মধ্যপ্রদেশের মহৌ গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন ভীমরাও, আটটি গানে সেটাই উদযাপন করছেন বীড জেলার মাজালগাঁওয়ের তিনজন গায়িকা। গানে গানে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের কথা তুলেছেন, যার মধ্যে দিয়ে নতুন এক পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। ১৪ই এপ্রিল বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মবার্ষিকী, তাই জাতপাতের সমস্যা তথা ডঃ আম্বেদকরকে ঘিরে সারা মাস জুড়ে একের পর এক দোহা প্রকাশিত হবে পারির জাঁতাপেষাইয়ের গীতি প্রকল্পের অধীনে
জাঁতাপেষাইয়ের গানের এই কিস্তিতে আটটি ওভি গেয়েছেন রঙ্গুবাই পোটভরে, ওয়ালহাবাই তাখনকার ও রাধাবাই রোরহাডে। গায়িকারা প্রত্যেকেই ভীম নগরের মানুষ, এটি বীড জেলার মাজালগাঁও গ্রাম তথা তালুকের একটি দলিত জনপদ।
বাবাসাহেব আম্বেদকরের কর্মজীবন তথা দলিত ও বাদবাকি সকল নিপীড়িত জাতির মুক্তির খোঁজে তাঁর আজীবন লড়াই এই ওভিগুলির উৎস ও অনুপ্রেরণার মূলে রয়েছে। প্রাণপ্রিয় লোকনায়কের পায়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করছেন তিন মহিলা। রাষ্ট্রনায়ক ডঃ আম্বেদকর, দেশজোড়া খ্যাতি তাঁর, অবদমিত সমাজের কণ্ঠ তিনি, আবার ভারতের সংবিধানের রূপকারও, জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পে তাঁকে ঘিরে রচিত ওভির স্বর্ণখনি হয়ে উঠে এসেছে মাজালগাঁও।
এখানে প্রকাশিত আটটি ওভির প্রথমটিতে রঙ্গুবাই তুলে ধরছেন মহৌ শহরে একটি শিশুর জন্ম ঘিরে কেমন আনন্দ আর শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। (মধ্যপ্রদেশের মহৌ শহর একটি ক্যান্টনমেন্ট বা সামরিক-শিবির, সরকারি ভাবে ২০০৩ সালে এটির নাম পাল্টে ডঃ আম্বেদকর নগর রাখা হয়। ১৮৯১ সালের ১৪ই এপ্রিল এখানেই জন্মেছিলেন বাবাসাহেব।) ওভি থেকে জানা যাচ্ছে যে রামজির (আম্বেদকর) কোল আলো করে জন্ম নিয়েছে এক শিশু, শহর জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সে সংবাদ।
দ্বিতীয় ওভিতে রাধাবাই বোরহাডে জানাচ্ছেন যে এবার নবজাতকের নামকরণের পালা। রামজির দিদি মীরাবাইয়ের ইচ্ছে, শিশুটির নাম যেন ভীমরাজ রাখা হয়। (মহারাষ্ট্রে প্রথা অনুযায়ী নবজাতকের নাম সাধারণত তার পিসিই রাখেন।)
তৃতীয় দোহায় সকাল হতে না হতেই বাবাসাহেবের নামোচ্চারণ করতে অন্যান্য মহিলাদের অনুরোধ করছেন গায়িকা – "কাটিলে ঘুমের ঘোর নিস রে ভীমের নাম গলাখানি ছাড়ি... বসুধা মায়ের ঠাঁয়ে তন্দ্রা জড়ানো পায়ে না নিয়ে ভীমের নাম দিসনে রে পাড়ি।" চতুর্থ ওভিতে রাধাবাই গাইছেন যে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই 'ভীম! ভীম!' জয়রবে মেতে ওঠেন তিনি, এমনটা না করা অবধি সারাদিনের কাজকর্মের কথা ভাবতেই পারেন না।
পরের চারটি গানে ওয়ালহাবাই তাখনকার ও রাধাবাই বোরহাডের যুগলবন্দি শুনতে পাচ্ছি আমরা। তিনটি দোহায় বলা আছে প্রভাতকালে উঠোন জুড়ে দুধের ছড়া দেওয়ার কথা। তাঁদের ঘর যে আদতে গৌতম বুদ্ধের রাজপ্রাসাদ, গানে গানে সেটা জানাচ্ছেন তাঁরা। এটাও বলছেন যে ওঁদের একজন বুদ্ধের আপন কন্যা, এবং অন্যজন তাঁর ভাইঝি।
অষ্টম ওভিতে আমরা ফিরে আসছি ডঃ আম্বেদকরের জন্ম লগ্নে, গায়িকারা জানাচ্ছেন যে ভীম তাঁর মায়ের (ভীমাবাই) যোগ্য সন্তান। এ গান মূলত মুক্তির জয়ধ্বনি।
বিঃ দ্রঃ একাধিক দলিত সম্প্রদায় নববৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বর্ণপ্রথা প্রত্যাখ্যান করে নব-পরিচয়ে সেজে উঠে বারবার ধ্বনিত হয়েছে বুদ্ধের নাম। গায়িকারা শুধুই যে তথাগতের উপাসক তা কিন্তু নয়, বরং তাঁরা গৌতমকে নিজ পরিবারের এক সদস্য হিসেবেই দেখেন। তাঁদের আঙিনা ও গৃহকোণ আর 'অচ্ছুৎ' নয়, আজ থেকে সেটা সিদ্ধার্থের আপন অট্টালিকা, ৫-৭ নং ওভিতে এই কথাটাই বলা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সকাল হলে সাধারণত দুধের ছড়া দেওয়া হয় উঠোনে, শুদ্ধির প্রতীক এটি। এছাড়াও যুগ যুগ ধরে দলিত সমাজের উপর চলে আসা অত্যাচার ও অস্পৃশ্যতার 'কলঙ্ক' ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাওয়ার দিকেও ইঙ্গিত করে এ উপমা।
বুঝিতে না
পারি সই, কেন
এতো হইচই? পড়েছে
মহৌ গাঁয়ে মহা শোরগোল...
জন্ম
নিয়াছে শুনি, খোকা
সে এট্টুখানি, আলোয়
উঠেছে ভরে রামজির কোল।
পড়শি
কাকিরা সব, নাম
দিবি আই...
'নাম দে রে
ভীমরাজ,' বলে
মীরাবাই।
শোন্ শোন্
সখী মোর, কাটিলে
ঘুমের ঘোর নিস রে ভীমের নাম গলাখানি ছাড়ি...
বসুধা
মায়ের ঠাঁয়ে তন্দ্রা জড়ানো পায়ে না নিয়ে ভীমের নাম দিসনে রে পাড়ি।
শোন্ শোন্
সখী মোর, কাটিলে
ঘুমের ঘোর "ভীম! ভীম!" জয়গানে দেশগাঁ মাতাই...
হেঁশেলের
কুটো চার, পড়ে
আছে সংসার, "ভীম!
ভীম!" বলে তবে হাঁড়িটা চড়াই।
শোন্ রে
পরাণ সখী, উড়িলে
ঘুমের পাখি, দুধেই
নিকাবো এই আঙিনা দুয়ার...
তথাগত বাড়ি
মোর, গৌতমে
হ'ল
ভোর, দিয়াছি
দুধের ছড়া এপার ওপার।
শোন্ রে
পরাণ সখী, বাঁধিয়া
ঘুমের আঁখি, আলগা
হাতের ছড়া উঠানের কোণে...
আলতো নিকানো
ভোর, বুদ্ধ
সে সহোদর, গৌতমী
আমি তাই হয়েছি গোপনে।
দ্যাখ্ রে
পাগল সখী, উড়েছে
আঁধার পাখি, ক্যামনে
দুধের পানা উঠানে ছড়াই...
নিকানো
আঙিনা ভোর, শাক্য
সে কাকা মোর, গৌতমে
গৌতমী হয়েছি রে তাই।
আয় রে পরাণ
সখী, "ভীম!
ভীম!" বল দেখি,
ভীম সে মায়ের পোলা অরূপরতন...
মায়ের
যোগ্য বেটা, ভীমেই
পথের কাঁটা হবে দূর চুরচুর,
মুক্ত জীবন।
পরিবেশক/গায়ক : রঙ্গু পোটভারে, ওয়ালহাবাই তাখনকার, রাধাবাই বোরহাডে
গ্রাম : মাজালগাঁও
জনপদ : ভীম নগর
তালুক : মাজালগাঁও
জেলা : বীড
জাতি : নববৌদ্ধ
তারিখ : ২ এপ্রিল, ১৯৯৬ সালে রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ২রা এপ্রিল গায়িকাদের সঙ্গে দেখা করতে আবারও মাজালগাঁওয়ে ফিরে যাই আমরা।
আলোকচিত্র: ভেরোনিক্ বাচ্চি ও স ময়ুক্তা শাস্ত্রী
পোস্টার: শ্রেয়া কাত্যায়নী
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)