শিলায় খোদাই করা লিপির ঘোষণা, "মৃত্যুর আস্বাদই সকল আত্মার নিয়তি।" নাহ্, এটা কোনও ভবিষ্যদ্বাণী নয়। এ হল নতুন দিল্লির বৃহত্তম গোরস্থান জাদীদ অহল-এ-ইসলাম-এর বেশিরভাগ কবরের উপরের খচিত কতবা (সমাধি-লিপি)।
কুরআনের এই আয়াতটি - كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ - কবরস্থানের থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে একাধারে শান্তি এবং বিষাদকে ধরে রেখেছে। আবারও একটি শবদেহ নিয়ে ছুটে আসে অ্যাম্বুল্যান্স, মৃতের পরিবার জানাজায় মগ্ন হয়। অ্যাম্বুল্যান্সের কোল খালি করে যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ভরে ওঠে কবরগুলো। তারপর বিশাল একটা যন্ত্র এসে মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয় সেই শূন্যস্থান।
বাহাদুর শাহ জাফর মার্গের উপর সারি সারি সংবাদ মাধ্যমের অফিস, আর তার গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই কবরস্থানটি। এখানেই এক নির্জন প্রান্তে ৬২ বছরের নিজাম আখতার বসে বসে কবরের ফলকে মৃত ব্যক্তিদের নাম লিখছিলেন। জানতে পারলাম এগুলিকে বলে 'মেহরাব'। দুই আঙুলের ফাঁকে আলতো করে একটি পারকাজা (ক্যালিগ্রাফি বা লিপিশিল্পে ব্যবহৃত কলম) ধরে অপূর্ব ছাঁদে একটি একটি করে নুক্বতা আঁকছিলেন তিনি। উর্দু লিপিতে 'নুক্বতা' হ'ল নির্দিষ্ট হরফে ব্যবহৃত সেইসব বিন্দু যা তাদের বিশেষ এক উচ্চারণ প্রদান করে। এই মুহূর্তে যে শব্দটি তিনি লিখছেন সেটি হল 'দুর্দানা' – কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত এক ব্যক্তির নাম।
নাম আর তার সঙ্গে থাকা সংক্ষিপ্ত কিছু পংক্তি সমাধি স্তম্ভের উপর জটিল অথচ নিঁখুত ছাঁদে এঁকে চলেছেন নিজাম। পরে তাঁর এক সহকর্মী ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কুঁদে কুঁদে এই লেখাগুলোকেই পাথরে ফুটিয়ে তুলবেন সযত্নে – শেষমেশ নিজামের হাতে আঁকা রঙের অস্তিত্ব আর একফোঁটাও থাকবে না।
নিজাম একজন কাতিব বা লিপিশিল্পী। তিনি কবরফলকের উপর বিগত ৪০ বছর ধরে মৃতদের নাম লিখে চলেছেন। তাঁর কথায়, "আজ অবধি কতজনের কবরফলক যে বানিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। এই বছর এপ্রিল আর মে মাস জুড়ে আমি ১৫০ জন কোভিড সংক্রমণে মৃত মানুষের নাম লিখেছি, তার সঙ্গে সঙ্গে আরও ১৫০ জনের নাম লিখেছি যাঁদের মৃত্যু কোভিডের কারণে হয়নি।" সবই উর্দুতে। ফলকের উল্টোপিঠে ইংরেজিতেই লেখা হয়, যদিও সেটা শুধুমাত্র মৃত ব্যক্তির নাম। আমি খাতায় নোট লিখছিলাম দেখে ব্যঙ্গের ছলে বললেন, "এটা অবশ্য নিমেষের মধ্যে পাতা ভরিয়ে ফেলার মতো সহজ কাজ নয়।"
অতিমারি শুরু হওয়ার আগে জাদীদ গোরস্থানে প্রতিদিন গড়ে একটা কি দুটো কবরফলকের বরাত আসত, এই সংখ্যাটা বেড়ে এখন দৈনিক চার-পাঁচে দাঁড়িয়েছে। ফলত কাজের চাপ ২০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। চারজন কর্মী মিলে এই কাজ সামলান। তাঁদের হাতে আপাতত ১২০টি অর্ধনির্মিত ফলক রয়েছে, এছাড়াও আরও ৫০টির বরাত আছে যেগুলোর কাজ তাঁরা এখনও শুরুই করে উঠতে পারেননি।
এ এমন এক ব্যবসা যা রমরমিয়ে চললে শেষমেশ তা হৃদয়বিদারক হয়ে দাঁড়ায়। এই কবরস্থানে তিন প্রজন্ম ধরে কাজ করে আসা মোহাম্মদ শামীম বলছিলেন, "বড্ড বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর তাঁদের সঙ্গে যেন মনুষ্যত্বও মারা গেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা আমার ভেতরটা গুমরে গুমরে কাঁদে, অন্তহীন মৃত্যুর দৃশ্য সহ্য হয় না আর।"
"জীবনের সার-সত্য তো এটাই যে মানুষ দুনিয়ায় বাঁচতে আসে, অন্যদিকে মৃত্যুর সারমর্ম হল এই যে একদিন বিদায় নিতেই হয়। আদতে এ দুটো কথা একে অপরের পরিপূরক," বললেন নিজাম। তামসিক কোনও এক দার্শনিকের মতো কথা বলছিলেন তিনি, "একের পর এক মানুষ চলে যাচ্ছে আর আমার হাতে আসছে তাদের কবরের ফলক, তবে এই বিভীষিকা আমি এর আগে কখনও দেখিনি।"
সবাই যে খরচ করে কবরের ফলক বানাতে দেন এমন নয়, অথচ আজ এই কাজ ঘিরে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। যাঁদের পক্ষে এতটা ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে কবরের উপর লোহার পাত লাগানোর ব্যবস্থা করেন, এই পাতে রঙ দিয়ে লেখা থাকে মৃত ব্যক্তির নাম এবং বার্তা। আবার অনেক ক্ষেত্রে কবরগুলি ফলকবিহীনই থেকে যায়। "কিছু ক্ষেত্রে গোর দেওয়ার ১৫ থেকে ৪৫ দিন পর ফলক বানানোর বরাত পাই আমরা," বললেন নিজাম। "আমরা বরাত গ্রহণ করার পর পরিবারটিকে ন্যূনতম ২০ দিন অপেক্ষা করতে হয়," বলছিলেন হরিয়ানার ফরিদাবাদ জেলার বল্লভগড় থেকে আগত পাথর খোদাইয়ের কাজে নিজামের সহকর্মী আসিম (তাঁর অনুরোধে আমরা নাম বদলে দিয়েছি)।
৩৫ বছরের আসিম গতবছর অবধি করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব স্বীকার করতেন না, আজ যদিও তাঁর ধারণা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। "মৃতদেহ তো আর মিথ্যে কথা বলে না। অসংখ্য লাশ দেখলাম এই ক'দিন, বিশ্বাস না করে আর উপায় নেই।" অনেকে তো নিজের হাতে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তেও বাধ্য হয়েছেন। "মাঝেমাঝেই কবর খোদাইয়ের লোক কম পড়ে যাচ্ছে," বললেন আসিম।
কবরস্থানটির পরিচালনার দ্বায়িত্ব সামলায় যে সমিতিটি, তার এক তত্ত্বাবধায়ক আমাদের জানালেন: “অতিমারির আগে দৈনিক ৪-৫টি লাশ আসতো আমাদের এখানে। অর্থাৎ মাসে ১৫০টির মতন।”
এই বছর মে মাসে যে ১,০৬৮টি মৃতদেহের মুখ দেখেছে জাদীদ গোরস্থান, তার মধ্যে ৪৫৩ জন কোভিডের শিকার এবং ৬১৫ জন অন্যান্য কারণে মারা গেছেন। তবে হ্যাঁ, এটা নিতান্তই সরকারি তথ্য। এখানকার কর্মী, যাঁদের মধ্যে অনেকেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তাঁদের মতে আসল পরিসংখ্যানটি এই সংখ্যার ৫০ শতাংশেরও বেশি।
আসিম বলছিলেন, “জনৈক মহিলা তাঁর দেড় বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন গোরস্থানে। করোনা সংক্রমণে মৃত তাঁর শোহর ছিলেন ভিনরাজ্যের এক পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের চেনাশোনা কেউই ছিল না এখানে। সৎকারের জন্য যা কিছু ব্যবস্থা তা আমরাই করে দিই। বাচ্চাটা নিজের আব্বার কবরে ছোট ছোট মুঠোয় ভরা মাটি ফেলছিল।" প্রাচীন এক প্রবাদ আছে যে শিশু মারা গেলে তাকে গোর দেওয়া হয় তার মা-বাবার হৃদয়ে। কিন্তু এই যে এক শিশু তার বাবাকে কবর দিচ্ছে, এটা নিয়ে কোনও প্রবাদ আছে কি আদৌ?
আসিম এবং তাঁর পরিবারও রেহাই পাননি করোনার হাত থেকে। তিনি নিজে, তাঁর দুই স্ত্রী, মা-বাবা, সবাই ভুগেছেন, তাঁদের শরীরে ফুটে উঠেছিল কোভিডের সবকটি উপসর্গ। তবে তাঁদের পাঁচ সন্তানের কিছু হয়নি। পরিবারের কেউই কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা করাননি – তবে প্রাণে বেঁচে যান প্রত্যেকেই। "সংসারের পেটে যাতে টান না পড়ে তাই আমি পাথর ভাঙি," খোদাইয়ের কাজ বিষয়ে সোজাসাপটা কথা তাঁর। করোনা এবং অন্যান্য কারণে প্রাণ হারানো শয়ে শয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য জাদীদ গোরস্থানে ৯,০০০ টাকা মাসমাইনের আসিম নামাজ-ই-জানাজায় ইমামের ভূমিকাও পালন করেছেন।
"মানুষের শেষযাত্রায় যাঁরা সহায় হন, আখিরাহে তাঁদের আল-ওয়াজিদ পুরস্কৃত করেন, তাই এখানে কাজ করতে আমার পরিবার আমাকে উৎসাহ দেয় সবসময়," আসিম বললেন। নিজামের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই, তাঁর পরিবারের লোকজন অনুরূপ বিশ্বাস যাপন করেন। তাঁরা দুজনেই প্রথম প্রথম এই কাজ করতে ভয় পেতেন, তবে খুব শিগগির তাঁরা এই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। "মাটিতে পড়ে থাকা মৃত ব্যক্তিকে দেখে আর আতঙ্কিত হওয়ার অবসর থাকে না, বরং কবর দেওয়ার দ্বায়িত্বটাই বড়ো হয়ে ওঠে," বললেন আসিম।
জাদীদে এক একটি কবরফলক বানাতে খরচ পড়ে ১,৫০০ টাকা। এর থেকে নিজাম তাঁর এই কিতাবত লিপিশিল্পের জন্য ২৫০-৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পান। পাথরের যে চাঙড়গুলি নিয়ে তিনি কাজ করেন সেগুলো লম্বায় ৬ ফুট আর চওড়ায় ৩ ফুট। এর থেকেই চারখানা ৩ ফুট বাই ১.৫ ফুটের কবরফলক কেটে বার করা হয়। ফলকের উপরের অংশগুলি গম্বুজাকৃতি বিশিষ্ট। শেষ অবধি যেটা দাঁড়ায় তার নাম মেহরাব। কেউ কেউ মার্বেল পাথর ব্যবহার করেন। যাঁরা পাথরের বদলে লোহার পাত ব্যবহার করেন তাঁদের খরচ পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, অর্থাৎ একটা পাথরের মেহরাবের যা দাম তার ছয় ভাগের এক ভাগ।
নতুন কোনও বরাত যখন পান, তখন নিজাম প্রয়াত ব্যক্তির পরিবারকে দরকারি তথ্যাদি সযত্নে একটা কাগজে লিখে দিতে বলেন। থাকে মৃতের নাম, তাঁর শোহর কিংবা আব্বার নাম (মৃত ব্যক্তি যদি মহিলা হন), জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ এবং ঠিকানা। এছাড়াও মৃতের পরিবারবর্গ কুরআনের বিশেষ কোনও আয়াত ফলকে খোদাই করার ইচ্ছাপোষণ করলে, সেটাও তাঁদের লিখতে বলেন নিজাম। "এতে দুটো জিনিস হয়। প্রথমত মৃতের পরিবারের লোকজন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটার নাম যত্ন করে লিখতে পারে, এবং দ্বিতীয়ত এতে বানানে ভুলচুক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না আর," আমাকে বলছিলেন নিজাম। অনেক সময় বরাত আসে উর্দু কোনও শের খোদাই করার, ঠিক যেমনটা করেছে জাহান আরা হাসানের পরিবার। তাঁদের অনুরোধে নিজাম যে দোহাটি লিখতে চলেছেন সেটি হল:
আবর্-এ-রেহমত্
উনকি মরকদ্ পর গুহর-বারি করে
হশর্
তক্ শান-এ-করিমি নাজ বরদারি করে।
দোয়ার
সে মেঘ শুক্ল সাদাফি কবরের অভিমানে,
আদুরে
বেলার মেয়ে সে আমার দিন ফুরোনোর গানে।
নিজাম ১৯৭৫ সালে কিতাবতের কাজ শুরু করেন। তাঁর আব্বাও ছিলেন শিল্পী। ১৯৭৯ সালে পিতার মৃত্যুর পর থেকে নিজাম কবরফলকের উপর লিখছেন। "আমার আব্বা ছিলেন শিল্পী-মানুষ, অবশ্য আমি তাঁর কাছে শিখিনি। তিনি যখন আঁকতেন আমি শুধু তাঁকেই দেখতাম। আর আমার নিজের এই যে শিল্প, এটা পুরোপুরি আল্লাহ্-তাআলার দান," জানালেন তিনি।
১৯৮০ সালে দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ের কিরোরি মল কলেজ থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতক স্তর পাশ করার পর নিজাম কিতাবত ও কবরফলকের কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। একসময় যেখানে পাকীজা বা মুঘল-ই-আজমের মতো কালজয়ী ছায়াছবি দেখানো হত, চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই এক-পর্দার থিয়েটার জগৎ সিনেমার কাছেই একটি দোকান দেন নিজাম। তারপর নাসীম আরার সঙ্গে তাঁর নিকাহ্ হয় ১৯৮৬ সালে। লিপিশিল্পে ওস্তাদ নিজাম কিন্তু নিজের বিবিজানকে একটা চিঠিও লেখেননি কোনওদিন! অবশ্য তার বিশেষ দরকারও পড়েনি, ওই একই মহল্লায় নাসীমের বাপের বাড়ি ছিল, আর তাই সেখানে তাঁর অনায়াস যাতায়াত ছিল। কন্যা, পুত্র এবং ছয়টি নাতিনাতনি নিয়ে এই দম্পতির ভরা সংসার। তাঁদের বাসা পুরাতন দিল্লির জামা মসজিদের কাছেই।
"আগে আমি মুশাইরা [উর্দু কবিতাপাঠের আসর], বিজ্ঞাপন এবং শিক্ষামূলক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সভার জন্য হোর্ডিং আঁকতাম।" দোকানে তিনি মেহরাব আঁকার বরাতও পেতেন। এছাড়াও প্রতিবাদী ব্যানার, হোর্ডিং এবং প্ল্যাকার্ডও বানানো হতো তাঁর দোকানে।
তিনি বলছিলেন কেমনভাবে আশির দশকের মাঝামাঝি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বাবরি মসজিদের তালা খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন। নিজামের কথায়, "স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সমাজ এবং অন্যান্য আরও অনেক সম্প্রদায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আমি কাপড়ের উপর রঙ করে প্রতিবাদী ব্যানার এবং পোস্টার বানাতাম। তারপর ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ধীরে ধীরে সমস্ত বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিলিয়ে গেল। মানুষের মধ্যে যথেষ্ট রাগ জমা হয়েছিল [মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায়] কিন্তু সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আজ আর হয় না বললেই চলে।" তিনি দেখেছেন যে এই ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ লাগে কেমন করে আস্তে আস্তে মুছে গিয়েছিল। "আমার অধীনে আটজন কর্মচারী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের দেওয়ার পর্যাপ্ত টাকাটুকুও আমার কাছে ছিল না, তাঁরা সবাই এক এক করে ইস্তফা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তাঁরা আজ কোথায় আছেন, কী করছেন, তা কিছুই জানি না, খুব কষ্ট হয় এসব ভাবলে।"
"২০০৯-১০ নাগাদ কণ্ঠনালীতে সংক্রমণের জন্য আমি গলার স্বর হারিয়ে ফেলি। প্রায় ১৮ মাস বাদে সেটা খানিকটা ফিরে পাই। কাজ চালানোর জন্য অবশ্য এটুকুই যথেষ্ট," হাসতে হাসতে বললেন নিজাম। সেবছরই তাঁর দোকান বন্ধ হয়ে যায়। "মেহরাবের উপর নাম লেখার কাজ কিন্তু আমি আজও ছাড়িনি।"
"তারপর ভারতবর্ষে এসে হাজির হল কোভিড-১৯। কবরস্থানের কর্মীরা যখন জানালেন যে তাঁদের আমাকে দরকার, তখন আমি আর না বলতে পারলাম না। তাই গতবছর জুন মাস থেকে আমি এখানেই কাজ করছি। তাছাড়া আমাকে আমার পরিবারের খরচাপানির কথাও তো ভাবতে হয়!" নিজামের ছেলে জামা মসজিদের কাছে একটা ছোট্টো জুতোর দোকান চালান, তবে এই অতিমারি এবং লকডাউনের ফলে তাঁর উপার্জন তলানিতে এসে ঠেকেছে।
২০০৪ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া জগৎ সিনেমার মতন নিজামের কাজের জায়গাটিও এখন শুধুই স্মৃতি। তিনি সাহির লুধিয়ানভির লেখনীর কদরদান, তাঁর কবিতা নিজামের খুবই পছন্দ। যে বছর নিজাম স্নাতক হলেন সেটাই ছিল এই মহান কবির প্রয়াণ বছরও। লুধিয়ানভির লেখা সবচেয়ে প্রিয় লাইনটি হল: "এসো। একে অপরের তরে আবারও আগন্তুক হই আমরা দুজন।" অন্যভাবে বলতে গেলে - জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে আদতে কোনওদিনই বনিবনা ছিল না।
তাঁর কথায়, "এককালে এমন সব উমদা শিল্পী ছিলেন যাঁরা উর্দুতেই লিখতে পারতেন। এখন কবরফলকে লেখেন যাঁরা, তাঁরা শুধুমাত্র হিন্দি আর ইংরেজি হরফেই কাজ করেন। মেহরাবের উপর উর্দুতে লিখতে পারবেন এমন কাউকে দিল্লিতে খুঁজে পাওয়াটা দুরূহ ব্যাপার। রাজনীতির গেরোয় পড়ে এই ভাষাটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেছে। উর্দু কেবলমাত্র মুসলিমদের ভাষা, এই গাঁজাখুরি কথাটা রটানো হচ্ছে। উর্দু লিপিশিল্পের ভরসায় জীবিকার্জন করাটা আর আগের মতো সহজ নেই মোটেই।"
একটি মেহরাবের উপর নিজাম তাঁর কিতাবতের ছাঁদে লেখা শেষ করলে পর আসিম, সুলেমান আর নন্দকিশোর এই তিনজন মিলে তাতে খোদাইয়ের কাজ করেন। পঞ্চাশের কোঠায় বয়স নন্দকিশোরের, এই গোরস্থানে আজ ৩০ বছর কাজ করছেন তিনি। কোনও মেশিন ছাড়াই, কেবলমাত্র ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে পাথর কেটে গম্বুজাকৃতি চূড়ার ফলক বানানোতে তিনি সিদ্ধহস্ত। তিনি বলছিলেন, "কবরস্থানটি এর আগে কখনই এমন বিভীষিকা চাক্ষুষ করেনি।"
অবশ্য কোভিডের কারণে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের জন্য পাথর কেটে ফলক বানান না নন্দকিশোর। পাছে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়েন, এই আশঙ্কায় তিনি জাদীদ গোরস্থানের আরেক প্রান্তে কাজ করেন। তিনি বলছিলেন, "এক একটা পাথর কেটে, খোদাই করে, ধুয়ে মুছে শেষ কাজ করে আমি দিনে ৫০০ টাকা পাই। এই গোরস্থানটি ইংরেজদের আমলে স্থাপিত হয়েছিল।" আমি যখন তাঁর কাছে জানতে চাই যে ইংরেজরা আমাদের জন্য কবরস্থান ব্যতীত আর কিছু আদৌ রেখে গেছে কিনা, তার উত্তরে তিনি একগাল হাসি উপহার দেন।
"নন্দকিশোর নামের কেউ যে মুসলিমদের গোরস্থানে কাজ করে, এটা শুনে অনেকেই অবাক হয়ে যায়। আমি তখন তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসি, ভেবে পাইনা যে ঠিক কী বলব। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমি এরকম লোকদের বলি 'আমি আপনাদের জন্য কুরআনের আয়াত খোদাই করে দিই, আপনারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও নিজেরা যা কখনও করেননি।' তখন তাঁরা আমার ওপর ভরসা করার কারণ খুঁজে পান, আমায় ধন্যবাদ দেন, আর তাতেই পুরো পরিস্থিতিটা সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে," বললেন তিনি। দিল্লির সদর বাজারের বাসিন্দা নন্দকিশোর তিন সন্তানের পিতা।
তাঁর কথায়, "এই কবরগুলোয় যাঁরা শায়িত আছেন, তাঁরাও আমার আপনজন। বরং এই গোরস্থানের বাইরে পা বাড়ালেই দুনিয়াটা কেমন যেন অচেনা ঠেকে। জাদীদ অহল-এ-ইসলাম-এর চৌহদ্দির মধ্যে আমি শান্তিতে থাকি।"
আজ ২ মাস হল, পাথর কাটার কাজে নতুন লোকের দরকার ছিল বলে কাজে বহাল করা হয়েছে ৩১ বছরের পবন কুমারকে। তিনি আদতে বিহারের বেগুসরাই জেলার মানুষ। পবনের স্ত্রী এবং তিন সন্তান বিহারেই থাকেন। ছোট্টো একটা পাথর কাটার যন্ত্র দিয়ে ২০টি পাথরের চাঙড় কাটার পর তিনি বললেন, "দেখুন আমার মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে।" পাথরের গুঁড়োয় ঢেকে গেছে তাঁর গোটা শরীর। "কোভিড থাক বা না থাক বউবাচ্চার জন্য দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করার ধান্দায় আমার সারাটা বছর না খেটে উপায় নেই। এখানে মাঝে মধ্যে আমার দৈনিক আয় ৭০০ টাকা অবধি থাকে।" জাদীদ কবরস্থানে কাজ নেওয়ার আগে পর্যন্ত রোজগারের কোনও স্থায়ী উপায় ছিল না তাঁর। নন্দকিশোর এবং শামীমের মতো তিনিও প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছেন আজীবন।
এই কবরখানায় কর্মরত আরেক শ্রমিক হলেন আস মোহাম্মদ। উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ের বাসিন্দা এই ২৭ বছরের যুবক কবরস্থানের সবকাজেই পটু। প্রায় ছয় বছর হতে চলল তিনি কাজ করছেন এখানে। তাঁর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় থাকেন উত্তরপ্রদেশের কাসগঞ্জ জেলায়, তাঁরই কন্যার সঙ্গে আস-এর সম্বন্ধ পাকা করেছিল তাঁর পরিবার।
"আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু গতবছর লকডাউনের সময় ও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়," বলছিলেন আস। তাঁর পরিবার তখন অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ দেখে। "এই বছর মার্চ মাসে মেয়েটি বিয়ে ভেঙে দেয় কারণ ও এমন কারও সঙ্গে নিকাহ্ করতে চায়নি যে কিনা কবরস্থানে কাজ করে।"
"দুঃখে, যন্ত্রণায় আমি আরও বেশি বেশি করে কাজ করতে শুরু করি। আরও কবর খোদাই, আরও আরও পাথর কাটা। আমার আর নিকাহ্ করার ইচ্ছা নেই," আস পাথর কাটতে কাটতেই কথা বলছিলেন। তাঁরও আপাদমস্তক পাথরের গুঁড়োয় ঢাকা। মাস গেলে ৮,০০০ টাকা রোজগার থাকে আস-এর।
কাছেই কবরের সারির মাঝে উড়ছিল একটা হলদে প্রজাপতি। কবরের ফুল নাকি পাথুরে সমাধিফলক – কোনটায় থিতু হয়ে বসবে তা নিয়ে সে বুঝি খানিক দোটানায় ছিল।
কতবা-লেখক নিজাম বলছিলেন: "যে গেল, সে আখেরে চলেই গেল। আল-হাদী'র দোয়ায় আমিই সেই ব্যক্তি যে শেষবারের মতন তাকে নাম প্রদান করি। স্মৃতিতে জারিয়ে রাখি যে এই নামে এই চরাচরে কেউ একজন ছিল, যে ছিল কারও পরম ভালোবাসার মানুষ।" সাদা-কালো রঙ মাখা নিজামের তুলিগুলো তাদের মালিকের মর্জিমাফিক মেহরাবের উপর নানান মুদ্রায় চলাফেরা করে। শেষ শব্দের শেষ আখরের উপর অপূর্ব ছাঁদে তিনি নুক্বতা বসালেন। উর্দুতে লেখা এই আয়াতটিতে ছিল সেই অমোঘ সত্যি: 'মৃত্যুর আস্বাদই সকল আত্মার নিয়তি।'
শব্দার্থ
কতবা:
সমাধিফলকের উপর খচিত এপিটাফ, (সমাধি-লিপি)
আয়াত:
কুরআনের এক একটি শ্লোক
জানাজা, নামাজ-ই-জানাজা:
গোর দেওয়ার পূর্বে মৃতের উদ্দেশ্যে শেষ সালাত বা প্রার্থনা
শোহর:
স্বামী
ইমাম:
ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিক গুরু যিনি সালাত বা প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেন
আখিরাহ:
ইসলাম ধর্মে বর্ণিত পরকাল বা পরজীবন।
আল-হাদী:
আল্লাহের ৯৯টি নামের একটি, যার অর্থ 'পথ-প্রদর্শক'
সাদাফ:
ঝিনুক
নিকাহ্:
বিবাহ
আল-ওয়াজিদ:
আল্লাহের ৯৯টি নামের একটি, যার অর্থ 'অফুরন্ত
ভান্ডারের অধিকারী'
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)