“আপনারা আমার গল্প শুনবেন?” পোন হরিচন্দ্রন অবাক, “মনেই পড়ে না কেউ কোনওদিন আমার কাছে আমার নিজের গল্প শুনতে এসেছে। আর সত্যি বলতে কি, নিজেকে নিয়ে আমার বলারই কী-ই বা আছে,” বছর ষাটেকের এই মানুষটি গোটা জীবনটাই কাটিয়েছেন অন্যের গল্প বলে – তাঁর গ্রাম কিলাকুইলকুড়ির গল্প, মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে ২০০০ বছরের পুরনো মাদুরাই শহরের গল্পও।
শ্রোতাদের মধ্যে আছেন অক্ষর পরিচয় না জানা মানুষ থেকে শুরু করে বিদ্বান অবধি সবরকমের মানুষ – স্থানীয় গ্রামসমাজ পাশাপাশি আছে বাইরের শহুরে শিক্ষিতসমাজ। সেসব গল্প ব্যবহার হয়েছে পুরস্কার পাওয়া উপন্যাসে, সিনেমায়। আবার আরেক দল মানুষ এই গল্প ব্যবহার করেছেন নৃতাত্ত্বিক গবেষণায়। “আজকাল আমার কাছে কলেজ-ইউনিভার্সিটির লোকই আসে বেশি। শিক্ষকরা আসেন ছাত্রদের নিয়ে, তাদের আমার গল্প শোনাতে। সেসব গল্পও এক-দুটো বলব নাকি?” তিনি সহজভাবে জানতে চান।
কিলাকুইলকুড়ি গ্রামে, ফুলে ফুলে ছয়লাপ এক পদ্মপুকুর আর বিরাট অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো জৈন গুহার সারির মাঝখানে আমরা বসে আছি। এই গ্রাম পড়ে মাদুরাইয়ের তিরুপারানকুন্দ্রম ব্লকে। গ্রামের ক’জন বয়স্ক মানুষ করুপ্পসামি মন্দিরে বসে ছিলেন, আমরা তাঁদের কাছে জানতে চাই, হরিচন্দ্রনকে কোথায় পাওয়া যাবে। তাঁরা বললেন, “হয় কোনও চায়ের দোকানে, নয় বাড়িতে। তবে আপনারা এসে যখন গেছেন, ও-ও ঠিক চলে আসবে।” সত্যিই, কিছুক্ষণের মধ্যে সাইকেলে চড়ে হরিচন্দ্রন উপস্থিত।
এসেই বলে ওঠেন: “গ্রামে ঢোকার রাস্তাটা একটু গোলমেলে ঠেকল না? আসলে আমাদের পূর্বপুরুষরা পথটা এমন করে বানিয়েছিল, যাতে ব্রিটিশ সৈন্যদের ঢুকতে দেরি হয়। ফলে যারা গ্রাম পাহারা দিত, তারা খবর দিয়ে দেওয়ার সময় পেয়ে যেত যে, ওরা আসছে। গ্রামের মানুষও তখন তৈরি থাকত।”
কিলাকুইলকুড়ি ছিল পিরামালাই কল্লারদের গ্রাম (তেভরদের এক উপগোষ্ঠী; তেভররা এখন তামিলনাড়ুর প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম)। এই গ্রামের মানুষ ব্রিটিশ যুগে বহুবার শাসকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন। ব্রিটিশ শাসনের সার্বভৌমত্ব তাঁরা মেনে নেননি, বারবার বিরোধিতা করেছেন। জাতি বা বর্ণের উপর ভিত্তি করে আদিবাসীদের অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়ার যে নির্মম আইন – ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট – তৎকালীন ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত এই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের দাবিয়ে রাখার জন্য তা বলবৎ করা হয়েছিল। তবে তাতেও কাজ হয়নি। “আপনারা নিশ্চয়ই ব্রিটিশ শাসককে কর দেওয়ার কথা শুনেছেন, এ গ্রামে কিন্তু নিয়ম অন্যরকম ছিল,” হরিচন্দ্রন জানান।
উল্টে শুরুতে নাকি ব্রিটিশ-নিযুক্ত স্থানীয় কর্মচারীরাই কর দিতে বাধ্য হতেন, গ্রামের অন্তত একটি পরিবারকে। “কালুভা তেভর-এর পরিবার,” হরিচন্দ্রন জানান। কালুভা তেভর মাদুরাইয়ের রানির গয়না চুরি করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তখনও ব্রিটিশরা আসেনি। ১৬২৩-১৬৫৯, মাদুরাইয়ে তখন রাজা তিরুমালাই নায়ক্করের রাজত্ব। বিখ্যাত মীনাক্ষি আম্মান মন্দির থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে রাজার বিরাট প্রাসাদ আজও একটি দর্শনীয় জায়গা।
গল্প শুরু হয়ে গেল …
কালুভা তেভর রানির গয়না চুরি করবেন বলে এক অদ্ভুত রাস্তা বার করেন। দু’টি গোসাপ ছিল তাঁর দুই ‘চোর শিষ্য’। কথায় বলে ‘গোসাপের কামড়’, ধরলে আর ছাড়তে চায় না। এক্ষেত্রে তারা কামড় দিয়ে ধরে রেখেছিল রানির বিশেষ বিশেষ গয়না, যা তারা মুখে করে এনে সোজা কালুভা তেভরের হাতে তুলে দেয়। “তিরুমালাই নায়কের প্রাসাদে আজও দেখবেন, এক জায়গায় বোর্ডে লেখা আছে যে, এখান থেকে রানির গয়না চুরি গিয়েছিল,” বললেন হরিচন্দ্রন (সে বোর্ড অতীতে থেকে থাকলেও আজ আর প্রাসাদে তার কোনও অস্তিত্ব নেই)।
রাজা প্রথমে রাগ করলেও পরে কালুভার কাজে মুগ্ধ হন। পুরস্কার দিতে চান। কালুভা একটি ভেষ্টি (পুরুষদের কোমর থেকে নিচে ঝুলিয়ে পরার কাপড়), একটি ভাল্লাভেট্টু (গামছার মতো গায়ে জড়াবার কাপড়) ও একটি উরুমা (পাগড়ির মতো শিরস্ত্রাণ) চান।
“এরই সঙ্গে তিনি চেয়ে নেন মাদুরাইকে রক্ষা করার অধিকার – আর একটি ছোটোখাটো সুরক্ষা বাহিনী চালাবার জন্য কিছু বাৎসরিক বেতন। এই বাহিনী ছিল তখনকার পুলিশ,” হরিচন্দ্রন বলছেন। “তাঁর এই প্রার্থনাও পূরণ হয়, এবং কালুভার পরিবার বহু বছর ধরে এই বেতনের সুবিধা পেয়ে আসছিল। এক ব্রিটিশ অফিসার প্রথম এই প্রথা অমান্য করেন।” হরিচন্দ্রনের মতে, সেই অফিসার কিন্তু এই বেতনের ইতিহাস জানতেন। “তবু তিনি তাঁর উপরের মহলের অফিসারদের চিঠি লেখেন, ‘আমাদের এই মহান শাসনব্যবস্থাকে শেষে এক অজানা গ্রামের সামান্য এক পরিবারের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে কর দিতে হবে?’”
হরিচন্দ্রন আর পাঁচজনের মতো পরম্পরাবাহিত পেশাদার কথক নন। কিন্তু ছোটোবেলা থেকে গ্রামবুড়োদের আড্ডায় তাঁদের নিজেদের তথা তাঁদের পূর্বজদের জীবনের নানান কথা কিসসা বলার মুন্সিয়ানা দেখে তিনি আকৃষ্ট হতেন। এসবের মধ্যে প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে শাসকদের বোকা বানানোর গল্পও ছিল, আবার ছিল ব্রিটিশ যুগে শাসকদের হাত থেকে পালাবার দুঃসাহসিক গল্পও। কিশোর বয়স থেকেই হরিচন্দ্রন লোককাহিনির কথক হয়ে ওঠেন। তখন জানতেন না, একদিন তিনিই হবেন এর অন্যতম প্রধান সংগ্রাহক, তিনি ছাড়া আর এই গল্প বলার আর কেউ-ই তেমন থাকবে না।
কিলাকুইলকুড়ি গ্রামের গোঁয়ার্তুমি দেখে তিতিবিরক্ত ব্রিটিশ এখানে অপরাধপ্রবণ জাতি আইন অর্থাৎ ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট (সিটিএ) ১৮৭১ বলবৎ করে। এই আইন ব্যবহার করেই উত্তর ভারতের বহু অঞ্চলে ব্রিটিশরা আদিবাসীদের প্রতিরোধ নির্মম ভাবে দমন করেছিল। ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সিতেই এর শেষ ব্যবহার।
“ব্রিটিশরা যখন আমাদের উপর ভয়ঙ্করতম নিপীড়ন চালাতে শুরু করল, তখন গ্রামের মানুষজন চুরির পথ বেছে নিতে বাধ্য হল,” হরিচন্দ্রন বলেন। “ওরা নিয়ম করল, কিলাকুইলকুড়ি গ্রামের কাউকে বিকেল ৫টা থেকে সকাল ১০টা অবধি মাদুরাইতে ঢুকতে দেওয়া হবে না।” এই নিয়মের শিকার হয়ে গ্রামের বহু মানুষের নানান পেশা ও ব্যবসা লাটে ওঠে।
হরিচন্দ্রনের মতে “চুরি চার রকমের– কালাভু (যা হাতের কাছে পাওয়া যায় তা-ই চুরি), তিরুডু (প্রয়োজন অনুযায়ী চুরি), কোল্লাই (চুরি করে কাউকে সর্বস্বান্ত করা) এবং সুরাই (চুরির জায়গা থেকে সমস্ত সরিয়ে ফেলা, বা কাউকে সর্বস্বান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকেও চুরি করা)।”এই চার রকমের চোরই কিন্তু দরকার মতো হত্যা বা ধর্ষণ করতে পিছপা হত না। অথচ আপনারা যে কোনও ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখুন – আমাদের গ্রামের মানুষ কখনও এমনটা করেনি।
প্রতিবাদী গ্রামটিকে ‘সংশোধন’ করবে বলে ব্রিটিশরা সেখানে ঋণ দেওয়া চালু করে, মেয়েদের জন্য একটা স্কুল অবধি খোলে, কারণ তাদের ধারণা হয়েছিল যে, মেয়েরাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পুরুষদের ফুসলাচ্ছে। “কিলাকুইলকুড়িতে একটা ছোটো জেলখানাও ছিল। সেখানে যাদের অপরাধ তত গুরুতর নয়, তাদের রাখা হত। আর মাদুরাইতে ছিল বড়ো জেল।” কিন্তু গ্রামের মানুষ “ঋণও প্রত্যাখ্যান করে, স্কুলও পুড়িয়ে দেয়,” হরিচন্দ্রন জানাচ্ছেন।
বেশ কিছু ঘণ্টা, বেশ কিছু গল্প পেরিয়ে গেছে। এখনও, আমরা তাঁর ‘নিজের’ গল্পে পৌঁছতে পারিনি। তিনি কথকতায় মত্ত, তাঁর নিজের কথা জানতে চাইলে একটু বিরক্তই হলেন। “আমি চাষি, এক টুকরো জমি আছে, তাতেই সংসার চলে। আর কিছু জানতে চান?” এক স্ত্রী, এক ছেলে, তাঁদের সম্পর্কেও বেশি কিছু বলতে চান না। মনে হল, পরিবারে কেউ তাঁর এই কথকতার চমকপ্রদ শিল্পটিকে আপন করে নেননি।
তবে, তাঁর নিজের গল্পের ভাঁড়ারও নেহাত শূন্য নয়। ১৯৭২ সালে এম. জি. রামচন্দ্রন তাঁর নিজের রাজনৈতিক দল ডিএমকে ভেঙে বেরিয়ে এসে এআইএডিএমকে দল (বর্তমান তামিলনাড়ু সরকার যে দলের) গঠন করেন। “আমি সেই দলে যোগ দিই, স্থানীয় মিটিংগুলোতে বক্তব্যও রাখতাম। এআইএডিএমকে দলের বরিষ্ঠ নেতা কালিমুথুর কাছের লোক ছিলাম আমি। তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন, আর আমরা প্রায়ই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম।” ২০০৬ সালে কালিমুথু মারা যাওয়ার পরে হরিচন্দ্রন দল ছেড়ে দেন। তাঁর কথায়, “এখন আমি গল্প শুনিয়েই খুশি।”
সু ভেঙ্কটেশন-এর সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস কাভল কোট্টাম-এর মুল ভিত্তি হরিচন্দ্রনের সঙ্গে তাঁর অসংখ্য কথোপকথন। তিনি হরিচন্দ্রনের গুণমুগ্ধ। “হরিচন্দ্রনের মত অনুযায়ী ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট এই গ্রামেই প্রথম বলবৎ করা হয়েছিল। উপন্যাস লেখার জন্য আমায় যে দীর্ঘ গবেষণা চালাতে হয়, তাতে আমি সরকারি রেকর্ডে এই কথার প্রমাণ পেয়েছি। ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সির ভিতর কিলাকুইলকুড়ি গ্রামেই এই অ্যাক্ট প্রথম আনা হয়।
“আমার বিশ্বাস, প্রতিটি গ্রামই এমন একজন মানুষকে খুঁজে নেয়, যে তার কাহিনিগুলিকে পিঠে করে বয়ে বেড়াবে। এমন মানুষের সংখ্যা বেশি নেই বটে, কিন্তু তাঁরা আছেন। হরিচন্দ্রন সেই বিরল মানুষদের মধ্যে একজন। তাঁর পিঠে কিলাকুইলকুড়ির গল্পের ঝুলি। যখন ছোটো ছিলেন, তখনও তিনি নাকি আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধদের সঙ্গেই সময় কাটাতেন। তাঁর প্রতিভা অদ্বিতীয়, আমাদের ভাগ্য ভালো যে, তাঁর মুখে গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছে,” ভেঙ্কটেশ বলেন।
প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক বসন্তবালনের নির্দেশিত সিনেমা আরাভন (২০১২) হরিচন্দ্রনের গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। (ঐতিহাসিক কাহিনিনির্ভর এই সিনেমাটিতে দেখান হয়, ১৮ শতকে কেমন ভাবে একটি জনগোষ্ঠী ধনীদের ঘরে চুরি করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল।)
তবে তাঁর কথকতার ধারাটি মৌখিকই থেকে গেছে। হরিচন্দ্রন কি এই গল্পগুলির কোনও ভাবে দস্তাবেজিকরণ করতে চান? এ নিয়ে তিনি ভাবনাচিন্তা করেছেন। কিন্তু তাঁর মতে, “কারও মুখ থেকে গল্প শোনার মতো রস আর কিছুতে পাওয়া যাবে না। আমার দুঃখ এই যে, এই গল্পগুলিতে আর কারও উৎসাহ নেই – এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া তো দূরের কথা। হয়তো আমারই উচিত, কাউকে ডেকে হৃদয় নিংড়ে সব গল্প তার কাছে জমা করে দিয়ে যাওয়া।”
অনুবাদ: মধুশ্রী বসু