জুঁইফুল গুলজার নিজের সরগরম দুনিয়ায়। সাতসকালে আবির্ভাব ঘটে তার। ধড়াম করে মুক্তোসম কুঁড়ি-বোঝাই বস্তা এসে নামে মাদুরাইয়ের মাট্টুঠাভনি বাজারে। বস্তা থেকে ফুল ঢালতে ঢালতে “ভাড়ি, ভাড়ি [হ্যাট, হ্যাট],” বলে চেঁচিয়ে ওঠে লোকজন। হুড়ুশ্! সারি সারি কুঁড়ি এসে পড়ে বিছিয়ে রাখা প্লাস্টিকের উপর। পলকা মল্লি (জুঁই), সযত্নে তাদের জড়ো করে লোহার দাঁড়িপাল্লায় ডাঁই করেন বিক্রেতারা — ঝনঝন! শেষে খদ্দেরের প্লাস্টিকের থলিতে জড়ো হয় এক কেজি কুঁড়ি। কেউ বা দাম জিগাচ্ছে, কেউ বা তারস্বরে দর জানাতে ব্যস্ত। ত্রিপলের উপর সচল পায়ের খসখস, পায়ের নিচে বাসি ফুলের আর্তনাদ। বিকিকিনির উপর দালালের শ্যেনচক্ষু, চটজলদি আখর এসে বসে নোটবইয়ের পাতায় পাতায়, এরই মাঝে কেউ হয়তো চিৎকার করে উঠল: “আমার পাঁচ কিলো চাই কিন্তু...”
সবচাইতে ভালো ফুলের খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়ান মহিলারা। মুঠোবন্দি কুঁড়ি একে একে মুক্ত হয়ে খসে পড়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে, চলতে থাকে যাচাই পর্ব। প্রকৃত অর্থেই পুষ্পবৃষ্টি। একজন খদ্দের তো সন্তর্পণে একখান গোলাপ আর গাঁদা তুলে নিলেন, দাঁতের চাপে ফাঁক হল চুলের কাঁটা — খুটুক! কেশরাজি সেজে উঠল জোড়া পুষ্পে। তারপর মল্লি, গোলাপ, গাঁদা — নানারঙা ফুলে ভর্তি ঝুড়িখান মাথায় তুলে ভিড়ভাট্টা ঠেলে বাজার থেকে ফেরার পালা।
পথের ধারে, ছাতার তলে এক চিলতে ছায়ায়, একে একে সুতোয় বেঁধে নিলেন ফুলগুলি। বেচতে হবে যে! সবুজ সুতোর দুইধারে বাধ্য শিশুর মতো চুপটি করে বসে পড়ল জুঁইয়ের কুঁড়ি, বৃন্তগুলি সাজানো ভিতরের দিকে, পাপড়ির গর্ভে সুরভির ইন্তেজার। হয়তো কারও বেণি, কারও গাড়ির ভিতর, কিংবা দেবতার ছবির উপর গাঁথা পেরেকে — যেখানেই ফুটুক না কেন, তার গন্ধে গন্ধে ঘোষিত হবে একটাই নাম: মাদুরাই মল্লি।
তিনবছরে মোট তিনবার এই মাট্টুঠাভনি বাজারে গিয়ে হাজির হয়েছিল পারি। সেপ্টেম্বর ২০২১-এ যখন প্রথমবার যাই, বিনায়ক চতুর্থী, অর্থাৎ গণেশের জন্মদিনের চারদিন আগে, সেটা ছিল ফুল ব্যবসায় চটজলদি হাতেখড়ি। কোভিডের জন্য তখন মাট্টুঠাভনি বাসস্ট্যান্ডের পিছনের দিকে অস্থায়ীভাবে বসছিল বাজারটা। কথা ছিল জোরজবরদস্তি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার, কিন্তু সে শুধু কথার কথা।
ফুল ব্যবসায় আমাকে পাঠ দেওয়ার আগে মাদুরাই ফ্লাওয়ার মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাঁর নামখানি ঘোষণা করলেন: “আমার নাম পূকাডাই রামাচন্দ্রন। আর এইটা,” ফুল বাজারের দিকে হাত নেড়ে বললেন, “আমার ইউনিভার্সিটি।”
জুঁইয়ের কারবারে পাঁচ দশক পার করেছেন ৬৩ বছর বয়সি রামাচন্দ্রন। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখার আগেই মল্লির দুনিয়ায় পথচলা শুরু। তাঁর কথায়, “আমরা তিন প্রজন্ম ধরে এই ব্যবসায় রয়েছি।” হাসিমুখে জানলেন যে, ঠিক এই কারণেই নিজেকে পূকাডাই বলে ডাকেন তিনি, কারণ তামিল ভাষায় এটির অর্থ ‘ফুলের বাজার’। “নিজের কারবারের প্রতি ভালোবাসা আর সম্ভ্রম — দুটোই আছে আমার, এই কাজকে আমি পুজো করি। গায়ের এই জামা থেকে সবকিছুই নিজের ঘাম ঝরিয়ে উপার্জন করেছি। আমি চাই — চাষি আর বেনিয়া, সব্বাই যেন সমৃদ্ধ হতে পারে।”
তবে ব্যাপারটা ঠিক অতটাও সহজ নয়। জুঁইয়ের ব্যবসায় উৎপাদন ও দরদাম — দুটোর ওঠানামাই লেগে আছে। সে উৎরাই-চড়াই বড্ড নিষ্ঠুর। এখানেই শেষ নয়: সেচ ব্যবস্থা, চাষের খরচা ও দিনে দিনে বাড়তে থাকা বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার মতো চিরাচরিত সমস্যা তো আছেই, তার উপর নেই চাহিদা মাফিক মজুরের জোগান — ফলে চাষিরা জেরবার।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছিল কোভিড লকডাউন। অনাবশ্যক সামগ্রীর তকমা লাগার ফলে তছনছ হয়ে যায় মল্লির (জ্যাসমিনুম সাম্বাক) কারবার, চাষি ও দালাল সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বহু কৃষক তখন ফুল ছেড়ে সবজি ও শুঁটি জাতীয় শস্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন।
এই সমস্যার সমাধান যে আছে, এ বিষয়ে রামাচন্দ্রনের বিশ্বাস অটুট। একসঙ্গে একাধিক কাজ সামলাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। চাষি, উৎপাদন, খদ্দের ও মালাকার — সব্বাইকে চোখে চোখে তো রেখেইছিলেন, উপরন্তু কেউ একটু গড়িমসি করলেই যখন-তখন “দেই [হেই]” বলে চেঁচিয়ে ওঠেন! তাঁর নির্দেশমূলক সমাধানের আওতায় জুঁই-চাষ থেকে শুরু করে তার খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা সবকিছুই পড়ছে। মাদুরাইয়ে অবিলম্বে একটি সরকারি আতরের কারখানা তৈরি হোক এবং রপ্তানির কারবার মসৃণ হয়ে উঠুক – এই তাঁর দাবি।
সোৎসাহে বলে উঠলেন, “সেটা যদি করি, মাদুরাই মল্লি মঙ্গধা মল্লিয়া ইরুকুম [মাদুরাই মল্লি কক্ষনো তার ঔজ্জ্বল্য হারাবে না]।” এই ঔজ্জ্বল্য কিন্তু ফুলের ঝলমলে লাবণ্য ছাড়িয়ে সমৃদ্ধির ইঙ্গিতও দেয়। বারংবার এই পংক্তিটি আউড়াচ্ছিলেন রামাচন্দ্রন। যেন তাঁর প্রিয় পুষ্পের জন্য মন্ত্রবলে এক সুবর্ণ ভবিষ্যৎ এনে দিচ্ছেন।
*****
বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বাড়ে মল্লির কারবারে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে হট্টগোল। ফুলের সুরভির মতো আমাদের ঘিরে ধরেছিল হাজার কণ্ঠের গুঞ্জন, না চেঁচালে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।
আমাদের জন্য গরম চায়ের বন্দোবস্ত করে দিলেন রামাচন্দ্রন। প্যাচপ্যাচে গরম সকালে চিনি-গোলা তরল পান করতে করতে ব্যবসার ইতিবৃত্ত শোনাচ্ছিলেন তিনি। এমনও জনাকয় চাষি আছেন যাঁরা হাজার হাজার টাকার বেচাকেনা করেন, একেকজন তো ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত। “তাঁরা সব একরের পর একর জুড়ে মল্লিচারা লাগিয়েছেন। এই তো কদিন আগেই, জুঁইয়ের দর তখন ১,০০০ টাকা কেজি, একজন চাষি সটান এসে ৫০ কেজি কিনে নিলেন।” ঠিক যেন লটারি জেতার মতো ব্যাপার — একদিনে ৫০ হাজার টাকা রোজগার!
কিন্তু বাজারের হালত কেমন শুনি? দিন গেলে কত টাকার বিকিকিনি হয়? রামাচন্দ্রনের আন্দাজ, দৈনিক ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা: “এই বাজারটা বেসরকারি। প্রায় শ’খানেক দোকান আছে, আর দিন গেলে দোকান-পিছু ৫০,০০০ থেকে এক লাখ টাকা ব্যবসা হয়। অঙ্কটা নিজেই কষে নিন।”
বেনিয়ারা ১০ শতাংশ কমিশন পান, বোঝালেন রামাচন্দ্রন। “কমিশনের হার আজ দশকের পর দশক ধরে বদলায়নি। এ কারবারে বড্ড ঝুঁকি।” কৃষক টাকাপয়সা দিতে ব্যর্থ হলে সে লোকশানটা এসে পড়ে কারবারির ঘাড়ে। আর এটা যে কোভিড লকডাউনের সময় অহরহ ঘটত, সেটাও জানালেন তিনি।
২০২২ সালের অগস্ট মাসে যখন দ্বিতীয়বারের জন্য যাই, সেটাও ছিল বিনায়ক চতুর্থীর ঠিক আগে। ফুল ব্যবসার কথা মাথায় রেখেই আলাদা করে বানানো বাজার, দুটো চওড়া অলিন্দের দুই ধারে সারি সারি দোকান। এখানকার নিয়মকানুন বাঁধাধরা খদ্দেরদের নখদর্পণে। চোখের নিমেষে সম্পন্ন হয় বেচাকেনা। বস্তাবোঝাই ফুল আসে, চকিতে বিদায় নেয়। অলিন্দ জুড়ে ডাঁই করা আছে বাসি ফুল, পায়ের তলায় পিষতে থাকে তারা। পচা ফুলের আঁশটে গন্ধ আর তাজা পুষ্পের সুরভি — নাসারন্ধ্রে যুদ্ধ লাগে তাদের। কারণটা পরে জেনেছিলাম। আমদের কাছে কোনটা সুগন্ধ আর কোনটা দুর্গন্ধ, তা নির্ভর করছে বিশেষ কিছু রাসায়নিক যৌগের ঘনত্বের উপর। এক্ষেত্রে সে যৌগটির নাম ইন্ডোল, যেটা কিনা প্রাকৃতিক ভাবে জুঁইফুলে পাওয়া যায়। তবে মল্লি ছাড়াও ইন্ডোলের দেখা মেলে বিষ্ঠা, তামাকের ধোঁয়া ও কয়লাপোড়া আলকাতরায় (কোল-টার)।
ইন্ডোলের পরিমাণ অল্প হলে গন্ধটা হয় ফুলেল, অথচ ঘনত্বের মাত্রা বেড়ে গেলেই সেটা পরিণত হয় আঁশটে পূতিগন্ধে।
*****
প্রধানত কোন কোন জিনিসের উপর ফুলের দাম নির্ভর করে, তা বুঝিয়ে বললেন রামাচন্দ্রন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ জুঁই ফুটতে শুরু করে। “এপ্রিল অবধি ফলন ভালো হলেও দর বেশি ওঠে না। ১০০ থেকে ৩০০ টাকা কিলোর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। মে মাসের শেষভাগ থেকে আবহাওয়া পাল্টে যায়, শনশনিয়ে ঝোড়ো বাতাস বয়। হুহু করে বাড়তে থাকে উৎপাদন। মল্লি-মরসুমের মাঝ বরাবর নাগাদ, অর্থাৎ অগস্ট আর সেপ্টেম্বরে ফলন আধা হয়ে যায়, কিন্তু দর হয় দুইগুণ। ওই সময় দামটা ১,০০০ টাকা কিলো অবধি ওঠে। তারপর, বছরের শেষভাগে — নভেম্বর, ডিসেম্বর নাগাদ — গড় ফলনের ২৫ শতাংশ মেলে কেবল। তখন চড়িচড়িয়ে বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁয় জুঁইয়ের দর। এক কিলোর দাম তখন তিন, চার কিংবা পাঁচ হাজার টাকা হলেও অবাক হবেন না। থাই মাসম -টা [১৫ই জানুয়ারি থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি] বিয়ে-শাদির মরসুমও বটে, তখন চাহিদা ওঠে তুঙ্গে, কিন্তু ফলন ঠেকে তলানিতে।”
খেত থেকে সরাসরি যেখানে ফসল এনে তোলেন চাষিরা, সেই মাট্টুঠাভানি বাজারের গড় মল্লি সরবরাহের হিসেব দিলেন রামাচন্দ্রন — আনুমানিক ২০ টন, অর্থাৎ ২০,০০০ কেজি। এছাড়াও ১০০ টন অন্যান্য ফুল তো রয়েইছে। এখান থেকে ফুলের দল পাড়ি দেয় দিন্দিগুল, তেনি, ভিরুধুনগর, শিবগঙ্গাই ও পুদুকোট্টাইয়ের মতো পড়শি জেলায়।
তবে মরসুমের সঙ্গে সঙ্গে ফুল ফোটার যে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়, সেটা গ্রাফ-কাগজে আঁকলে কিন্তু গম্বুজের আকার নেবে না। রামাচন্দ্রনের কথায়: “পানির উপর নির্ভর করেছে, বৃষ্টিবাদলার উপর।” যে চাষির ধরুন এক একর জমি রয়েছে, তিনি এই সপ্তাহে জমিনের এক-তৃতীয়াংশে জল দেবেন, পরের সপ্তাহে সিঞ্চিত হবে আরেক তৃতীয়াংশ — এভাবে একের-তিন ভাগ করে পানি ছড়ালে তবেই গিয়ে [খানিকটা হলেও] স্থিরতা লাভ করবে পুষ্প-ফলন। কিন্তু বৃষ্টি নামলে একসঙ্গে ভিজে যায় প্রত্যেকের জমি, ফুলে ফুলে ভরে ওঠে সব্বার গাছ। “ওরকমটা হলেই দুড়ুম করে মুখ থুবড়ে পড়ে দর।”
১০০ জন কৃষক মিলে জুঁই সরবরাহ করেন রামাচন্দ্রনকে। “আমি নিজে বিশেষ মল্লিচাষ করি না,” জানালেন তিনি, “বড্ড মেহনত করতে হয়।” শুধুমাত্র কুঁড়ি তোলা আর রাহাখরচ মিলিয়েই কিলো-পিছু ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই। এর দুই-তৃতীয়াংশ শুধু খেতমজুরের পিছনেই বেরিয়ে যায়। তাই জুঁইয়ে দর যদি একশো টাকা কিলোর নিচে নামে, তখন ভরাডুবি ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকে না কৃষকের ঝুলিতে।
চাষি আর কারবারির সম্পর্কটা বেশ জটিল। ৫১ বছর বয়সি জুঁইচাষি পি. গনপতির বাড়ি তিরুমঙ্গলম তালুকের মেলাউপ্পিলিগুন্দু জনপদে। রামাচন্দ্রনের সরবরাহকের তালিকায় ইনিও রয়েছেন। অন্যান্য ক্ষুদ্র চাষির মতো গনপতিও কারবারিদের “আদইকলম” বা সাহায্য নেন। তাঁর কথায়, “ফুলচাষ যখন তুঙ্গে ওঠে, আমি ফুলের বস্তা নিয়ে বারবার বাজারে যাই — সকাল, বিকেল, রাত। বেনিয়াদের ছাড়া ফসলটুকু বেচা অসম্ভব আমার পক্ষে।” পড়ুন: তামিলনাড়ু: যাদের মেহনতে সুরভিত হল জুঁই
পাঁচ বছর আগে, রামাচন্দ্রনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা ধার করেছিলেন গণপতি। সে কর্জ শোধ হয়েছিল ফুল বেচে। এ হেন লেনদেনের ক্ষেত্রে কমিশনটাও বাড়ে খানিক — একলাফে গিয়ে ঠেকে ১০-১২.৫ শতাংশে।
মল্লির দর কে বাঁধে? এ সওয়ালের উত্তর দিয়েছিলেন রামাচন্দ্রন: “বাজার তো মানুষেরই তৈরি। মানুষের হাত ধরেই এর ট্যাঁক থেকে পয়সাকড়ি যায় ওর ট্যাঁকে। জুঁইয়ের দর বড্ড অস্থির, এক কিলোর দাম ধরুন ৫০০ টাকা থেকে শুরু হল। চটপট বিক্রি হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ আমরা দাম বাড়িয়ে ৬০০ করে দিই। যদি দেখি তাতেও চাহিদা কমছে না, ৮০০ হেঁকে বসি।”
ওঁর যখন উঠতি বয়স, তখন, “১০০খানা ফুল মোটে ২ আনা, ৪ আনা, ৮ আনায় বিক্রি হত।”
তখনকার দিনে ঘোড়ায় টানা গাড়ি চেপে রওনা দিত ফুলের রাশি। এছাড়াও দিন্দিগুল স্টেশন থেকে যাত্রীবাহী দুইখান রেলগাড়ি ছাড়ত। “ফুলগুলো যাতে হাওয়া-বাতাস পায়, আবার চিঁড়েচ্যাপ্টাও না হয়ে যায়, তাই বাঁশ আর তালপাতার ঝোড়ায় করে পাঠানো হত। জুঁইচাষির সংখ্যা ছিল হাতে-গোনা। আর মহিলা চাষির কথা ছেড়েই দিন, গুটিকয় ছিল মোটে।”
ছোটোবেলায় পাওয়া যেত যে সুবাসিত গোলাপ, তার কথা খুব মনে পড়ে রামাচন্দ্রনের। “পনীর গোলাপ [তীব্র সুরভিযুক্ত এক প্রজাতির গোলাপ]। হাজার ঢুঁড়লেও ওসব আর পাবেন না এখন। একেকটা ফুলের চারদিকে অসংখ্য মৌমাছি উড়ে বেড়াত, কতবার যে হুল খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।” তবে তাঁর কণ্ঠে কিন্তু একফোঁটাও রাগ ছিল না, বরং ভরা ছিল বিস্ময়ে।
তারপর, আরও এক পরত শ্রদ্ধা চড়িয়ে ফোন খুলে ফুলের ছবি দেখাতে থাকলেন আমায়। মন্দিরে মন্দিরে চলতে থাকা ধর্মীয় উৎসবে রথ, পালকি এবং দেবদেবীর মূর্তি সাজাতে ভেট স্বরূপ চড়িয়েছেন যে পুষ্পরাজি। আঙুলের ছোঁয়ায় পাল্টে যাচ্ছিল ছবিগুলো, প্রতিটা তার আগেরটার চেয়েও জমকালো, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর।
তবে হ্যাঁ, ফেলে আসা দিনের মোহে পড়ে থাকার পাত্র তিনি নন। ভবিষ্যৎ নিয়েও তাঁর ধ্যান-ধারণা বেশ স্বচ্ছ। “নিত্যনতুন উদ্ভাবন আর মুনাফার জন্য ডিগ্রিধারী যুবসমাজকে ব্যবসায় নামতে হবে।” নাহ্, রামাচন্দ্রন নিজে হয়তো কোনও ঝাঁচকচকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ ডিঙোননি, আর কোনও ভাবেই তাঁকে ‘যুবক’ বলা চলে না, তবে দুদিক থেকেই দেখতে গেলে সবচাইতে উত্তম ধারণাগুলো যে তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত, একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
*****
প্রথম প্রথম অবশ্য ফুলের মালা আর আতরের কথা শুনলে বৈপ্লবিক ব্যবসার কথা মাথায় আসে না। কিন্তু এসব মোটেও সাথামাটা কোনও ধারণা নয়। মালায় মালায় লুকিয়ে আছে শিল্প ও চাতুর্য, স্থানীয় পুষ্পরাজি গেঁথে গেঁথে এমন দৃষ্টিনন্দন মালা বানানো, যা কিনা স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া যায়, পরা যায়, দেখলে দুচোখ জুড়িয়ে যায়, আবার ব্যবহার শেষে সারও বানানো যায় — এ মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়।
রোজ রোজ শিবগঙ্গাই থেকে বাস ধরে মাদুরাইয়ে কাজ করতে আসেন ৩৮ বছর বয়সি এস. জেয়রাজ। মালা-গাঁথার “অ-আ-ক-খ” সবই তাঁর নখদর্পণে, আজ ১৬ বছর ধরে অতুলনীয় সব মালা বানিয়ে আসছেন তিনি। সগর্বে জানালেন, ছবি দেখে যে কোনও ছাঁদের মালা গাঁথা তাঁর বাঁ-হাতের খেল। এছাড়া নিজের বানানো নিত্যনতুন নকশা তো আছেই। একজোড়া গোলাপ-পাপড়ির মালা গাঁথলে মজুরি স্বরূপ ১,২০০-১,৫০০ টাকা পান জেয়রাজ। তবে সাদামাটা একখান জুঁইয়ের মালার জন্য অবশ্য ২০০-২৫০ টাকার বেশি জোটে না।
রামাচন্দ্রন জানালেন, আমরা যাওয়ার দুদিন আগে হঠাৎই প্রয়োজন-মাফিক মালাকার ও ফুল-গাঁথাইকারী মিলছিল না। “এ কাজে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না হলে চলে না। মুনাফা হবে না যে,” বেশ জোর দিয়েই বলছিলেন, “এক মহিলা খানিক টাকাপয়সা খরচা করে দুই কেজি মল্লি কিনে, সুতোয় গেঁথে-টেঁথে, সেসব বেচলে পরে ৫০০ টাকা লাভ করতে পারে।” সে নারীর সময় ও মেহনতের কথা মাথায় রেখেই এ অঙ্কটা কষা হয়েছে। এক কিলো মাদুরাই মল্লি, অর্থাৎ ৪,০০০-৫,০০০টি কুঁড়ি গাঁথার মজুরি ১৫০ টাকা বলে ধরা হয়। এছাড়া খুচরো ফুল বেচে খানিক উপরি রোজগারের সম্ভাবনাও রয়েছে বটে। এক্ষেত্রে ১০০টা করে ফুল একত্রে খুদে খুদে ঢিপি সাজিয়ে বেচে হয়, যার নাম ‘কূরু’।
ফুল-গাঁথার কাজে দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতা দুটোই সমান জরুরি। মুখে বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতেনাতেও সেটা করে দেখালেন রামাচন্দ্রন। বাঁহাতে কয়েকগাছি কলাপাতার সুতো ধরে চটজলদি খানিক জুঁইকুঁড়ি তুলে নিলেন ডানহাতে, তারপর একের পাশে দুই করে সাজিয়ে ফেললেন তাদের — কুঁড়ির বৃন্তগুলি সব ভিতরের দিকে ফেরানো। এবার পালা একগাছি সুতো উল্টে-পাল্টে কুঁড়িগুলি বেঁধে ফেলার। তারপর, একইভাবে বেঁধে ফেললেন ফুলের দ্বিতীয় সারিটা। এবার তৃতীয়র পালা। তারপর চতুর্থ... এভাবেই বেড়ে চলল মল্লিমালার বহর...
বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন মালা বা ফুল গাঁথার কাজ শেখাতে পারে না? সওয়াল ছুঁড়লেন রামাচন্দ্রন। “এ দক্ষতা যেমন বৃত্তিমূলক, তেমনই রুটিরুজির সহায়ও বটে। আমিও শেখাতে পারি। চাইলে করেস্পন্ডেন্টও হতে পারি...প্রয়োজনীয় দক্ষতা আমার আছে।”
কন্যকুমারী জেলার তোভালাই ফুল বাজারে যে কুঁড়ি গাঁথার কাজটি বেশ সমৃদ্ধ একখান কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে, সেকথা জানালেন রামাচন্দ্রন। “ওখান থেকে মালায় গাঁথা ফুল পাঠানো হয় বিভিন্ন শহর ও নগরে, বিশেষ করে পড়শি রাজ্য কেরালার তিরুবনন্তপুরম, কোল্লাম এবং কোচিন জেলায়। একই নকশায় অন্য কোথাও এরকম কুটিরশিল্প চালু করা যাবে না কেন? বেশি সংখ্যায় মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিলে, মুনাফার দিক থেকে খুবই সুবিধাজনক হবে। খোদ মল্লির নিজের রাজ্যপাটে এরকম হওয়াটা উচিত নয়, বলুন তো?”
তাই ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ, তোভালাই শহরের অর্থনীতি বুঝতে সেখানকার বাজারে গিয়ে হাজির হয়েছিল পারি। গগনচুম্বী হাওয়াকলের এই শহরের চারিপাশে শুধু পাহাড় আর মাঠ, কাছেই নাগেরকোইল। দৈত্যাকার একখান নিমগাছের ছায়ায় বাজার বসে। পদ্মপাতায় জুঁই বেঁধে তালপাতার ঝোড়ায় ভরে রাখা হয়। কন্যাকুমারী ছাড়াও তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি জেলা থেকে রাশি রাশি মল্লি আসে এখানে। একথা জেনেছিলাম বেনিয়াদের থেকে — পুরুষ বই মহিলা কারবারি চোখে পড়েনি। ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে তখন কিলো-পিছু দর ছিল ১,০০০ টাকা। তবে কারবারের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে মহিলা মালাকারদের হাতে গাঁথা মল্লিমালা। কিন্তু বাজারে তাঁদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওঁরা তবে কোথায়? জবাব এল, “নিজের নিজের বাড়িতে,” বলেই পিছনের একটি রাস্তার দিকে ইশারা করলেন পুরুষ বেনিয়ারা।
আর ঠিক সেইখানেই মোলাকাত হল আর. মীনার সঙ্গে। অশীতিপর এই মানুষটি ক্ষিপ্র হাতে একখাছি সুতোয় একের পর এক জুঁই (পিৎচি বা জাঠি মল্লি প্রজাতির) বেঁধে চলেছিলেন। চোখে চশমার বালাই নেই দেখে অবাকই হয়েছিলাম। কিন্তু হুট করে সে প্রশ্ন করতেই হাসির ঝড় উঠল। তারপর হাসি-টাসি চেপে জানালেন, “ফুলগুলো চিনি তো, তবে গাঁ ঘেঁষে না দাঁড়ালে মানুষ চিনতে পারি না মোটেই।” অভিজ্ঞতা নামক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়েই জোরেই তবে চলছে তাঁর আঙুলগুলি।
দক্ষতা ষোল আনা হলেও যথাযথ মজুরি পান না মীনা। পিৎচি প্রজাতির ২০০ গ্রাম ফুল বাঁধলে ৩০ টাকা মেলে। অর্থাৎ এক ঘণ্টা খেটে বাঁধা প্রায় ২,০০০টি কুঁড়ি। এক কিলো মাদুরাই মল্লি (আনুমানিক ৪-৫ হাজার কুঁড়ি) সুতোয় বাঁধলে ৭৫ টাকা জোটে। মাদুরাইয়ে কাজ করতে গেলে এর দুগুণ মিলবে। সুতোয় বাঁধা মল্লি গুটিয়ে একটি কোমল সুগন্ধি বল বানাতে বানাতে জানালেন, দিন ভালো গেলে তোভালাইয়ে ১০০ টাকা রোজগার হয় তাঁর।
অন্যদিকে মালার দাম যেমন আকাশছোঁয়া, তেমনই এ শিল্পে নারীর কোনও স্থান নেই বললেই চলে।
রামাচন্দ্রনের আন্দাজ, মাদুরাই অঞ্চলে হররোজ প্রায় ১,০০০ কিলো জুঁই রূপান্তরিত হয় মালায়, কিংবা বাঁধা পড়ে সুতোর পাকে। তবে এই কারবারে অনেক অসুবিধাও আছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ে তাপমাত্রা, তড়িঘড়ি সুতোয় না বাঁধলে “মোট্টু ভেদিচিদুম” হয়ে যাবে — অর্থাৎ ফুটুস করে ফুটে যাবে কুঁড়িগুলি, বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন বটে! তেমনটা হলেই দাম পড়ে যায়। “কেন? মেয়েদের জন্য আলাদা একটা জায়গার কেন বন্দোবস্ত করা যায় না? যেমন ধরুন এসআইপিসিওটি [স্টেট ইন্ডাস্ট্রিজ প্রমোশন কর্পোরেশন অফ তামিলনাড়ু]। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে জায়গাটাকে, তাহলে ফুলগুলোও তাজা থাকবে, মহিলারা চটজলদি কাজও করতে পারবেন, তাই না?” এ কাজে গতির ভূমিকা বিশাল, কারণ সুতোয় বাঁধা কুঁড়ির দল দেশে-বিদেশে যেখানেই যাক না কেন, পৌঁছনোর ফুটে গেলেই মুশকিল।
“আমি কানাডা আর দুবাইয়ে মল্লি রপ্তানি করেছি। কানাডা পৌঁছতে ৩৬ ঘণ্টা লাগে। আপনিই বলুন, ওদের হাতে টাটকা টাটকা ফুল না পাঠালে চলে?”
এই বলে পরিবহণের প্রসঙ্গে এসে পড়লেন রামাচন্দ্রন। এই কাজেও আপদ কম নেই। ফুলগুলো গাড়ি থেকে খালাস করা হয়, কিংবা উড়োজাহাজে তাদের তোলার জন্য সুদূর চেন্নাই, কোচি কিংবা তিরুবনন্তপুরমে পাঠাতে হয়। মাদুরাইকে মল্লি রপ্তানির প্রাণকেন্দ্র না করে যে সত্যিই আর উপায় নেই, সেটা বেশ জোর দিয়ে জানালেন তিনি।
এই বিষয়ে তাঁর পুত্র প্রসন্ন বললেন: “রপ্তানির জন্য করিডর আর পথপ্রদর্শন দরকার আমাদের। মার্কেটিংয়ে সাহায্য করতে হবে চাষিদের। তাছাড়া রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় কর্মী নেই যাঁরা বাঁধছাঁদ করতে পারেন। বাধ্য হই কন্যাকুমারীর তোভালাই কিংবা চেন্নাই যেতে। প্রত্যেকটা দেশের আলাদা আলাদা নিয়ম আর শংসাপত্রের চক্কর আছে — এই ব্যাপারে চাষিদের একটু দিশা-নির্দেশ দিলে বড্ড উপকার হয়।”
২০১৩ থেকে মাদুরাই মল্লির ঝুলিতে ভৌগলিক শংসাপত্র (জিআই ট্যাগ) আছে ঠিকই, তবে প্রসন্নর মতে এতে চাষি বা কারবারি, লাভবান হন না কেউই।
“লোকে অন্যান্য অঞ্চলে চাষ হওয়া জুঁইও মাদুরাই মল্লি বলে চালিয়ে দিচ্ছে, এ বিষয়ে একাধিকবার আবেদন জমা দিয়েছি।”
যে কথাটা প্রত্যেক চাষি ও কারবারির মুখে মুখে ফেরে, সেটা দিয়েই উপসংহার টানলেন রামাচন্দ্রন: মাদুরাইয়ের নিজস্ব একটি আতর কারখানা দরকার; এবং সেটা যে সরকারি হতেই হবে — এটাও জোরগলায় জানালেন তিনি। জুঁইয়ের দেশে ঘুরতে ঘুরতে একথাটা এতবার শুনেছি যে মনে মনে বিশ্বাস হতে লেগেছে, ফুলের নির্যাস নিংড়ে সুগন্ধি আতর বানাতে পারলেই কেল্লাফতে! কিন্তু, সবাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেই বা, বাস্তবে সেটাই হবে তো?
তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হওয়ার বছরটাক পর, ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দেন রামাচন্দ্রন। আপাতত তাঁর মেয়ের সঙ্গে ওখানেই থাকেন তিনি। তাই বলে জুঁই কারবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এমনটা ভাববেন না যেন! তাঁর কর্মচারীবৃন্দ তথা যে চাষিরা তাঁকে ফুল সরবরাহ করেন, দুই তরফের কাছেই শুনলাম যে তিনি রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে বিদেশে বসে দিনান্ত খাটছেন। এছাড়া তাঁর ব্যবসাপাতি এবং এখানকার বাজারের উপর নজরও রেখেছেন।
*****
প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাজারের অস্তিত্ব আজ বহু শতাব্দীর ধরেই বিদ্যমান। বাজার না থাকলে বাণিজ্যিক লেনদেনের বাস্তবায়নের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ কোনদিনও হত না। এর ব্যাখ্যা করলেন জেনিভা গ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউটে ডক্টরাল স্তরের গবেষক রঘুনাথ নাগেশ্বরন। ইনি স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ইতিহাসের উপর কাজ করছেন। “তবে আনুমানিক একশো বছর হতে চলল, বাজারকে একটি নিরপেক্ষ ও স্বয়ংচালিত প্রতিষ্ঠান বলে প্রচার করা হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে, বাজার নামক বস্তুটিকে আজ পূজার বেদিতে তুলে রাখা হয়েছে।”
“আপাতদৃষ্টিতে যে প্রতিষ্ঠান কিনা এতটাই দক্ষ, তাকে মুক্ত রাখাটাই বাঞ্ছনীয় — ধীরে ধীরে এই ধারণাটির স্বাভাবিকীকরণ হয়েছে। এবং বাজারের হতে উদ্ভূত ফলাফল যদি তেমন ফলপ্রদ না হয়, তাহলে তার জন্য অপ্রয়োজনীয় বা বিভ্রান্তিকর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের উপরেই দায় বর্তায়। বাজারের এই রং-চড়ানো উপস্থাপনা কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ভুল।”
“তথাকথিত খোলা-বাজার”-এর ব্যাখা করলেন রঘুনাথ, যেখানে “বিভিন্ন কলাকুশলী আলাদা আলাদা মাত্রায় স্বাধীনতা উপভোগ করে।” তবে হ্যাঁ, বাজারের লেনদেনে যদি স্বক্রিয়ভাবে অংশ নেন, তবেই এ “স্বাধীনতার” স্বাদ পাবেন — এটাও জানালেন তিনি। “তথাকথিত একখান অদৃশ্য হাত আছে বটে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দৃশ্যমান কিছু মুঠিও আছে যাদের কিল-চড়ের জোরে বাজার ঘুরছে। বাজারে যা কিছু কাজকর্ম চলে, তার কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই ব্যবসায়ীরা। তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে যাবতীয় মূল্যবান তথ্যের মহাফেজও তাঁরা, আর সেই কারণেই তাঁদের ক্ষমতা অসীম।”
“তথ্যের অসমতা যে বিশাল ক্ষমতার উৎস,” রঘুনাথের মতে এটা বোঝার জন্য গবেষণাপত্র পড়ার দরকার নেই। তাঁর কথায়: “জাতপাত, শ্রেণি ও লিঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতেই জন্ম এই তথ্য ঘিরে অসমতার। খেত বা কারখানা থেকে সরাসরি যখন মালপত্র কিনি, বা স্মার্টফোনে বিভিন্ন অ্যাপ নামাই, কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে এই জিনিসটা আমরা হাতেনাতে টের পাই, তাই না বলুন?”
“বিভিন্ন পণ্য ও সেবা যাঁরা উৎপাদন করেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন বলে বাজার-ক্ষমতা প্রয়োগ করাটাও তাঁদের হাতের মুঠোয়। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু উৎপাদকও আছেন যাঁদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই নিজেদের পণ্যের দামের উপর — কারণ তাঁদের উৎপাদনের পুরোটাই বর্ষা ও বাজার-ঝুঁকির উপর নির্ভরশীল। এখানে আমরা কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী কৃষকদের কথাই বলছি।”
“চাষিদের মধ্যেও বিভিন্ন ভাগ আছে। তাই খুঁটিনাটি অনেক কিছুর উপর মনোযোগ দিতে হবে,” জানালেন রঘুনাথ, “আর প্রসঙ্গের কথাটাও ভোলা চলবে না। চলুন, এই জুঁইয়ের দাস্তান থেকেই উদাহরণ নেওয়া যাক না হয়। সরকারের সরাসরি আতরশিল্পে যোগ দেওয়া উচিত না কি তা ঠিক নয়? না কি মূল্য-সংযোজিত পণ্যের জন্য রপ্তানি-কেন্দ্র ও বিপণন পরিকাঠামো বানানোর জন্য হস্তক্ষেপ করা উচিত, যাতে ময়দানে খেলতে থাকা ছোটো খেলোয়াড়দের খানিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়?”
*****
জুঁই খুবই দামি ফুল। ঐতিহাসিকভাবে কুঁড়ি, ফোটা ফুল, কাঠ, শেকড়, জড়িবুটি ও তেলের মতো সুগন্ধি সামগ্রীর বহুল ব্যবহার হয়ে এসেছে। সে উপাসনাস্থলে ভক্তি জাগ্রত করার জন্য হোক, বা হেঁশেলে স্বাদ বাড়ানোর জন্য, কিংবা শোওয়ার ঘরে কাম বাড়ানোর জন্য। চন্দন, কর্পূর, এলাচ, জাফরান, গোলাপ ও জুঁই-বেলি-গন্ধরাজ — আরও অনেককিছুর মতো এগুলির সুগন্ধও বড্ড চেনা ও জনপ্রিয়। এগুলি যেহেতু বহুলরূপে ব্যবহৃত, আর হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় খুব সহজে, তাই আর যা-ই হোক না কেন আহামরি বলে তো মনে হয় না। কিন্তু আতরশিল্পের দরবারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখুন, অন্য উত্তর মিলবে।
সুগন্ধিশিল্পের কলকাঠি কেমন করে নড়ে, সেটা এই সবে একটু একটু করে বুঝতে শিখছি।
প্রথম তথা প্রারম্ভিক ধাপে, খাদ্যমানের দ্রাবকের সাহায্যে পুষ্প হতে তার নির্যাস নিংড়ে নিয়ে যে আধা-তরল ও মোমের মতন বস্তুটি তৈরি হয়, তার নাম ‘কংক্রিট’। মোমজাতীয় পদার্থগুলি ছেঁকে বাদ দেওয়ার পর যে তরলটি পড়ে থাকে, তার নাম ‘অ্যাবসোল্যুট’ – যেহেতু এটি অ্যালকোহলে দ্রাব্য, তাই উপাদান রূপে এটিই সবচাইতে সহজে ইস্তেমাল করা যায়।
এক কিলো জুঁইয়ের ‘অ্যাবসোল্যুট’ কিনতে গেলে প্রায় ৩,২৫,০০০ টাকা খসবে আপনার।
বিশ্বের বৃহত্তম পুষ্পনির্যাস প্রস্তুতকারক সংস্থাটির নাম জ্যাসমিন সি.ই. প্রাইভেট লিমিটেড (জেসিইপিএল), এরা জ্যাসমিন সাম্বাকের কংক্রিট ও অ্যাবসোল্যুটও বানায়। জেসিইপিএলের পরিচালক রাজা পালানিস্বামী জানালেন, জ্যাসমিন সাম্বাকের এক লিটার অ্যাবসোল্যুট পেতে গেলে এক টন গুন্দু জুঁই (বা মাদুরাই মল্লি) লাগে। চেন্নাইয়ে তাঁর দফতরে বসে শুনিয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী আতরশিল্পের ইতিবৃত্ত।
শুরুতেই খোলসা করে দিলেন: “আমরা কিন্তু আতর বানাই না। আমরা প্রাকৃতিক একটা উপাদান তৈরি করি, যেটার সঙ্গে আরও হাজারটা জিনিস মেশালে তবেই গিয়ে তৈরি হয় ফ্রাগ্র্যান্স কিংবা পারফিউম।”
চার প্রজাতির জুঁই নিয়ে তাঁদের কারবার, তার মধ্যে জ্যাসমিন গ্রান্ডিফ্লোরুম (জাঠি মল্লি) ও জ্যাসমিন সাম্বাক (গুন্দু মল্লি) প্রজাতি দুটিই প্রধান। এদের মধ্যে জাঠির অ্যাবসোল্যুট অপেক্ষাকৃত কম দামি, আনুমানিক ৩,০০০ মার্কিন ডলার প্রতি কিলো। ওদিকে গুন্দুর অ্যাবসোল্যুট কিলো-পিছু ৪,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ওঠে।
“শুধুমাত্র ফুলের দরের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে কংক্রিট আর অ্যাবসোল্যুটের দাম, এবং ইতিহাস সাক্ষী আছে যে ফুলের দাম বেড়েছে বই কখনোই কমেনি। দু-একবার কমবেশি এদিক-ওদিক হলেও, বছর বছর দামের ফারাক কেবল ঊর্ধ্বমুখীই থেকেছে,” জানালেন পালানিস্বামী। ওঁর কোম্পানিতে প্রতিবছর ১,০০০-১,২০০ টন মাদুরাই মল্লি (গুন্দু মল্লি নামেও পরিচিত) প্রক্রিয়াজাত করা হয়। বিশ্বজুড়ে জ্যাসমিন সাম্বাক অ্যাবসোল্যুটের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৩.৫ টন, তার মধ্যে থেকে ১-১.২ টন অ্যাবসোল্যুট একা জেসিইপিএল বানায়। তামিলনাড়ুতে রাজার দুটি বড়ো কারখানা ছাড়াও ভারতজুড়ে কয়েকটি ছোটো নির্মাতা আছে, অথচ এ দেশে “যে পরিমাণে সাম্বাক ফুল উৎপাদন হয়, তার ৫ শতাংশেরও কম” ইস্তেমাল হয় আতরশিল্পে।
সংখ্যাটা সত্যিই অবাক করার মতো। কারণ জুঁইয়ের কারবারে “আতর কারখানার” মাহাত্ম্য প্রচার করেন না, এমন কোনও চাষি বা দালালের সঙ্গে অন্তত আমার আলাপ হয়নি। জবাবে মুচকি হাসলেন রাজা পালানিস্বামী। “একটা শিল্প হিসেবে আমরা যে পরিমাণে ফুল কিনি, মোট উৎপাদনের নিরিখে তা নামমাত্র, কিন্তু যে ভূমিকাটা পালন করি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চাষিরা যাতে নিশ্চিতভাবে লাভের মুখ দেখেন, তার জন্য ন্যূনতম মূল্য বজায় রাখি আমরা। হ্যাঁ, কৃষক ও এজেন্টরা অবশ্যই চাইবেন যাতে সারাটা বছর ধরে চড়াদামে ফুল বিকোয়। কিন্তু জানেনই তো, এই প্রসাধন ও আতরের শিল্পটা বড্ড খামখেয়ালি। ওঁনারা ভাবেন যে বিশাল মুনাফা করছি আমরা, কিন্তু আদতে এটা কেবলই পণ্যের বাজার।”
গল্পে গল্পে উঠে এলো দেশ-দেশান্তরের কথা। ভারত থেকে ফ্রান্স, মাদুরাইয়ের ফুল বাজার থেকে তাঁর ক্রেতাবৃন্দ — যাদের মধ্যে রয়েছে ডিয়হ্, গ্যেরলাঁ, লাশ ও ব্যুলগারির মতো দুনিয়ার অন্যতম আতর-উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি। একটা জিনিস দিব্যি ঠাহর হল — দুটো পৃথিবীর মাঝে ফারাক যেমন বিস্তর, আঁতাতও তেমন গাঢ়।
সুগন্ধির রাজধানী বলে ধরা হয় ফ্রান্সকে। আনুমানিক গত পাঁচ দশক ধরে তারা ভারত থেকে জুঁই-চামেলির নির্যাস কিনছে। ফরাসিরা জ্যাসমিনুম গ্রান্ডিফ্লোরুম বা জাঠি মল্লির খোঁজে এসেছিল বটে, কিন্তু, “এখানে এসে আমাদের পুষ্পজগতে ওরা সাতরাজার ধন আবিষ্কার করেছিল, একেকটা ফুলের আবার বিভিন্ন প্রজাতিও আছে,” বুঝিয়ে বললেন রাজা।
তারপর ১৯৯৯ সালে আচমকাই মোড় নেয় আমাদের কাহিনি, ডিয়হ্ পারফিউম সংস্থার হাতে সৃষ্টি হয় জাদোহ্ (J’adore) নামক কালজয়ী ফরাসি পারফিউমটি। ওদের ওয়েবসাইটে এটির সম্বন্ধে লেখা আছে, “এটি এমন একটি ফুলের জন্ম দিয়েছে যেটা বাস্তবে পাওয়া যায় না, যা কিনা আদর্শ।” এবং এই “আদর্শ ফুলের” গন্ধে তার “তাজা ও শ্যামল সুরভি” নিয়ে একঝলক ভারতীয় জ্যাসমিন সাম্বাকও উপস্থিত রয়েছে, জানালেন রাজা। “অচিরেই এটি রূপান্তরিত হল জনপ্রিয় ধারায়।” এবং সোনালি রিং দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের শিশিতে করে ফ্রান্স হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেল মাদুরাই মল্লি — ডিয়হ্ অবশ্য তাকে “ঐশ্বর্যপূর্ণ জ্যাসমিন সাম্বাক” বলেই ডাকে।
কিন্তু এসবের বহুযুগ আগে থেকেই আতরশিল্পে জুঁইয়ের উৎস মাদুরাই তথা আশেপাশের ফুল-বাজারগুলি। তবে সবদিন কিন্তু কেনা হয় না। বছর সিংহভাগ জুড়ে জ্যাসমিন সাম্বাকের দাম এতটাই চড়া থাকে যে ও দিয়ে নির্যাস বানালে কারোরই পোষাবে না।
পালানিস্বামীর কথায়: “এই জাতীয় ফুল-বাজারে ফুলের চাহিদা ও সরবরাহ কোন কোন বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝতে হবে আমাদের। বাজারে-বাজারে একজন করে পার্চেজার/কোঅর্ডিনেটর (ক্রেতা/সমন্বয়কারী) মোতায়েন করে রেখেছি, তাঁরা খুব মনোযোগ দিয়ে দরদাম নিরীক্ষণ করেন। আমরা জানি যে দর কতটা হলে ব্যবসা করে পোষাবে, ধরুন সেটা যদি ১২০ টাকা হয় তো আমরা অপেক্ষা করে থাকব যতক্ষণ না ওই দামে ফুল মিলছে। দরদামের ওঠা-নামায় আমাদের কোনও হাত থাকে না,” সঙ্গে এটাও যোগ করলেন যে মূল্য নির্ধারণের চাবি বাজারের হাতেই আছে।
“আমরা কেবল অপেক্ষা করে থাকি আর বাজারের উপর নজর রাখি আসলে এই পরিমাণে ফুল কেনায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে তো — কোম্পানিটা অবশ্য ১৯৯১ সালে শুরু হয়েছিল — তাই মরসুম মাফিক দরদাম আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না। হুড়মুড়িয়ে দর পড়লেই আমরা ফুল কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, চেষ্টা করি যাতে ক্রয় ও উৎপাদন দুটোরই মাত্রা সর্বাধিক হয়।”
এমন উপায়ে ব্যবসা করে বলেই জেসিইপিএলের যতটা ধারণক্ষমতা, সেটা সবসময় সম্পূর্ন ইস্তেমাল করা হয়ে ওঠে না, জানালেন রাজা। “রোজ রোজ সমান পরিমাণে ফুল জোটে না। এটা তো আর ইস্পাত-কারখানা নয় যে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা আছে লোহার আকর, আর সারাটা বছর ধরে সমান তালে চলছে যন্ত্রপাতি। এখানে, ফুলের ইন্তেজারে তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকি আমরা। হঠাৎ হঠাৎ করে এমন একেকটা দিন আসে যখন ফুলে-ফুলে ছয়লাপ হয়ে যায় বাজার — সেদিনগুলোয় যাতে পুরোদমে কাজ চালাতে পারি, সেইভাবেই প্রস্তুত করা আছে আমাদের ধারণক্ষমতা।”
বছর গেলে, ওরকম ‘পুষ্পবৃষ্টি’ ২০-২৫ দিনের বেশি হয় না, রাজার কথায়: “তখন দৈনিক আমরা ১২ থেকে ১৫ টন ফুল প্রসেস্ করি। বাকি বছরটা হয় অল্প অল্প করে ফুল জোটে, ওই ১ থেকে ৩ টন, কিংবা কিছুই জোটে না।”
কিন্তু চাষিরা যে দরদামের চড়াই-উতরাই এড়াতে সরকারের কাছে একটি কারাখানা বানানোর আবেদন জানাচ্ছেন, সেটা কতটা কার্যকরী? জবাব এল, “চাহিদা এতটাই অনিশ্চয়তা ও খামখেয়ালিপনায় ভরা যে সরকার এমন হুট করে উপাদান-কারবারে পা না-ও রাখতে পারে। কৃষক ও বেনিয়াদের চোখে যতই সম্ভাবনা থাকুক না কেন, সরকারের কাছে বাণিজ্যিক রূপে এটা অর্থহীন হতেই পারে।” জোরদার তর্ক জুড়েছিলেন রাজা: “শেষমেশ কলাকুশলীর তালিকায় আরও একজন যোগ হবে, এটাই যা। সরকার যদি বাদবাকি সব্বার উপর উপাদান বানাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুরো বাজার জুড়ে একাধিপত্য কায়েম করে তাহলে ঠিক আছে, নতুবা সেই একই চাষিদের থেকে কিনতে হবে আর ফুলের নির্যাস সেই একই খদ্দেরের কাছে বেচতে হবে।”
সবচাইতে উন্নত মানের সুগন্ধ পেতে হলে জুঁই ফোটামাত্র তাদের প্রসেস্ করতে হবে, বললেন পালানিস্বামী, “ফুল ফুটলে যে গন্ধটা বেরোয়, তার পিছনে লুকিয়ে আছে ধ্রুবক রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া; আবার ওই ফুলটা পচে গেলেই দুর্গন্ধ ছড়াবে।”
এই প্রক্রিয়া যাতে আরও ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি, তারজন্য এই বছর ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে মাদুরাইয়ের সন্নিকটে নিজের আতর কারখানায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন রাজা।
*****
ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মাট্টুঠাভনি বাজারের ঝটিকা সফর দিয়ে শুরু হল আমাদের মাদুরাই ভ্রমণ। এই নিয়ে তৃতীয়বার এলাম এখানে, অবাক লাগল এমন চুপচাপ ভিড়ভাট্টাহীন বাজার দেখে। জুঁই প্রায় নেই বললেই চলে, তবে রংচঙে ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে চারিদিক: ঝুড়িতে ভরা গোলাপ, বস্তাবন্দি রজনীগন্ধা আর গাঁদা, স্তূপীকৃত ধাভনম (মুর্রু বা মিঠে মারজোরাম)। জোগান কম থাকা সত্ত্বেও ১,০০০ টাকা কিলোয় বিকোচ্ছিল মল্লি, কারণ সেদিন কোনও একটা পুণ্য তিথি পড়েছিল, বেনিয়াদের থেকে জানা গেল।
গ্রান্ডিফ্লোরুম ও সাম্বাক — এই দুই প্রজাতির মল্লি যে চাষিরা রাজার সংস্থায় সরবরাহ করেন, তাঁদের সঙ্গে মোলাকাত করতে মাদুরাই থেকে গাড়ি করে পাশের দিন্দিগুল জেলার নিলাক্কোট্টাই তালুকে গেলাম। ওখানে গিয়ে যে গল্পটা শুনলাম, তা সত্যিই তাজ্জব বনে যাওয়ার মতো!
মল্লিচাষে প্রায় দুই দশক কেটেছে মারিয়া ভেলাঙ্কান্নির, এই সম্পন্ন চাষিটি জানালেন — ভালো ফসলের যদি চান, তাহলে ছাগল দিয়ে সমস্ত বুড়ো পাতা সাবাড় করিয়ে দিন!
এক একর জমির এক-ষষ্ঠাংশ জুড়ে ঝলমলে সাদাফরঙা জুঁইয়ের বাহার। সেদিকে ইঙ্গিত করে মারিয়া বললেন, “কায়দাটা কেবল মাদুরাই মল্লির ক্ষেত্রেই খাটে। ফসল বেড়ে দুগুণ, কখনও কখনও তিনগুণও হয়ে যায়।” প্রক্রিয়াটা এতখানি সাদামাটা যে বিশ্বাস করতে চাপ হয়। খানকতক ছাগল ছেড়ে দিন জুঁই-খেতে, ওরা ঘুরে ঘুরে পাতা-টাতা সব সাবড়ে দেবে। এরপর দশদিন শুখা ফেলে রাখার পর মাঠে সার দিন। ১৫তম দিনে কচি কচি পল্লব দেখা দেবে আর ২৫ দিন পর যে ফলনটা হবে তা ফাটাফাটি বললেও কম বলা হয়।
একমুখ হেসে আশ্বাস দিলেন, এ অঞ্চলে এই কায়দাটা বহুল প্রচলিত: “ছাগলের কামড়ে ফুলের উৎপাদন বাড়ছে, এটা তো প্রথাগত জ্ঞান। বছরে তিনবার এই অভিনব প্রথায় গাছের ‘চিকিৎসা’ করা হয়। দাবদাহের মাসে ছাগলের পাল পেটভরে জুঁইগাছের পাতা খায়। একবার এ ডালে টান দেয় তো আরেকবার ওই ডালে, ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে বিষ্ঠাত্যাগের পালা — ভেজালহীন জৈবসার! ছাগপালকেরা কোনও মজুরি নেন না, চা আর বড়া খেয়েই খুশি থাকেন। তবে হ্যাঁ, রাত্তিরে যদি কয়েকশো ছাগল মাঠের মধ্যেই বেঁধে রাখতে চান, তাহলে কিন্তু শ-পাঁচেক টাকা লাগবে। সে যা-ই হোক না কেন, মল্লিচাষিরা লাভবান হবেনই।”
জেসিইপিএলের দিন্দিগুল কারখানায় গিয়ে দেখলাম, তাক লাগানো আরও অনেককিছুই ইন্তেজার করে আছে। সুবিশাল প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট ঘুরিয়ে দেখানো হল আমাদের। দেখলাম, সারি সারি ক্রেন, কপিকল, আবগার যন্ত্র ও হিমযন্ত্রে কেমনভাবে ব্যাচের পর ব্যাচ ‘কংক্রিট’ ও ‘অ্যাবসোল্যুট’ তৈরি হয়। ফেব্রুয়ারির শুরু, ফুলের জোগান নেই তেমন, দামও গগনচুম্বী। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ছাঁকা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি, স্টেইনলেস ইস্পাতে বানানো যন্ত্রের ফোঁসফোঁস, গুঞ্জন, ঝনঝনাৎ, মন-মাতানো ফিরদৌসি গন্ধে এমন ম-ম করছে চারিদিক যে জোরে জোরে শ্বাস না নিয়ে আর থাকতে পারলাম না আমরা। মুচকি হাসি দিলাম শেষে।
একগাল হাসি নিয়ে, আমাদের হাতে ‘অ্যাবসোল্যুট’ -এর বিভিন্ন নমুনা তুলে দিয়ে শুঁকতে বললেন জেসিইপিএলের আর অ্যান্ড ডি বিভাগের অধ্যক্ষ, ৫১ বছর বয়সি ভি. কাতিরোলি। লম্বাটে একখান টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, টেবিলের উপর সাজানো ছিল ফুলে ভরা বেতের ঝুড়ি, সুরভির তথ্য ছাপা ল্যামিনেটেড কাগজ ও পুঁচকে পুঁচকে শিশিতে রাখা “অ্যাবসোল্যুট” । পরীক্ষণের জন্য পাতলা পাতলা কাগজের ফালি এক এক করে শিশিতে চুবিয়ে আমাদের শুঁকতে দিচ্ছিলেন সোৎসাহে, লিখে রাখছিলেন প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়া।
প্রথমে এল কাঠচাঁপা — মিঠে, লাস্যময়; তারপর রজনীগন্ধা — বেশ কড়াপাক। তারপর দুটি প্রজাতির গোলাপের অ্যাবসোল্যুট বার করে আনলেন কাতিরোলি — প্রথমটির সুরভি হালকা ও তাজা, দ্বিতীয়টিতে সোঁদা সোঁদা খড়ের গন্ধ। এরপর পালা গোলাপি ও সাদা পদ্মের — দুটোতেই বেশ স্নিগ্ধ ফুলেল সুরভি। শেষে কাগজের ডগায় মেখে হাজির হল চন্দ্রমল্লিকা — খাঁটি বিয়েবাড়ির গন্ধ!
তারপর একে একে আসতে লাগল বিভিন্ন জড়িবুটি ও মশলার অ্যাবসোল্যুট , একাধারে চেনা ও অচেনা সব ঘ্রাণ। গরম তড়কার মতো গন্ধওয়ালা মেথি, ঠাকুমার রান্নার কথা মনে-করানো কারিপাতা। তবে প্রথম পুরস্কারটা কিন্তু জুঁই-ই ছিনিয়ে নিল। গন্ধটা বর্ণনা করতে গিয়ে হালে পানি পাচ্ছিলাম না। কাতিরোলি এগিয়ে এলেন: “ফুলেল, মিষ্টি, বুনো, সবজেটে, ফলের মতো, আবার হাল্কা একটু চামড়ার গন্ধও আছে,” এক নিঃশ্বাসে বললেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার প্রিয় গন্ধ কোনটা? ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই কোনও ফুলের নাম বলবেন।
খিলখিলিয়ে হেসে উত্তর দিলেন, “ভ্যানিলা।” এ সংস্থার নাম বললেই যে ভ্যানিলা এসেন্সটির কথা মাথায় আসে, সেটি কাতিরোলি ও তাঁর দলের গবেষণার ফসল। তবে উনি নিজে যদি কোনওদিনও সিগনেচার কোনও আতর বানান, অবশ্যই মাদুরাই মল্লি ইস্তেমাল করবেন বলে জানালেন। আতরশিল্প ও কসমেটিক্সের জগতে উৎকৃষ্টতম গুণমান সম্পন্ন উপাদান বানানোর কাজে এগিয়ে থাকতে চান তিনি।
কারখানার কাছেই, মাদুরাই নগরীর ঠিক বাইরে পান্নারঙা মাঠে মাঠে মল্লি পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষিরা। তাঁদের মেহনতের ফুল শেষমেশ যেখানেই গিয়ে উঠুক না কেন — ঘষাকাচের শিশি, উপাসনাস্থল, বিয়েবাড়ি, বেতের ঝুড়ি, ফুটপাত, কিংবা বেণিতে সজ্জিত মালায় — জুঁই সেই স্বীয় অপার্থিব গন্ধে ভরে তুলবে চরাচর।
২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র