করে কাঙ্খিত সুর। তারপর নলের দুটি মুখকে মাপমতো কেটে নিয়ে সাদা সুতো দিয়ে একটা গাঁইতির সঙ্গে সেটিকে বেঁধে রাখেন।

“জিভলি লা আকার দ্যায়চা কঠিন আস্তে [জিভলির সঠিক আকার দেওয়া কঠিন কাজ],” বলেন তিনি; বলিরেখা-অধ্যুষিত কপালের সিঁদুর ঘামের সঙ্গে বিস্রস্ত হয়ে যায় মনোসংযোগের চাপে। তীক্ষ্ণ ছুরির ঘায়ে তর্জনীতে ছোটবড় নানা দাগ পড়েছে, কিন্তু তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। “প্রতিটা ছোটো ছোটো কাটাছেঁড়ায় যদি মন দিতে যাই, তবে সানাইটা কে বানাবে?” হাসতে হাসতে বলেন তিনি। নলটা মনের মতো আকারে এসে গেলে এবার সানাইয়ের চওড়া মুখটায় প্লাস্টিকের ঘণ্টা লাগিয়ে দেন – সাবেকি পদ্ধতিতে যেখানে পিতলের ঘণ্টা বসানোর কথা।

তিনটি আলাদা দৈর্ঘ্যের সানাই বানান নারায়ণ, ২২, ১৮, আর ৯ ইঞ্চি। এদের দাম যথাক্রমে ২০০০ টাকা, ১৫০০ টাকা, আর ৪০০ টাকা। “২২ আর ১৮ ইঞ্চির জন্য অর্ডার একেবারেই বিরল; শেষ অর্ডার পেয়েছি ১০ বছর আগে,” জানালেন তিনি।

Narayan soaks tadacha paan (perennial cane) so it can easily be shaped into a reed. The reed is one of the most important element of shehnais, giving it its desired sound
PHOTO • Sanket Jain
Narayan soaks tadacha paan (perennial cane) so it can easily be shaped into a reed. The reed is one of the most important element of shehnais, giving it its desired sound
PHOTO • Sanket Jain

তাড়াচা পান-এর (চিরহরিত বেত) টুকরোটিকে জলে ভিজিয়ে রাখেন নারায়ণ, যাতে সহজে তাকে নলের আকার দেওয়া যায়। সানাইয়ের নলটি তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ; কাঙ্খিত স্বর বার হয় এই নলের অভিঘাতেই

Left: Narayan shapes the folded cane leaf into a reed using a blade.
PHOTO • Sanket Jain
Right: He carefully ties the reed to the mandrel using a cotton thread
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: ব্লেড দিয়ে চেঁছে চেঁছে ভাঁজ করা বেতের টুকরোটিকে নলের আকার দিচ্ছেন নারায়ণ। ডানদিকে: অতি সাবধানে নলটিকে গাঁইতির সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধছেন তিনি

চাহিদা পড়েছে তাঁর হাতে তৈরি কাঠের বাঁশিরও। “আজকাল কেউ কাঠের বাঁশি কেনে না, বলে অনেক দাম।” তাকি বছর তিনেক আগে কালো এবং নীল রঙের পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) পাইপ দিয়ে বাঁশি তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। পিভিসি বাঁশির দাম ৫০ টাকা করে, অন্যদিকে কাঠের বাঁশির দাম কাঠের গুণমান এবং বাঁশির দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে শুরুই হয় ১০০ টাকা থেকে। কিন্তু এই আপোষে নারায়ণ খুশি হতে পারেননি। “কাঠের আর পিভিসির বাঁশির মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না,” জানালেন তিনি।

প্রতিটি হস্তনির্মিত সানাই তৈরির পিছনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, চুল্লির ধোঁয়া থেকে কাশির দমক, ঝুঁকে ঝুঁকে বেতের কাজ করা থেকে সারাক্ষণের পিঠে ব্যথা, আর তার সঙ্গে ক্রমাগত কমতে থাকা মুনাফার কারণেই নতুন প্রজন্ম আর এই কাজে আগ্রহী হচ্ছে না, মনে করেন নারায়ণ।

সানাই বানানো যদি কষ্টকর হয়, সানাই বাজানো তার চেয়ে কিছু কম যায় না। ২০২১ সালে কোলাপুরের জ্যোতিবা মন্দিরে তাঁকে বাজানোর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। “একঘণ্টার মধ্যেই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, আমায় ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ দিতে হয়েছিল,” জানালেন তিনি। সেই ঘটনার পর থেকে সানাই বাজানো ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। “সহজ কাজ নয়। সানাই বাজানো শেষ হওয়ার পর যে কোনও সানাইবাদককে দেখবেন কেমন খাবি খাচ্ছে, তাহলেই বুঝতে পারবেন কতটা কঠিন সানাই বাজানো।”

কিন্তু সানাই বানানো ছেড়ে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা তাঁর নেই। “কলাত সুখ আহে [এই কলা আমায় আনন্দ দেয়],” জানালেন তিনি।

Left: Narayan started making these black and blue PVC ( Polyvinyl Chloride) three years ago as demand for wooden flutes reduced due to high prices.
PHOTO • Sanket Jain
Right: He is cutting off the extra wooden part, which he kept for margin to help correct any errors while crafting the shehnai
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: চড়া দামের কারণে কাঠের বাঁশির চাহিদা কমতে শুরু করায় তিন বছর আগে কালো আর নীল রঙের পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) পাইপ দিয়ে বাঁশি বানানো শুরু করেন নারায়ণ। ডানদিকে: সানাই বানানোর সময়ে কোনও ভুলচুক যদি হয়ে যায় তার জন্য বাঁচিয়ে রাখা অতিরিক্ত কাঠের অংশটি চেঁছে ফেলে দিচ্ছেন নারায়ণ

Left: Narayan has made more than 5000 shehnais , spending 30,000 hours on the craft in the last five decades.
PHOTO • Sanket Jain
Right: Arjun Javir holding a photo of Maruti Desai, his late grandfather, considered one of the finest shehnai players in Manakapur
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: গত পাঁচ দশকে ৫০০০টিরও বেশি সানাই বানিয়েছেন নারায়ণ, ৩০,০০০ ঘন্টারও বেশি সময় দিয়েছেন এই শিল্পে হাত পাকাতে। ডানদিকে: মানকাপুর গ্রামের সর্বোৎকৃষ্ট সানাইবাদক হিসেবে পরিচিত প্রয়াত মারুতি দেশাইয়ের ছবি হাতে তাঁর নাতি সানাইবাদক অর্জুন জাভির

*****

অনেক কাল আগেই নারায়ণ বুঝে গেছেন যে শুধু সানাই আর বাঁশি বানিয়ে সংসার চলবে না। তাই এখন থেকে তিরিশ বছর আগে আয়ের একটা দ্বিতীয় উপায় হিসেবে রঙিন কাগজের চরকি বানাতে শুরু করেন তিনি। “গ্রামের মেলায় এখনও চরকির ভালোই চাহিদা, কারণ সবাই তো আর স্মার্টফোন কিনে গেম খেলতে পারে না।” মাত্র ১০ টাকা দামের কাগজের খেলনাগুলি ক্রেতাদের মনে খুশি আনে, আর নারায়ণের ঘরে আনে অতি-প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত উপার্জন।

চটজলদি তৈরি হয়ে যাওয়া চরকি ছাড়াও ছোটো আকারের স্প্রিং এবং টানা খেলনা বানান তিনি। তাঁর পসরায় ২০টি আলাদা আলাদা ধরনের ওরিগ্যামি পাখি আছে, ১০-২০ টাকা দামে বিকোয় সেগুলি। “আমি কখনও আর্ট স্কুলে যাইনি। কিন্তু হাতে একবার কাগজ নিলে কিছু না কিছু বানিয়ে তবেই ছাড়ি,” বলেন তিনি।

কোভিড-১৯ অতিমারি এবং তৎপরবর্তী গ্রামের মেলা ও জনসমাগমের উপর নিষেধাজ্ঞায় তাঁর ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছিল। “দুই বছরে একটাও চরকি বিকোতে পারিনি,” জানালেন তিনি। ২০২২ সালের মার্চ মাসে অবশেষে মানকাপুরের মহাশিবরাত্রি যাত্রা দিয়ে খরা কাটে। কিন্তু একবার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে, তাই এখন অন্য লোক দিয়ে চরকি বিক্রি করান তিনি। “প্রতিটা বিক্রি হওয়া চরকির জন্য তিন টাকা করে কমিশন দিতে হয় ওদের,” জানাচ্ছেন তিনি। “এটা নিয়ে আমি খুশি নই, তবে কিছুটা আয় তো হয়,” জানালেন মাসে মোটে ৫০০০ টাকা উপার্জন করা নারায়ণ।

Left: Sushila, Narayan's wife, works at a brick kiln and also helps Narayan in making pinwheels, shehnais and flutes.
PHOTO • Sanket Jain
Right: Narayan started making colourful pinwheels three decades ago to supplement his income
PHOTO • Sanket Jain

বাঁদিকে: নারায়ণের স্ত্রী সুশীলা একটি ইটভাটায় কাজ করার পাশাপাশি তাঁকে চরকি, বাঁশি আর সানাই বানাতেও সাহায্য করেন। ডানদিকে: তিন দশক আগে আয়ের একটা দ্বিতীয় পথের খোঁজে রঙিন কাগজের চরকি বানাতে শুরু করেন নারায়ণ

Narayan marks the tone holes (left) of a flute using the wooden reference scale he made and then checks if it is producing the right tones (right)
PHOTO • Sanket Jain
Narayan marks the tone holes (left) of a flute using the wooden reference scale he made and then checks if it is producing the right tones (right)
PHOTO • Sanket Jain

নিজের তৈরি কাঠের স্কেল দিয়ে বাঁশির উপর স্বরছিদ্রের দাগ (বাঁদিকে) দিচ্ছেন নারায়ণ, তারপর পরীক্ষা করছেন (ডানদিকে) তাতে ঠিক ঠিক স্বর বেরোচ্ছে কিনা

তাঁর স্ত্রী, মধ্য চল্লিশের সুশীলা, একটি ইটভাটায় কাজ করেন, আর তার পাশাপাশি হাত লাগান চরকি বানানোর কাজেও। সানাই আর বাঁশি নির্মাণেও মাঝে মাঝে সাহায্য করেন তিনি, আর সেইভাবেই লঙ্ঘন করে যান বহু শতাব্দী ধরে পুরুষের কুক্ষিগত এক পরিসরের লক্ষ্মণরেখা। “সুশীলা আমায় সাহায্য না করলে এই শিল্প কবেই অবলুপ্ত হয়ে যেত,” বলছেন নারায়ণ। “এই সংসারটা চালাতে ও অনেক করে।”

“আমি বেশি কিছু পারি না। শুধু এক জায়গায় বসে বসে নানা জিনিস বানাই,” সবিনয়ে বলে ওঠেন তিনি। “আমহি গেল ম্‌হাঞ্জে গেলি কলা [আমি চলে গেলে এই কলাও চলে যাবে],” বলেন তিনি। তারপর হাতে তুলে নেন ফ্রেমে বাঁধানো এক ফোটোগ্রাফ; সেখানে একসঙ্গে বসে সানাই বাজাচ্ছেন তাঁর বাবা ও দাদু।

মৃণালিনী মুখার্জি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় লিখিত সংকেত জৈনের এই প্রতিবেদনটি গ্রামীণ কারিগরদের ঘিরে সৃষ্ট একটি সিরিজের অংশ।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Sanket Jain

ସାଙ୍କେତ ଜୈନ ମହାରାଷ୍ଟ୍ରର କୋହ୍ଲାପୁରରେ ଅବସ୍ଥାପିତ ଜଣେ ନିରପେକ୍ଷ ସାମ୍ବାଦିକ । ସେ ୨୦୨୨ର ଜଣେ ବରିଷ୍ଠ ପରୀ ସଦସ୍ୟ ଏବଂ ୨୦୧୯ର ଜଣେ ପରୀ ସଦସ୍ୟ ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Sanket Jain
Editor : Sangeeta Menon

ସଙ୍ଗୀତା ମେନନ ମୁମ୍ବାଇରେ ଅବସ୍ଥାପିତ ଜଣେ ଲେଖିକା, ସମ୍ପାଦିକା ଓ ସଞ୍ଚାର ପରାମର୍ଶଦାତା।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Sangeeta Menon
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Dyuti Mukherjee