“আচ্ছা!” সে বলে উঠল। “ছবি তোলা হচ্ছে? বেশ, ছবিগুলো তোলো এবং তারপর মুম্বইয়ের বিট্টু সেহগলকে দিও।” সেহগাল স্যাংচুয়ারি পত্রিকার সম্পাদক। আমাকে ছবি তুলতে দেখে মাতালটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে আমি নির্ঘাৎ পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার ছবি তুলছি। বিদর্ভ অঞ্চলের চন্দ্রপুর জেলায় ঠিক কেন এই কথোপকথন চলছিল তা আজও আমার কাছে একটি রহস্য। মাতালটি হয়তো কিছুদিন মুম্বইয়ে কাজকর্ম করেছে। হয়তো স্যাংচুয়ারি পত্রিকার একটি দল এই জঙ্গলে ছাওয়া এলাকায় সাম্প্রতিককালে কাজ করে গেছে। মাতালটি এতটাই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল যে বিশেষ কিছু বোঝাই গেল না। তার খপ্পরে পড়ে আরেকটু হলেই আমরা দুজনেই পঙ্গু হচ্ছিলাম আর কি! এরপর তাকে আর প্রশ্ন করার সাহস আর আমার ছিল না!
দেলানওয়াড়ির এই ‘ শঙ্করপাত ’ অর্থাৎ মেলাটি জোর কদমে চলছিল। এই মেলার মূল আকর্ষণ অবশ্যই ওই গরুর (বলদ) গাড়ির দৌড়। আমাদের মনে হল, দৌড় না বলে একে বরং গতির পরীক্ষা বলা উচিত। গরুর গাড়িগুলি একসঙ্গে দৌড়ের ময়দানে নামে না। গাড়ির দৌড়ের জন্য নির্দিষ্ট পথটি যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। একসঙ্গে বড়জোর দুটি গরুর গাড়ি এক কিলোমিটারের পথটা দৌড়তে সক্ষম। বিগত কয়েক দশক জুড়ে গরুর গাড়ির দৌড়ের ফলে ময়দানে দুটি ‘পথ’ সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এক বারে একটি গাড়ি, দুটো বলদ নিয়ে একজন চালক দৌড়ে অংশ নেয়।
আর পাঁচটা দৌড়ের পরিবেশ থেকে এখানকার চিত্র একেবারেই আলদা, এখানে চতুর্দিকে দর্শকের ভিড়, দৌড়ের পথও বাদ যায় নি, এমনকি কেউ কেউ আবার দৌড় চলাকালীন উর্ধশ্বাসে ছুটে আসা বলদগুলোর দৌড়পথ দিব্যি হেলতে দুলতে অতিক্রম করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও দুর্ঘটনা ঘটে নি। দর্শকেরা চিলচিৎকার করে এই অপদার্থ মানুষটিকে সাবধান করলে সে হতচকিত পালোয়ানের মতো নিমেষের মধ্যে পথ থেকে ছিটকে সরে আসে। এতসবের পরেও গরুর গাড়ির চালক কিন্তু তার গতি হ্রাস করে না মোটেই। দৌড়পথের একেবারে ধার ঘেঁষে বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তরুণের দলগুলি তাদের নায়কদের উদ্দেশ্যে উল্লাস জানাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম উৎসাহী দর্শকের দল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ আবার উঁচু খড় বোঝাই সাধারণ গরুর গাড়ির উপর চেপে পড়েছে। বলা যায়, এগুলো হল এখানকার ড্রেস সার্কেল এবং ব্যালকনি! বাদবাকি মানুষজন মেলার ময়দান জুড়ে ইতস্তত বিচরণ করছে, কেনাকাটায় ব্যস্ত, তবে দৌড়ের গর্জন কানে এলেই তখন সব ফেলে সেদিকেই মন ছুটছে তাদের।
এ কিন্তু আপনার আমার দৈনন্দিনের সাধারণ গরুর গাড়ি নয়, গরুর গাড়ির নিরিখে দেখলে এগুলি হল ঝকঝকে ধাবমান যন্ত্র। গাড়িগুলি আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট, ছিমছাম, তুলনামূলকভাবে হালকা এবং বিস্ময়কর গতিতে দৌড়তে সক্ষম। গাড়ির চালকেরা সকলেই বিভিন্ন বয়স এবং চেহারার অভিজ্ঞ কৃষক। একজন চালককে দেখেই বোঝা গেল তাঁর বয়স ৬০ তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে। এই দৌড়ে বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপারই নয়। যাবতীয় ব্যাপার ওই দৌড় ঘিরেই। অতএব, এহেন দৌড়ের জন্য সরকারি ‘পুরস্কার’ নেই, যদিও কিছু প্রতীকী ‘উপহার’ দেওয়া হয়। দৌড়ে অংশ নেওয়াটা প্রতিযোগীদের জন্য খুব সম্মানের ব্যাপার।
দৌড়ের জন্য তাঁরা যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন আমরা ময়দানে পৌঁছাই। তাঁরা তখন তাঁদের গাড়ি পরীক্ষা করতে, পশুদের দেখভাল করতে ব্যস্ত। কোনও কোনও বলদকে দারুণ অঙ্গশোভায় সজ্জিত করা হয়েছে, অবশ্য এই সাজ অন্য আরেক অনুষ্ঠানের জন্য। দৌড়ে অংশ নেওয়া বলদদের এইসব সাজসজ্জার বালাই নেই, এগুলি সব শক্ত সমর্থ বলদ, এই বেলা নাক ডেকে এক ঘুম দিয়ে নিচ্ছে মাঠের একদিকে। নাগাড়া বজিয়েরা অনুষ্ঠানের সূচনা ঘোষণা করলেন। নাগাড়া বজিয়েরা প্রতিটি দৌড় শুরু হওয়ার পর সারিবদ্ধভাবে ফিরে যান দৌড় শুরু করার নির্দিষ্ট স্থানটিতে। প্রতিযোগীর বলদহীন ফিরতি খালি গাড়িটি তাঁর ছোট ছেলেরা টেনে নিয়ে যায়।
চারদিক গর্জনে ছেয়ে গেল, দৌড়ে অংশগ্রহণকারী বলদ জোতা গাড়ি হুস করে ছুটে পেরিয়ে গেল, বিশ্বাস হয় না যে, সত্যিই ওটা গরুর গাড়ি। এই গাড়ির গতি দেখে আমরা হতচকিত। প্রতিযোগী আরোহী এক হাতে হাল ধরার মতো বলদের লেজ ধরে, আর অন্য হাতে একটি লাঠি ধরে আছেন অন্য কোনও কারণে নয়, বরং নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য – এই অবস্থায় তিনি নিমেষে পেরিয়ে গেলেন পথ। দেখে মোটেই বোঝার উপায় নেই যে কে দৌড় নিয়ন্ত্রণ করছে – আরোহী নাকি পশুটি। দর্শকদের উল্লাসে চারদিক মুখরিত। ধূলোর মেঘে আমাদের ক্যামেরা ঢাকা পড়েছে। মাতালটি আমাদের অযোগ্যতা সম্পর্কে কটু মন্তব্য করছে। ‘নিরাপত্তা রক্ষীদের’ দল দৌড়পথ থেকে দর্শকদের সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে মাঝপথে থেমে গিয়ে আমাদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। আমাদের উদ্দেশ্যে তাঁদের প্রশ্ন, আর আমাদের কী হবে? অতএব, আমরা তাদের ছবিও কিছু তুললাম।
এদিকে, জোর চিৎকারে আমাদের সম্বিত ফিরে আসে, এবং আমরা বুঝতে পারি পরের প্রতিযোগী মাত্র কয়েক মিটার দূরত্বেই রয়েছেন, এবং জোরালো গতিতে আমাদের দিকে ছুটে আসছেন। আতঙ্কিত হয়ে আমরা, নিরাপত্তা রক্ষীরা এবং বাকি সকলেই মাঝপথ থেকে চটজলদি সরে গিয়ে বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলাম, তখনই গাড়িটি প্রবল বেগে আমাদের অতিক্রম করে গেল। আরোহী প্রাণপনে গাড়ি ছোটাচ্ছেন। আবার জনতার ভিড় ঘিরে ধরল। নিরাপত্তার কাজে নিযুক্ত লোকেরা আবার দর্শকদের মাঝপথ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন, নিজেদের ছবি তোলানোর জন্য আরও একবার প্রস্তুত তাঁরা।
পরের দৌড়টি ছিল চমকপ্রদ, গাড়ির আরোহী অসাধারণ। পেশায় কৃষক এই প্রতিযোগীর বয়স ৬০-এর কাছে। দর্শকদের সোৎসাহ উল্লাসে তিনি উত্তেজনায় টগবগ করছেন, আমি তাঁর যতটা কাছে যাওয়া যায় গেলাম, তাঁর মুখমন্ডলের পরিষ্কার ছবি কাছ থেকে তোলার জন্য আমি উৎসুক ছিলাম। ঠিক এই সময়েই মাতালটি এসে কান্ডটি ঘটাল। চারদিকের এত শব্দের মধ্যে আমি খেয়াল করিনি সে কখন এসে ঠিক আমার পেছনে আমার হাঁটুর কাছে ঝুঁকে পড়েছে। এক পা পিছিয়েছি কিনা, আমি হুড়মুড়িয়ে প্রায় মাতালটির গায়ের ওপর গিয়ে পড়লাম। কোনমতে সামনের দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে এ যাত্রা সম্পূর্ণ পতনের হাত থেকে বাঁচলাম বটে, কিন্তু দেখলাম ধাবমান গাড়িটির থেকে আমি মাত্র কয়েক মিলিমাটার দূরত্বেই রয়েছি, ঘাড়ের উপর পশুগুলোর নিঃশ্বাস পর্যন্ত অনুভব করতে পারছিলাম। আর হ্যাঁ, প্রতিযোগীর মুখ খুব কাছ থেকে দেখতে পেলাম, সত্যি কথা বলতে এতটা কাছ থেকে আমি আদৌ দেখতে চাই নি!
জনতা সকল প্রতিযোগীদের উদ্দেশ্যেই নিজেদের সোৎসাহ উল্লাস জানাচ্ছিল। মাতালটি আমার দিকে তাকালো কাতর সারল্য নিয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরে যে অনুভূতির উদয় হল, তার কথা বয়ান করলে ফ্রন্টলাইনের সম্পাদক আর আমার এই প্রতিবেদনখানি ছাপবেন না। দিগন্তরেখার কাছে ধূলোর মধ্যে প্রতিযোগীর অবয়ব গোচর হল। কিছুসময় অতিবাহিত হলে তবে আমি ধাতস্থ হলাম: গরুর গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে এমন বিরল মানুষদের তালিকার একজন হতে হতে আমি একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছি। তাও আবার গরুর গাড়ির দৌড়ে। গাড়ির কাছ থেকে কোনমতে ঝাঁপিয়ে সরে দাঁড়ালেও গাড়ির চাকা আমার ক্যানভাস জুতোর প্রান্ত স্পর্শ করল। শেষ দুটো ছবি যতটা না স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, তার থেকে অনেকবেশি আকস্মিক ছিল!
বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী আবার দৌড়ের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বোঝা গেল যে, যখন দুটি পশুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীটি কোন পথে এগোনো হবে সে বিষয়ে স্বাধীন ধারণা গ্রহণ করতে চায় তখনই এইরকম দুর্ঘটনা ঘটে। বলাই বাহুল্য, চালক নিজে এই বিদ্রোহ প্রশমিত করতে ব্যর্থ হন। এরকমই একটি বিপথগামী বলদ খড় বোঝাই শকটে গিয়ে জোর ধাক্কা মারে, খড়ের গাদার উপর বসেছিলেন এক উৎসাহী দর্শক, তবে এখন তিনি বেশ সতর্ক। আরেকটি বলদ নিজের নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে অন্য রাস্তায় দর্শককুলের দিকে ধেয়ে গেল এবং তাকে নিরস্ত করতে বেশ বেগ পেতে হল।
এদিকে, বিক্রেতা, অস্থায়ী গুমটি, ছোটখাটো জিনিসপত্রের ফেরিওয়ালা এবং মন্ত্রপুত জলপড়া, ওষুধ বিক্রেতাদের ব্যবসা মন্দ হল না। চালকেরা গাড়ি থেকে বলদগুলিকে খুলে দিলেন। মাতালটি টলতে টলতে গোধূলি বেলার দিগন্তে মিলিয়ে গেল। আমরাও এবার জনতার সঙ্গে প্রস্থানে রত হলাম। এবারের মতো মেলা সাঙ্গ হল।
এই প্রতিবেদনটি ২০০৭ সালের ৯ই মার্চ ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় প্রথমবার প্রকাশিত হয়।
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর