আগে থাকতে মালুম হয়নি, এ যে সত্যিই ভোজবাজির খেল! দোকানের পিছনে রাখা একটি পুরাতন নীল বাক্স খুলে সাতরাজার ধন বার করছিলেন ডি. ফাতিমা। শিল্পের নমুনা বই তো নয়: বড়ো বড়ো, তাগড়া মাছ, ডেরা যাদের থুথুকুড়ি ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রে, আজ তারা সূর্য, লবণ ও দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় শুকিয়ে শুঁটকি বনে গেছে।
একখান কাট্টা পারই মীন বা রূপসা মাছ তুলে মুখের সামনে ধরলেন ফাতিমা। লম্বায় তাঁর আধা, গলাখানা তাঁর হাতের মতন চওড়া। মুড়ো থেকে ল্যাজা অবধি শুকিয়ে যাওয়া গভীর ক্ষত। ধারালো ছুরি দিয়ে মাছটার নধরকান্তি মাংস কেটে নাড়িভুঁড়ি বার করেছিলেন, এ তারই চিহ্ন। তারপর রূপসাটির পেটে নুন ভরে গনগনে রোদ্দুরে ফেলে রেখেছিলেন। এই মুলুকে সূর্যের তেজ এতটাই যে মাছ, মাটি, মানুষ — সব্বাই শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়...
ফাতিমার চোখমুখ আর দুহাতের বলিরেখা সেই ঝলসানো দিনযাপনের দাস্তান শোনায়। তবে সেসব সরিয়ে রেখে আপাতত অন্য একখানা গল্প জুড়লেন মানুষটি। সে এক ফেলে আসা সময়ের কথা, তাঁর আচি (ঠাকুমা/দিদা) যখন শুঁটকি বানিয়ে বেচতেন। সে এক অন্য শহর, এক অন্য সড়ক, আর সড়ক পেরিয়ে মোটে হাতখানেক চওড়া একটি খালের কাহিনি। এই খালপাড়েই ছিল তাঁদের পুরোনো বসতবাটি। এই গাথা ২০০৪ সালের সেই সুনামির। রাক্ষুসে ঢেউটা একরাশ জঞ্জাল বয়ে এনেছিল বটে তাঁদের জীবনে, তবে তার সঙ্গে নতুন বাস্তুভিটার প্রতিশ্রুতিও ছিল। অবশ্য একখান সমস্যাও ছিল। ঘাড় এলিয়ে, দিগন্তপানে হাত দেখিয়ে ফাতিমা জানালেন, নয়া ভিটেখানি “রম্ভা ধূরম [অনেক দূর],” ছিল। বাসে আধাঘণ্টা লাগত। আর যাতায়াত না করেও উপায় নেই, মাছ কিনতে সাগরতীরে তো আসতেই হবে।
ন’বছর পর, বোনদের সঙ্গে পুরোনো পাড়ায় ফিরে এসেছিলেন ফাতিমা — তেরেসপুরম, থুথুকুড়ির শহরের একপ্রান্তে। সারি সারি ঘরবাড়ি আর দোকানের পাশে আগের সেই খালটি আছে বটে, তবে সেটা যেমন চওড়া হয়েছে, পানির বেগও হয়েছে মন্থর। মন্থর আজকের বিকেলটাও — খানিক লবণ আর অনন্ত সূর্য মিশিয়ে নারীর জিন্দেগি বাঁচিয়ে রাখে যে শুঁটকি, ঠিক তারই মতো অনড়, অটল।
বিয়েথা করা পর্যন্ত দাদির মাছ ব্যবসার যুক্ত ছিলেন ৬৪ বছরের প্রৌঢ়া ফাতিমা। দুই দশক আগে শোহরের ইন্তেকাল হলে আবারও ফিরে আসেন এই ধান্দায়। আট বছর বয়সের কথা মনে পড়ে ফাতিমার, সেই যখন টাটকা তাজা জ্যান্ত মাছভর্তি জাল টেনে আনা হত দরিয়াপাড়ে। অথচ ৫৬ বছর বাদে, আজ সবই ‘বরফের মীন।’ বরফ-বোঝাই নৌকায় চেপে ফিরে আসে মৃত মাছের ঝাঁক। ইয়াব্বড়-বড় মাছ সব, লাখ লাখ টাকার বিকিকিনি চলে। “তখনকার দিনে আনা, পয়সা, এসবের কারবার ছিল, একশো টাকার মূল্য ছিল বিশাল, আর আজ তো হাজার বা লাখের নিচে কথাই নেই কোনও।”
তাঁর আচির সময় মহিলারা যেখানেই যান না কেন, হেঁটেই যেতেন। মাথায় থাকত তালপাতার ঝুড়িভর্তি শুঁটকি মাছ। “ওঁরা ১০ কিলোমিটার হেঁটে বিভিন্ন পাত্তিকাডুতে [জনপদ] যেতেন মাছ বেচতে।” আর আজ তার জায়গায় অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় মাছ থাকে, যাতায়াত করেন বাসে। আশপাশের প্রতিটা জেলা, প্রতিটা ব্লকে, এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম শুঁটকি বেচে ফেরেন তাঁরা।
২০২২ সালের অগস্ট মাসে পারি দেখা করে তাঁর সঙ্গে, তখন বাতাস কেটে এ অঞ্চলের মানচিত্র এঁকে তিনি বলেছিলেন, “তিরুনেলভেলি সড়ক আর তিরুচেন্দুর সড়কের উপর যে গ্রামগুলো আছে, করোনার আগে আমরা সেখানে যেতাম। তবে ইদানিং শুধু এরাল শহরের সান্থই-এই [হাট] যাই, ফি সোমবারে।” মুখে মুখে রাহাখরচের একটা হিসেব দিলেন — অটোয় চেপে বাস-ডিপোয় পৌঁছে, ঝুড়ি বাবদ বাসভাড়া মিলিয়ে কড়কড়ে দুশো টাকা। “উপরন্তু হাটের প্রবেশমূল্য রয়েছে, পাঁচশো [টাকা]। রোদ্দুর মাথায় নিয়ে বসি [খোলা আসমানের নিচে], তাও এইটাই যে বাঁধা দর।” তবে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার শুঁটকি বেচেন ফাতিমা, তাই খরচাপাতির পরিমাণটা গায়ে লাগে না বিশেষ।
কিন্তু খান চারেক সোমবার জুড়ে তো আর গোটা একটা মাস হয় না। এ কারবারের সঙ্গে যুক্ত নানান সমস্যা বিষয়ে ফাতিমার ধারণা বেশ স্বচ্ছ। “কয়েক দশক আগেও, জেলেদের থুথুকুড়ি ছাড়িয়ে খুব একটা দূরে যেতে হত না, তাও বিশাল পরিমাণে মাছ ধরে ফিরতেন। আর আজ? সাত সাগর পাড়ি দিয়েও মাছ-টাছ জোটে না তেমন।”
আপন রক্তমাংসের অভিজ্ঞতা থেকে দুকথায় মাছ কমে যাওয়ার ইতিবৃত্ত তুলে ধরলেন ফাতিমা, এক মিনিটও লাগল না। “সে যুগে জেলেরা আজ রাত্রে বেরিয়ে কাল সন্ধেয় ফিরে আসতেন। আজ একেক দফা সমুদ্রযাত্রায় ১৫-২০ দিন কেটে যায়, সুদূর কন্যাকুমারী, মায় সিংহল আর আন্দামান অবধি যেতে হয়।”
এলাকাটা বিশাল, সমস্যার পরিধিটাও। থুথুকুড়ি লাগোয়া অঞ্চলে ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে জালে ওঠা মাছের পরিমাণ। তবে হ্যাঁ, এ মুসিবতের উপর ফাতিমার কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও আপন জীবন ও জীবিকা রাশ কিন্তু পুরোপুরি তাঁর নিজের হাতে।
সে সমস্যার কথা তিনি বলছেন, তার একটা বাহারি নাম আছে: ওভারফিশিং, অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত মাছ-ধরা। চট করে গুগলে দেখে নিন, ১৮ লক্ষ উত্তর পেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। এতটাই জলবৎ তরলং মুসিবত। রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংগঠনের (এফএও) মতে এর কারণ, “২০১৯ সালে, বিশ্বভর প্রাণীজ প্রোটিনের ১৭ শতাংশ ও সকল প্রোটিনের ৭ শতাংশের উৎস ছিল জলজ খাদ্য ।” অর্থাৎ বছর বছর “মহাসাগর থেকে ৮-৯ কোটি টন বন্য জলজ খাদ্য” তুলে নিই আমরা, জানাচ্ছেন আমেরিকার ক্যাচ অ্যান্ড ফোর ফিশ-এর লেখক পল গ্রীনবার্গ। পরিমাণটা হতভম্ব করে দেওয়ার মতোই, কারণ গ্রীনবার্গের মতে এটা “ চিনের মোট জনসংখ্যার দৈহিক ওজনের সমান।”
আর ঠিক এখানেই নিহিত আমাদের কাহিনি। সব মাছ টাটকা খাওয়া হয় না। মাংস বা শাকসবজির মতো এটাও ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা হয়। আর নুনে জারিয়ে রোদে শুকানোর কায়দাটা দুনিয়ার প্রাচীনতম প্রক্রিয়ার অন্যতম।
*****
শুঁটকি শুকোয় ওই দরিয়ার বালির চরে,
তেল জ্যাবজ্যাব হাঙর খেতে আইল উড়ে,
হুররর হুট হুট তাড়িয়ে পাখি যাচ্ছি ফিরে,
কী ছাই তুঁহার সাত গুণাগুণ? বেকার সবই।
আঁশটে মোদের গন্ধ গায়ে! ভাগ তো দেখি!
নাত্রিনাই ৪৫ , নেইতাল তিনই (সাগরপাড়ের গান)
কবি অজানা। নায়িকার সই যা বলেছিল নায়ককে।
এই কালোত্তীর্ণ পদটি ২,০০০ বছর পেরিয়ে আসা প্রাচীন তামিল সঙ্গম সাহিত্যের অংশ। উদ্ধৃত পংক্তিগুলি ছাড়াও এই কাব্যে কয়েকটি বেশ মজাদার জিনিসের উল্লেখ রয়েছে: লবণ কারবারি, আর তাদের পসরা সাজানো গাড়ি কীভাবে উপকূল থেকে যাতায়াত করত। তার মানে বুঝি এই যে, নুনে জারিয়ে মাছ শুকানোর প্রথাটা অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাতেও ছিল?
ইতিবাচক উত্তর মিলল খাদ্য-গবেষণায় পণ্ডিত ড. কৃষ্ণেন্দু রায়ের কাছে। “বহির্মুখী, বিশেষত সাগরচারী সাম্রাজ্যগুলির হয়তো মাছধরার সঙ্গে অন্যরকমের সম্পর্ক ছিল। এর পিছনে খানিকটা হলেও যে কারণটা রয়েছে, তা হল মৎস্যজীবীদের থেকেই নৌকা নির্মাণ তথা নৌকা চালানোর দক্ষ শ্রম পেয়ে যেত এই সাম্রাজ্যগুলি, এই একই জিনিস আমরা পরবর্তী যুগে ভাইকিং, জেনোইজ, ভেনেশিয়ান, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের মধ্যে দেখেছি।”
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও জানালেন, “রেফ্রিজেরশনের আগে নুনে জারানো, বাতাসে শুকোনো, ধোঁয়ায় স্যাঁকা আর গাঁজানো (ফিস সস্ রূপে) ছাড়া এই ধরনের মূল্যবান প্রোটিন সংরক্ষণ করার আর কোনও উপায় ছিল না; দূর-দূরান্তের জাহাজযাত্রায় রসদ বলতে এটাই ছিল, নইলে সময় আর দূরত্বের মোকাবিলা অসম্ভব। এই কারণেই মধ্যোপসাগর ঘিরে রোম সাম্রাজ্যে গারুমের [গাঁজিয়ে তৈথি একপ্রকারের মাছের সস্] এতখানি কদর ছিল, যা রোমের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে যায়।”
এফএও-র আরেকটি রিপোর্ট মোতাবেক, তামিলনাড়ুতে প্রচলিত কারিগরি প্রক্রিয়াকরণে “সাধারণত পচনকারী জীবাণু আর এনজাইম নষ্ট হয়ে যায় , এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যেটা অণুজীব বৃদ্ধি ও বিস্তারের জন্য অনুপযুক্ত।”
উক্ত রিপোর্ট অনুসারে নুনে জারানো “মাছ সংরক্ষণের একটি সস্তা পন্থা। নুনে জারানোর দুটি প্রচলিত কায়দা আছে: শুকনো জারানো, যেখানে সরাসরি মাছের গায়ে লবণ মাখানো হয়; আর ব্রাইনিং, যেখানে গাঢ় নুনজলে মাছ চুবিয়ে রাখা হয়।” এমত অবস্থায় মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয় মাছগুলি।
এ হেন সুপ্রাচীন বিরাসত ও প্রোটিনের সস্তা ও সহজলভ্য উৎস হওয়া সত্ত্বেও জনসমাজে হাসিঠাট্টার খোরাক হয়ে থেকেছে কারুভাডু [তামিল ছায়াছবির কথাই ধরুন না হয়]। স্বাদের শ্রেণিবিভাগেই বা এর স্থান কোথায়?
“চিন্তনের অনুক্রমে একাধিক পরত রয়েছে। সর্বগ্রাসী স্থলজ জীবন যেখানেই তার আধিপত্য বিস্তার করেছে — ব্রাহ্মণ্যবাদের কিছু ধারার হাতে হাত মিলিয়ে — সেখানে জলজ জীবন ও জীবিকার ভাগে জুটেছে চূড়ান্ত অবমূল্যায়ন এবং সংশয়, কথাটা নোনাপানির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্যি... জাতপাতের জন্মের সঙ্গে খানিকটা হলেও স্থান ও পেশার সম্পর্ক রয়েছে, তাই বৈষম্যের শিকার হয়েছে মাছ-ধরা,” বললেন ড. রায়।
তাঁর মতে মাছই, “সর্বশেষ বন্যপ্রাণ যা আমরা ব্যাপকহারে ধরে খাই। এই কারণে হয় তার মূল্য অপরিসীম, কিংবা সে অবজ্ঞার ভাগীদার। ভারতের যে যে অঞ্চলে সংস্কৃতায়ন ঘটেছে সেখানে সেখানে আবাদযোগ্য জমি, মন্দির বিনিয়োগ এবং জলবাহী অবকাঠামোয় সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগের সঙ্গে আঞ্চলিকতা, গৃহস্থজীবন এবং শস্য উৎপাদনের মূল্যায়ন হয়েছে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পণ্য হিসেবে, এমন বহু জায়গায় মাছ-ধরা ও খাওয়া ঐতিহাসিকভাবে তাচ্ছিল্যের শিকার।”
*****
সানশেডের একচিলতে ছায়ায় বসে একপিস পূমীন বা পাঁচ কাটি মাছের আঁশ ছাড়াচ্ছিলেন সহায়াপুরানি। খচর খচর শব্দে ছুরি চলছিল তেরেসপুরম নিলামকেন্দ্রে ৩০০ টাকায় কেনা তিন কিলো ওজনের মাছটির গায়ে। ফাতিমার দোকানের ঠিক উল্টোমুখে তাঁর কাজের জায়গা, মাঝে বহমান একটি খাল। কালচে বিদঘুটে পানি, জলের চাইতে পাঁকই বেশি। পাঁচ কাটির আঁশগুলো চারিদিকে ছিটকে যাচ্ছিল — কেউ কেউ বাধ্য বাচ্চার মতো মাছের পাশেই শুয়ে পড়ছে, কেউ বা তিড়িং করে লাফিয়ে আমার পায়ে এসে পড়ছে। আঁশগাত্রে ঠিকরে ওঠা আলোর ঝিকিমিকি। কয়েকটা আঁশ আমার জামায় এসে লাগায় হেসে উঠলেন সহায়াপুরানি। বড্ড সারল্য ভরা ছিল চকিতের সেই হাসিটা। আমরাও না হেসে পারলাম না। আঁশ ছাড়ানোর শেষে শুরু হল কাটাকাটির পালা। দক্ষ দুই কোপে বাদ পড়ল পাখনাগুলো। তারপর মাছের মুড়োটা ঈষৎ চিরে কাস্তে দিয়ে কোপাতে লাগলেন। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে ছয় কোপে আলাদা হয়ে গেল মুণ্ডুটা।
একটা সাদা কুকুর বেঁধে রাখা ছিল পিছনে, প্রখর দাবদাহে জিভ বার করে হাঁপাচ্ছিল বেচারা। ওদিকে সহায়াপুরানি ততক্ষণে নাড়িভুঁড়ি ছাড়িয়ে ছুরির সাহায্যে বইয়ের মতো খুলে ফেলছেন পাঁচ কাটির দেহটা। কাস্তে দিয়ে মোটা মোটা আর ছুরি দিয়ে সরু সরু করে চিরে দিলেন পেশিগুলো। তারপর, একহাতে মুঠো মুঠো নুন তুলে মাছের গায়ে ঘষতে লাগলেন, চিরে দেওয়া ক্ষতগুলো ভরে উঠল একে একে। গোলাপি মাংসে এখন সাদাটে দানার বিচ্ছুরণ। এবার শুকোতে দেওয়া হবে। কাস্তে, ছুরি, হাত — একে একে সব ধুয়েমুছে ঝেড়েঝুড়ে শুকিয়ে নিয়ে বললেন, “আসুন।” সহায়াপুরানির পিছু পিছু তাঁর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
সামুদ্রিক মৎস্যপালন সুমারি ২০১৬ অনুসারে, তামিলনাড়ুর মৎস্যজীবীদের মধ্যে ২.৬২ লাখ মহিলা ও ২.৭৪ লাখ পুরুষ। শুধু তাই নয়, সামুদ্রিক মাছ ঘিরে যাঁদের রুজিরুটি, এমন ৯১ শতাংশ পরিবারের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে (বিপিএল)।
রোদ এড়িয়ে বসেছিলাম আমরা। দিনে কতটা বিক্রি হয়, জিজ্ঞেস করলাম সহায়াপুরানিকে। জবাব এল, “আন্দাভার [যিশু] আমাদের জন্য কী ঠিক করে রেখেছেন, তার উপর নির্ভর করছে।” আমাদের কথোপকথনে খ্রিস্টদেবের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসতে থাকল। “তাঁর নেকনজর থাকলে যদি শুঁটকির পুরোটাই বেচতে পারি, তাহলে সকাল ১০.৩০টার মধ্যে বাড়ি ফিরে যাব।”
মুখ বুজে আপোস করে নেওয়ায় তিনি যে কতটা সিদ্ধহস্ত, সেটা তাঁর কাজের জায়গাটা দেখলেই বোঝা যায়। মাছ শুকানোর জন্য খালপাড়টাকেই বেছেছেন সহায়াপুরানি। জায়গাটা একেবারেই আদর্শ নয়, স্বীকার করলেন বটে, কিন্তু আর উপায়ই বা কী আছে? কাঠফাটা রোদ্দুর তো আছেই, উপরন্তু অসময়ে বৃষ্টি নামলে না তিনি, না তাঁর শুঁটকি — রক্ষে পায় না কেউই। “এই তো সেদিন, মাছে নুন মাখিয়ে শুকোতে দিয়ে সবেমাত্র বাড়ি এসে দুচোখের পাতা এক করেছি...তক্ষুনি একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে জানাল যে বৃষ্টি নেমেছে, শোনামাত্র তড়িঘড়ি দৌড়লাম, কিন্তু অর্ধেক মাছ ততক্ষণে ভিজে একসা হয়ে গেছে। বুঝতেই তো পারছেন, চুনোমাছ হলে বাঁচানো যায় না, সব পচে যায়।”
৬৭ বছরের এই প্রৌঢ়া একদা তাঁর চিতি, অর্থাৎ ছোটমাসির কাছে শুঁটকি বানানোয় হাতেখড়ি নিয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মাছের কারবার বেড়েছে ঠিকই, তবে দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে শুঁটকিভক্ষণ। “কারণ যাঁরা যাঁরা মাছ খেতে ইচ্ছুক, তাঁরা খুব সবজেই টাটকা মাছ পেয়ে যান। একেক সময় তো বেশ সস্তাতেই বিক্রি হয়। তাছাড়া হররোজ সেই এক জিনিস থোড়াই না খেতে মন চায়, তাই না? হপ্তায় দুদিন মাছ খেলে একদিন বিরিয়ানি খাবেন, অন্যদিন সম্বর, বাকিদিন রসম, সোয়াবিনের বিরিয়ানি ইত্যাদি...”
তবে আসল কারণটা হল চিকিৎসকদের পরস্পরবিরোধী মতামত। “কারুভাডু খাবেন না, বড্ড নোনতা।’ ডাক্তারবাবুরা বলেন যে এটা খেলে রক্তচাপ বাড়ে। তাই লোকে আর শুঁটকি ছুঁয়েও দেখে না।” ডাক্তারি উপদেশ আর ব্যবসায় মন্দার কথা বলতে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছিলেন সহায়াপুরানি, তারপর বাচ্চাদের মতো তলার ঠোঁট বেঁকিয়ে মুখ ভ্যাংচালেন — এই বালখিল্যতায় একই সঙ্গে তাঁর হতাশা ও দুর্বলতা গোচর হল।
কারুভাডু তৈরি হয়ে গেলে বাড়িতেই মজুত করে রাখেন তিনি — ধান্দার জন্য বরাদ্দ পাশের কামরায়। “বড়ো মাছগুলো সাধারণত বহু মাস টেকে,” বললেন তিনি। যেভাবে মাছের গায়ে আঁচড় কেটে ঘষে ঘষে নুন বসিয়ে দেন চেরা জায়গাগুলোয়, তাতে নিজ দক্ষতার উপর তাঁর আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট হয়। “খদ্দেররা অনেক সপ্তাহ এটা রেখে দিতে পারে। আর যদি হলুদ মাখিয়ে, খানিক লবণ ছড়িয়ে, খবরের কাগজ দিয়ে ভালোভাবে জড়িয়ে বাতাসবন্ধ কৌটোয় ভরে রাখে, তাহলে ফ্রিজের মধ্যে আরও অনেকদিন ফেলে রাখা সম্ভব।”
তাঁর আম্মার যুগে আরও ঘনঘন শুঁটকিভক্ষণ চলত। শামাধানের জাউ (মিলেট পোরিজ) সহকারে খাওয়া হতো কারুভাডু ভাজা। “বড়সড় একখান পাত্র নিয়ে, সজনেডাঁটা, বেগুন আর শুঁটকির ঝোল বানিয়ে সেটা জাউয়ের উপর ঢালা হত। কিন্তু আজকাল তো আবার ‘টিপ-টপের’ যুগ চলছে,” অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন সহায়াপুরানি, “আরে এখন তো ভাতও ‘টিপ-টপ’ হয়ে গেছে, লোকে আলাদা করে সবজির কূটু [ডাল সহকারে রাঁধা হয়] আর ডিমভাজা খায় তার সঙ্গে। ৪০ বছর আগে সবজি কূটুর নামই শুনিনি।”
অধিকাংশ দিনই ভোররাত ৪.৩০টেয় ঘর ছাড়েন, গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরে বেড়ান বাসে চেপে — বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে। “গোলাপি বাসে বিনাপয়সায় চড়ি,” ২০২১ সালে মুখ্যমন্ত্রী এম.কে. স্তালিন তামিলনাড়ুর মহিলাদের জন্য বিনা টিকিটে বাসযাত্রার যে যোজনাটি ঘোষণা করেছিলেন, সেটারই কথা বলছিলেন সহায়াপুরানি। “তবে ঝুড়ির জন্য ফুল টিকিট কাটতে হয়। কখনও ১০ টাকা, কখনও বা ২৪। সেটা অবশ্য অনেককিছুর উপর নির্ভর করে।” মাঝেসাঝে ১০ টাকার একটি করে নোট গুঁজে দেন কন্ডাক্টরের হাতে। মুচকি হেসে জানালেন, “ওইটা করলে তেনারা একটু বেশি ভদ্র হয়ে ওঠেন।”
গন্তব্যে পৌঁছে, গাঁয়ের পথে পথে মাছ ফেরি করেন। কাজটা যে খুবই কঠিন শ্রমসাধ্যও, সেটা স্বীকার করলেন তিনি। রেষারেষিও বহুত। “টাটকা মাছ বেচার সময় কাজটা আরও ঝক্কির ছিল। যতক্ষণে আমরা পায়ে হেঁটে দুটো ঘরে ঢুঁ মারতাম, ততক্ষণে দুচাকায় চেপে মরদরা ১০ ঘরে মাছ বেচে ফেলত। হাঁটতে হাঁটতে জান ঢিলা হয়ে যেত, উপরন্তু মরদরা হরবখত আমাদের চেয়ে সস্তায় বেচে দিত।” নিজেকে তাই শুঁটকির জগতেই বেঁধে করে রেখেছেন সহায়াপুরানি।
মরসুমের সঙ্গে বদলাতে থাকে শুঁটকি মাছের চাহিদা। “গাঁয়ে পালা-পরব লাগলে লোকে দিনের পর দিন, এমনকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ নিরামিষ খায়। প্রচুর মানুষ এমনটা করলে আমাদের বিক্রিবাটা তলানিতে ঠেকে বৈকি।” আর এসব আচার-বিচার যে আনকোরা নতুন, সেটাও জানালেন সহায়াপুরানি, “পাঁচ বছর আগেও দেখেছি এসব ধর্মীয় নিয়মকানুন খুবই কম লোক মানত।” তবে উৎসবের সময় আর তার পরে, যখন ছাগল বলি দিয়ে মহাভোজের আয়োজন হয়, তখন আত্মীয়দের জন্য প্রচুর পরিমাণে মাছের বরাত দেয় লোকে। “কখনও কখনও তো এক কিলো অবধিও কিনতে চায়,” তাঁর মেয়ে, ৩৬ বছর বয়সি ন্যান্সি বুঝিয়ে বললেন আমাদের।
মন্দার মাসে কর্জের ভরসায় জীবন কাটে এই পরিবারটির। ন্যান্সির কথায়, “দশ পয়সা সুদ, দৈনিক সুদ, সাপ্তাহিক সুদ, মাসিক সুদ। বর্ষাকাল এবং অন্যান্য সময়, যখন মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, তখন এভাবেই দিন চলে আমাদের। কেউ কেউ গয়নাগাঁটি বন্ধক রাখে। হয় সোনার দোকানে বা ব্যাংকে। আমরা ধারদেনা না করলে...” পেশায় সমাজকর্মী মেয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাক্যটা সম্পূর্ণ করলেন মা, “খাবার কিনতে পারব না।”
শুঁটকির ব্যবসায় মেহনত আর মুনাফা সমান নয়। সক্কাল সক্কাল নিলামে ১,৩০০ টাকার মাছ কিনে ৫০০ টাকা লাভ হয় বটে, তবে সেটার জন্য দুই-দুই চারদিন খেটে মরেন সহায়াপুরানি। প্রথম দুটো দিন কাটে সাফ-সাফাই, নুন মাখিয়ে, মাছ শুকিয়ে শুঁটকির তৈরিতে, পরের দুটো দিন কাটে বাসে চেপে ফেরি করতে। সময় আর শ্রম মিলিয়ে দৈনিক ১২৫ টাকা তো হচ্ছেই, তাই না? সওয়ালটা না করে থাকতে পারলাম না।
উত্তরে শুধু ঘাড় নেড়েছিলেন মানুষটি। এবার কিন্তু হাসির ছিটেফোঁটাও দেখলাম না তাঁর চোখমুখে।
*****
থুথুকুড়ির শুঁটকি ধান্দায় মানবসম্পদ আর অর্থনীতির ছবিটা ধোঁয়াশায় ভরা। তামিলনাড়ুর সামুদ্রিক মৎস্যপালন সুমারিতে খানিক পরিসংখ্যান মেলে: তেরেসপুরমে মাছ জারানো ও প্রক্রিয়াকরণে সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৭৯ জন, সমগ্র তুতিকোরিন জেলায় যে সংখ্যাটা ৪৬৫। এই রাজ্যে মোটে ৯ শতাংশ মৎস্যজীবী এই কারবারে যুক্ত। অথচ তাঁদের মধ্যে ৮৭ শতাংশই মহিলা। এফএও-র এই রিপোর্টটি অনুযায়ী: বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানের নিরিখে এটি অনেকখানি বেশি, কারণ “ক্ষুদ্র মৎস্যপালন শিল্পের সংগ্রহ-পরবর্তী খাতে যতজন মজুর রয়েছেন, তার আর্ধেক” মহিলা।
তবে মুনাফা-লোকসানের খতিয়ান খোঁজা হন্যে হয়ে যাওয়ার সামিল। দৈত্যাকার যে ৫ কেজির মাছটার দাম ১,০০০ টাকা হওয়া উচিত, সেটাই কিঞ্চিৎ নরম হয়ে গেলে মোটে ৪০০ টাকায় বিকোয়। মেয়েদের জবানে যেটার নাম ‘গুলুগুলু’, তাকে বোঝাতে গিয়ে আঙুলে আঙুল চেপে ধরেন, ঠিক যেন অদৃশ্য কোনও প্রাণী ধরা পড়েছে দুই আঙুলের ফাঁকে। টাটকা মাছের ব্যবসায়ীর চোখে এসব মাছ বাতিল, অথচ কারুভাডু কারিগররা এগুলোই খুঁজে ফেরেন। ছোটো কুঁচে মাছের চেয়ে গুলুগুলু বড়ো মাছের চাহিদা বেশি, কারণ সেক্ষেত্রে জারানোর কাজে অতটা সময় নষ্ট হয় না।
ঘণ্টাখানেক ঘাম ঝরিয়ে পাঁচ কিলোর মাছটা তৈরি করেছিলেন ফাতিমা। তাঁর মতে, ওই একই ওজনের ছোটো ছোটো মাছ হলে দুগুণ সময় লাগত। লবণের পরিমাপেও তারতম্য আছে। বড়ো গুলুগুলু মাছ হলে মাছের ওজনের আধা নুন লাগে, আর চুনো মাছ হলে ওজনের এক-অষ্টমাংশ।
শুঁটকি উৎপাদকেরা সরাসরি উপ্পালাম বা লবণভাটি থেকে নুন খরিদ করেন। বাঁধাধরা কোনও পরিমাণ নেই — কতটা ইস্তেমাল করবেন, সেই আন্দাজ মতো ১-৩ হাজার টাকার নুন কেনেন। রাহাখরচের জন্য আছে সাইকেল কিংবা ‘কুট্টিয়ানই’ (আক্ষরিক অর্থে ‘ছোটো হাতি’, ক্ষুদ্র টেম্পো গাড়িগুলি এই নামেই পরিচিত)। তারপর নিজ নিজ ভিটের কাছে নীলচে প্লাস্টিকের লম্বাটে পিপেয় মজুত করেন।
কারুভাডুর প্রক্রিয়াটা সেই তাঁর ঠাকুমার যুগ থেকে আজ অবধি একটুও পাল্টায়নি, বুঝিয়ে বললেন ফাতিমা। মাছের পেট চিরে, নাড়িভুঁড়ি বার করে আঁশ ছাড়ানো হয়। তারপর গায়ে নুন মাখিয়ে, পেটে নুন ভরে শুকোনো হয় রোদ্দুরে। তাঁদের কাজটা যে সাফসুতরো, সে বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে কয়েক ঝুড়ি মাছ দেখালেন আমায়। একটায় রয়েছে হলুদে জারানো টুকরো করে কেটে রাখা শুঁটকি। একেক কিলো ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিকোবে। কাপড়ের একটা গাঁঠরিতে রয়েছে ঊলি মীন (ব্যারাকুডা), আর তার তলায় প্লাস্টিকে জড়ানো আছে সালই কারুভাডু (সার্ডিন) বা খয়রা শুঁটকি। পাশের গুমটি থেকে হাঁক পাড়লেন ফ্রেডেরিকে, ইনি ফাতিমার বোন, “আমাদের কামকাজ যদি ‘নাকরেই মূকরেই’ (ছন্নছাড়া আর অপরিচ্ছন্ন) হয়, কেউ থোড়াই কিনবে? আজকাল তো তাবড় তাবড় লোকে আমাদের কাছ থেকে কেনে — মায় পুলিশও! আমাদের কারুভাডুর বেশ নামডাক হয়েছে।”
দুই বোনের উপরি রোজগার বলতে হাজারটা কাটাছেঁড়া। নিজের দুটি হাত আমার সামনে মেলে ধরলেন ফ্রেডেরিকে। হাত তো নয়, যেন ছুরিকাঘাতের জীবন্ত দলিল। অজস্র ক্ষতচিহ্ন — কোনওটা ছোট্ট, কোনওটা গভীর — হাতের রেখায় তাঁর ভবিষ্যৎ যত না ভালোভাবে বোঝা যায়, ছড়েকেটে যাওয়ার দাগে তার চেয়ে ঢের স্পষ্ট ফ্রেডেরিকের অতীত।
“বোনের বর মাছ কিনে আনে, চার বোন মিলে সেটা শুকিয়ে-টুকিয়ে বেচি,” গুমটির ভিতর, ছায়ায় বসতে বসতে জানালেন ফাতিমা। “চার-চারবার অপারেশন হয়েছে জামাইবাবুর; মাছ ধরতে আর সাগরে যেতে পারে না। তাই কয়েক হাজার টাকার করে মাছ কিনে নেয় — হয় তেরেসপুরমের নিলামখানা কিংবা থুথুকুড়ি প্রধান মেছুয়াবন্দর থেকে। কেনাকাটির যাবতীয় হিসেবনিকেশ একখান কার্ডে লেখা থাকে। আমি আর আমার তিনটে বোন জামাইবাবুর থেকে মাছ কিনি, খানিক কমিশন দিই, তারপর শুঁটকি বানাই।” বোনের বরকে “মাপিল্লই” বলে ডাকেন ফাতিমা, যার আক্ষরিক অর্থ ‘জামাইবাবু’। তবে বোনদের আদর করে “পোন্নু” বলেই ডাকেন তিনি, সাধারণত অল্পবয়সি মেয়েদেরকেই এ নামেই ডাকা হয়।
সকলেই অবশ্য ষাট পার করেছেন।
ফ্রেডেরিকে তাঁর নিজের নামের একটি তামিল সংস্করণ ব্যবহার করে থাকেন: পেত্রি। স্বামী জন জেভিয়ার মারা যাওয়ার পর থেকে আজ ৩৭ বছর ধরে একাহাতে খাটছেন তিনি। মজার কথা, নিজের বরকেও মাপিল্লই বলে ডাকেন ফ্রেডেরিকে। তাঁর কথায়, “বর্ষার মাসগুলোয় মাছ শুকোতে পারি না। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তখন। চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হই আমরা — প্রতি টাকায় মাসিক ৫ কি ১০ পয়সা।” অর্থাৎ বার্ষিক হিসেবে ৬০ থেকে ১২০ শতাংশ সুদ।
মন্দ গতিতে বয়ে চলা সেই খালের ধারে বসে আছেন ফ্রেডেরিকে, অস্থায়ী গুমটির বাইরে। নতুন একখান বরফবাক্স কেনার বড্ড ইচ্ছে তাঁর। “বড়ো দেখে, মজবুত ঢাকনাওয়ালা, যেটায় বর্ষাকালে বেচার জন্য তাজা মাছ ভরে রাখা যাবে। দেখুন, একে অপরের কাছে হাত পাততে পারি না, সব্বারই তো কামধান্দার ক্ষতি হয়। পয়সাকড়ি আর কারই বা আছে? একেক সময় তো এক প্যাকেট দুধ কিনতেও নাভিশ্বাস ওঠে।”
শুঁটকি বেচে যেটুকু উপার্জন হয়, তা ঘরদোর, খাবার আর ডাক্তারবদ্যির পিছনেই বেরিয়ে যায়। অন্তিম বিষয়টির উপর জোর দিয়ে ফ্রেডেরিকে বলে উঠলেন, “প্রেসার আর সুগারের বড়ি।” এছাড়া আরও একটা জিনিসের উপর আলোকপাত করলেন, যে সময়টায় “লঞ্চ”-এর (মাছ-ধরা নৌকা) উপর নিষেধাজ্ঞা চাপে, তাঁরা খাবারদাবার বাবদ ধারদেনা করতে বাধ্য হন। “এপ্রিল আর মে মাস মাছের প্রজননকাল, তখন মাছ ধরা বেআইনি। আমাদের কামকাজ শিকেয় ওঠে। তাছাড়া বর্ষার সময়টায় — অক্টোবর থেকে জানুয়ারি — লবণ কেনা খুবই চাপের, মাছ শুকোনোও দায়। না পারি পয়সাকড়ি সঞ্চয় করতে, না পারি মন্দার মাসগুলোর জন্য খানিক টাকাপয়সা তুলে রাখতে।”
আনুমানিক ৪,৫০০ টাকার একটা নতুন বরফবাক্স, লোহার দাঁড়িপাল্লা আর এখান অ্যালুমিনিয়ামের ঝুড়ি — ফ্রেডেরিকের বিশ্বাস এগুলো পেলেই তাঁদের জিন্দেগিটা বদলে যাবে। “আমি শুধু নিজের জন্য বলছি না কিন্তু; এটা সব্বার জন্য চাই। এগুলো পেলে ঠিক চালিয়ে নেব,” জানালেন তিনি।
*****
তামিলনাড়ুর নিরিখে যে সকল ফসল হাতে করে কেটে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, আর যেটা করে থাকেন মূলত বয়স্ক মহিলা মজুররা, তার মূল্য অগোচর হলেও ওজন নেহাত কম নয়: এই নারী শ্রমিকদের সময় ও অপর্যাপ্ত মজুরি।
কথাটা শুঁটকির জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
“ইতিহাস সাক্ষী আছে কেমনভাবে বারবার লিঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে মজুরিহীন মেহনতের রীতি। ঠিক এই কারণেই পূজাপাঠ, নিরাময়, রান্না, শিক্ষা ও সংস্থান প্রদান যখন পেশাদারিকরণের মধ্যে দিয়ে গেছে, তার সিংহভাগের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত থেকেছে ভয়াবহ নারী-বিদ্বেষ। সঙ্গে ডাইনিবিদ্যা, মেয়েলি কুসংস্কার, জাদুটোনা ইত্যাদির মত অভিধাও রয়েছে,” ড. রায় বুঝিয়ে বললেন। এককথায় বলতে গেলে নারীর মজুরিবিহীন মেহনতকে যুক্তিসঙ্গত করার জন্য গতেবাঁধা ধারণাকেই অস্ত্র করা হয়। “পেশা নির্মাণ ও বিনির্মাণের প্রসঙ্গে এটা কাকতালীয় নয়, বরং অত্যন্ত জরুরি। তাই এ যুগেও পেশাদার রাঁধুনিদের প্রায়শই পৌরুষের নিরিখে হেয় করা হয়, তাঁরা নাকি ঘরোয়া রান্নাবান্নাকেই উন্নত করার চেষ্টায় লেগে আছেন, উদ্ভট শোনালেও এমনটাই দাবি। এর আগে এ জিনিসের সাক্ষী থেকেছেন পূজারীরা। সঙ্গে রয়েছেন চিকিৎসকরাও। অধ্যাপকরাও বাদ যাননি।”
থুথুকুড়ি শহরের আরেক প্রান্তে, লবণ কারিগর এস. রানির হেঁশেলে হাতেনাতে কারুভাডু কোরাম্বু (ঝোল) রাঁধা দেখেছিলাম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লবণভাটিতে তাঁর নুন বানানোর সাক্ষী থেকেছিলাম আমরা — সূর্যের তাণ্ডবে আঙার হওয়া মাটি আর জ্বলেপুড়ে খাক হওয়া পানির সঙ্গমে যেখানে জন্ম নেয় ঝিকমিকে লবণের দানা।
পাড়ায় বানানো শুঁটকি কেনেন রানি, সঙ্গে থাকে স্থানীয় নুন। ঝোল রাঁধবেন বলে পানিতে পাতিলেবুর আকারের একদলা তেঁতুল ভিজিয়ে রাখেন। তারপর একখান নারকেল ভেঙে, কাস্তের বাঁকানো ডগা দিয়ে মালা থেকে শাঁস ছাড়িয়ে নেন। সেটা কুচিয়ে, খোসা ছাড়ানো ছাঁচি পেঁয়াজের সঙ্গে ভরে দেন বৈদ্যুতিক মিক্সারে। যতক্ষণ না মিশ্রণটা মখমলের মতো মোলায়েম হচ্ছে ততক্ষণ বাটতে থাকেন রানি। রাঁধতে রাঁধতেই গল্প করছিলেন তিনি। “কারুভাডু কোরাম্বু,” মুখ তুলে বললেন, “একদিন বাদেও সুস্বাদু থাকে। খানিকটা জাউয়ের সঙ্গে এটা কাজে নিয়ে যাওয়ার পক্ষেও চমৎকার।”
এরপর ধুয়ে-টুয়ে সবজি কাটতে বসেন তিনি — দুটো সজনেডাঁটা, কাঁচকলা, বেগুন আর তিনটে টমেটো। কয়েক গুচ্ছ কারিপাতা আর এক প্যাকেট গুঁড়ো মশলা দিয়ে শেষ হয় উপাদানের ফিরিস্তি। মাছের গন্ধ পেতেই ম্যাঁও করে ওঠে একটি ক্ষুধার্ত বেড়াল। এদিকে প্যাকেট খুলে হরেক কিসিমের শুঁটকি বার করে ফেলেছেন রানি: নাগর, আসালাকুট্টি, পারই ও সালই। সেদিনের কোরাম্বুর জন্য তার অর্ধেক বাছতে বাছতে বলে উঠলেন, “এটা চল্লিশ টাকায় কেনা।”
তাঁর মনপসন্দ আরও একটি রান্নার পদ আছে, বললেন রানি: কারুভাডু আভিয়াল। তেঁতুল, কাঁচালংকা, পেঁয়াজ, টমেটো ও শুঁটকি সহকারে এটা রাঁধেন তিনি। মশলা, লবণ ও টকের চমৎকার মেলবন্ধন থাকায় এই পদটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। লবণভাটি যাওয়ার সময় এটা সঙ্গে করে নিয়ে যান মজুররা। রানি ও তাঁর বন্ধুরা আমায় আরও নানান পদের কথা জানালেন। জিরে, রসুন, সর্ষে ও হিং একসঙ্গে গুঁড়িয়ে তেঁতুল, টমেটো, খানিক কালোমরিচ আর কারুভাডুর সঙ্গে ঝোল-ঝোল করে ফোটানো হয়। রানির কথায়, “এটার নাম মিলাগুতান্নি, এটা ঔষধি মশলায় ভরপুর, তাই সদ্য বাচ্চা হওয়া মায়েদের জন্য খুবই ভালো।” দেশজ জ্ঞান অনুযায়ী এটা খেলে নাকি বুকে বেশি বেশি করে দুধ আসে। শুঁটকি ছাড়াও নানান প্রকারের মিলাগুতান্নি হয়, এটা রসম নামে পরিচিত, আর তামিলনাড়ুর বাইরেও বেশ জনপ্রিয়। বহুযুগ আগে, ভারত ছাড়ার সময় ব্রিটিশরা এটা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ‘মুল্লিগাটওনি’ নামের একপ্রকারের সুউপ হিসেবে এটি একাধিক মহাদেশীয় মেনুতে বিদ্যমান।
একপাত্র জলে শুঁটকি ফেলে মাছ সাফাইয়ে বসন রানি। একে একে ছাড়িয়ে ফেলেন মুড়ো, ল্যাজা ও পাখনাগুলো। “এখানে সব্বাই কারুভাডু খায়,” জানালেন সমাজকর্মী উমা মহেশ্বরী। “বাচ্চারা এমনিই খেয়ে নেয়। আবার আমার স্বামীর মতো অনেকেই আবার শুঁটকি ভাপা পছন্দ করে।” কাঠকয়লার উনুনের গরম ছাইয়ে পুঁতে রাখা হয় কারুভাডু, রান্নাটা ভালোভাবে হয়ে গেলে গরমগরম খাওয়া হয়। “গন্ধে জিভে জল আসে। সুট্টা কারুভাডু সত্যিই পরম উপাদেয় সুখাদ্য,” বললেন উমা।
কোরাম্বুটা যতক্ষণ ফুটছে, ঘরের বাইরে একখানা প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসেছিলেন রানি। জমে উঠেছিল আমাদের আড্ডা। চলচ্চিত্রে শুঁটকির নেতিবাচক উপস্থাপনা বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করায় তিনি মুচকি হেসে জবাব দিলেন, “কিছু জাতির মানুষ মাংস খায় না। ওদের মতো লোকেরাই তো এসব সিনেমা বানায়। কারও কাছে এটা নাথম [দুর্গন্ধ]। আর আমাদের কাছে এটা মনম [সুবাস]।” কারুভাডুর বিতর্কে এভাবেই যবনিকা টানেন থুথুকুড়ির লবণভাটির রানি ...
২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র