সেদিন বালাজি হট্টাগলে আখ কাটছিলেন। আর তার পরের দিন থেকে তিনি বেপাত্তা। তাঁর বাবা-মা হাজার চেষ্টা করেও এর বেশি কিছু জানতে পারেননি। “এই অনিশ্চয়তা আমাদের শেষ করে দিচ্ছে,” বললেন বালাজির বাবা, বাবাসাহেব হট্টাগলে। এক মেঘলা দুপুরে, তাঁদের এক-কামরার ইটের বাড়ির উপর এক খণ্ড মেঘ জমা হয়ে যেন বা বাবাসাহেবের মনে ঘনিয়ে ওঠা বিষাদেরই আভাস দিচ্ছিল। বিষন্ন গলায় তিনি বললেন, “আমরা এটুকুই শুধু জানতে চাই ও বেঁচে আছে কিনা।”

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে বাবাসাহেব ও তাঁর স্ত্রী, সংগীতা শেষবারের মতো তাঁদের ২২ বছরের ছেলেটিকে দেখেছেন। মহারাষ্ট্রের বীড জেলার কড়িওয়াড়গাঁও থেকে কর্ণাটকের বেলাগাভি (বেলগাঁও) জেলার আখ খেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন বালাজি।

মারাঠাওয়াড়া থেকে পশ্চিম মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে যে লক্ষাধিক শ্রমিক ছয় মাসের জন্য আখ কাটতে যান তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। প্রতি বছর দিওয়ালির পর নভেম্বরে তাঁরা যান আর ফিরে আসেন মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে। বালাজি এবছর আর ফিরলেন না।

প্রায় দুই দশক ধরে তাঁর মা-বাবা যা করে চলেছেন, বালাজি এইবারই প্রথম গিয়েছিলেন সেই একই কাজ করতে। বাবাসাহেব জানালেন, “আমি আর আমার স্ত্রী প্রায় ২০ বছর ধরে আখ কাটতে যাচ্ছি। দুজনে মিলে আমরা ৬০,০০০-৭০,০০০ টাকা রোজগার করি প্রতি মরশুমে। আমাদের বাঁধা উপার্জন বলতে এটাই আছে শুধু। বীড জেলায় দিনমজুরির কাজ পাওয়া যাবে এমন কোনও নিশ্চয়তা এমনিতেই থাকে না, তার উপর কোভিড এসে অবস্থা আরও খারাপ করে তুলেছে।”

অতিমারির সময়ে, নির্মাণ ক্ষেত্রে অথবা খেত-খামারে মজুরির ভিত্তিতে কাজ জোটানো পরবারটির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। “২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বরের মধ্যে আমরা তেমন কিছু রোজগার করে উঠতেই পারিনি,” বললেন বাবাসাহেব। কোভিড-১৯ এর আগে, বীড জেলার ওয়াদওয়াণি তালুকে নিজেদের গ্রামে থাকলে বাবাসাহেব, সপ্তাহে ২-৩ দিন কাজ করে দিনে ৩০০ টাকা করে আয় করতেন।

কাজ করতে বাইরে যাওয়ার সময় হলে বাবাসাহেবের মা অসুস্থ থাকায় তাঁর দেখাশুনার জন্য, এ বছর বাবাসাহেব আর সংগীতা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। “কিন্তু পেটের তাগিদে কিছু একটা তো না করলেই নয়, কাজেই এইবার যায় আমার ছেলে,” বললেন বাবাসাহেব।

Babasaheb (left) and Sangita Hattagale are waiting for their son who went missing after he migrated to work on a sugarcane farm in Belagavi
PHOTO • Parth M.N.
Babasaheb (left) and Sangita Hattagale are waiting for their son who went missing after he migrated to work on a sugarcane farm in Belagavi
PHOTO • Parth M.N.

বেলাগাভির আখ খেতে কাজ করতে গিয়ে নিখঁজ হয়ে যাওয়া ছেলের অপেক্ষায় (বাঁ দিকে ) বাবাসাহেব ও সংগীতা হ ট্টা গলে

২০২০ সালের মার্চ মাসে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করায় বাবাসাহেব আর সংগীতার মতো লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ে। অনেকের কাজ চলে যায় আবার অনেকের পক্ষে কাজ জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায়। জুন মাসে লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও দীর্ঘ সময়ে অবধি তাঁদের পক্ষে কাজ জোটানো মোটেই সহজ হয়নি।

হট্টাগলে পরিবারের অবস্থাও ঠিক এমনই বেহাল ছিল। কাজের অভাবে বালাজি বাধ্য হয়ে আখ কাটার মরশুমে বীড ছেড়ে কাটাইয়ের কাজে চলে যান। তার আগে অবধি তিনি গ্রামে বা তার আশপাশের এলাকাতেই কাজ করতেন।

সদ্য বিবাহিত বালাজি নিজের স্ত্রী আর শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে, নিজেদের গ্রাম থেকে ৫৫০ কিলোমিটার দূরে বেলাগাভির বাসাপুর গ্রামে আখ কাটতে গেলেন। “ছেলে রোজ আমাদের ফোন করত যাতে আমরা ওর জন্য চিন্তা না করি,” বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন সংগীতা।

ডিসেম্বর মাসে এক সন্ধ্যায় বালাজিকে ফোন করে সংগীতা দেখলেন যে ছেলের বদলে ফোন ধরলেন তাঁর শ্বশুর। তিনি জানালেন যে বালাজি একটু বাইরে গেছে। “পরে আবার যখন ফোন করি, দেখি ওর ফোন বন্ধ আছে,” সংগীতা জানালেন।

বালাজির ফোন ২-৩ দিন ধরে বন্ধ পাওয়ায় বাবাসাহেব আর সংগীতা চিন্তায় পড়ে যান। তাঁরা ঠিক করেন বেলাগাভি গিয়ে দেখে আসবেন ছেলে কেমন আছে। কিন্তু যাওয়ার মতো যথেষ্ট অর্থ তাঁদের কাছে ছিল না। মেয়ে অলকা, ১৫ ও আরও এক ১৩ বছরের ছেলে তানাজি সহ তাঁদের পাঁচ জনের পরিবারের তখন কোনও মতে দুবেলা খাবার জুটছে মাত্র। মাতাং নামের এক প্রান্তিক দলিত গোষ্ঠীর সদস্য এই পরিবার।

এক মহাজনের কাছ থেকে ৩৬ শতাংশ সুদের হার হওয়া সত্ত্বেও ৩০,০০০ টাকা ধার করেন বাবাসাহেব। ছেলেকে যে তাঁর একবার চোখের দেখা দেখতেই হবে।

Left: A photo of Balaji Hattagale. He was 22 when he left home in November 2020. Right: Babasaheb and Sangita at home in Kadiwadgaon village
PHOTO • Parth M.N.
Left: A photo of Balaji Hattagale. He was 22 when he left home in November 2020. Right: Babasaheb and Sangita at home in Kadiwadgaon village
PHOTO • Parth M.N.

বাঁ দিকে: বালাজি হ ট্টা লে র একটি ছবি। ২০২০ -এর নভেম্বর মাসে ঘর ছাড়ার সমেয়ে তাঁর বয়স ছিল ২২। ডা নদিকে: ড়ি ওয়া গাঁও গ্রামে নিজেদের বাড়িতে বাবাসাহেব ও সংগীতা

গাড়ি ভাড়া করে বাবাসাহেব আর সংগীতা বেলাগাভির পথে রওনা হন। “আমরা সেখানে পৌঁছবার পর ওর শ্বশুর শাশুড়ি আমাদের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করে। বালাজির কথা জানতে চাইলে ওরা কেউ কোনও উত্তর দিল না,” জানালেন বাবাসাহেব। গোলমাল সন্দেহ করে তাঁরা পুলিশে একটি নিখোঁজ ডাইরি করেন। “ওরা এখনও অনুসন্ধান চালাচ্ছে।”

বালাজিকে যদি তিনি পাঠাতে রাজি না হলে আজও তাঁদের সন্তান তাঁদের কাছেই থাকত — এমনই বিশ্বাস বাবাসাহেবের। “কী করব? আমরা যে পরিযায়ী শ্রমিক। লকডাউনের পর গ্রাম আর তার আশপাশে কাজই পাওয়া যাচ্ছিল না।” আখ কাটতে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বলে তিনি জানালেন। “আমি যদি নিশ্চিত জানতাম যে আশেপাশে কাজ পাওয়া যাবে, তাহলে আমি ওকে কিছুতেই যেতে দিতাম না।”

জীবিকার সুযোগ এমনিতেই কম, তার উপর দীর্ঘায়িত কৃষি সংকট আর এখন জলবায়ুর পরিবর্তন — সব মিলিয়ে বীডের অধিবাসীরা গ্রাম ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য হয়েছেন। আখ কাটতে যাওয়া ছাড়াও অনেকে মুম্বই, পুণে, ঔরঙ্গাবাদের মতো শহরে গিয়ে শ্রমিক হিসাবে, অথবা গাড়ির চালক, নিরাপত্তা কর্মী, বা গৃহ শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন।

দেশব্যাপী লকডাউনের পর তাঁদের বাড়ি ফেরার পর্ব চলে টানা দুই মাস ধরে — এমন মহাপ্রস্থান দেশ আগে কখনও দেখেনি। জোটেনি খাবার বা জল, হতক্লান্ত অবস্থায় দীর্ঘ পথ হেঁটে তাঁরা বাড়ি ফেরেন। পথেই অনেকে, খিদে তেষ্টা ক্লান্তি আর আতঙ্কে মারা যান। তাঁদের ফিরতি যাত্রার খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছিল বটে কিন্তু বিগত দেড়খানা বছর তাঁরা কীভাবে কাটালেন সে বিষয়ে তারা বিশেষ কিছু প্রকাশ করেনি।

গতবছর মে মাসে, ৫০ বছর বয়সী সঞ্জীবনী সালভে পুণে থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নিজের গ্রাম বীড জেলার রাজুরি ঘোড়কায় সপররিবারে ফিরেছিলেন। “টানা একমাস কোনওরকমে চালিয়েছিলাম। আমরা কিন্তু আগেই বুঝতে পারি যে সব কিছু স্বাভাবিক হতে বেশ খানিক সময় লাগবে, আর একথা বুঝতে পেরে আমরা তখন একটা টেম্পো ভাড়া করে ফিরে চলে আসি,” বললেন সঞ্জীবনী। পুণে শহরে গৃহ শ্রমিক হিসাবে কাজ করে তিনি মাসে ৫,০০০ টাকা আয় করতেন। তাঁর দুই ছেলে অশোক (৩০) এবং অমর (২৬) ও কন্যা ভাগ্যশ্রী (৩৩) শহরে দিনমজুরি করতেন। তাঁরা সঞ্জীবনীর সঙ্গেই ফিরে আসেন। তারপর থেকেই এই নব বৌদ্ধ (অতীতে দলিত) পরিবারটি কাজ জোটানোর জন্য মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

কিছু সময় আগে ভাগ্যশ্রী পুণে ফিরে গেছেন কিন্তু তাঁর ভাইয়েরা থেকে গেছেন বীডেই। “আমরা আর শহরে ফিরতে চাই না। ভাগ্যশ্রী ফিরে গেছে বাধ্য হয়ে (নিজের ছেলের লেখাপড়ার জন্য)। কিন্তু ও মোটেই কাজ পাচ্ছে না। শহরের অবস্থা আর আগের মতো নেই,” বললেন অশোক।

Sanjeevani Salve and her son, Ashok (right), returned to Beed from Pune after the lockdown in March 2020
PHOTO • Parth M.N.

২০২০ সালের মার্চ মাসে লকডাউনের পর সঞ্জীবনী ও তাঁর পুত্র, অশোক (ডান দিকে ) পুণে থেকে বী ডে ফিরে আসেন

লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর পুণেতে যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে তাঁরা দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন তার স্মৃতি এখনও অশোককে তাড়া করে ফেরে। “কোভিডের তৃতীয় ধাক্কা এলে কী হবে বলুন তো? আমাদের আবার সেই একই পরিস্থির মধ্যে পড়তে হবে?” তাঁর প্রশ্ন। “আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়। খাবার, এমন কি জল অবধি আছে কিনা কেউ এসে জিজ্ঞেস করেনি। আমরা মরে গেলেও কারও কিছু যায় আসত না।”

গ্রামের সমাজ অশোককে একরকম নিরাপত্তাবোধ দেয়। “এখানে ভরসা করার মতো মানুষ আছে। আর আছে খোলা জায়গা। শহরে একটা ছোট্টো ঘরের মধ্যে আটক হয়ে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে।”

অশোক আর অমর দুজনেই ছুতোরের কাজ করে বীডেই থিতু হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অশোকের কথায়, “কাজ খুবই অনিয়মিত। তবে, গ্রামে খরচ কম বলে আমরা প্রাণে বেঁচে আছি। কোনও বিপদ আপদ এসে হাজির হলে অবশ্য আমাদের রক্ষে থাকবে না।”

ইতিমধ্যে অনেকেই যেমন শহরে ফিরে গেছেন তেমনই যাঁরা যাননি কাজের জোগান আর মজুরি দুটোই তলানিতে এসে ঠেকায় উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা এই পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের (এমজিএনআরইজিএস) জন্য কার্ড করানো হঠাৎ বেড়ে যাওয়াই প্রমাণ করে কত মানুষই না কাজের সন্ধানে আছেন।

২০২০-২১ অর্থনৈতিক বর্ষে মহারাষ্ট্রে এমজিএনআরইজিএস এর অধীনে কাজের জন্য ৮.৫৭ লক্ষ পরিবার নাম লিখিয়েছে - গত অর্থনৈতিক বর্ষের ২.৪৯ লক্ষ পরিবারের তুলনায় যা তিন গুণ বেশি।

যাই হোক, লকডাউনের সময়েও এই প্রকল্প তার শর্তানুযায়ী বছরে ১০০ দিন কাজ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মহারাষ্ট্রে কাজের দাবিদার ১৮.৮৪ লাখ পরিবারের মধ্যে ৭ শতাংশ অর্থাৎ, ১.৩৬ লাখ পরিবার, পুরো ১০০ দিন কাজ পেয়েছে। বীড জেলার পরিসংখ্যানও এর চেয়ে আলাদা কিছু নয়।

Sanjeevani at home in Rajuri Ghodka village
PHOTO • Parth M.N.

রাজুরি ঘোড়কা গ্রামে নিজের বাড়িতে সঞ্জীবনী

ইতিমধ্যে অনেকেই যেমন শহরে ফিরে গেছেন তেমনই যাঁরা যাননি কাজের জোগান আর মজুরি দুটোই তলানিতে এসে ঠেকায় উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা এই পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের (এমজিএনআরইজিএস) জন্য কার্ড করানো হঠাৎ বেড়ে যাওয়াই প্রমাণ করে কত মানুষই না কাজের সন্ধানে আছেন

একদিকে নিজেদের গ্রামে কর্ম সংস্থানের অভাব আর অন্যদিকে শহরে গিয়ে আটকে পড়ার ভয় — অতিমারির সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা, যাঁদের বেশিরভাগই প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ, পড়েছেন উভয় সংকটে। বীড তালুকের, মাহসেওয়াড়ি গ্রামে নিজের বাড়ির ফুটো টিনের ছাদের তলায় বসে, ৪০ বছর বয়সী অর্চনা মাণ্ডবে বললেন, “আমরা লকডাউনের একমাস পরে বাড়ি ফিরেছি।” তাঁর পরিবার রাতের বেলায় ২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। “পাঁচজন মিলে মোটরবাইকে করে যাওয়া খুব ঝুঁকির কাজ ছিল। কিন্তু না করে আমাদের উপায় ছিল না। লকডাউনে কোনও আয় না থাকায় আমাদের টাকা-পয়সা ফুরিয়ে আসছিল।”

অক্ষয় (১৮), বিশাল (১৫) আর মহেশ (১২) নিজেদের এই তিন সন্তানকে নিয়ে ঔরঙ্গাবাদে থাকতেন অর্চনা আর তাঁর স্বামী চিন্তামণি। সেখানে চিন্তামণি ট্রাক চালাতেন, আর অর্চনা কাপড়ে রঙিন সুতোয় ফুল তোলার কাজ করতেন। দুজনের মোট মাসিক আয় ছিল ১২,০০০ টাকা। “আমরা পাঁচ বছর ঔরঙ্গাবাদে ছিলাম আর তার আগে ১০ বছর ছিলাম পুণেতে। ও (চিন্তামণি) বরাবরই ট্রাক চালানোর কাজ করেছে।”

মহাসেওয়াড়িতে ফিরে চিন্তামণি পড়লেন বেকায়দায়। “ও আগে কোনওদিনই খেত-খামারে কাজ করেনি। চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। আমিও খুঁজেছি খেতের কাজ। কিন্তু পাইনি,” বললেন অর্চনা।

কোনও রোজগার ছাড়া বাড়িতে বসে চিন্তামণির দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। ছেলেদের ভবিষ্যৎ আর তাদের পড়াশুনার চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। অর্চনা বলছিলেন, “ও নিজেকে হীন মনে করতে শুরু করে। আমাদের টাকাকড়ির হাল খারাপ ক্রমে খারাপ হচ্ছিল, অথচ ও কিছুতেই তা সামাল দিতে পারছিল না। ওর আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগছিল। অবসাদ গ্রাস করেছিল ওকে।”

গতবছর জুলাই মাসের এক বিকেলে বাড়ি ফিরে অর্চনা দেখলেন চিন্তামণি তাঁদের টিনের চাল থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। সেই থেকে এক বছর ধরে অর্চনা একার আয়ে সংসার চালাবার চেষ্টা করে চলেছেন। “খেতমজুরি করে, সপ্তাহে ৮০০ টাকাও আমি আয় করতে পারি না। ঔরঙ্গাবাদে ফিরে যেতেও আমি পারব না,” তিনি বললেন। “আমি আর শহরে একা থাকতে পারব না। ও থাকাকালীন পরিস্থিতি আলাদা ছিল। গ্রামে অন্তত [সাহায্যের জন্য] ভরসা করার মানুষ আছে আমার।”

অর্চনা আর তাঁর ছেলেরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাতে চান। তিনি বলছিলেন, “বাড়িতে ঢুকলেই আমার ওর কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন বাড়ি ফিরে যা দেখেছিলাম তা বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।”

Archana.Mandwe with her children, (from the left) Akshay, Vishal and Mahesh, in Mhasewadi village
PHOTO • Parth M.N.

মহাসেওয়া ড়ি তে অর্চনা মান্ড বে ও তাঁর তিন ছেলে, (বাঁদিক থেকে) অক্ষয়, বিশাল ও মহেশ

কিন্তু নতুন বাড়ি খোঁজার কথা এখনি তিনি ভাবতে পারছেন না। স্থানীয় সরকারি স্কুলে ছেলেরা পড়াশুনা চালিয়ে যেতেও পারবে কিনা, সে নিয়েও তাঁর চিন্তার শেষ নেই। তাঁর কথায়, “আমি জানি না ওদের ইস্কুলের মাইনে কোথা থেকে দেব।”

অর্চনার ভাই ছেলেদের একটা স্মার্ট-ফোন কিনে দিয়েছেন অনলাইন ক্লাস করার জন্য। ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়া, দ্বাদশ শ্রেণিতে পাঠরত অক্ষয় জানালো, “অনলাইনে পড়া বোঝাটা বেশ কঠিন কাজ। আমাদের গ্রামের (মোবাইল) নেটওয়ার্ক খুব খারাপ। আমি আমার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ওর বই নিয়েই পড়াশুনা করি।”

আত্মহত্যায় বাবাকে হারানোর পর, সাহসে বুক বেঁধে অক্ষয় নিজের লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে আর তানাজি হট্টগালে চেষ্টা চালাচ্ছে নিজের ভাই, বালাজির বেমালুম নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে আপোষে আসতে। “দাদার জন্য খুব মন খারাপ করে,” এর বেশি আর কোনও কথা সে বলতে চাইল না।

বালাজিকে খোঁজার যথাসম্ভব চেষ্টা বাবাসাহেব আর সংগীতা করছেন বটে, কিন্তু কাজটা তাঁদের পক্ষে সহজ না। বাবাসাহেব বলছিলেন, “আমরা বীড জেলার কালেক্টরকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছি। আমাদের বার বার বেলগাঁও (বেলাগাভি) যাওয়ার মতো পয়সা নেই।”

একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও পুলিশে অভিযোগ করে তার পিছনে হত্যে দিয়ে লেগে থাকা একটা দুরূহ কাজ। অতিমারির সময়ে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ায় নানা বিধিনিষেধের কারণে এবং টাকাপয়সা বা খুঁটির জোর না থাকায় কাজটি আরও কঠিন হয়ে গেছে।

বালাজির খোঁজে প্রথমবার ডিসেম্বরে যাওয়ার পর বাবাসাহেব আর সংগীতা আরও একবার গিয়েছিলেন। সেবার তাঁরা নিজেদেরর ১০টি ছাগল বিক্রি করে দেন ৬০,০০০ টাকায়। “আমরা মোট ১,৩০০ কিলোমিটার পথ যাতায়াত করেছিলাম,” গাড়ির ওডোমিটার থেকে জেনে বাবাসাহেব বলেছিলেন। সেই টাকার খানিক এখনও রয়ে গেছে বটে, কিন্তু তাতে আর খুব বেশিদিন চলবে না।

নভেম্বর মাসে আবার শুরু হবে আখ কাটার আরেকটা মরশুম। মা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও এবার বাবাসাহেব আর সংগীতা আখ কাটতে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। পরিবারটিকে টিকিয়ে তো রাখতেই হবে। “বাকি সন্তানদের কথাও তো আমাদের ভাবতে হবে,” বললেন বাবাসাহেব।

এই প্রতিবেদনটি পুলিৎজার সেন্টারের সহায়তাপ্রাপ্ত একটি সিরিজের অংশ।

অনুবাদ: চিলকা

Parth M.N.

पार्थ एम एन हे पारीचे २०१७ चे फेलो आहेत. ते अनेक ऑनलाइन वृत्तवाहिन्या व वेबसाइट्ससाठी वार्तांकन करणारे मुक्त पत्रकार आहेत. क्रिकेट आणि प्रवास या दोन्हींची त्यांना आवड आहे.

यांचे इतर लिखाण Parth M.N.
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

यांचे इतर लिखाण Chilka