দক্ষ চাষি ছিলেন তিনি, তবু নিজের জমি বলতে ছিল না কিছু। নিজেই বলেছিলেন, একসময় তাঁদের পরিবারের একফালি জমি ছিল বটে, তবে তাও গেছে আজ বহুকাল। বছর পঞ্চান্ন-ষাট বয়স হবে হয়তো এখন শিবু লাইয়ার, এখনও হারায়নি তাঁর দক্ষতা, নৈপুণ্য।
ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলার নোনমাটি গ্রামের কাহার গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের মতোই, শিবুও পেশায় ছিলেন শ্রমিক, দিন কাটত অত্যন্ত দারিদ্র্যে। আর, প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলে– আর পাঁচজন কাহারের মতো তাঁরও ছিল উপায় উদ্ভাবনের আশ্চর্য ক্ষমতা। প্রায় দুই দশকেরও অনেক আগে যখন তাঁর বাড়ি গেছিলাম, তিনি বলেছিলেন: “নিজের জমি না থাকা মানে তো আর এই নয় যে আমাদের খারবারদাবারের-ও দরকার হয় না। আর সব দরকারি জিনিসপত্র কেনার টাকাপয়সা যখন নেই-ই, তখন কিছু একটা…কোথাও একটা নিজেদেরকেই ফলাতে হবে।”
এই ‘কোথাও একটা’ জায়গাটা আদতে তাঁর ছোট্ট বাড়ির ছাদটুকু, যেখানে তাঁর যত্নআত্তিতে বেড়ে ওঠে সবুজ শাকপাতা এবং আরও কত কিছু। আমরা অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলাম ছাদখানা– শীতল, সবুজ, সুন্দর। শৌখিন শহুরে কৃষকদের ‘মার্জিত’ ছাদ বাগান নয় তা। লাইয়া এবং তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেউই পাকা বাড়িতে থাকেন না, যেখানে ছাদের পরিসরটাও অনেক বেশি। অথচ, কী আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গেই না তিনি গুছিয়েছেন তাঁর বাগানকে। ছাদ বলতে যেটুকু জায়গা পেয়েছেন শিবু তা আড়ে-দৈর্ঘ্যে সাকুল্যে হবে ছয় ফুট বাই দশ ফুট। তাও তাঁর এই ছোট্ট উঁচু ‘জমি’ শিবু লতাপাতা আর ছোটো ছোটো গাছে ভরিয়ে দিয়েছেন অসীম সৃষ্টিশীলতায়। আমি যদ্দুর জানি, জমির ভিত বলতে মাটি প্রায় ব্যবহৃত হয়নি বললেই চলে।
শিবু একা নন যদিও। নোনমাটি (ভিন্ন উচ্চারণে নুনমট্টি) গ্রামের আরও অনেক কাহার বাড়িতেও দেখেছি একই কাজ করতে। অন্যান্য জায়গাতেও দরিদ্র ভূমিহীন (বা যাঁদের সামান্যই জমি আছে) মানুষদের মধ্যে বেশ প্রচলিত এই রীতি। আরও নানান জেলায়, নানা দরিদ্র বসতিতেও দেখা যাবে এইভাবে ফসল ফলানোর রেওয়াজ। ২০০০ সালে ঝাড়খণ্ড রাজ্য হিসেবে মান্যতা পাওয়ার আগে আমরা গেছিলাম ওখানে। বন্ধুরা জানিয়েছেন, এখনও দিব্যি রয়েছে সেইসব ছাদ খামার।
সাঁওতাল পরগণায় কাহারদের এই গোষ্ঠী (অন্যান্য গোষ্ঠীর বাস বিহার ও অন্যত্র) অনেক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এতটাই যে, বহু বছর ধরে এই অনগ্রসর শ্রেণি (ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস) হিসেবে নিজেদের নথিভুক্ত করতে চেয়েছে তফসিলি জাতি হিসেবে। গত শতকের নয়ের দশকের শুরুর দিকে এই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র পনেরো হাজারের আশেপাশে (তৎকালীন কালেক্টরেটের হিসেব অনুযায়ী)। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই থাকতেন গোড্ডা বা বাঁকা আর ভাগলপুর জেলায় (তৎকালীন বিহারের অন্তর্গত)। সংখ্যায় এত অল্প হওয়ায় নির্বাচনে নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে তাঁরা ছিলেন নগণ্য, ছিল না মতপ্রকাশের পরিসরটুকুও। শিবু লাইয়া বিশ্বাস করেন অন্যান্য নানা জায়গায় তাঁদের জাতিগোষ্ঠীর এমন শাখা আছে, যাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো কিন্তু তাতে, “আমাদের আর কী সুবিধে হবে?”
আমাদের ওখানে যাওয়ার পর থেকে কেটে গেছে প্রায় বছর পনেরো। ওই গোষ্ঠী এখনও তফসিলি জাতি হিসেবে নথিবদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং যে সুযোগ সুবিধেগুলো তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষেরা খাতায় কলমে অন্তত পান, তার কণামাত্রও এসে পৌঁছয় না তাঁদের কাছে। তবু তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন কুটোটুকু আঁকড়ে বাঁচার: শিবু লাইয়ার উদ্যোগ-ও বুঝি তেমনই এক প্রয়াস।
অনুবাদ: রম্যাণি ব্যানার্জী