বীরসিং পার্ট ১ চর গ্রামে বসন্তের আভাস নিয়ে এসেছে এক সুন্দর সকাল। তবে ৩০ বছরের শাহিদা খাতুনের সে আনন্দ উপভোগ করার জো নেই। গায়ে জ্বর, অতএব নদীচরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে (পিএইচসি) ডাক্তারের অপেক্ষায় আছেন।
অসমে ব্রহ্মপুত্র নদী জুড়ে অবস্থিত বহমান বালির দ্বীপ বা চরের ২২৫১ জনপদের একটি বীরসিং। স্তরে স্তরে পলিমাটি জমা হয়েই এই চরগুলির অধিকাংশ তৈরি হয়েছে। বীরসিং অবশ্য পূর্বে ফকিরগঞ্জ শহরের অংশ ছিল, পরে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জেরে এই অঞ্চল মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে অন্য চরের মতো বীরসিং দুর্বল ও ক্ষয়প্রবণ নয় এবং বহু বছর যাবত মোটামুটি অক্ষতই রয়েছে।
২০১১ সালের জন গণনা অনুসারে বীরসিং চরের অন্তর্গত ৩টি গ্রাম: বীরসিং পার্ট ১ (জনসংখ্যা: ৫৫৪৮), বীরসিং পার্ট ২ (জনসংখ্যা ২৩৮৬) এবং বীরসিং পার্ট ৩ (জনসংখ্যা ৩১১৭)।
শাহিদা ও পিএইচসিতে অপেক্ষারত আরও কিছু রুগী নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন। আলোচনার বিষয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ১৮-ঘরওয়ালা এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের টিনের চালে বসানো সোলার প্যানেল। ৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন ২০টি প্যানেল ও ১৬টি ব্যাটারি এখানে বসিয়েছে অসম এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি।
বহু যুগের অন্ধকারের পর, সৌর বিদ্যুতের আগমনে চর বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার খানিক সুরাহা হয়েছে। শাহিদার কথায়, “পিএইচসিতে এখন বিদ্যুৎ ও কলের জলের ব্যবস্থা হয়েছে। এখন গর্ভবতী মহিলারা এখানে তাদের চিকিৎসা করাতে আর সন্তানের জন্ম দিতে আসতে পারবে।”
বীরসিংয়ের মতো বিচ্ছিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে শিশুর জন্ম দেওয়ার গুরুত্ব শাহিদা বোঝেন। তিনি বলেন, “দাই ও প্রতিবেশীদের সাহায্যে আমি [বাড়িতেই দুই বাচ্চার] জন্ম দিয়েছি। তাদের দক্ষতা নিয়ে আমার সংশয় ছিল, আর তাই দুইবারেই খুব চিন্তা হয়েছে। কিন্তু আর কোনও উপায় ছিল না, আর ওরা আমায় আশ্বাস দিয়েছিল যে সব ঠিক হয়ে যাবে...”
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সৌর বিদ্যুৎ আসার আগে কেবলমাত্র গর্ভবতী মহিলাদেরই জরুরি চিকিৎসার জন্য নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হত ধুবড়ি টাউনের সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে। দিনেরবেলা রোজকার খেয়া পরিষেবা বন্ধ হলে, রাতের বেলা প্রচুর বেশি ভাড়া খসিয়ে নৌকা ভাড়া করতে হত, প্রায় ২০০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা পড়ে যেত। এর সঙ্গে হাসপাতালের খরচ তো ছিলই।
বিকেলের পর বীরসিংয়ে পিএইচসি বন্ধ হয়ে যায় বটে, এবং কোনও জরুরি প্রয়োজন হলে মানুষকে এখনও ধুবড়ি যেতে হয়ে, তবু সৌর বিদ্যুৎ আসায় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেন এক প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ড. জওহরলাল সরকার বললেন, “সোলার প্লেটগুলি বসেছে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে, এবং সে বছর ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসের মধ্যেই এখানে ১৮টি প্রসব করানো সম্ভব হয়েছে।” ২০১৪ সালে ফকিরগঞ্জে সাবডিভিশনাল মেডিকেল অফিসার (এপিডেমিক) পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি এখন এই পিএইচসির প্রধান। “এই চরে ১০ জন আশা [স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী বা অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট, এককথায় আশা] কর্মী আছেন যাঁরা গর্ভবতী মহিলাদের নিরাপদ প্রতিষ্ঠানিক প্রসব সুনিশ্চিত করেন।”
ড. সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নেওয়া হয়ে গেলে আমি শাহিদার সঙ্গে হেঁটে তাঁর বাড়ি গেলাম। বাড়ির পথেই বাজার, সকালে কিছু চায়ের স্টল আর ওষুধের দোকান ছাড়া বাজার ফাঁকা। দোকান-মালিকরা নিজেদের সারাদিনের কাজ শেষ করে ফেরার পর সন্ধের দিকেই বেশিরভাগ দোকান খোলেন। এঁদের কেউ ধুবড়ি শহরে রিকশা চালক, কেউ ফেরিওয়ালা আবার কেউ বা বাঁশের কাজ করেন। শাহিদার স্বামী শাহজামাল শেখ ধুবড়ি শহরে রিকশা চালান। চর বাজারে তাঁর একটা ছোটো মুদিখানার দোকানও আছে।
বীরসিংয়ে শাহিদা-সহ অনেকের বাড়িতেই সৌর প্যানেল লাগানো হয়েছে। সরকারি যোজনার মাধ্যমে অনেকেই ৩৬০০ টাকায় একটা সোলার প্যানেল আর একটা ব্যাটারি পেয়েছেন, যা দিয়ে ১.৫ ওয়াটের দুটো সিএফএল বা এলিডি আলো জ্বালানো যায়। বহু পরিবার অবশ্য বাজার থেকেই ২০,০০০ টাকা দামের সোলার সিস্টেম কিনেছে। এগুলি দিয়ে চারখানা আলো এবং একটা টিভি অথবা একটা পাখা চালানো যায়। বাজারের এক ছোটো খাবার দোকানের মালিক তারাচাঁদ আলি বললেন, “[ধুবড়িতে] নানা উপায়ে ধুবড়িতে আয় করে আমরা কিছু বাড়তি উপার্জন করতে পারি। তা দিয়েই সৌর প্লেটের মতো খানিক দরকারি জিনিসপত্র কেনা যায়।”
পঞ্চায়েতের এক সদস্য, ৬২ বছর বয়সি আসমাত আলির অনুমান বীরসিংয়ে অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়িতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। তাঁর কথায়, “বাচ্চারা এখন রাত্রিবেলা শান্তিতে পড়াশোনা করতে পারে। আগে এটা নেহাতই অসম্ভব ছিল, তখন কেরোসিনের আলোই ছিল একমাত্র সম্বল।”
চার বছর আগে, অসম এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি বীরসিংয়ের কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়েও ৪ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বসিয়েছিল। অসম এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি হল ভারতের নবীন ও নবীকরণযোগ্য শক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি মুখ্য সরকারি এজেন্সি। এই সংস্থার মতে একটি নতুন সৌর প্যানেল অন্তত ২৫ বছর ঠিকঠাক কাজ করতে সক্ষম যদি না বাইরে থেকে তাতে আঘাত করে ভেঙে ফেলা হয়ে। ব্যাটারিগুলো অবশ্য মেরামতের প্রয়োজনের হতে পারে, সেক্ষেত্রে ধুবড়ি থেকেই মেরামতি পরিষেবার জন্য কর্মীদের তলব করা যেতে পারে।
ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মাইক্রো এটিএমটি চরের সবেধন নীলমণি, সেটিও সৌরশক্তিতেই কাজ করে। ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি তথা বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কার্রেসপন্ডেন্ট, মহম্মদ আহমেদ আলি প্রতিদিন সকালে ধুবড়ি থেকে কিছু নগদ টাকা নিয়ে আসেন আর সন্ধে হলে ফিরে যান। তাঁর কথায়, “সোলার শক্তিতে দৈনিক লেনদেনের কাজ সহজেই হয়ে যায়।”
তবে শাহিদা, তারাচাঁদ ও চরের অন্যান্য বাসিন্দাদের জন্য ২০১৪ সালে নির্মিত পিএইচসিটিই হল সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার। শুরুতে তাঁদের মনে সংশয় ছিল কারণ সরকারি কর্মচারিরা সাধারণত চরগুলিতে কাজ করতে চান না। তাছাড়াও শাহিদার মতে বীরসিংয়ের মানুষ পিএইচসিতে যেতে দ্বিধা বোধ করতেন কারণ তাঁরা নিজেদের অসুখবিসুখের কথা স্পষ্ট করে ডাক্তারকে গুছিয়ে বলে উঠতে পারতেন না। কিন্তু ড. সরকার, যিনি ২০১৪ সাল থেকে সরকারি অনুরোধে চরে কাজ করছেন, তিনি এই ব্যাপারে বড়ো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। পিএইচসিতে কর্মীরা যাতে নিয়মিত এসে গ্রামবাসীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধপত্র দিতে পারেন এবং নিরাপদ প্রসবের বন্দোবস্ত করতে পারেন, সেটা তিনি সুনিশ্চিত করেছেন।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সৌর প্লেট বসানোর জন্য প্রায় দুই বছর ধরে ড. সরকারকে বারংবার ধুবড়ির স্বাস্থ্য কার্যালয়ে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। তারপরেই জল আর বিদ্যুৎ এসেছে। “গড়ে ৬৫ জন রোগী রোজ আসেন হাসপাতালে,” বলছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী, সামিমাতুল কোবরা খাতুন। “জ্বর, চর্মরোগ, পেটের অসুখ এখানকার সাধারণ সমস্যা।”
পিএইচসির কর্মীদের মধ্যে আছেন এক ফার্মাসিস্ট, সহকারী নার্স ও ধাত্রী বা অক্সিলিয়ারি নার্স মিডউইফ এবং একজন ল্যাব টেকনিসিয়ান। এঁদের প্রত্যেকেই ধুবড়ির বাসিন্দা, রোজ মেশিন লাগানো ন্যাড়া ছোটো নৌকা করে নদী পার হয়ে সকাল ৮:৪৫ নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছে যান।
“এমন বিচ্ছিন্ন এলাকা বলেই লোকে চরে কাজ করতে চায় না। কিন্তু চাকরি থেকে অবসরের পর আমায় যখন এখানে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হল, আমি অবশ্য সেটাকে একরকম আশীর্বাদ বলেই গ্রহণ করেছিলাম। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি সেইসব মানুষের সেবা করার সুযোগ পাব, যাদের সত্যিই সেটার প্রয়োজন আছে। আমি জানি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য এখনও অনেক কাজ করতে হবে, বিশেষ করে মহিলাদের চিকিৎসার জন্য,” ড. সরকার বললেন।
২০১৪ সালের অসম মানব উন্নয়ন রিপোর্ট অনুসারে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) চরাঞ্চলেই সবচেয়ে অধিক - ২.৮। রিপোর্টে এ কথাও বলা হয়েছে যে এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা বাল্য বিবাহ। শতকরা ২৫.৩ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে হয় ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে, যা দেশের স্থানিক বৈচিত্র্য সম্পন্ন এলাকাগুলোর (স্পেশিয়াল ডাইভারসিটি এরিয়া অর্থাৎ চর, চা বাগান, পাহাড়, সীমান্তবর্তী এলাকা ইত্যাদি) মধ্যে সর্বোচ্চ। রিপোর্ট অনুযায়ী ধুবড়ি জেলায় ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি বিবাহিত মেয়েদের হার সর্বাধিক: শতকরা ২৯.২ শতাংশ।
বীরসিংয়ের এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি, তবু এখন সূর্য অস্ত গেলে বীরসিংয়ের বাসিন্দারা আর অন্ধকারে ডুবে থাকেন না। এখনও ঘরে আলো জ্বালতে অনেকেই খোলা বাজার থেকে ৪০ টাকা প্রতি লিটার দরে কেরোসিন কিনে ব্যবহার করলেও, নতুন ভোর নিয়ে বীরসিংহে এসেছে আশার আলো।
অনুবাদ: দীপান্বিতা ভট্টাচার্য
অনুবাদ সম্পাদনা: স্মিতা খাটোর