মানুষটা রিক্তহস্তে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন । ইনসান নয়, বরং প্রতীয়মান দুঃখের মুজস্সমা যেন। নাহ্, ওদের থাবা থেকে আর কিচ্ছুটি ফিরে পাওয়ার মুরাদ নেই তাঁর। মাথার ভিতর জট পাকানো কিছু সংখ্যা, এ ক্ষতির খতিয়ান যে তাঁর নাগালের বহুদূর। ইনকার থেকে দহশত, ক্রোধ থেকে প্রতিরোধ, উম্মিদ হারানো থেকে অসাড় হয়ে যাওয়া – কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেছে পালাবদল, একে একে একাকার। এ কেয়ামতের সাক্ষী অনেকেই, রাস্তার দুধারে কাঠপুতলির মতো দাঁড়িয়ে আছে যারা। আজ তিনিও নাম লিখিয়েছেন সে পুতুলের দলে। চোখের পানি চোখেই গেছে জমে, গলার ভিতর দলা পাকানো যন্ত্রণা। জীবন তাঁর জীবন নয় আর, বুলডোজারের পায়ে কুরবানি কেবল। এই তো কদিন আগেই দাঙ্গা হয়ে গেল এ মহল্লায়, কিন্তু ওটুকুতে তো আর বাবু-বিবিদের তেষ্টা মেটে না…

বেশ কিছুদিন হতে চলল যুগান্তরের দামামা বেজেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা টের পান নাজমা। দিনকতক আগে দই পাতবেন বলে খানিকটা দম্বল চাইতে গিয়েছিলেন রেশমির কাছে। এতকালের পড়শি, তাও যেন কেমন কেমন ঠেকেছিল চাউনিটা। কিন্তু, শুধু কি তাই? শাহিনবাগে আন্দোলনরত মহিলাদের স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন পাকাপাকিভাবে, আর ঠিক সেদিন থেকেই গা-ছমছমে একটা দুঃস্বপ্ন জেঁকে বসে তাঁর মনে। চারিদিকে অতল খাদ, মাঝে একচিলতে জমিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, উফ্! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু, শুধু তাই নয়। নবযুগের কাড়া-নাকাড়া যে তাঁর শিরায় শিরায় বাজছে আজ। নিজের আঁখিতে নিজেকে দেখার ভঙ্গিমা, ছোট ছোট মাইয়াগুলো তাঁর, এ দেশ, এ জাতি, ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল সবই। ইবলিশের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল নামহীন এক ভয়।

এ যাবৎ যেটা নিজের বলে ভাবছেন, সেটা যে আপসে বেহাত হতে পারে যে কোনও দিন, এটা তাঁর খানদানের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। ঘৃণার মশালে মজহবি দাঙ্গার ফুলকি এসে পড়লে ইনসান যে এক লহমায় কেমন অশরীর হয়ে যায়, একথা তাঁর দাদিও জানেন। হঠাৎই খেয়াল হল নাজমার, পুঁচকে পুঁচকে আঙুলের টান পড়েছে তাঁর ওড়নায়। ঝটকা মেরে ঘুরতেই রূ-বা-রূ ছোট্ট একচিলতে অসহায় মুখ, আতঙ্কে ভরা হাসির সাকিন। আর ঠিক তক্ষুনি যেন জংলা হাওয়ায় বিলি কেটে গেল চিন্তারা তাঁর...

প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়ার কণ্ঠে মূল কবিতাটি শুনুন

জংলাটে বেনোফুল

বুলডোজার ওহে বুলডোজার
পাথুরে জংধরা দাঁত তোমার!
মানুষ কিংবা সে জায়গা হোক
গুঁতিয়ে দূর হটে ঘরদুয়ার।
বুলডোজার ওগো বুলডোজার,
ইতিহাসের ভূতে ভয় কী আর?
মিনারে, মসজিদে, আগাছা দল বাঁধে,
গুটিয়ে দেবে তোর হাটবাজার।
বুড়িয়ে যাওয়া বট শুকনো জট জট,
মৃত পাখির বাসা, বুলডোজার...
গুঁড়িয়ে দাও সবে, আজকে পাতা হবে
বুলেট রেলগাড়ি সাতরাজার।
চাঁই, চাঙড়, গুঁড়ি, বুলডোজার বুড়ি
চিবিয়ে চট্ করে খাইয়া যাও...
ছুঁড়িতে হবে গোলা, গুলি বা কাঁচকলা,
বুলডোজার ওহে দাঁত শানাও।

সাতরাজার দেশে, ভাঙাচোরার শেষে
শব্দ শুধু কিছু রহিয়া যায়...
ফুলকি, মিঠেকড়া, পিরিতি গাঁটছড়া
আঁখরে, উত্তরে, ছেঁড়া পাতায়।
শব্দে সদাশিবে, আল্লাহ্ আলজিভে,
এদের ভাঙতে তো বুলডোজার
লাগে না কক্ষনো, বই বা জিভ যেন
হ্যাঁচকা টানে হবে জেদ কাবার।
দমকা হাওয়া, পাখি, ভ্রমরে মান রাখি,
বেহায়া শব্দ সে হল ফেরার...
ভাসে নদীর জলে, ডোবে গজল তলে
মটকা মেরে থাকে বুলডোজার।
কুনকি রাজা ভাবে, কী আর করা যাবে?
শত স্বয়ম্ভূ এ শব্দরাগ...
এখানে, ওইখানে, হাতকড়ার গানে,
লেগেছে লালচে সে মুক্তিদাগ।

হলদে একরোখা মিহি ধূলায় ঢাকা
পিছলে যাওয়া বুলি, মনমেজাজ...
পাপড়ি ঝরা মাঠে, দ্যাখ্ কেমন ফোটে
ইতি আগুনফুলে ধরণী আজ।
নাচে স্বপন মাঝে গন্ধকের সাজে
পাগলা চিন্তারা ধিন্ তা ধিন্...
আঁকড়ে ধরে মাটি যেন শীতলপাটি
হলদে একগুঁয়ে সাত শাহিন।

বুলডোজার ওহে বুলডোজার
তোমার দাঁতভাঙা ইন্তেজ়ার।
হলদে আশা যত, ঘাসপাতার মতো
আটটি চাকা-তলে ডাকিছে আজ...
বাড়িছে গুটি গুটি আজাদি খুনসুটি,
ঝেঁটিয়ে দূর হবে লুঠতরাজ।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Poem and Text : Pratishtha Pandya

प्रतिष्ठा पांड्या, पारी में बतौर वरिष्ठ संपादक कार्यरत हैं, और पारी के रचनात्मक लेखन अनुभाग का नेतृत्व करती हैं. वह पारी’भाषा टीम की सदस्य हैं और गुजराती में कहानियों का अनुवाद व संपादन करती हैं. प्रतिष्ठा गुजराती और अंग्रेज़ी भाषा की कवि भी हैं.

की अन्य स्टोरी Pratishtha Pandya
Illustration : Labani Jangi

लाबनी जंगी साल 2020 की पारी फ़ेलो हैं. वह पश्चिम बंगाल के नदिया ज़िले की एक कुशल पेंटर हैं, और उन्होंने इसकी कोई औपचारिक शिक्षा नहीं हासिल की है. लाबनी, कोलकाता के 'सेंटर फ़ॉर स्टडीज़ इन सोशल साइंसेज़' से मज़दूरों के पलायन के मुद्दे पर पीएचडी लिख रही हैं.

की अन्य स्टोरी Labani Jangi
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र ने कोलकाता की जादवपुर यूनिवर्सिटी से तुलनात्मक साहित्य में एमफ़िल किया है. वह एक कवि, कला-समीक्षक व लेखक, सामाजिक कार्यकर्ता हैं और पारी के लिए बतौर अनुवादक काम करते हैं.

की अन्य स्टोरी Joshua Bodhinetra