যতবারই আনারুল ইসলাম নিজের জমিতে চাষের কাজে যান তাঁকে পেরোতে হয় আন্তর্জাতিক সীমানা। আর তাই প্রত্যেকবারই সীমানা পেরোবার আগে তাঁকে কঠোর নিয়ম কানুন ও নিরাপত্তামূলক তল্লাশির সম্মুখীন হতে হয়। পরিচয়পত্র হিসেবে নিজের ভোটার কার্ডটি জমা রাখতে হয়, রেজিস্টারে সই করতে হয়, তবেই নিস্তার মেলে। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় কোনও যন্ত্রপাতি সঙ্গে থাকলে সেটারও আমূল পরীক্ষা হয়। গবাদি পশু সঙ্গে থাকলে সেদিন আবার তার ফটোটিও জমা দিতে হয়।

আনারুল বলছিলেন, "দুটির বেশি [একসঙ্গে] গরু নেওয়ার অনুমতি নেই। ফেরার পথে আবার সই সাবুদ করতে হয়। তারপরে আমার নথিপত্র ফেরত পাই। যার কোনও পরিচয়পত্র নেই তার এখান দিয়ে যাবার উপায় নেই।"

আনারুল ইসলামকে সবাই এখানে বাবুল নামে চেনে, পরিবার নিয়ে থাকেন মেঘালয়ের দক্ষিণ পশ্চিম গারো পাহাড় জেলার বাগিচা গ্রামে। বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম স্থলসীমানা - ৪,১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত - বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তের মধ্যে এই রাজ্যের ৪৪৩ কিলোমিটার বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর গেছে। মেঘালয়ের সীমান্ত অঞ্চল ইটের দেওয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা।  ১৯৮০-এর দশক থেকে এই বেড়া ঘেরার কাজ শুরু হয়, অথচ বহু শতাব্দী ধরেই অভিবাসন এই অঞ্চলের অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে আছে। উপমহাদেশের বিভাজন ও পরে বাংলাদেশের জন্ম এই অভিবাসন নির্ভর জীবনে ছেদ টেনেছিল। দুই দেশের মধ্যে চুক্তির শর্ত রূপে দুই কাঁটাতারের বেড়ার মাঝ বরাবর ১৫০ গজ খালি জমি রাখা হয় বাফার জোন হিসেবে।

৪৭ বছর বয়স্ক আনারুল ইসলাম এই জীবনধারা উত্তরাধিকার সূত্রেই অর্জন করেছেন। যখন তাঁর মাত্র সাত বছর বয়স, স্কুলের পড়া ছেড়ে বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করতে মাঠে নামেন তিনি। তাঁর অন্য তিন ভাইও নিজ নিজ ভাগের জমিতে হয় চাষাবাস করেন, বা জমি লিজ দিয়ে ভাড়ায় খাটান। (আর তাঁর চার বোন গৃহস্থালির কাজকর্ম দেখেন।)

Anarul Islam in front of his house in South West Garo Hills: 'My ancestors lived here, what is now the international border'
PHOTO • Anjuman Ara Begum

মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম গারো পর্বতে , নিজের বাড়ির সামনে আনারুল ইসলাম। ‘এটাই আমার বাপ-ঠাকুরদার ভিটে। এখন এখান দিয়েই গেছে আন্তর্জাতিক সীমানা’

চাষবাস ছাড়াও আনারুলকে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যান্য কাজ কারবার করতে হয়। কখনও মহাজনী, কখনও বা ইমারতি শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। কিন্তু এই একফালি জমির সঙ্গে তার প্রাণের সম্পর্ক। তিনি বলেন, “ছোটোবেলা থেকে বাবার সঙ্গে এই জমিতে আসতাম। আমার কাছে এ জমির কদরই আলাদা। এখন এই জমিত চাষ করতে আমার ভালো লাগে।”

তাঁর সাত বিঘা জমিই (প্রায় আড়াই একর মত) ঠিক সীমান্ত রেখা বরাবর, কাঁটাতারের বেড়ার গা ঘেঁষে। নিরাপত্তা বন্দোবস্তের ফলে এই সীমার মধ্যবর্তী এলাকায় চাষবাস বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক চাষিই বাধ্য হয়ে কৃষিকাজ ত্যাগ করেছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আনারুলের জমিটি বর্ডার গেটের কাছাকাছি বলে তিনি অবশ্য চাষের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, এই জমিতেই তো তাঁর শিকড় গাঁথা আছে। তিনি বলেন, "আজ যেটা আন্তর্জাতিক সীমা, আমার বাপ- দাদারা তো সেখানেই থেকেছে।”

এককালে বেশ প্রভাবশালী ছিল তাঁর পরিবার। তাঁদের জ্ঞাতিকুটুম্বদের নানান শাখা প্রশাখার বসত-ভিটে ছড়িয়ে রয়েছে যে প্রসারিত অঞ্চল জুড়ে তার নাম 'দফাদারের ভিটা’ (জমিদারের বসতি)। ১৯৭০-এর দশক থেকে, যুদ্ধের পরে, সীমান্ত অঞ্চলের ডাকাতদের হাত থেকে নিরাপত্তার অভাব জনিত কারণে বহু গ্রামবাসীই অন্যান্য গ্রামে বা জিকজাক ব্লকের সবথেকে বড়ো পৌর অঞ্চল মহেন্দ্রগঞ্জের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েন - তাঁদের ৬০০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট বাগিচা গ্রামও এই পৌর অঞ্চলেরই অংশ। আনারুল আরও বললেন যে সীমানা তৈরির ফলে তাঁদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ, যা সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তারও আজও অনেকটাই বকেয়া আছে।

সীমান্তের ফটক খোলে সকাল আটটায় আর বন্ধ হয় বিকেল চারটেয়। মাঝের সময়টাও এই প্রবেশপথ বন্ধ থাকে। চাষিদের কাজে যাওবার পথে প্রতিদিন সরকারি খাতায় নিজেদের নথিপত্র দেখিয়ে স্বাক্ষর অথবা টিপসই দিতে হয়। সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষীর (বিএসএফ) খাতায় এই প্রতিটি যাতায়াতের তথ্য নথিবদ্ধ থাকে।

"এঁরা খুব কড়াকড়ি করেন। পরিচয়পত্র ছাড়া এখানে প্রবেশ অসম্ভব। কেউ যদি একদিনের জন্যও পরিচয়পত্রটি ভুলে যায় তবে তার সেই গোটা দিনটাই নষ্ট,” জানালেন আনারুল।

কাজে যাবার সময় তিনি খাবারও সঙ্গে নিয়ে যান, "ভাত বা রুটি, ডাল, সবজি, মাছ, গরুর মাংস...." সব একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে ভরে, একটা থালা দিয়ে ঢেকে ভালো করে গামছা দিয়ে জড়িয়ে সেটা নিয়ে কাজে যান। সীমান্তের কাছে এক মাজারের কূপ থেকে খাবার জল নিতে হয়। জল শেষ হয়ে গেলে তাঁকে বিকেল চারটে অবধি তেষ্টা নিয়েই দরজা খোলার অপেক্ষা করতে হয়! নতুবা, আসা যাওয়ার সব বিধিনিষেধ আবার পালন করে তবেই জলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, যদিও অনেক সময় সীমান্ত রক্ষীরা এই ব্যাপারে সাহায্য করেন। "মাঝখানে আমার জল তেষ্টা পেলে সীমানার যাবতীয় নিয়ম পালন করে পারাপার করতে হয় নয়তো তেষ্টা সহ্য করতে হয় চারটে বাজা পর্যন্ত। আমার মতো চাষির পক্ষে এসব সম্ভব নাকি?” আনারুল বলছিলেন।

Anarul has to cross this border to reach his land in a 'buffer zone' maintained as part of an India-Bangladesh agreement
PHOTO • Anjuman Ara Begum

রোজ এই সীমানা পে রোতে হয় আনারুলকে তাঁর নিজের জমিতে পৌঁছানোর জন্য। দুই দেশের সীমানায় এই জমি এখন ভারত-বাংলাদেশের চুক্তি অনুযায়ী বাফার জোন

সকাল আটটা থেকে বেলা চারটের বাঁধা সময়টাও কম সমস্যার নয়। মহেন্দ্রগঞ্জের চাষিরা সাধারণত খুব ভোরে উঠে সূর্যের তেজ বেড়ে যাওয়ার আগেই মাঠের কাজ সেরে ফেলেন। আনারুল বলেন, "পান্তাভাত অথবা রাতের বাসি খাবার খেয়ে আমরা ভোর ৪টে থেকে মাঠের কাজে নেমে পড়ি আর সূর্য মাথার ওপর গনগনে হয়ে ওঠার আগেই কাজ সেরে ফেলি। কিন্তু এখানে তো ফটক খোলেই ৮টায়, ওই ঠা ঠা রোদে কাজ করার ফলে আমার শরীর স্বাস্থ্যের উপর ধকল পড়ে।”

সারাবছর ধরে নিরাপত্তা ঘিরে যাবতীয় নিয়ম মেনে চলেন তিনি। ফটক পেরনোর অনুমোদন দেওয়ার আগে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর সেনারা সব জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখেন। মোবাইল ফোনও সঙ্গে নেওয়া নিষেধ। তাঁকে নিজের ফোন জমা রাখতে হয়। ফেরার পথে তা আবার হাতে পাওয়া যায়। চাষের সরঞ্জাম সহ আর যা কিছু তাঁর সঙ্গে থাকে সবকিছুর তল্লাশি হয়। এমনিতে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার নিয়ে যাওয়া যায়। আনারুল মাঝে মধ্যে এগুলো ভাড়া করেন। তবে কোনও বড়ো অফিসারের সীমা পরিদর্শনে আসার কথা থাকলে এসব যন্ত্রপাতি সেদিন নেওয়া নিষিদ্ধ থাকে। একেক সময় গরুগুলির ছাড়পত্রও আটক করা হয়। তখন তাদের সারাদিন রেখে কাজে যাওয়া এক বিষম ঝকমারি হয়ে দাঁড়ায়, জানান আনারুল। তিনি তাঁর তিনটি গরু গতবছর বিক্রি করে দিয়েছেন, আর বাছুর সমেত একটি গরু ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। এখন নিজের দরকার পড়লে ওপারে চাষের জমিতে যাবার আগে তিনি গরু ভাড়া নিয়ে নেন।

সীমান্ত ফটকে শস্যের বীজও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পাট ও আখের বীজ নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ – যে সব ফসল তিনফুটের বেশি লম্বা হতে পারে, সেগুলি নিষিদ্ধ কারণ তাতে দৃশ্যমানতায় অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে।

অগত্যা, আনারুল শীতকালে ডাল চাষ করেন, বর্ষায় ধান আর বছরভর পেঁপে, মুলো, বেগুন, লংকা, লাউ, সজনে ও নানান সবুজ শাক সবজি জাতীয় নানান ফল ও তরকারি ফলান। বর্ষায় ধান চাষের মরশুমে আনারুল জমির অংশবিশেষ ভাগচাষের জন্যে ভাড়া দেন, বছরের অন্যান্য সময়ে তিনি নিজের জমি নিজেই চাষ করেন।

এই ফসল নিয়ে ঘরে ফেরা আরেক ঝক্কির ব্যাপার - ধান কাটা হলে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় ২৫ কুইন্টাল, আলু আরও ২৫ - ৩০ কুইন্টাল ওপারে নিয়ে যেতে হয়। আনারুল জানান, "এই ফসল আমি নিজের মাথায়  করেই নিয়ে যাই - এতে আমার ২ থেকে ৫ খেপে যাতায়াত করতে হয়।” তিনি প্রথমে সব ফসল ফটকের কাছে নিয়ে আসেন। তারপরে সেসব টেনে টেনে ফটকের এপারে আনতে হয়। তারপরে আবার পথের ধারে টেনে নিয়ে যাওয়ার পালা, সেখান থেকে স্থানীয় যানবহনের সাহায্যে নিজের বাড়িতে অথবা মহেন্দ্রগঞ্জের বাজারে নিয়ে যান।

In his backyard, tending to beetle nut seedlings. Seeds are checked too at the border gate, and seeds of jute and sugarcane are not allowed – anything that grows more than three-feet high is not allowed to grow so that visibility is not obstructed
PHOTO • Anjuman Ara Begum

তাঁর ভিটের পেছনের জমিতে আনারুল এলাচ গাছের যত্ন নিচ্ছেন। সীমান্ত ফটকে শস্যের বীজও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পাট ও আখের বীজ নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ – যে সব ফসল তিনফুটের বেশি লম্বা হতে পারে, সেগুলি নিষিদ্ধ কারণ তাতে দৃশ্যমানতায় অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে

মাঝেমধ্যে সীমান্ত বরাবর নানা কারণে সংঘর্ষ দেখা দেয় - অনেক সময় গবাদি পশু সীমানা পেরিয়ে এদিকওদিক চরতে থাকে, কখনও বা খড়ের গাদা চুরি হয়ে যায়, সীমানার এক্তিয়ার নিয়েও মাঝে মাঝে ঝামেলা হয়। আনারুল বলছিলেন, "বছর দশেক আগে আমার সঙ্গে কিছু বাংলাদেশী নাগরিকের সংঘাত হয়, আমি আমার জমির একটা ঢিবি ভেঙে সমান করার চেষ্টা করছিলাম তখন। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা এসে মাটি খুঁড়তে নিষেধ করে। তারা বলে এ বাংলাদেশের জমি। আমি আমাদের বিএসএফের আধিকারিকদের ডাকি।" স্থানীয় লোকদের মতে একাধিক  দফায় ফ্ল্যাগ মিটিং ও দুই পক্ষের সীমান্ত রক্ষীদের বাকবিতণ্ডার পরে একটি বাঁশ ফেলে সীমা নির্ধারিত হয়। সেই বাঁশ অচিরেই গায়েব হয়ে যায়। আনারুল বলেন এই ঘটনায় তাঁর দুই বিঘা জমির অধিকার হাতছাড়া হয়ে যায় যা তিনি আজও ফিরে পাননি। অর্থাৎ, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাত বিঘা জমির মাত্র পাঁচ বিঘা জমিতেই তিনি চাষ করতে পারেন এখন।

মাত্র কয়েক হাতের দূরত্বে, সীমারেখায় বিভাজিত দুই দিকে ভারতীয় এবং বাংলাদেশী কৃষকেরা পাশাপাশি কাজ করলেও আনারুল বলেন যে, "আমি ওদের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলি না কারণ নিরাপত্তা রক্ষীরা তা মোটেই পছন্দ করে না। সন্দেহজনক কিছু ঘটলে শেষে আমার জমির অধিকার নিয়ে টানাটানি পড়বে। আমার তরফ থেকে আদানপ্রদান এক্কেবারে সীমিত। ওদিক থেকে কেউ কোনও প্রশ্ন করলেও আমি শুনতে না পাওয়ার ভান করে নীরব থাকি।”

অনুযোগের সুরে আনারুল বলছিলেন, "চোরেরা আমার সবজি চুরি করে নেয়, তবে আমার নালিশ নেই সে নিয়ে। ওদের কোনও ইমান নেই, তবে আমার ওপর তো আল্লাহর কৃপা আছে।" এই সীমান্ত এলাকা গবাদি পশু চোরাচালানের জন্যে কুখ্যাত। মহেন্দ্রগঞ্জের বাসিন্দারা বলছিলেন মাদক চোরাচালানের কারবারও নাকি খুব বেড়েছে। আনারুল ২০১৮ সালে এক ২৮ বছরের যুবককে ৭০, ০০০ টাকা ধার দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন যে তার থেকে আরও ২০,০০০ টাকা সুদ বাবদ লাভ থাকবে। কিন্তু সেই যুবক অচিরেই মাদকাসক্তির কারণে মারা যায়। এই অঞ্চলের মানুষজন বলেন এই মাদক বড়ি (ট্যাবলেট) ওপার থেকে চালান আসে। আনারুল বলছিলেন, "মাদক পাচার করা তো সহজ, বেড়াজালের ওপার থেকে ছুঁড়ে এপারে ফেলে দিলেই হল, যে ভালো ছুঁড়তে পারবে সেই মাদক পাচারে সিদ্ধহস্ত হয়ে যাবে।” ধার দেওয়া টাকাটার জন্যে চিন্তায় আছেন আনারুল। মৃতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা অবশেষে ৫০,০০০ টাকা ফেরত দিতে রাজি হয়েছে।

তাঁর সুদের কারবার সম্পর্কে তিনি আরও বললেন, “আমার পক্ষে এতো বড়ো সংসার টানা সম্ভব নয়। তাই যখনই কিছু টাকা হাতে আসে আমি তা লোককে সুদে ধার দিই। আমার টাকার দরকার। তাই এই ব্যবস্থা।”

The road and gate at the border on the India side. At times, fights break out when cattle stray across, or straw is stolen or demarcation lines are disputed
PHOTO • Anjuman Ara Begum
The road and gate at the border on the India side. At times, fights break out when cattle stray across, or straw is stolen or demarcation lines are disputed
PHOTO • Anjuman Ara Begum

ভারতের দিকে র সীমানার রাস্তা ও ফটক। মাঝেমধ্যে সীমানা ঘিরে ঝামেলা, গবাদি পশু সীমা পেরিয়ে চরতে শুরু করলে অথবা খড়ের গাদা চুরি হলে সংঘর্ষ বেধে যায়

সীমারেখা বরাবর বেড়ার জন্য চাষের কাজে প্রয়োজনীয় সেচ ও নিকাশি ব্যবস্থায় অন্তরায় সৃষ্টি হয়। বর্ষার জলে পুষ্ট আনারুলের চাষের জমিতে জুলাই - অগস্ট মাসের ভারি বৃষ্টিতে প্রচুর জল জমে যায় যা নিষ্কাশনের কোনও উপায় নেই। জমিতে পাম্প রাখা আইনত কঠিন, তার ওপরে চুরির ভয়। অত ওজনদার মেশিন প্রতিদিন আনা-নেওয়া করাও অসম্ভব। জমি সমান করার জন্যে জেসিবির মতো বড়ো মেশিন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তাই তিনি জল নামার জন্যে দুতিন দিন অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই, আর বেশি বর্ষণের সময় সেই অপেক্ষা দুসপ্তাহ অবধিও গড়াতে পারে। এতে তাঁর ফসলের যে ক্ষতি হয় তার বোঝাও নিজেকেই বইতে হয়।

খেতমজুর নিয়োগ করাও এক কষ্টসাধ্য কাজ, আনারুল কেবলমাত্র তাঁদেরই নিয়োগ করতে পারেন যাঁদের সঠিক পরিচয়পত্র আছে। সকলের জন্য খাবার জলের ব্যবস্থা করাও মুশকিল, তাছাড়া সেরকম কোনও বড়ো গাছের ছায়াও নেই যেখানে জিরিয়ে নেওয়া যায়। "এত নিয়ম কানুন মেনে চলা মজুরদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে," তিনি বলেন। তাঁর জমি কোথায় জানলেই মজুরদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দেয়। সেই কারণে আনারুল একাই কাজ করতে বাধ্য হন। মাঝে মধ্যে নিজের স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্যকে সঙ্গে নেন।

কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সীমান্তের চাষ জমিতে কাজ মানে শৌচালয়ের সমস্যা জাতীয় বাড়তি নানান সমস্যা। এই বাফার জোন বা দুদেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী এলাকায় শিশু নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু যেসকল মহিলা কামিনদের তিনি নিয়োগ করেন প্রায়শই তাঁরা শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাজে উপস্থিত হন।

নির্মাণক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ তাঁর তৃতীয় জীবিকা, আনারুল বলেন এই কাজ থেকে তাঁর আয় বেশ নিয়মিত। পনেরো কুড়ি কিলোমিটার চৌহদ্দির মধ্যে নানান সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত বাড়িঘর তৈরির কাজ প্রায়শই মিলে যায়। মাঝেমধ্যে তিনি ৮০ কিলোমিটার দূরে তুরা শহরে যান। (তবে গতবছর থেকে কোভিড- ১৯ অতিমারির প্রকোপ ও লকডাউনের ফলে তা বন্ধ আছে।)। আনারুল জানান বছর তিনেক আগে তিনি প্রায় তিন লাখ টাকা রোজগার করতে পেরেছিলেন এবং তা দিয়ে একটা পুরনো মোটর বাইক ও মেয়ের বিয়ের গয়নার বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হন। সাধারণত দৈনিক ৭০০ টাকা হারে কাজ করে বছরে ১ লাখ টাকার রোজগার হয় ইমারতি ক্ষেত্রের কাজ থেকে। তাঁর কথায়, "এখন থেকে আমি হাতে হাতে নগদ টাকা আয় করতে পারি, অথচ ধান চাষ থেকে টাকা পেতে অন্তত তিনমাস সময় লেগে যায়।”

Left: Anarul and others in his village discussing ever-present border issues. Right: With his family celebrating the birth of his granddaughter
PHOTO • Anjuman Ara Begum
Left: Anarul and others in his village discussing ever-present border issues. Right: With his family celebrating the birth of his granddaughter
PHOTO • Anjuman Ara Begum

বাঁদিকে : আনারুল অন্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে সীমান্তের চিরন্তন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন। ডানদিকে: সপরিবারের আনারুল - নাতনির জন্মদিনের উৎসব

আনারুল শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাঁর বড়ো দাদা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পনেরো বছর বয়সী মেয়ে শোভা বেগম অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, ১১ বছরের ছেলে সাদ্দাম ইসলাম চতুর্থ শ্রেণিতে, আর ছয় বছরের সীমা বেগম পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। তাঁর অন্য তিন বড়ো মেয়ে, যাঁদের বয়স ২১ থেকে ২৫ এর মধ্যে, সবাই বিবাহিত। আনারুলের দুই স্ত্রী, জিপসিলা টি সাংমা আর জাকিদা বেগম, উভয়েরই বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।

আনারুলের সাধ ছিল তাঁর বড়ো মেয়েরাও গ্র্যাজুয়েশন অবধি পড়ুক। কিন্তু "সিনেমা, টিভি, মোবাইল ফোনের প্রভাবে তারা সব প্রেমে পড়ে আর তারপর বিয়ে করে নেয়। আমার সন্তানদের মধ্যে কোনও উচ্চাশা নেই, আর সেটাই আমার দুঃখ। তারা না পরিশ্রমী, না মন দিয়ে পড়াশুনা করে। তবে আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী এবং আশা রাখি যে তাদের জীবনে ভাগ্য সহায় হবে।"

২০২০ সালে আনারুল কাজু বাদামের চাষে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু বিএসএফ রক্ষীরা জানান যে কোভিড-১৯ অতিমারির জন্য সীমান্তের ফটক বন্ধ থাকবে এবং চাষিরা কৃষিকাজ করতে জমিতে যেতে পারবেন না। ফলে, চাষে আনারুলের কিছুটা লোকসান হয়। তবে সুপুরি চাষ করে তিনি কিছুটা লাভ রাখতে পেরেছিলেন।

গতবছর এপ্রিলের ২৯ তারিখ পর্যন্ত এই ফটক সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল, তারপরে চাষিদের জমিতে যাওয়ার অনুমোদন মেলে ৩-৪ ঘণ্টার জন্য, যতক্ষণ না ধীরে ধীরে তা পূর্বের সময়-সীমায় ফেরার অনুমতি পায়।

এত বছরে আনারুলের সঙ্গে বিএসএফ-এর কিছু জওয়ানের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। "একেক সময় আমার ওদের জন্য খারাপই লাগে, বলেন আনারুল। ওরা সব কত দূর থেকে এসে নিজের পরিবার ছেড়ে থাকে, আমাদের নিরাপত্তার জন্য।" মাঝে মধ্যে তিনি তাঁদের বাড়িতে ডেকে ঈদের উৎসবে দাওয়াত দিয়েছেন। কখনও বা পালা পার্বণে তাঁদের জন্য মাংস-ভাত নিয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে এই কর্মীরাও তাঁকে ডেকে চা খাওয়ান সীমান্ত পারাপারের পথে।

সাংবাদিকের পরিবার মহেন্দ্রগঞ্জের অধিবাসী।

অনুবাদ : নন্দিনী

Anjuman Ara Begum

ଅଞ୍ଜୁମନ ଆରା ବେଗମ ଆସାମର ଗୌହାଟୀରେ ଅବସ୍ଥାପିତ ଜଣେ ମାନବାଧିକାର ଗବେଷକ ଓ ମୁକ୍ତବୃତ୍ତିର ସାମ୍ବାଦିକ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Anjuman Ara Begum
Translator : Nandini