আজ ২৬শে ফেব্রুয়ারি, কে শ্যাইলার আঠেরো বছরের জন্মদিন। তার গায়ে আজ নতুন জামা, চুলে জুঁইফুল। মা আজ তার প্রিয় খাবার চিকেন বিরিয়ানি রান্না করেছেন, আর সে নিজে কলেজের বন্ধুদের আজ ছোট্টো করে খাইয়েছে।

শ্যাইলা চেন্নাইয়ের শ্রী স্বাস্থ্য কলেজ অফ নার্সিং নামের এক বিখ্যাত বেসরকারি নার্সিং কলেজে পড়াশোনা করে। এই ইংরেজি-মাধ্যম কলেজে ভর্তি হতে পারাটাই ছিল বেশ কঠিন এক সংগ্রাম। আর তার চেয়েও কঠিন ছিল সকলের স্বীকৃতি।

যেদিন অন্যান্য পড়ুয়ারা জানতে পারল যে তার বাবা আই কান্নান সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন, তাই অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটিই ছিল তার জাতি পরিচয় ঘিরে।

শ্যাইলার কথায়, “হঠাৎ যেন, নিজেদের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাচীর অনুভব করলাম।”

২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭, যেদিন কান্নান এবং আরও দুই সাফাইকর্মী প্রাণ হারালেন, সেইদিন থেকেই শ্যাইলা আর তার মা সেই অদৃশ্য প্রাচীরটি ভাঙার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। কান্নান ছিলেন আদি দ্রাবিড় মাদিগা সম্প্রদায়ভুক্ত রাজমিস্ত্রি এবং কুলি। প্রধানত স্বহস্তে বর্জ্যবহনের কাজে সাফাইকর্মী হিসাবেই এই তফসিলি জাতির মানুষেরা নিযুক্ত হন। সেপটিক ট্যাংক এবং পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কারের প্রয়োজন হলেই তাঁর ডাক পড়ত।

‘My mother is a fearless woman’
PHOTO • Bhasha Singh

নাগাম্মার বড়ো মেয়ে শ্যাইলা এখন ১৮ বছরে পা দিল; তার কথায় , ‘এটা একটা লম্বা লড়াই’

শ্যাইলার কথায়, “এ এক দীর্ঘ সংগ্রাম। ইংরেজি ভাষাটা আয়ত্ত করার জন্য আমি কঠোর পরিশ্রম করছি। আমার বাবার ইচ্ছে ছিল আমি বড়ো হয়ে ডাক্তার হই, কিন্তু তাঁকে ছাড়া এই স্বপ্ন পূর্ণ করা দুরূহ কাজ। তাই ডাক্তারির পরিবর্তে আমি নার্সিং কলেজে যোগ দিই। আমাদের এলাকা থেকে কেউ এই কোর্স নেয়নি। শেষ পর্যন্ত যদি আমি একজন নার্স হয়ে উঠতে পারি, তাহলে তা হবে আমার বাবার স্মৃতির প্রতি যথার্থ সম্মান। আমি জাত, বর্ণে বিশ্বাস করি না এবং মনে করি জাতি,বর্ণ ও ধর্মের ভিত্তিতে কোনও বৈষম্য থাকা উচিত নয়। একটা কথা আমি সারা দুনিয়াকে বলতে চাই - বাবা যেভাবে প্রাণ হারিয়েছিল সেই অবস্থায় যেন আর কেউ না মারা যায়।

শ্যাইলা বলে চলে, “ধীরে ধীরে, ভেদাভেদের বেড়া পেরিয়ে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হতে শুরু করল। এখন সেই বন্ধুদের কেউ কেউ আমার পড়াশোনায় আমাকে সাহায্য করে। আমি তামিল মাধ্যমে পড়েছি, তাই ইংরেজি বেশ দুর্বল। সবাই আমাকে ইংরেজির জন্য আলাদা করে কোচিং নিতে পরামর্শ দিলেও আমাদের সেই সামর্থ্য ছিল না, তাই নিজেই শেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই ফেল করা চলবে না।”

দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ভালো ফলাফল নিয়ে শ্যাইলার খুব গর্ব, এই ফলাফল তার এলাকায় নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছিল। প্রচার মাধ্যমে তার সাফল্যের গল্প উঠে আসে, এর ফলে নার্সিং প্রশিক্ষণের জন্য আর্থিক সহায়তাও পাওয়া যায়।

ভিডিও দেখুন: কে শ্যাইলা: ‘যে কাজ আমার বাবা করতেন, সেই কাজ যেন আর কাউকেই না করতে হয়’

সব বাঁধ ভেঙে গেছে যেন, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে জমে থাকা কত কথা। তার মা, বছর ৪০-এর কে নাগাম্মা ভীষণ অবাক, কারণ শ্যাইলা লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। এই প্রথম তিনি তাঁর মেয়েকে এত খোলাখুলিভাবে কথা বলতে দেখলেন।

নাগাম্মার মেয়েদের এই সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন যাতে বাস্তব হয়ে ওঠে তার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁর ছোটো মেয়ে কে আনন্দীর বয়স এখন ১৬, সে দশম শ্রেণির ছাত্রী।

স্বামীর মৃত্যুর খবরে সেদিন নাগাম্মা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা মা তাঁর দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেইসময়। শ্যাইলা তখন আট বছরের আর আনন্দীর বয়স মাত্র ছয় এবং তখনও সে স্কুলে ভর্তি হয়নি।

‘My mother is a fearless woman’
PHOTO • Bhasha Singh

ইন্দিরা নগরে বাড়ির কাছেই নিজের ছোটো দোকানে নাগাম্মা: ‘আমার সব দুঃখ-কষ্টকে আমি আমার শক্তিতে পরিণত করেছি’

“মনে করতে পারি না ঠিক কেমন করে আমি আমার স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রকাশম জেলায় আমাদের গ্রাম পামুরু গিয়েছিলাম। মনে নেই শেষকৃত্য কীভাবে হল। আমার শ্বশুরমশাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে আমাকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ দেওয়া হল [ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি], পাশাপাশি চলল অন্য চিকিত্সা। এতসবের পরে অবশেষে যেন আমি হুঁশ ফিরে পেলাম। আমার স্বামী যে সত্যিই মারা গিয়েছেন এটা মেনে নিতে আমার দুই বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।”

দশ বছর হয়েছে স্বামীর মৃত্যুর, কিন্তু সেকথা মনে করতে করতে আজও নাগাম্মা দুঃখে ভেঙে পড়েন। “আমার আত্মীয়স্বজন আমাকে বলেছিল মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে আমাকে বাঁচতে হবে, এরপরেই শুরু হয় আমার সংগ্রাম। কাছাকাছি একটা কারখানায় আমি হাউসকিপিংয়ের চাকরি নিলাম, যদিও কাজটাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাম। আমার বাবা-মাও ছিলেন সাফাই কর্মচারী [সংরক্ষণ-কর্মী] - বাবা সেপটিক ট্যাংক, ম্যানহোল পরিষ্কার করতেন, আবর্জনা তুলতেন আর মা ঝাড়ুদারের কাজ করতেন।”

তামিলনাড়ুর, বেশিরভাগ সাফাই কর্মচারীই অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছেন; তাঁদের ভাষা তেলুগু। তামিলনাড়ুর অনেক স্থানেই সাফাই কর্মচারীদের জন্য বিশেষ তেলুগু-মাধ্যম স্কুল রয়েছে।

নাগাম্মা ও তাঁর স্বামীর আদি নিবাস ছিল পামুরু গ্রামে। নাগাম্মা জানাচ্ছেন, “১৯৯৫ সালে ১৮ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। বাবা-মা আমার জন্মের আগেই চেন্নাইয়ে চলে আসেন। আমার বিয়ের জন্য আবার আমরা গ্রামে ফিরে যাই এবং পুনরায় চেন্নাই ফিরে আসার আগে বছর কয়েক ওখানেই ছিলাম। আমার স্বামী নির্মাণ প্রকল্পে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে শুরু করেন। যখনই সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার ডাক আসত, তাঁকে যেতে হত। যখন আমি জানতে পারলাম যে তিনি পয়ঃপ্রণালী, নালা-নর্দমায় নেমে কাজ করছেন, আমি ভীষণভাবে এই কাজের বিরোধিতা করেছিলাম। তারপর থেকে এই কাজে গেলে তিনি আর আমাকে জানাতেন না। ২০০৭ সালে তিনি এবং আরও দুজন সাফাই কর্মচারী সেপটিক ট্যাংকের ভিতরেই মারা গেলেন, অথচ কেউ গ্রেফতার হল না; তাদের হত্যার দায়ে কেউ অপরাধী সাব্যস্ত হল না। দেখতেই পাচ্ছেন, এই দেশে আমাদের সঙ্গে কেমন বীভৎস আচরণ করা হয়; আমাদের জীবনের কোনও মূল্যই নেই। কেউই এগিয়ে আসেনি – না কোনও সরকার না কোনও কর্মকর্তা। অবশেষে, সাফাই কর্মচারী আন্দোলন (এসকেএ) আমাকে শেখালো কেমন করে নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে। সবে ২০১৩ সালে আমি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই।”

নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নাগাম্মা এবার হয়ে উঠলেন সোচ্চার এবং প্রত্যয়ী। পয়ঃপ্রণালী এবং সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে যেসকল মহিলারা তাঁদের স্বামী অথবা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে নাগাম্মার দেখা হল। “এইটা যখন বুঝলাম যে আমিই একমাত্র আমার জীবনসঙ্গীকে হারাইনি, শত শত মহিলা এই একই দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তখন এই দুঃখই আমার শক্তিতে পরিণত হল।”

ভিডিও দেখুন: কে নাগাম্মা: ‘তিনি আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আর কখনও এই কাজে যাবেন না’

সেই শক্তির ভরসাতেই নাগাম্মা হাউসকিপিংয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর ২০,০০০ টাকা ঋণ এবং তাঁর বাবা আর সর্বভারতীয় সংগঠন এসকেএ-এর সহায়তায় ইন্দিরা নগরে তাঁর বাড়ির সামনেই নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের একটি দোকান খোলেন।

একবিংশ শতকের ভারতবর্ষের এই জাতিবৈষম্যের বাস্তবতার মধ্যে, স্বামীর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ আদায়ের যুদ্ধই নাগাম্মাকে জেদি করে তোলে। অবশেষে, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে পৌর নিগম, নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে মৃত ব্যক্তির পরিবারবর্গকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের ২০১৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী নাগাম্মাকে তাঁর প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। এই টাকা দিয়ে তিনি ঋণ পরিশোধ করলেন, তাঁর দোকানে আরও কিছু পুঁজি বিনিয়োগ করলেন এবং অবশিষ্ট টাকাটা মেয়েদের নামে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করলেন।

‘My mother is a fearless woman’
PHOTO • Bhasha Singh

ছোটো মেয়ে, ১৬ বছরের আনন্দী তার মায়ের কষ্টোর্জিত আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়তায় গর্ববোধ করে

“আমার মা খুব সাহসী মহিলা,” গর্বিত আনন্দী বলে। “মা নিরক্ষর হলেও যে কোনও কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা ধরে, তা সে যত বড়োই হোক না কেন! মা নিজের আবেদন নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে বেরিয়েছে। মা আসছে দেখলেই অফিসাররা সাবধান হয়ে যেত, কারণ তারা জানে মা ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করবে আর নিজের অধিকার আদায়ের জন্য অবিরাম তর্ক করেই যাবে।”

নাগাম্মা বলছেন, “২০০৭ সালে আমার স্বামী মারা গেল, তারপর দীর্ঘ সংগ্রাম এবং একটি সংগঠনের সহায়তায় আমি শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের শেষে ক্ষতিপূরণ পেলাম। ২০১৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, সেই বছরেই আমার ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করার কোনও ব্যবস্থাই নেই। কারও কোনও মাথাব্যাথাই নেই। এই ব্যবস্থার দৌলতেই তো আমি একজন বর্জ্য সাফাইকারীতে পরিণত হয়েছি। কিন্তু কেন? আমি এটা কিছুতেই মেনে নেব না; নিজের এবং আমার মেয়েদের জন্য জাতপাতমুক্ত এক জীবন গড়ে তুলব বলে লড়াই করে চলেছি। আপনি কার পক্ষ নেবেন?”

বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর

Bhasha Singh

ଲେଖକ ପରିଚୟ: ଭାଷା ସିଂହ ଜଣେ ସ୍ୱାଧୀନ ସାମ୍ବାଦିକ , ଲେଖକ ଏବଂ ୨୦୦୭ ପରି ବ୍ୟକ୍ତିତ୍ୱ। ହାତରେ ମଇଳା ସଫାକୁ ନେଇ ହିନ୍ଦିରେ ଲିଖିତ ତାଙ୍କର ପୁସ୍ତକ ‘ଅଦୃଶ୍ୟ ଭାରତ’ ୨୦୧୨ ମସିହାରେ ପ୍ରକାଶିତ ହୋଇଥିଲା। ୨୦୧୪ରେ ପେଙ୍ଗୁଇନ୍ ଦ୍ୱାରା ଏହାର ଇଂରାଜୀ ଅନୁବାଦ ‘ଅନସିନ୍’ ପ୍ରକାଶ ପାଇଥିଲା। ତାଙ୍କ ସାମ୍ବାଦିକତା ଉତ୍ତର ଭାରତରେ କୃଷକମାନଙ୍କ ଦୂରବସ୍ଥା ଏ ନ୍ୟୁକ୍ଲିୟର୍ ପ୍ଲାଣ୍ଟର ରାଜନୈତିକ ଓ ଭୂ-ବାସ୍ତବିକତା ଏବଂ ଦଳିତ, ଲିଙ୍ଗଗତ ଓ ସଂଖ୍ୟାଲଘୁ ଅଧିକାର ଉପରେ ପର୍ଯ୍ୟବେସିତ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Bhasha Singh
Translator : Smita Khator

ସ୍ମିତା ଖାତୋର୍ ପିପୁଲ୍ସ ଆର୍କାଇଭ୍ ଅଫ୍ ରୁରାଲ ଇଣ୍ଡିଆ (ପରୀ)ର ଅନୁବାଦ ସମ୍ପାଦିକା। ସେ ନିଜେ ଜଣେ ବଙ୍ଗଳା ଅନୁବାଦିକା ଏବଂ କିଛି ବର୍ଷ ହେଲା ଭାଷା ଏବଂ ସଂଗ୍ରହାଳୟ କ୍ଷେତ୍ରରେ କାମ କରିଆସୁଛନ୍ତି। ମୁର୍ଶିଦାବାଦର ସ୍ମିତା ବର୍ତ୍ତମାନ କୋଲକାତାରେ ରହୁଛନ୍ତି ଏବଂ ମହିଳା ତଥା ଶ୍ରମିକମାନଙ୍କ ସମସ୍ୟା ଉପରେ ଲେଖାଲେଖି କରୁଛନ୍ତି।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ ସ୍ମିତା ଖଟୋର୍