বুলডোজার যখন এল তখন দুপুর। “বুলডোজার, বুলডোজার...স্যার...স্যার”, বলে স্কুলের মাঠে বাচ্চারা চেঁচিয়ে উঠল। তাদের চিৎকার শুনে অধ্যক্ষ প্রকাশ পাওয়ার ও প্রতিষ্ঠাতা মতীন ভোসলে অফিস ঘর থেকে ছুটে এলেন।
“আপনারা কেন এখানে এসেছেন”, জিজ্ঞেস করলেন পাওয়ার। “রাস্তা বানাবার জন্য আমাদের (শ্রেণিকক্ষগুলি) ভাঙতে হবে। দয়া করে সরে দাড়াঁন,” একজন বুলডোজার চালক বললেন। “কিন্তু কোনও আগাম নির্দেশ তো দেওয়া হয়নি,” প্রতিবাদ করলেন ভোসলে। “নির্দেশ এসেছে উপর মহল (অমরাবতীর কলেক্টারের কার্যালয়) থেকে,” বললেন সেই চালক।
বিদ্যালয়ের কর্মচারিরা দ্রুত হাতে বেঞ্চি আর সবুজ লেখার বোর্ডগুলি বার করে আনলেন। তাঁরা খালি করে ফেললেন মারাঠি ভাষায় লেখা আম্বেদকর, ফুলে, গান্ধি, পৃথিবীর ইতিহাস ও আরও নানা বিষয়ের উপর প্রায় ২০০০ পুস্তক সম্বলিত অস্থায়ী গ্রন্থাগারটি। এই সব নিয়ে যাওয়া হল নিকটবর্তী ছাত্রাবাসটিতে। শীঘ্রই আঘাত হানল বুলডোজার। গুঁড়িয়ে মাটিতে পড়ল একটি দেওয়াল।
৬ই জুন, দুঘন্টা ধরে এই চলল প্রশ্নচিহ্ন আদিবাসী আশ্রমশালায়। যে সব বাচ্চারা গ্রীষ্মাবকাশেও ছাত্রাবাসে থাকে তারা নিজের চোখে তাদের ক্লাস ঘরগুলো ধবংস হতে দেখল। “তাহলে ২৬শে জুন আমাদের স্কুল শুরু হবে না? কেন এমন করছে এরা?” তাদের মধ্যে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করল।
প্রথম থেকে দশম শ্রেণি অবধি যেখানে ফান্সে পারধি আদিবাসী গোষ্ঠীর ৪১৭টি ও কোর্কু আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৩০টি পড়ুয়া পড়ত তেমন তিনটি কাঁচা ও চারটি কংক্রিটের পাকা শ্রেণি কক্ষ এবং একটি গ্রন্থাগার কিছুক্ষণের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। শিক্ষার সাংবিধানিক অধিকারও চাপা পড়ে গেল ওই ধ্বংস স্তুপের নিচেই।
মহারাষ্ট্র সরকারের ৭০০ কিমি ব্যাপী সমৃদ্ধি মহামার্গ তৈরির জন্য অমরাবতী জেলার বিদ্যালয়টি ভেঙে ফেলা হল। ২৬টি তালুকের ৩৯২টি গ্রামের মধ্য দিয়ে এই সড়ক যাবে। অমরাবতী জেলায় এই সড়ক যাবে তিনটি তালুকের ৪৬টি গ্রামের মধ্য দিয়ে।
“আমাদের সাত বছরের কঠোর পরিশ্রমও জলে গেল”, বললেন ৩৬ বছর বয়সী মতীন। তিনি আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন নন্দগাঁও খন্দেশ্বর তালুকের একটি বর্জিত সঙ্কীর্ণ পথের ধারে। ২০১৮ সালের জুন মাসে মহারাষ্ট্র সড়ক উন্নয়ন নিগম (এমএসআরডিসি) একটি চিঠিতে অমরাবতী জেলা কালেক্টরেটকে জানাচ্ছে যে যেহেতু সর্বেক্ষণ সংখ্যা ২৫-এর উপর ১৯.৪৯ হেক্টর সরকারি চারণভূমির উপর বিদ্যালয়টি আংশিকভাবে নির্মিত ছিল সেহেতু তাদের “ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”
১০টি কক্ষ সম্বলিত দোতলা পাকা ছাত্রাবাস, যেখানে ৬০ জন মেয়ে ও ৪৯ জন ছেলে থাকে, সেটিকে সমৃদ্ধি সড়ক গিলে নিতে পারবে না কারণ সেটি নির্মীত হয়েছে বিদ্যালয় পরিচালনাকারী আদিবাসী ফান্সে পারধী সমিতির ৩ একর জমির উপর (মতীন এই সমিতির চেয়ারম্যান)। ২০১৬ সালে এই কাজের সমর্থনে একটি মারাঠি সংবাদপত্রে প্রচারের ফলে জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থানুকূল্যে নির্মীত হয়েছে এই ছাত্রাবাস ও দুটি শৌচাগার।
কিন্তু সরকার এই তিন একরের মধ্যে থেকেও প্রায় এক একর জমি দাবি করছে। অমরাবতী জেলা প্রশাসন ১১ই জানুয়ারি ২০১৯ তারিখের একটি নোটিসে জানাচ্ছে যে ছাত্রাবাস ও ভেঙে ফেলা শ্রেণি কক্ষের মাঝের ৩৭ নম্বর সর্বেক্ষণের উপর ৩,৮০০ বর্গ মিটার ভূখণ্ডটিও (এক একরে আন্দাজ ৪,৪০৬ বর্গ মিটার জমি) সড়ক নির্মাণের জন্য প্রয়োজন। এই বাবদ রাজ্য সরকার সমিতিকে ১৯.৩৮ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছে।
“এই অর্থ বিদ্যালয় পুনর্নিমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। যদিও শ্রেণিকক্ষগুলি, গ্রন্থাগারটি ও রান্নাঘর সরকারি জমির উপর নির্মীত ছিল তবু আইনমাফিক আমাদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য,” ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে মতীন আমাকে বলেছিলেন। আমরা বিক্রয়পত্র স্বাক্ষর করিনি (এমএসআরডিসি-এর সঙ্গে ৩,৮০০ বর্গ মিটার জমির জন্য)। অমরাবতী কালেক্টরেটের কাছে আমাদের আপত্তি নথিভুক্ত করে আমরা আগে বিদ্যালয়ের জন্য বিকল্প জমির ব্যবস্থা দাবি জানিয়েছি।”
অমরাবতী কালেক্টরেটের কাছে ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মতীন আরও অনেক দরখাস্ত করেছেন, ২০১৮ সালে ৫০-৬০ পড়ুয়াকে নিয়ে তিনবার কালেক্টরের কার্যালয়ে গেছেন ও ২০১৯ সালে একদিনের জন্য অনশন করেছেন - প্রতিবারই সামগ্রিক পুনর্বাসন অর্থাৎ সম্পূর্ণ বিদ্যালয় কাঠামোটির জন্য পর্যাপ্ত জমির দাবি করেছেন।
প্রশ্নচিহ্ন বিদ্যালয়ে পাঠরত শিশুদের পিতা-মাতাও এ বিষয়ে চিন্তিত। বিদ্যালয় থেকে দুই কিমি দূরে ৫০টি কুটির সম্বলিত ফান্সে পারধি বসতি এলাকায় তাঁর ইটের তৈরি বাড়ির বাইরে বসে বিনের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ৩৬ বছর বয়সী সুরনিতা পাওয়ার আমাকে বলেছিলেন, “আমার মেয়ে সুরনেশা এই বিদ্যালয় থেকে দশম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করে এখন দূর-শিক্ষার মাধ্যমে একাদশ শ্রেণির পাঠ গ্রহণ করছে।” তাঁর বসতি এলাকা সংলগ্ন ৩,৭৬৩ জন মানুষের গ্রাম মাংগ্রুল ছাওয়ালায় সুরনিতা কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। বিদ্যালয় ভাঙার পর আমি তাঁকে ফোন করায় তিনি বলেন, “আমি শুনেছি শ্রেণিকক্ষগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সুরনেশ (আমার ছেলে) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছিল সে। এখন ও কোথায় যাবে?”
অপরাধী জনজাতি আইনের আওতায় ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার ফান্সে পারধি সম্প্রদায়কে ‘অপরাধপ্রবণ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৫২ সালে ভারত সারকার এই আইনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে এঁদের এই তকমা থেকে ‘বি-মুক্ত’ করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এখন তফসিলি জাতি, কেউ জনজাতি আবার কেউ বা অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায় সমূহের অন্তর্গত (দেখুন অপরাধ নেই, রয়েছে অন্তহীন শাস্তি )। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ২২৩,৫২৭ জন পারধি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ মহারাষ্ট্রে বাস করেন, যার মধ্যে আছে পাল পারধি, ভীল পারধি এবং ফান্সে পারধির মতো নানান উপগোষ্ঠী।
সমাজের বিভিন্ন স্তরেই এঁরা বৈষম্যের শিকার। “গ্রামের মানুষ আমদের কাজ দেয় না,” বললেন সুরনিতা। “ফলে তখন আমাদের সমাজের লোকেরা অমরাবতী শহরে অথবা মুম্বই, পুণে, নাসিক, নাগপুর ইত্যাদি শহরে ভিক্ষা করতে যায়।”
যেমন করতেন তাঁর প্রতিবেশী, ৪০ বছর বয়সী হিন্দোস পাওয়ার। এক দশক আগে অবধি তিনি ভিক্ষা করতেন। তারপর মাঝেসাঝে খেতখামারে বা নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ পেলে করেন। “আমি সারা জীবন দুঃখ-কষ্ট দেখেছি”, তিনি বললেন। “পুলিশ যে কোনও সময় আমাদের ধরে নিয়ে যায়। আমার দাদুর আমলে যে অবস্থা ছিল, বর্তমানেও সেটাই বহাল আছে। কিচ্ছু বদলায়নি। আমাদের শিশুরা যদি পড়াশুনা না করে, তাহলে তাদেরও হাল আমাদের মতোই হবে।” কয়েক মাস আগে যখন এই পরিবারটির সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয় তখন এঁর ছেলে শরদেশ আর মেয়ে শরদেশা প্রশ্নচিহ্ন আদিবাসী আশ্রমশালায় যথাক্রমে ৭ম ও ১০ম শ্রেণিতে পড়ত।
২০১৭ সালে হায়দ্রাবাদের সামাজিক উন্নয়ন কাউন্সিল দ্বারা মহারাষ্ট্রের ২৫টি জেলায় যাযাবর ও আধা-যাযাবর বি-মুক্ত জনজাতির উপর করা একটি সমীক্ষা বলছে যে ১৯৯টি পারধি পরিবারের মধ্যে (সমীক্ষাটি ১,৯৪৪টি পরিবার ও ১১টি সম্প্রদায়ের উপর করা হয়) শতকরা ৩৮ শতাংশ পরিবারের সন্তানেরাই প্রাথমক বিদ্যালয়-ছুট হয় বৈষম্য, ভাষাগত ব্যবধান, বিবাহ ও শিক্ষা সম্বন্ধে স্বল্প সচেতনতার অভাব ইত্যাদি কারণে। সমীক্ষা আরও বলছে যে উত্তরপ্রদানকারীদের মধ্যে ২ শতাংশ বলেছে যে তাদের পিছনের বেঞ্চে বসতে দেওয়া হয় এবং ৩ শতাংশ বলেছে যে তাদের প্রতি শিক্ষাকর্মীদের ব্যবহার অপমানজনক।
জেলা পরিষদ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে মোটেই ভালো ব্যবহার করেন না,” বললেন সুরনিতা। ১৪ বছরের জীবেশ পাওয়ারও সহমত, সে বলল, “আমি জেলা পরিষদ ইস্কুল ফিরে যেতে চাই না আর।” ২০১৪ অবধি সে ইয়াভাতমল জেলার নের তালুকে অজান্তি গ্রামের জেলা পরিষদ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। “শিক্ষকরা আমাকে পিছনে গিয়ে বসতে বলত। অন্য বাচ্চারা আমাকে পারধি পারধি বলে খেপাতো...গ্রামের লোকেরা বলে আমরা নোংরা। আমাদের কুঁড়ে ঘরগুলি গ্রামের বাইরের দিকে। মা ভিক্ষা করেন। আমিও সঙ্গে যাই। আমার বাবা দুবছর আগে মারা গেছেন।”
তারপর সে তাদের বসত এলাকা থেকে ১৭ কিমি দূরে প্রশ্নচিহ্ন আদিবাসী আশ্রমশালায় ভর্তি হয়। নিজেদের এলাকায় জল ও বিদ্যুৎ অমিল তাই সে ছাত্রাবাসে থাকে। “আমি পড়াশুনো করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। আমি চাই না আমার মা ভিক্ষা করুক,” সে বলে। সবেমাত্র সে নবম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করেছে, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারার আনন্দ-উত্তেজনা ইতিমধ্যেই উদ্বেগে পরিণত হয়েছে।
কিরণ চভনও ধুলে জেলার সক্রি তালুকের জমাদে গ্রামের জেলা পরিষদ বিদ্যালয়ে পড়ত। জঙ্গলের দুই একর জমিতে বাবা-মা ধান আর জোয়ার চাষ করেন। “গ্রামবাসীরা আমাদের জেলা পরিষদ ইস্কুলে পড়ার বিরোধী,” সে জানালো। “আমার বন্ধুরা ছেড়ে দিয়েছে কারণ অন্য বাচ্চারা তাদের পিছনে লাগত। আমাদের কুঁড়ে ঘরগুলি গ্রামের বাইরের দিকে। গ্রামে ঢুকলে ওরা বলে, “সাবধান চোরগুলো এসেছে। আমি জানি না কেন ওরা এমন বলে। আমি তো চোর নই। পুলিশ যে কোনও সময়ে আমাদের বসত এলাকায় ঢুকে চুরি বা খুনের জন্য যাকে ইচ্ছা ধরে নিয়ে যায়। সেইজন্যই আমি পুলিশ হতে চাই। আমি নিরপরাধ মানুষকে কখনও ঝামেলায় ফেলব না।”
এই সব ভালো করেই জানেন মতীন ভোসলে আর তাই তিনি ফান্সে পারধি সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁর সঞ্চিত অর্থ আর পরিবারের ছয়টি ছাগল বিক্রি করে সংগ্রহ করা টাকা খরচ করে ৮৫ জন বাচ্চা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ২০১২ সালে। তাঁর কাকা শঙ্কুলি ভোসলে, এখন বয়স ৭৬, তাঁর দেওয়া তিন একর জমিতে বানানো সেই বিদ্যালয়টি ছিল খড়ের চালার একটি কুঁড়ে ঘর। মতীন বললেন যে জমিটি তাঁর কাকা বহু বছর ধরে অর্থ সঞ্চয় করে ২০০ টাকা দিয়ে ১৯৭০ সালে কিনেছিলেন। তিনি বিশেষ ধরনের চারপেয়ে মাংসভোজী সরীসৃপ, মোরগ জাতীয় পাখি, খরগোশ, ও শুয়োর শিকার করে অমরাবতী শহরে বিক্রি করতেন।
‘এই সবগুলিই হল পারধিদের প্রশ্ন, যার কোনও উত্তর নেই। অতএব সেইজন্যই প্রশ্নচিহ্ন আদিবাসী আশ্রমশালা’
মতীনের স্ত্রী সীমা বিদ্যালয় পরিচালনায় সহায়তা করেন এবং তাঁদের তিনটি বাচ্চাও অমরাবতী, বীড, ধুলে, ওয়াসিম ও ইয়াভতমল জেলা থেকে আসা ফান্সে পারধি পড়ুয়াদের সঙ্গেই পড়ে। বাচ্চাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের এখানে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা হয়। বিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষকের মধ্যে চারজন ফান্সে পারধি সম্প্রদায়ের।
“ফান্সে পারধিদের কোনও স্থায়ী বাসস্থান এবং নিশ্চিত রোজগারের উপায় নেই। তারা ঘুরে বেড়ায়, ভিক্ষা করে, শিকার করে অথবা সুযোগ পেলে কখনও মজুর হিসাবে কাজ করে,” বললেন মতীন। তাঁর বাবা শিকার করতেন আর মা যেতেন ভিক্ষা করতে। “অনেক সময়েই বাচ্চারাও মা-বাবার সঙ্গে রেল স্টেশন বা বাস স্টপেজে ভিক্ষা করে। শিক্ষা ও ভদ্র কাজের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। শিক্ষা এবং স্থিরতা তাদের উন্নতির জন্য খুব জরুরী। কিন্তু পারধি বাচ্চারা এখনও জেলা পরিষদ বিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। তাদের জন্য শিক্ষার অধিকার কই? আর মহারাষ্ট্র সরকার (আদিবাসী বাচ্চাদের জন্য) যথেষ্ট আবাসিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করেনি। তাহলে তারা অগ্রসর হবে কী করে? এই সবগুলিই হল পারধিদের প্রশ্ন, যার কোনও উত্তর নেই। অতএব সেইজন্যই ‘প্রশ্নচিহ্ন আদিবাসী আশ্রমশালা’।”
নিজের পরিবার ও সম্প্রদায় ঘিরে থাকা শতেক বাধা অতিক্রম করে ২০০৯ সালে মতীন অমরাবতীর সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে শিক্ষা বিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। যে গ্রামের বাইরে তিনি বাবা-মা আর বোনেদের সঙ্গে একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন সেই মাংগ্রুল ছাওয়ালা গ্রামের জেলা পরিষদ বিদ্যালয়ে তিনি দুবছর পড়িয়েছেন। তিনি নিজেও ওই বিদ্যালয়েই পড়তেন এবং একজন দরদি শিক্ষকের কারণেই শেষ অবধি স্কুল-ছুট হননি।
১৯৯১ সালে যখন তাঁর বয়স আট তখনকার কথা মনে করে মতীন বলেন, “আমরা বনমোরগ আর খরগোশ শিকার করতাম। না হলে গ্রামবাসীদের ফেলে দেওয়া পচা খাবার খেতাম আমি আর আমার তিন দিদি। একবার আমরা (প্রায়) ৫-৬ দিন কিচ্ছু খাইনি। আমার বাবা আর আমাদের অভুক্ত দেখতে না পেরে কারও খেত থেকে ২-৩ গোছা জোয়ার তুলে এনেছিলেন। আমার মা জোয়ার আম্বিল (সবজি) তৈরি করে আমাদের খাইয়েছিলেন। পরে সেই খেতের মালিক আমার বাবার বিরুদ্ধে পাঁচ কুইন্টাল জোয়ার চুরির নালিশ জানিয়ে এফআইআর করে। মনের জ্বালায় তিনি চুরি করতে বাধ্য হয়েছিলে কিন্তু ২-৩ গোছা আর পাঁচ কুইন্টালের মধ্যে তো বিশাল ফারাক!”
তাঁর বাবা শঙ্কর ভোসলেকে তিনমাসের জন্য অমরাবতীর জেলে যেতে হয়েছিল। সেখানে ইউনিফর্ম পরা লোকজনকে দেখে, মতীন বললেন, বাবা বুঝেছিলেন শিক্ষা আর জ্ঞানের ক্ষমতা কত। “জেলে বসে তিনি তাঁর পারধি জেল সঙ্গীদের বলতেন সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে”, একথা বলতে বলতে তিনি মনে করলেন নিজের বাবার কথাগুলি, ‘যদি শিক্ষা আর জ্ঞানের অপব্যবহার নির্দোষ মানুষকে এতখানি কষ্ট দিতে পারে তবে তার সঠিক ব্যবহার তাদের সুরক্ষাও দিতে পারে’।
মতীন তাঁর বাবার কথার মর্যাদা রেখে শিক্ষক হয়েছেন এবং এই বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। কিন্তু সাত বছর পর এখনও সেই বিদ্যালয় রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগ ও জনজাতি উন্নয়ন বিভাগে অজস্র চিঠিপত্র দেওয়ার পরেও হা-পিত্যেশ করে বসে আছে সরকারি স্বীকৃতি আর অর্থ সাহায্যের জন্য।
২০১৫ সালে মতীন রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন বিদ্যালয়টিকে নিয়মমাফিক সরকারি স্বীকৃতি ও অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ার জন্য। কমিশন রাজ্যকে শিক্ষার অধিকার (রাইট টু এডুকেশন, ২০০৯) মোতাবেক অনগ্রসর গোষ্ঠীর শিশুরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাজ্যের বাধ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়। বলা হয় যে যদি বিদ্যালয়টিতে আইনানুগ পরিকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা থাকে তাহলে অভিযোগকারীর সেই বিদ্যালয় চালাবার এবং স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার আছে।
“জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নিরপেক্ষভাবে যাতে প্রতিটি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে পারে তা দেখা সরকারের দায়িত্ব। একথাই তো শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত আইন স্পষ্ট ভাবে বলে। সরকার যদি সততার সঙ্গে তা অনুসরণ করত তাহলে ‘প্রশ্নচিহ্ন’ থাকতই না। উপরন্তু যখন নিজ উদ্যোগে কেউ তেমন বিদ্যালয় স্থাপন করেন তখন সরকার সেটিকেও স্বীকৃতি দেয় না,” বললেন আহমেদনগরের শিক্ষাকর্মী ভানু চাসকর।
“ওই নির্দেশিকা আসে চার বছর আগে অথচ আজও জনজাতি বিভাগ বা শিক্ষা বিভাগ কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি,” বললেন বিদ্যালয় অধ্যক্ষ ফান্সে পারধি সম্প্রদায়েরই প্রকাশ পাওয়ার। অর্থ বরাদ্দ করে সরকার বিজ্ঞান ও কম্পিউটার গবেষণাগার, পাঠাগার কক্ষ, শৌচাগার, পানীয় জল, ছাত্রাবাস এবং শিক্ষকদের বেতন ছাড়াও আরও কতকিছুর বন্দোবস্ত করতে পারে। এখন আমরা এই সব খরচ চালাই মানুষের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে”, আরও জানালেন পাওয়ার।
কোনও কোনও ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যালয় খাতা দেয়, বইও দেয় কেউ কেউ (গ্রন্থাগারের জন্য), খোরাকি আসে ব্যক্তিবর্গ অথবা রাজ্যের নানা সংগঠনের কাছ থেকে—এই ভাবেই আটজন শিক্ষকের বেতন (মাসিক ৩,০০০ টাকা) ও ১৫ জন সহায়কের বেতন (মাসিক ২০০০ টাকা) ও অন্যান্য খরচ চলে।
নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও প্রশ্নচিহ্ন বিদ্যালয় থেকে ৫০ জন ছাত্র দশম শ্রেণি অতিক্রম করে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করছে। বালিকা বিদ্যালয়ের কাবাডি দল ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে তালুক ও রাজ্যস্তরে প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেছে।
কিন্তু এখন সমৃদ্ধি মার্গ তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। “আমি জানি না কী করে এই বছরের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করব। হয়তো ছাত্রাবাসের ঘরেই ক্লাস নিতে হবে”, বললেন পাওয়ার। “বৈষম্য, সামাজিক প্রত্যাখ্যান ও ন্যূনতম সুযোগসুবিধার অভাব সংক্রান্ত ‘প্রশ্নের’ সম্মুখীন হয়ে অবশেষে যখন আমরা এসবের উত্তর হিসাবে ‘শিক্ষা’কে খুঁজে পেলাম তখন কিনা তোমরা (মহারাষ্ট্র সরকার) আমাদের সামনে নতুন করে উৎপাটিত হওয়ার ‘প্রশ্ন’ তুলে দিলে। কেন?” রুষ্ট মতীনের প্রশ্ন। “আমি সব শিশুদের আজাদ ময়দান নিয়ে গিয়ে (দক্ষিণ মুম্বাইয়ে) অনশন ধর্মঘট করব। যতক্ষণ না আমরা পুনর্বাসনের লিখিত আশ্বাস পাব আমরা নড়ব না সেখান থেকে।”
বাংলা অনুবাদ : চিলকা