নামের গোড়ায় আরও একখান তকমা জোড়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন হেমন্ত কাওয়ালে।

“আমি শিক্ষিত, বেকার, আর...আইবুড়ো,” নিজের অকৃতদার পরিচয় নিয়ে নিজেই ইয়ার্কি মারছিলেন ৩০ বছরের এই যুবক। তবে এই ঠাট্টার নিশানায় প্রায় সব জোয়ান চাষিই রয়েছেন।

নিজের ছোট্ট পানের গুমটিটায় বসেছিলেন হেমন্ত, চারপাশে বন্ধুবান্ধবের জটলা, সকলেরই বয়স তিরিশের কোঠায়। “সুশিক্ষিত। বেরোজগার। অবিবাহিত,” প্রতিটা শব্দ এমনভাবে কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন যে সকলেই শুকনো মুখে হেসে উঠলেন, যেন অনিচ্ছার এই ব্রহ্মচর্য ঘিরে তাঁদের রাগ-লজ্জা দুটোই ঢেকে রাখতে চাইছেন। মনে হল হেমন্তর ইয়ার্কিটা তাঁদেরও ঘাড়ে এসে পড়েছে।

“এইটাই আমার প্রধান সমস্যা,” হেমন্ত কাওয়ালে জানালেন। তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন।

আমরা আজ সেলোডি গাঁয়ে এসেছি। জায়গাটা ইয়াবতমল- দারহ্বা সড়কের উপর পড়ছে, কৃষক-আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত পূর্ব মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ তুলো বলয়ে। কৃষি-সংকট ও পরিযানের যুগ্ম অসুখে বহুযুগ ধরে ধুঁকছে এই এলাকাটি। হেমন্তর পানের দোকান গ্রামের চকে অবস্থিত, গুমটির সবজেটে ছায়ায় বসে বেকারত্ব ভরা সময় কাটাচ্ছে একদল যুবক। সকলেই স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর, প্রত্যেকের নামে জমিজমা আছে, চাকরি-বাকরি কিছু হয়নি কারও, সর্বোপরি সক্কলেই অবিবাহিত।

এঁদের সব্বাই পুণে, মুম্বই, নাগপুর বা অমরাবতীর মতো দূর-দূরান্তের শহরে-শহরে কিসমত পরখ করতে গিয়েছিলেন। দিনকতক নামমাত্র বেতনে চাকরিও করেছেন, শেষে রাজ্য কিংবা কেন্দ্রের পাবলিক সার্ভিস কমিশন তথা অন্যান্য চাকরির-পরীক্ষায় বসে অকৃতকার্য হয়ে ফিরে আসেন।

এই তল্লাটের, বা হয়তো সমগ্র দেশের-ই অধিকাংশ যুবক-যুবতীর মতো হেমন্ত কাওয়ালেও এটা ভেবে বড়ো হয়েছিলেন যে চাকরি পেতে গেলে বিস্তর পড়াশোনা করতে হবে।

তবে আজ তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, স্থায়ী সরকারি চাকরি না বাগাতে পারলে বিয়ের পাত্রী জোটানো কঠিন।

অথচ দেশে আজ চাকরিবাকরি নেই বললেই চলে, তাই ঠোক্কর খেতে খেতে শেষে দেশগাঁয়ে তাঁর পারিবারিক খেতজমিতে এসে ঠেকেছেন হেমন্ত। আর খানিক উপরি রোজগারের আশায় গ্রামে এই গুমটিটাও দিয়েছেন।

তাঁর জবানে, “ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম পান-দোকান খুলব, একজন বন্ধুকে বললাম রসওয়ন্তি [আখের-রসের দোকান] চালাতে, অন্য আরেকজনকে বললাম খাবারদাবারের গুমটি দিতে, যাতে সবাই মিলে খানিক কামধান্দা চালাতে পারি।” রসিকতায় হেমন্তর জুড়ি মেলা ভার। “পুণেতে বসে একটা গোটা হাতরুটি খাওয়ার চেয়ে নিজের গাঁয়ে আর্ধেকটা রুটি খাওয়া ঢের ভালো,” বললেন তিনি।

PHOTO • Jaideep Hardikar

চাকরির পরীক্ষা দিয়ে, পুণে তথা অন্যান্য শহরে কারখানায় কাজ করে, শেষে ইয়াবতমলের দারহ্বা তেহসিলে তাঁর গাঁ সেলোডিতে ফিরে এসে একটি পানের গুমটি খোলেন হেমন্ত কাওয়ালে (ডানদিকে)। এছাড়া তিনি ও তাঁর দোস্ত অঙ্কুশ কঙ্কিরাদ (বাঁদিকে) নিজের নিজের পারিবারিক খেতে চাষবাসও করেন, নইলে পেট চলবে না। প্রথমজন এমএ করেছেন, তার দ্বিতীয়জন দারহ্বা থেকে কৃষি নিয়ে বিএসসি পাশ

বছরের পর বছর অর্থনৈতিক দুর্যোগ সহ্য করার পর গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের যুবসমাজ আজ আনকোরা এক সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী: বিয়েশাদিতে বিলম্ব কিংবা হাজার চেষ্টাচরিত্র সত্ত্বেও আইবুড়ো তকমা না ঘোচা, অবিবাহিত জীবনের ফাঁড়া যে কাটতেই চাইছে না।

“মা সারাটাক্ষণ আমার বিয়ে নিয়ে ভেবে মরছে,” হেমন্ত বাবুর খুব কাছের বন্ধু অঙ্কুশ কঙ্কিরাদ (৩১) বললেন। ২.৫ একর জমি এই মালিকটির কৃষিবিজ্ঞানে বিএসসি করেছেন। “আমার বয়স বাড়ছে, অথচ বিয়েথা হচ্ছে না, এটা কিছুতেই মায়ের বোধগম্য হচ্ছে না,” সঙ্গে এটাও জানালেন যে তিনি যতই বিয়ে করতে চান, তাঁর আয়-ইনকাম এতই যৎসামান্য সে তেমনটা হওয়া অসম্ভব।

এই অঞ্চলে বিবাহের সামাজিক গুরুত্ব যে কতখানি, সেটা সব্বাই নিজের নিজের মতো করে পারিকে বোঝালেন। গোন্ডিয়ার অর্থনৈতিক রূপে অনগ্রসর পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিম মহারাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ চিনি-বলয়ে এমন অসংখ্য যুবক-যুবতীর সঙ্গে আপনার আলাপ হবে যারা এখানকার দস্তুরমাফিক বিয়ের বয়স পার করে ফেলেছে।

সামাজিক দক্ষতা বা বোলচালের নিরিখে তাঁরা মেট্রোপলিটন নগরী বা শিল্পকেন্দ্রে বসবাসকারী ছেলেমেয়েদের থেকে পিছিয়ে, এটাও একটা বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এপ্রিল ২০২৪-এর গোড়া থেকে গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের বহু যুবক-যুবতীর সঙ্গে মোলাকাত করে পারি, গোটা একটা মাস ধরে চলে তাঁদের সাক্ষাৎকার। প্রত্যেকেই শিক্ষিত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অথচ মন-পসন্দ পাত্রপাত্রী মিলছে না কিছুতেই। ফলে আশাভঙ্গ হচ্ছে তাঁদের, ক্রমেই জেঁকে বসেছে ত্রাস, ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়োই অনিশ্চিত।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) ও মানব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান (আইএইচডি) থেকে যুগ্মভাবে প্রকাশিত ইন্ডিয়া এমপ্লমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ মোতাবেক ভারতের কর্মহীন জনসংখ্যার প্রায় ৮৩ শতাংশ শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়। সেখানে এটাও বলা আছে যে ২০০০ সালে কর্মহীন যুবসমাজের ভিতর ৩৫.২ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, আর ২০২২-এ সেই সংখ্যাটা বেড়ে ৬৫.৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

৩৪২ পাতার সেই রিপোর্ট অনুসারে: “শ্রমিকদলের অভিমুখ ধীরে ধীরে কৃষি ছেড়ে কৃষিক্ষেত্র থেকে অন্যত্র প্রবাহিত হচ্ছিল, কিন্তু ২০১৯-এ (কোভিড-১৯) অতিমারির ফলে তা বিপরীতগামী হয়ে যায়; কৃষি কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিকদলের মোট আয়তন।”

আইএলও-র রিপোর্ট বলেছে, ভারতে কর্মসংস্থান প্রধানত স্বনিযুক্ত এবং আলগা, “শ্রমিকদলের আনুমানিক ৮২ শতাংশ আলগা খাতে নিযুক্ত, এবং প্রায় ৯০ শতাংশই অস্থায়ীভাবে কর্মরত।” কথাটা সেলোডির উঠতি প্রজন্মের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য — কেউ পানের গুমটি চালাচ্ছে, কেউ বা রসওয়ন্তি, আর কেউ চা-জলখাবার।

“২০১৯-এর পর থেকে কর্মসংস্থানের হার এমনভাবে বেড়েছে যে সামগ্রিক কর্মনিয়োগের ভিতর আলগা খাত এবং/কিংবা অস্থায়ী কর্মসংস্থানের ভাগটি বৃদ্ধি পেয়েছে।” ২০২১-২২-এ অনিয়মিত মজুরদের মাইনেবৃদ্ধির হার অল্প হলেও ঊর্ধ্বমুখী ছিল বটে, তবে নিয়মিত শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি হয় বদলায়নি কিংবা হ্রাস পেয়েছে। স্বনিযুক্তদের প্রকৃত রোজগারও ২০১৯ সালের পর থেকে কমে গেছে। মজুরি সামগ্রিক ভাবে বাড়েনি। সারা ভারত জুড়ে অদক্ষ তথা আলগা খেতমজুরদের ৬২ শতাংশ এবং নির্মাণক্ষেত্রে অনুরূপ শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ ২০২২ সালের নির্ধারিত ন্যূনতম দৈনিক মজুরিটুকুও পাননি।

PHOTO • Jaideep Hardikar
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: খানিক উপরি রোজগারের আশায় হেমন্তর পান-দোকানের পাশে একখান রসওয়ন্তি (আখের রসের দোকান) খুলেছেন রামেশ্বর কঙ্কিরাদ। দোস্তমহলে তিনিই সবার ছোটো, চাষবাসে রুজিরোজগার এতই কম যে বিয়ে করে ঘরসংসার করার কথা তিনি ভাবছেনই না। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন হেমন্ত কাওয়ালে (চেক-চেক জামায়) ও অঙ্কুশ কঙ্কিরাদ (বাদামি গেঞ্জি গায়ে)

*****

বাস্তবটা অত্যন্ত শোচনীয়।

পাত্রী পাওয়া যতটা দুষ্কর, ঠিক ততটাই কঠিন গ্রামাঞ্চলের শিক্ষিত যুবতীদের পক্ষে স্থায়ী চাকরিওয়ালা উপযুক্ত পাত্র পাওয়াটা।

সেলোডির এক বিএ পাশ করা যুবতীর (নাম বলতে চাননি, উপযুক্ত পাত্রের বিবরণ দিতে গিয়েও লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন) কথায়, “চাষবাসের চক্করে আটকা পড়ার চেয়ে শহরে গিয়ে পাকা চাকরি আছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে ঘর করা ঢের ভালো।”

একই জাতের ছেলে, যার কিনা শহরে স্থায়ী চাকরি আছে, এমন বিয়ের পাত্র ঢুঁড়তে গিয়ে তাঁর গাঁয়ের অন্যান্য মেয়েদের নাকাল হতে হচ্ছে বলেও জানালেন তিনি।

কথাটা অঞ্চলের সকল জাতবর্ণ ও শ্রেণির জন্য খাটে। উচ্চবর্ণের ওবিসি ও মারাঠাদের মতো প্রভাবশালী জাতি, যাদের হাতে নিজস্ব জমিজমা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্যি।

প্রবীণ কৃষকরা বলছেন যে বেকারত্ব কোনও নতুন চিজ নয়, চাকরি-অযোগ্য হওয়া কিংবা বিবাহে বিলম্ব হওয়াটাও তাই — তবে এই সামাজিক সমস্যাটা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটা খুবই আশঙ্কাজনক।

“যাঁরা আগে আগে ঘটকালি করতেন, তাঁরাও পিছিয়ে যাচ্ছেন,” জগওয়ন্ত কঙ্কিরাদ বললেন, সেলোডির এই বরিষ্ঠ চাষির দুই ভাইপো ও এক ভাইঝি আজ উপযুক্ত পাত্রপাত্রীর অভাবে আইবুড়ো হয়ে বসে আছেন। জগওয়ন্ত কাকা বহুবছর ধরে তাঁর বেরাদরিতে ঘটকালি করতেন, অসংখ্য বিবাহযোগ্য তরুণ-তরুণীদের তরি ঘাটে ভিড়িয়েছেন। তবে আজ যে তিনি ইতস্তত বোধ করেন, সেটা নিজের মুখেই জানালেন জগওয়ন্ত কঙ্কিরাদ।

“পারিবারিক বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে আর যাই না,” যোগেশ রাউত (৩২) জানাচ্ছেন। পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী এই মানুষটি সেচযুক্ত ১০ একর জমির মালিক। “কারণ যখনই যাই, লোকে জিজ্ঞেস কখন বিয়েথা করছি, খুবই শরম লাগে, হাতপা কামড়াতে ইচ্ছে হয়।”

বাড়িতে তাঁর বাবামা-ও চিন্তিত। তবে পাত্রী জুটলেও বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যোগেশ, এমন যৎসামান্য রোজগারে ঘরসংসার করা যে অভাবনীয়!

তাঁর জবানে: “চাষবাসের টাকায় পেট চলে না।” এইজন্যই তো যেসব ছেলেরা গ্রামে থাকে কিংবা শুধু কৃষির উপর নির্ভরশীল, এ গাঁয়ের অধিকাংশ পরিবারই তাদের জামাই হিসেবে চায় না। পাকা সরকারি চাকরি, কিংবা বেসরকারি ক্ষেত্রে নিযুক্ত, অথবা শহরে নিজস্ব ব্যাবসাবাণিজ্য আছে — মেয়ের মা-বাবার কেবল এসব ছেলেই পছন্দ।

গ্যাঁড়াকলটা কোথায় জানেন? বাঁধা চাকরি হাতে-গোনা, হাজার ঢুঁড়েও মেলে না।

PHOTO • Jaideep Hardikar
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: ‘বাঁধা রোজগার না থাকলে পরিবার চালানোর কথা ভাবাও মূর্খামি,’ যোগেশ রাউত জানাচ্ছেন, তিনি পেশায় চাষি। পাছে লোকে তাঁকে জিজ্ঞেস করে যে তিনি কবে বিয়ে করছেন, সেই ভয়ে পারিবারিক বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। ডানদিকে: অঙ্কুশ কঙ্কিরাদের সঙ্গে পানের গুমটি চালাচ্ছেন হেমন্ত কাওয়ালে

যুগ যুগ ধরে জলসংকটে অতিষ্ঠ মারাঠওয়াড়ার যে অঞ্চলগুলো সবচাইতে রুখাশুখা, সেখানকার ছেলেরা দেশগাঁয়ে পাত্রী পাওয়ার উমিদ ছেড়ে হয় চাকরি কিংবা পানি, অথবা দুটোরই খোঁজে শহরে পাড়ি দিচ্ছেন — এই কথাটা বহু সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে।

স্থায়ী রোজগারের রাস্তা চট্ করে মেলে না, আর গ্রীষ্মের মতন যে যে মরসুমে চাষবাস হয় না, তখন অন্য কোনও উপায়ে অনটন ঘোচানোর মতো সুযোগও নেই।

“গরমকালে খেত-খামারে কোনও কাজ হয় না,” বলছেন হেমন্ত কাওয়ালে। গাঁয়ে তাঁর দশ একরের জমিটায় সেচের বন্দোবস্ত নেই, পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তাঁর জনাকয় দোস্তের খামারে কুয়ো বা নলকূপ আছে ঠিকই, তবে গরমকালে যতই তাঁরা ঢেঁড়শের মতো মরসুমি সবজি ফলান না কেন, আয়-ইনকাম বিশেষ হয় না।

“রাত ২টো থেকে জেগে আছি; সক্কাল সক্কাল খেতের ঢেঁড়শ তুলে দারহ্বা গিয়ে ১৫০ টাকায় ২০ কিলোর একটা ক্রেট বেচেছি,” উত্তেজিত হয়ে জানালেন অজয় গাওয়ান্ডে। ৮ একর জমি আছে অজয়ের, বিএ পাশ করে আইবুড়ো হয়ে বসে আছেন। “ঢেঁড়শ তোলাতে ২০০ টাকা বেরিয়ে গেল, আজকের দিনমজুরিটুকুও উঠল না।”

এরই সঙ্গে বন্যপ্রাণীর হানা যোগ করুন, হাহাকার পড়ে যাবে। অজয় জানাচ্ছেন যে বাঁদরের জ্বালায় নাজেহাল সেলোডি গাঁ। খেত-খামার আর রুক্ষ বনজঙ্গলের মাঝে জন্তুজানোয়ারের কোনও আশ্রয় নেই, ফলে জল বা খাদ্য কিছুই পায় না তারা। “একদিন আমার খেতে হামলা করবে তো পরেরদিন অন্য কারও খেতে, কী করি বলুন তো?”

হেমন্ত সংখ্যাগুরু তিরালে-কুনবি জাতির (ওবিসি) মানুষ, দারওয়াহ শহরে একটি কলেজে পড়ার পর চাকরির সন্ধানে পুণে গিয়েছিলেন। সেখানে ৮,০০০ টাকা বেতনে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজে ঢোকেন, কিন্তু ওটুকু রোজগারে পোষায়নি বলে বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর খানিক উপরি রোজগারের আশায় পশুচিকিৎসায় সার্টিফিকেট কোর্স করেন, তাতেও অবশ্য লাভ হয়নি। হাল না ছেড়ে টেকনিক্যাল দক্ষতা অর্জনের আশায় ফিটার হিসেবে ডিপ্লোমা করেন হেমন্ত কাওয়ালে, কিন্তু হায়, সেটাও জলে যায়।

এসবের ফাঁকে ফাঁকে রীতিমতো আদাজল খেয়ে ব্যাংক, রেলওয়ে, পুলিশ ও সরকারি কেরানির মতো নানান পদের পরীক্ষায় বসেছিলেন...

তবে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁর বন্ধুবান্ধবের প্রত্যেকেই দেখলাম মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে, এটা যে তাঁদেরও কাহিনি।

PHOTO • Jaideep Hardikar
PHOTO • Jaideep Hardikar

বাঁদিকে: সেলোডি গাঁয়ের চক। ডানদিকে: ইয়াবতমলের তিরঝাড়া গাঁয়ের সরপঞ্চ একটি শিক্ষাকেন্দ্র বানিয়ে দিয়েছেন, সেখানে সরকারি কম্পিটেটিভ পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছেন বছর তিরিশেকের কিছু যুবক। তাঁদের সব্বাই হয় স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পাশ দিয়ে বসে আছেন, অথচ উপযুক্ত পাত্রী পাচ্ছেন না

এবছর তাঁরা দিনবদলের আশায় ভোট দিচ্ছেন বলে জোরগলায় জানালেন। তার দুদিন বাদেই সাধারণ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় পশ্চিম বিদর্ভের ইয়াবতমল-ওয়াশিম আসনে ভোটগ্রহণের তারিখ ছিল — এপ্রিল ২৬। এবারের লড়াইটা শিব সেনার দুটি গোষ্ঠীর মাঝে — সেনা-উদ্ধব ঠাকরের প্রার্থী সঞ্জয় দেশমুখ বনাম একনাথ শিন্ডে-সেনার প্রার্থী রাজশ্রী পাতিল।

এখানকার যুবকরা দেশমুখ সাহেবের সমর্থক, কারণ সেনা-ইউবিটি কংগ্রেস আর এনসিপির সঙ্গে জোট বেঁধেছে, আর বিদর্ভ বরাবরই কংগ্রেসের দুর্জয় ঘাঁটি।

“থিয়ে নুসতাচ বাতা মারতে, কে কেলা জি ত্যানে [উনি বড়ো বাচাল, কাজের কাজ করেছেনটা কী]?” উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন জগওয়ন্ত কাকা। তিনি যে ভাষায় কথা বলেন তার নাম বরহডি, যে ব্যঙ্গাত্মক রসে এ মাটি পুষ্ট, শিকড় গাঁথা আছে এই বুলিতে।

কে? আমরা সওয়াল করলাম। কে এমন অকর্মণ্য বাচাল আছে শুনি?

উত্তরে সবাই মুচকি হাসল। “সে তো আপনি জানেনই,” বলে হেমন্ত চুপ মেরে গেলেন।

তাঁদের এ ব্যঙ্গের নিশানা আর কেউ নন, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী, আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাঁদের মতে মোদী সাহেব তাঁর একটাও প্রতিশ্রুতি রাখেননি। ২০১৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রচার তদবিরে এসে পাশের দারহ্বা গাঁয়ে চায়ে-পে-চর্চায় বসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানে বেশ নির্লিপ্ত কণ্ঠে তিনি চাষিদের এক কর্জহীন জীবন, তুলো ও সোয়াবিনের দরবৃদ্ধি এবং এ তল্লাটে ছোটোখাটো অনেক শিল্প গড়ার কথা দেন।

২০১৪ ও ২০১৯ সালে এই যুবকেরা বিজেপির ভোটের ঝুলি ভরিয়ে দেন, তাঁদের বিশ্বাস ছিল মোদী সাহেব নিশ্চয় তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। ২০১৪ সালে তাঁরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার হটিয়ে পরিবর্তনের জন্য ভোট দেন। তবে আজ তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন যে নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতি ছিল নেহাতই বেলুনের মতন — হাওয়া ফুরিয়ে যেটা আজ চুপসে গেছে।

সেবার এঁদের অধিকাংশই প্রথমবারের জন্য ভোট দিয়েছিলেন। আশা ছিল চাকরিবাকরি হবে, অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, এদ্দিন বাদে মুনাফার মুখ দেখবে চাষবাস। মোদী সাহেবের কথায় এতখানি ওজন ছিল যে বিপর্যস্ত কৃষকবৃন্দের প্রত্যেকেই পদ্মফুল চিহ্নে বোতাম টিপে এসেছিলেন, গেরুয়া জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল সমগ্র বিদর্ভ।

তারপর একে একে কেটে গেছে দশটা বছর, তুলো আর সোয়াবিনের দর যে কে সেই রয়ে গেছে, অথচ উৎপাদনের মূল্য বেড়েছে দুগুণ-তিনগুণ। মুদ্রাস্ফীতির গুঁতোয় ঘরোয়া বাজেট টালমাটাল। না আছে কর্মসংস্থান, না আছে কোথাও কিছুর সুযোগ, যুবসমাজ আজ উদ্বেগ আর অবসাদে নাজেহাল।

এতকিছুর ধাক্কায় তাঁরা সেই কৃষিকাজেই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যার থেকে তাঁরা মুক্তি চেয়েছিলেন। ব্যঙ্গ আর রসিকতার ফাঁকফোঁকর গলে তাঁদের চেপে রাখা উদ্বেগ বেরিয়ে পড়ছে। সেলোডির যুবসমাজ তথা গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের কোনায় কোনায় এক নতুন স্লোগান কানে এল: “নৌকরি নাহি, তার ছোকরি নাহি [চাকরি নেই তো বিয়ের পাত্রীও নেই]!”

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Jaideep Hardikar

जयदीप हार्दिकर, नागपुर स्थित पत्रकार-लेखक हैं और पारी की कोर टीम के सदस्य भी हैं.

की अन्य स्टोरी जयदीप हरडिकर
Editor : Priti David

प्रीति डेविड, पारी की कार्यकारी संपादक हैं. वह मुख्यतः जंगलों, आदिवासियों और आजीविकाओं पर लिखती हैं. वह पारी के एजुकेशन सेक्शन का नेतृत्व भी करती हैं. वह स्कूलों और कॉलेजों के साथ जुड़कर, ग्रामीण इलाक़ों के मुद्दों को कक्षाओं और पाठ्यक्रम में जगह दिलाने की दिशा में काम करती हैं.

की अन्य स्टोरी Priti David
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र, पीपल्स आर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया के भारतीय भाषाओं से जुड़े कार्यक्रम - पारी'भाषा के कॉन्टेंट मैनेजर हैं. उन्होंने कोलकाता की जादवपुर यूनिवर्सिटी से तुलनात्मक साहित्य में एमफ़िल किया है. वह एक बहुभाषी कवि, अनुवादक, कला-समीक्षक और सामाजिक कार्यकर्ता भी हैं.

की अन्य स्टोरी Joshua Bodhinetra