যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের প্রধান সেনাপতিকে খুঁজে পেলেন নিকটবর্তী গ্রামের মহিলারা। এসেছিলেন পরিবারের পুরুষদের খুঁজতে, আর তার বদলে তাঁরা খুঁজে পেলেন নিজেদের নেতাকে – উমাইদুরাই। আহত, ক্ষতবিক্ষত, রক্ত ঝরছে কিন্তু তখনও বেঁচে। সাবধানে তাঁকে তুলে নিয়ে তিন মাইল দূরে নিজেদের গ্রামে নিয়ে গেলেন তাঁরা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল সৈন্যদল। তারা খুঁজছে ‘ওয়ান্টেড’ উমাইদুরাইকে। মহিলারা তাড়াতাড়ি একটা সাদা কাপড়ে তাঁকে ঢাকা দিলেন। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। সৈন্যদের বললেন, তিনি গুটি বসন্ত রোগে মারা গেছে। প্রাণের ভয়ে পগাড় পার হল সৈন্যদল। আর প্রাণে বাঁচলেন উমাইদুরাই-সহ অনেক মানুষ।

দুর্দান্ত কাহিনি, আর সত্যিও বটে। ২০০ বছরেরও আগে তামিলনাডুতে ঘটেছিল এই ঘটনা। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই যুদ্ধ নিয়ে ব্রিটিশদের লেখায় এই ঘটনার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এখন সেই কাহিনি শোনাচ্ছেন প্রখ্যাত লেখক চো ধর্মন। তামিল ভাষায় তাঁর সুললিত লেখনী দিয়ে কাহিনিটিকে আরও সমৃদ্ধ করছেন। আজকের কোভিড-১৯ অতিমারির সঙ্গে যুক্ত ধ্যান-ধারণা, ত্রাস, এবং আতঙ্কের প্রেক্ষিতে একে রেখে কাহিনিটিকে আরও জোরালো করে তুলেছেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন এক অমূল্য কথিত ইতিহাস – কেমনভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে গ্রামগুলি রোগজীবাণু, প্লেগ এবং মড়কের সঙ্গে যুঝেছে।

ধর্মনের কাছে জানা গেল “উমাইদুরাই ছিলেন প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরাপান্ডিয়া কাট্টাবোম্মানের ভাই। এই কাট্টাবোম্মান ছিলেন পঞ্চলমকুরিচির [দক্ষিণ তামিলনাডু অঞ্চলে] পোলিগার [প্রধান]। মূক এবং বধির উমাইদুরাইকে ‘উমি’ [স্থানীয় ভাষায়] এবং ‘ডাম্বি’ [ব্রিটিশদের দেওয়া নাম] বলে ডাকা হত। সবাই ভালোবাসত তাঁকে, আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাঁকে যাতে ‘কুখ্যাত এবং সর্বজনবিদিত প্রধান’-কে খতম করা যায়।” এরপর তিনি আরও জানালেন, “এই সমস্ত কথা আপনারা কর্নেল জেমস ওয়েলশের বই মিলিটারি রেমিনিসেন্স –এ পাবেন।”

তামিলনাডুর থুথুকুডি জেলার ছোটো একটি শহর কোভিলাপট্টিতে থাকেন ধর্মন। সেখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পঞ্চলমকুরিচির ঐতিহাসিক যুদ্ধটি হয়েছিল ১৭৯৯ সালে। ব্রিটিশ কর্নেল ওয়েল্‌শ তাঁর স্মৃতিকথায় মহিলা উদ্ধারকারীদের বর্ণনা করেছেন “হতভাগ্য এবং আপাতদৃষ্টিতে অর্ধ-মূর্খ” বলে। কিন্তু যে সব মহিলা উমাইদুরাইকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের সহজাত জ্ঞান এবং সাহসকে গভীর সপ্রশংস দৃষ্টিতেই দেখছেন ধর্মন। “বলুন,” জিজ্ঞেস করলেন ধর্মন, “এই সাহসী মহিলারা কি এটা জেনেই এই কাজ করেননি যে সে দাগী আসামী? তাঁরা কি জানতেন না যে সৈন্যরা তাঁদের পিছু ধাওয়া করবে? জানতেন না যে তাঁদের বাড়িঘর তছনছ হয়ে যেতে পারে?”

Cho Dharman: 'The Covid crisis is an ‘idiyappa sikkal’ [the tangle of rice strings in rice hoppers]. The poor are suffering, how do we help them?'
PHOTO • R.M. Muthuraj

চো ধর্মন: ‘কোভিড সংকট হল ‘ইডিয়াপ্পা সিক্কল’ [চাল দিয়ে তৈরি ইডিয়াপ্পায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকা চালের সুতোর মোক্ষম জট]। গরিব মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমরা তাদের সাহায্য করব কোন উপায়ে?’

আমার সঙ্গে ধর্মনের দেখা হয়েছিল কোভিলাপট্টিতে। সম্প্রতি খবরে এই শহরটির নাম উঠে এসেছিল ২০১৫ সালে চিনাবাদাম দিয়ে তৈরি এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি কাদালামিট্টাই জি আই [জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশান] তকমা পাওয়ার পরে। সেই সময়ে ধর্মন জানিয়েছিলেন তাঁর মতামত – “ দলিত লেখা বলে কিছু হয় না । আমি জন্মসূত্রে দলিত হতে পারি। কিন্তু আমার লেখাকে এভাবে আলাদা করে দেবেন না।” সম্প্রতি আমরা ফোনে কথা বলেছি। “[এই লকডাউনে] আমার রুটিন খুব একটা পাল্টায়নি,” একটু হেসে তিনি বললেন। “একা থাকা আমার কাছে জীবন যাপনের একটা রীতি। দিনের প্রথম অংশে আমি লিখি, তারপর দুপুরবেলা কানমাই [পুকুর]-এর ধারে মাছ ধরে সময় কাটাই।”

কোভিড সংকট হল ‘ইডিয়াপ্পা সিক্কল’ [চাল দিয়ে তৈরি ইডিয়াপ্পায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকা চালের সুতোর মোক্ষম জট]। গরিব মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমরা তাদের সাহায্য করব কোন উপায়ে?’? ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প হলে কী করতে হয় আমরা জানি। কিন্তু এই পরস্পর সংযুক্তির দুনিয়ায়, যেখানে এক দিনে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়, ঠিক যে ভাবে পৌঁছেছে এই ভাইরাস, সেখানে এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমরা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।”

ঐতিহাসিকভাবে গ্রামগুলি অনেক সংক্রামক ব্যাধির সাক্ষী থেকেছে। এদের মধ্যে কয়েকটা কোভিড-১৯-এর মতোই মারাত্মক। “যেমন ধরুন ‘পেরিয়া আম্মাই’ – সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়া গুটি বসন্ত রোগটি তামিল ভাষায় এই নামে পরিচিত। বৈঁচি ফলের মতো ফোঁড়ায় সংক্রমিত ব্যক্তির চামড়া ছেয়ে যেত মাথা থেকে পা পর্যন্ত। অনেক সময় চোখেও হত। এই রোগ খুব সহজেই অন্ধ বা পঙ্গু করে দিত, মেরেও ফেলত। ব্রিটিশ পদাতিক সৈন্যরা যে এর নাম শুনেই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল তা কি খুব আশ্চর্যের? ঠিক সেরকমই কলেরা এবং প্লেগও ছিল এমন মারাত্মক দুটি রোগ যেগুলিতে মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি।”

“এই তিনটেকে [বসন্ত, কলেরা, প্লেগ] বলা হত ‘ওট্টুভার-ওট্টি নোই’ – সংক্রামক ব্যাধি যা ছোঁয়াচ, সংস্পর্শ এবং সংক্রমণের মধ্যে দিয়ে ছড়াতে পারে। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে না ছিল ভ্যাকসিন, না ছিল ওষুধ। চিকিৎসা বলতে ছিল একমাত্র নিম – শক্তিশালী এক অ্যান্টিসেপ্টিক। তাই তারা নরম নিম পাতা এনে, সেগুলো বেটে ফোঁড়ার ওপর লাগাত। বসন্ত-আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখে মনে হত তার গায়ের রংটাই বুঝি সবুজ।”

A monument to legendary freedom fighter Veerapandiya Kattabomman; he and his brother Umaidurai were hanged by the British in 1799. It's in Kayatharu, around 30 km from Kovilpatti, where Dharman lives, and he tells a riveting tale about Umaidurai that speaks of the courage of local communities
PHOTO • Roy Benadict Naveen

প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরপান্ডিয়া কাট্টাবোম্মানের স্মৃতিস্তম্ভ; ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশরা তাঁকে ও তাঁর ভাই উমাইদুরাইকে ফাঁসি দেয়। ধর্মন যেখানে থাকেন, সেই কোভিল্পাট্টি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কায়াথারুতে এই স্তম্ভটি রয়েছে। উমাইদুরাইকে নিয়ে একটা দারুণ গল্প শোনালেন ধর্মন, যে গল্পে রয়েছে স্থানীয় মানুষের সাহসের কথা

৬৬ বছর বয়সী ধর্মন ছোটোবেলায় গুটি বসন্ত দেখেছেন তাঁর দেশের বাড়িতে – কোভিলাপাট্টি থেকে আন্দাজ ১০ কিলোমিটার দূরে, থুথুকুডি জেলার এট্টায়াম তালুকের উরুলাইকুডি গ্রামে। তাঁর ছোটো গল্প এবং উপন্যাসে তিনি বিশদে এই মাটির কথা লিখেছেন – কারিসাল ভূমি – বৃষ্টি-স্নাত অঞ্চল – এবং লিখেছেন এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা। এই সমস্ত লেখা তাঁকে এনে দিয়েছে পুরস্কার এবং খ্যাতি। ২০১৯ সালে তাঁর উপন্যাস সূল (তাঁর নিজের গ্রামের প্রেক্ষাপটে পরিবেশ নিয়ে লেখা) সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পায়।

এতই ব্যাপক এবং মারাত্মক ছিল গুটি বসন্ত রোগ যে তার বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটা বিশেষ ভাষাই তৈরি হয়ে গেছিল, বুঝিয়ে বললেন ধর্মন। “‘থাই কুতিকিট্টা’ – এই শব্দবন্ধের অর্থ ছিল দেবী সেই ব্যক্তিকে কাছে টেনে নিয়েছেন – অর্থাৎ বসন্তের ফলে মৃত্যু বোঝাতে এটা ব্যবহার করা হত। এটাই ছিল ভদ্র এবং সতর্কভাবে এই বিষয়ে কথা বলার উপায়। কিছু শব্দবন্ধ ছিল যার মাধ্যমে সংক্রমণ কতটা হয়েছে বোঝা যেত: ‘ আম্মাই ভান্ধিরুক্কু ’ – বসন্ত হাজির হয়েছে, অর্থাৎ কয়েকটি সংক্রমনের ঘটনা ঘটেছে; ‘ আম্মাই ভিলায়াদুথু ’ মানে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে এবং গ্রামের অনেক বাড়িতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।”

এর সঙ্গে বর্তমানে কোভিড-১৯ এর বিভিন্ন পর্যায়ের মিল রয়েছে – ক্লাস্টার, কমিউনিটি স্প্রেড এবং কন্টেইনমেন্ট জোন। আরো দুটি শব্দবন্ধ – ‘ আম্মা এরাঙ্গিট্টা ’ এবং ‘ থান্নি উথিয়াচু ’-র অর্থ ছিল যে দেবী চলে গেছেন এবং জল ঢালা হয়েছে। অনুবাদে বেখাপ্পা এবং জটিল এবং প্রসঙ্গ-বিহীন – মূল শব্দবন্ধগুলির অর্থ ছিল সংক্রমণের ইতি। (আমাদের সময়কার কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশান অর্থাৎ নিভৃতবাস শেষ হওয়ার মতো)।

ধর্মন বলছিলেন, “বসন্ত এক্কেবারে চলে যাওয়ার পর, আক্রান্ত ব্যক্তি তিনবার স্নান করার পরেই অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারত। করোনা ভাইরাসের জন্য আমরা যা করছি তা এর থেকে খুব একটা আলাদা নয়। কিন্তু এইবার কিন্তু নাটকীয়তা আর আতঙ্ক অনেকটাই বেশি, তবে এর খানিকটা মিডিয়া-সৃষ্টও বটে।”

“পুরোনো দিনের এই রোগগুলির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য যে আইসোলেশানে থাকার নিয়ম ছিল, সেটা কিন্তু কঠোরভাবে পালন করা হত। সংক্রমিত ব্যক্তি যে বাড়িতে থাকত, তার দরজায় নিমের ডাল ঝুলিয়ে দেওয়া হত। ফলে ওখান দিয়ে যাতায়াত করার সময় লোকে সহজেই বুঝে যেত যে বাড়িতে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছে। রোগ যখন অত্যধিক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ত, তখন খড় দিয়ে নিমের ডাল গেঁথে সেটা গ্রামের প্রবেশ পথে টাঙিয়ে দেওয়া হত – আগন্তুক এবং বিক্রেতাদের সাবধান করে দেওয়ার জন্য যে ভেতরে একটি রোগ তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই সংকেত দেখে তারা চলে যেত।”

ধর্মন বলছেন যে আগে মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কারণে বেশ কিছু সুবিধে ছিল। “প্রত্যেক বাড়িতে নিজস্ব দুধ আর দইয়ের জোগান ছিল। কম পড়লে কোনও প্রতিবেশী এসে বাড়ির বাইরে রেখে যেত, সেটা তুলে নেওয়া হত। বেশিরভাগ মানুষ চাষের কাজ করত, নিজেরাই সবজি ফলাত, চাল আর ডাল মজুত থাকত। লাউ, কুমড়ো, ঝিঙে, চিচিঙ্গে – এসব আমরা আমাদের খেত থেকে তুলতাম। তাছাড়া সব লেনদেন তো টাকা দিয়ে হত না – অনেকটাই হত বিনিময়ের মাধ্যমে। ধরো তোমার কাছে শুকনো লঙ্কা নেই, তাহলে কিছুটা ধনে বীজের বদলে সেটা তুমি দিব্যি নিয়ে নিতে পারতে।”

Dharman saw smallpox as a young lad in his native village, Urulaikudi: 'What we’re doing now for the coronavirus is not very different...'The three [pox, cholera and the plague] were called ‘ottuvar-otti noi’ – infectious diseases that spread with touch, contact and contamination'
PHOTO • Roy Benadict Naveen
PHOTO • Roy Benadict Naveen
Dharman saw smallpox as a young lad in his native village, Urulaikudi: 'What we’re doing now for the coronavirus is not very different...'The three [pox, cholera and the plague] were called ‘ottuvar-otti noi’ – infectious diseases that spread with touch, contact and contamination'
PHOTO • Roy Benadict Naveen

ধর্মন ছোটোবেলায় গুটি বসন্ত দেখেছেন তাঁর দেশের বাড়িতে উরুলাইকুডিতে: ‘করোনা ভাইরাসের জন্য আমরা যা করছি তা তখনকার থেকে খুব একটা আলাদা নয়... এই তিনটেকে [বসন্ত, কলেরা, প্লেগ] বলা হত ‘ওট্টুভার-ওট্টি নোই’ – সংক্রামক ব্যাধি যা ছোঁয়াচ , সংস্পর্শ এবং সংক্রমণের মধ্যে দিয়ে ছড়াতে পারে’

ধর্মন বলছেন, বসন্ত ছিল গ্রীষ্মকালের রোগ। প্রচণ্ড গরমের মাসগুলোকেই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার জন্য বেছে নিয়েছিল। কলেরা আর প্লেগ হত বর্ষাকালে। এবং প্রত্যেকটাই যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল। “আমার ঠাকুরদা আমাকে সেই সময়ের কতই না গল্প শুনিয়েছেন – সংক্রমণে মারা গেছে এমন কাউকে হয়তো ছেলেরা কবরখানায় নিয়ে গেছে, গ্রামে ফিরে দেখল ইতিমধ্যে আরও দুজন মৃত। মৃতদেহ সৎকারের প্রশ্নে না বলার কোনও উপায়ও ছিল না, আসলে ছোটো গ্রামে সবাই সবার আত্মীয়। অগত্যা কোনও রকম সুরক্ষা সরঞ্জামের বন্দোবস্ত ছাড়াই তারা মৃতদেহ টেনে টেনে নিয়ে যেত সমাধিক্ষেত্রে।”

সাম্প্রতিক কালে, এই কোভিড অতিমারির সময়ে সংক্রমিত সন্দেহে মানুষকে দেগে দেওয়া, ভাড়া বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের বহিষ্কার, কোভিডে মৃত ব্যক্তির দেহ নিতে আত্মীয়দের অস্বীকার করা, এবং বাড়ির কাছাকাছি মৃতদেহ কবর দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ইত্যাদি ঘিরে যেসব খবর শোনা গেছে তার থেকে নিঃসন্দেহে সেই সময় ছিল আলাদা। ধর্মন বললেন যে তাঁরই জেলার একজন তাঁর মুম্বই-ফেরত ভাইকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। কেন? উপকূলবর্তী ওই বড়ো শহরে সংক্রমণ ছিল খুব বেশি, এবং স্থানীয় এই বাসিন্দা কোনও ঝুঁকিই নিতে চাননি।

“এটা কি আমাদের মূল্যবোধ, এমনকি আমাদের মনুষ্যত্বের অবক্ষয় নয়? আগের সঙ্গে এই পরিস্থিতির তুলনা করুন। ওই তেজস্বী মহিলারা কি নিজেদের প্রাণের ভয়ে উমাইদুরাইকে ছেড়ে পালিয়ে গেছিল নাকি সাহসের সঙ্গে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল?” প্রশ্ন করলেন ধর্মন।

এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, কর্নেল ওয়েল্‌শ উমাইদুরাই সম্পর্কে লিখেছিলেন যে সে " doomed to grave a gallows " [ফাঁসিকাঠেই তার মৃত্যু লেখা আছে]। উমাইদুরাই এবং তার দাদা কাট্টাবোম্মান – দুজনকেই ব্রিটিশরা ১৭৯৯ সালে ফাঁসি দেয়।

'My routine hasn’t changed much [with this lockdown]. Solitude is a way of life for me. I write in the first half of the day and spend the afternoons by the kanmai [pond], fishing'
PHOTO • Aparna Karthikeyan

‘[এই লকডাউনে] আমার দিনচর্যার নিয়মে বিশেষ হেরফের হয়নি। একা থাকা আমার কাছে জীবন যাপনের একটা রীতি। দিনের প্রথম অংশে আমি লিখি, তারপর দুপুরবেলা কানমাই [ঝিল]-এর ধারে মাছ ধরে সময় কাটাই’

ধর্মন বলছেন যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে শুধু এই সংহতির বোধ পালটে গেছে তা নয়, পালটে গেছে আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও। তাঁর মতে এর কারণ হল আমাদের খাদ্যাভ্যাস। আমাদের খাবারের তালিকা থেকে বাজরা বাদ পড়েছে বলে আক্ষেপ করছিলেন তিনি। ডাক্তাররা সবসময় বাজরা খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। “আমরা স্থানীয় খাবার খাচ্ছি না কেন? বহুকাল ধরে প্রথাগতভাবে যে ফসল ফলানো হচ্ছে, তাতে জল কম লাগে। দু’তিনবার ভালো বৃষ্টি হলেই ফসল কাটা অবধি বেশ চলে যায়।”

“আমার জন্য পেয়ারাই যথেষ্ট। গরম আবহাওয়াতে ফলে। এটা আমার মাটির ফল। আমার আপেলের কী দরকার? সে তো আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরের, শীতের, পাহাড়ি পরিবেশের ফল। আর তাছাড়া আমার কাছে পৌঁছতে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয় তাকে।”

এই ব্যাপারে তাঁর ঠাকুমা সিনিয়াম্মাল অবশ্য আরেক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। যখনই ধর্মন কোভিলাপাট্টি থেকে উরুলাইকুডিতে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে ফিরতেন, তখন তিনি সঙ্গে করে জলের বোতল নিয়ে গেলে তাঁর ঠাকুমা বকাঝকা করতেন। “জলটা ফেলে দিতে বলতেন তিনি আমাকে কারণ ও নাকি ‘মরা’ জল। তারপর কুয়োর জল খেতে হুকুম দিতেন!”

কোভিড-১৯ আসার আগে জীবনে মাত্র একবারই কারফিউয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ধর্মনের। সেটা ছিল ১৯৯৫ সালে একটি জাত ঘিরে সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে ঘোষিত আট দিনের কারফিউ। তখন বাড়ি থেকে বেরোলেই পুরুষদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল।

আতঙ্কে ভরা সেই দিনগুলিতে ধর্মনের সঙ্গে এমন একজনের দেখা হয় যে পরে তাঁরই একটি ছোটো গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছিল। এক গর্ভবতী মহিলার প্রসব বেদনা শুরু হয়েছিল। গভীর রাতে লেখক এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরাই মহিলাকে একটি নার্সিং হোমে নিয়ে যান। তারপর, ডাক্তার যা যা জিনিস চেয়েছিলেন তার খোঁজে গোটা শহরে দৌড়ে বেরিয়েছিলেন ধর্মন।

“সেখানেই শেষ নয়। এই ঘটনার সবথেকে আশ্চর্য ব্যাপার ছিল এই যে ওই মহিলা আর আমি ছিলাম জাতি সংঘর্ষে লিপ্ত সেই দুই জাতের মানুষ। বাচ্চাটা জন্মানোর পর সেই দম্পতি আমাকে শিশুকন্যার নাম রাখতে বলে। আমি তার নাম দিয়েছিলাম কালা দেবী [সেই সময়ে যে কালাভারাম বা হিংসার ঘটনা ঘটছিল সেই প্রেক্ষিতে]। জানেন আমি কী ভাবে ওই গল্পটা শুরু করেছিলাম?” জিজ্ঞেস করলেন ধর্মন, সত্যি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা তাঁর কাল্পনিক কাহিনি সম্বন্ধে। “দশকের পর দশক যারা আমার বন্ধু ছিল তারা পরিণত হল আমার শত্তুরে আর যারা নাকি ছিল শত্রু ছিল তারা হয়ে গেল বন্ধু, আর এত সবকিছু ঘটে গেল চোখের নিমেষে…”

চেনা চেনা ঠেকছে, তাই না? সাম্প্রদায়িকতা, কোভিড-১৯ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের মহাপ্রস্থানের ক্ষত বয়ে চলা এই সময়ে চেনা চেনা ঠেকা উচিত বৈকি!

বাংলা অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য

Aparna Karthikeyan

ଅପର୍ଣ୍ଣା କାର୍ତ୍ତିକେୟନ ହେଉଛନ୍ତି ଜଣେ ସ୍ୱାଧୀନ ସାମ୍ବାଦିକା, ଲେଖିକା ଓ ପରୀର ବରିଷ୍ଠ ଫେଲୋ । ତାଙ୍କର ତଥ୍ୟ ଭିତ୍ତିକ ପୁସ୍ତକ ‘ନାଇନ୍‌ ରୁପିଜ୍‌ ଏ ଆୱାର୍‌’ରେ ସେ କ୍ରମଶଃ ଲୋପ ପାଇଯାଉଥିବା ଜୀବିକା ବିଷୟରେ ବର୍ଣ୍ଣନା କରିଛନ୍ତି । ସେ ପିଲାମାନଙ୍କ ପାଇଁ ପାଞ୍ଚଟି ପୁସ୍ତକ ରଚନା କରିଛନ୍ତି । ଅପର୍ଣ୍ଣା ତାଙ୍କର ପରିବାର ଓ କୁକୁରମାନଙ୍କ ସହିତ ଚେନ୍ନାଇରେ ବାସ କରନ୍ତି ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ ଅପର୍ଣ୍ଣା କାର୍ତ୍ତିକେୟନ୍
Translator : Sarbajaya Bhattacharya

ସର୍ବଜୟା ଭଟ୍ଟାଚାର୍ଯ୍ୟ ପରୀର ଜଣେ ବରିଷ୍ଠ ସହାୟିକା ସମ୍ପାଦିକା । ସେ ମଧ୍ୟ ଜଣେ ଅଭିଜ୍ଞ ବଙ୍ଗଳା ଅନୁବାଦିକା। କୋଲକାତାରେ ରହୁଥିବା ସର୍ବଜୟା, ସହରର ଇତିହାସ ଓ ଭ୍ରମଣ ସାହିତ୍ୟ ପ୍ରତି ଆଗ୍ରହୀ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Sarbajaya Bhattacharya