চার বছরে দুবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন জীবনভাই বারিয়া। ২০১৮ সালে প্রথম অ্যাটাকের সময় বাড়িতে ছিলেন। স্ত্রী গাভিবেন তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান। ২০২২ সালের এপ্রিলে আরব সাগরে মাছ ধরার ট্রলার চালানোর সময় হঠাৎ বুকে প্রবল ব্যথা শুরু হয়। এক সহকর্মী হাত থেকে স্টিয়ারিং নিয়ে নেন, আর একজন ভয়ে ভয়ে তাঁকে শোয়ান। উপকূল থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দূরে ছিলেন তাঁরা। দুঘণ্টারও বেশি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চলেন জীবনভাই।

গাভিবেনের জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক আশঙ্কাটাই সত্যি হয়ে গেল।

প্রথমবার হৃদরোগ হওয়ার এক বছর পরে জীবনভাই যখন আবার মাছ ধরতে যাবেন বলে মনস্থ করলেন, গাভিবেনের সেটা মানতে পারেননি। তিনি জানতেন ঝুঁকি আছে। জানতেন জীবনভাইও। “আমি ওঁকে বারণ করেছিলাম,” গুজরাটের আমরেলি জেলার ছোট্ট উপকূলবর্তী গঞ্জ জাফরাবাদে তাঁর মরা আলোয় ভরা কুঁড়েঘরে বসে জানান গাভিবেন।

কিন্তু গঞ্জের বেশিরভাগ মানুষের মতো ৬০ বছরের জীবনভাইও মাছ ধরা ছাড়া আর কোনও কাজ জানতেন না, যেটা থেকে বছরে তাঁর মোটমাট ২ লক্ষ টাকা মতো আয় হত। “৪০ বছর ধরে এই ব্যবসায় ছিলেন,” জানাচ্ছেন ৫৫ বছর বয়সি গাভিবেন। “প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর এক বছর যখন বিশ্রামে ছিলেন, আমি দিনমজুরি [অন্য জেলেদের ধরা মাছ শুকানোর কাজ] করে কোনওমতে সংসার টানছিলাম। যখন ওঁর মনে হল উনি সুস্থ হয়ে গেছেন, তখনই কাজে ফিরবেন বলে স্থির করেছিলেন।”

জাফরাবাদের এক বড়ো জেলের মাছধরা ট্রলারে কাজ করতেন জীবনভাই। বর্ষাকাল বাদে বছরে আট মাস এই ট্রলারগুলি নিয়ে আরব সাগরে ভেসে পড়েন মাল্লারা, এক-একবারে ১০-১৫ দিনের জন্য। হপ্তা দুয়েক কাটানোর মতো পর্যাপ্ত জল ও খাবার নিয়ে বেরনো হয়।

“জরুরি পরিষেবার নাগালের বাইরে দিনের পর দিন সমুদ্রে কাটানোটা একেবারেই নিরাপদ নয়,” বলছেন গাভিবেন। “ওদের শুধু একটা ফার্স্ট-এইড কিট থাকে। একজন হৃদরোগীর পক্ষে ব্যাপারটা তো আরও ঝুঁকির।”

Gabhiben holding a portrait of her late husband, Jeevanbhai, at their home in Jafrabad, a coastal town in Gujarat’s Amreli district
PHOTO • Parth M.N.

গুজরাটের আমরেলি জেলার উপকূলবর্তী গঞ্জ জাফরাবাদে নিজের বাড়িতে প্রয়াত স্বামী জীবনভাইয়ের ছবি হাতে গাভিবেন

ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে দীর্ঘতম উপকূলভূমি আছে গুজরাটে – ৩৯টি তালুক ও ১৩টি জেলার প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। দেশের সামুদ্রিক উৎপাদনের ২০% আসে এই উপকূল থেকে। ফিশারিজ কমিশনারের ওয়েবসাইট বলছে, রাজ্যের এক হাজারেরও বেশি গ্রাম থেকে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্রে যুক্ত আছেন।

প্রতি বছর যে মাস চারেক সমুদ্রে কাটাতে হয়, তার পুরো সময়টা জুড়ে সবরকম স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকেন এঁদের অধিকাংশই।

প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে যতবার জীবনভাই সমুদ্রে গেছেন, গাভিবেনের দিন কেটেছে উদ্বেগে আর মানসিক চাপে। আশা-আশঙ্কায় দোদুল্যমান একা একা রাত জাগতেন সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে চেয়ে। জীবনভাই নিরাপদে ঘরে ফিরলে হাঁফ ছাড়তেন।

তারপর একদিন, আর ফিরলেন না উনি।

*****

গুজরাট সরকার হাইকোর্টে দেওয়া তাদের পাঁচ বছর পুরনো প্রতিশ্রুতিটা রাখলে হয়তো জীবনভাইয়ের ভাগ্য কিছু অন্যরকম হতে পারত।

২০১৭ সালের এপ্রিলে জাফরাবাদ উপকূল থেকে কিছু দূরে অবস্থিত শিয়াল বেট দ্বীপের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সি জনদুরভাই বালাধিয়া গুজরাট হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন নৌকা অ্যাম্বুল্যান্স চালু করার দীর্ঘদিনের দাবি নিয়ে। মামলায় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ৪৩ বছর বয়সি অরবিন্দভাই খুমান, বিপন্ন জনগোষ্ঠীগুলির অধিকার নিয়ে কাজ করা আমেদাবাদ-ভিত্তিক সংগঠন সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিস-এর সঙ্গে যুক্ত এক উকিল ও আন্দোলনকর্মী।

মামলাটিতে বলা হয়, প্রাণধারণের অধিকার প্রদানকারী ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারাটিকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে মৎস্যজীবীদের “মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করছে” রাজ্য সরকার।

২০০৭ সালের ওয়ার্ক ইন ফিশিং কনভেনশন – যা “কর্মকালীন নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা-সংক্রান্ত ন্যূনতম প্রত্যাশাসমূহ” বিধৃত করে - তাও উদ্ধৃত করা হয় মামলাটিতে।

Standing on the shore of Jafrabad's coastline, 55-year-old Jeevanbhai Shiyal says fisherfolk say a silent prayer before a trip
PHOTO • Parth M.N.

জাফরাবাদ উপকূলে দাঁড়িয়ে ৫৫ বছর বয়সি জীবনভাই শিয়াল জানাচ্ছেন, সমুদ্রে যাওয়ার আগে মনে মনে প্রার্থনা করেন জেলেরা

২০১৭ সালের অগস্ট মাসে রাজ্য সরকারের তরফে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিশ্রুতির পর মামলাটি বন্ধ করে হাইকোর্ট। সরকারপক্ষের আইনজীবী মনীষা লাভকুমার আদালতকে জানান যে রাজ্য সরকার “মৎস্যজীবী এবং উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের অধিকার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন।”

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, কোর্টের নির্দেশনামায় উল্লেখ করা আছে যে রাজ্য সরকার ১৬০০ কিলোমিটার উপকূল এলাকায় কাজ করার জন্য সাতটি নৌকা অ্যাম্বুল্যান্স কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেগুলি “যে কোনও ধরনের জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত” থাকবে।

পাঁচ বছর পরেও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিপদে পড়েই চলেছেন জেলেরা, কিন্তু প্রতিশ্রুত সাত অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে এখনও অবধি মাত্র দু’টি কার্যকর, একটি ওখলায়, একটি পোরবন্দরে।

“উপকূলের বেশিরভাগ এলাকাই এখনও অসুরক্ষিত,” বলছেন অরবিন্দভাই, জাফরাবাদের ২০ কিলোমিটার উত্তরে ছোট গঞ্জ রাজুলায় বসে। “জল অ্যাম্বুল্যান্সগুলি আদতে স্পিডবোট, মাছধরা ট্রলার যে গতিতে যে দূরত্ব যায়, তার দ্বিগুণ গতিতে একই দূরত্ব যেতে পারে ওগুলো। আমাদের এই অ্যাম্বুল্যান্সের প্রয়োজনটা অত্যন্ত গুরুতর, কারণ আজকাল জেলেরা আর উপকূলের কাছাকাছি কাজ করেন না।”

জীবনভাইয়ের কালান্তক হার্ট অ্যাটাকটি যখন হয়, উপকূল থেকে ৪০ নটিক্যাল মাইল (সামুদ্রিক মাইল) বা প্রায় ৭৫ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে ছিলেন তিনি। ২০ বছর আগেও মৎস্যজীবীরা সাধারণত এতটা গভীর সমুদ্রে যেতেন না।

“প্রথম যখন মাছ ধরা শুরু করেন, পাঁচ কি আট নটিক্যাল মাইলের মধ্যে পর্যাপ্ত মাছ পেয়ে যেতেন,” জানাচ্ছেন গাভিবেন। “উপকূল থেকে এক বা দুঘণ্টার দূরত্বের মধ্যেই থাকতেন। বছর বছর পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। আজকাল তো উপকূল থেকে ১০-১২ ঘণ্টার দূরত্বে চলে যেতে হয়।”

Gabhiben recalls the stress and anxiety she felt every time Jeevanbhai set off to sea after his first heart attack. Most fisherfolk in Gujarat are completely cut off from medical services during time they are at sea
PHOTO • Parth M.N.

প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকের পর প্রতিবার জীবনভাই সমুদ্রে যাওয়ার সময় তাঁর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কথা মনে করছেন গাভিবেন। সমুদ্রে থাকার সময় স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকেন গুজরাটের অধিকাংশ মৎস্যজীবী

*****

জেলেদের গভীর সমুদ্রে ঠেলে দেওয়ার পিছনে কাজ করছে দুটি কারণ: উপকূলবর্তী দূষণের বাড়বাড়ন্ত এবং ক্রমহ্রাসমান ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদন।

উপকূল জুড়ে যথেচ্ছ কারখানা-কেন্দ্রিক দূষণ সামুদ্রিক জীববৈচিত্রে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, জানাচ্ছেন ন্যাশনাল ফিশওয়ার্কারস ফোরামের সচিব উসমান গনি। “এতে করে যেটা হয়, মাছেরা উপকূল থেকে দূরে সরে যেতে থাকে, আর মৎস্যজীবীরা বাধ্য হন আরও গভীর সমুদ্রে যেতে,” বলছেন তিনি। “আর তাঁরা যত দূরে যান, জরুরি পরিষেবা ততটাই অবশ্যপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।”

২০১৩ সালের স্টেট অফ এনভায়রনমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে গুজরাটের উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে মোট ৫৮টি বৃহৎ শিল্প আছে, যার মধ্যে অন্যতম কেমিক্যাল, পেট্রোকেমিক্যাল, লোহা এবং অন্যান্য ধাতু, ইত্যাদি। ৩১৫৬টি খনি খোদাইয়ের এবং ৮২২টি খননকার্য চালানোর লিজ রয়েছে। ২০১৩ সালের এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সংখ্যাটা আরও বহুগুণে বেড়েছে বলেই বিশ্বাস আন্দোলনকর্মীদের।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে রাজ্যের শক্তি উৎপাদন প্রকল্পগুলির ৭০ শতাংশেরও বেশি রয়েছে এই ১৩টি উপকূলবর্তী জেলায়, আর বাকি ২০টি জেলায় রয়েছে বাকি ৩০ শতাংশ।

এই কারখানাগুলি প্রায়ই পরিবেশ-সংক্রান্ত নিয়মকানুন লঙ্ঘন করেন। আর বর্জ্য পদার্থ তো সবাই হয় নদীগুলোতে নয় সরাসরি সমুদ্রেই ফেলে,” জানাচ্ছেন বরোদার পরিবেশ আন্দোলনকর্মী রোহিত প্রজাপতি। “গুজরাটে প্রায় ২০টি দূষণগ্রস্ত নদী আছে। বেশিরভাগই আরব সাগরে গিয়ে পড়ে।”

উপকূলে উন্নয়নের নাম করে ম্যানগ্রোভ অরণ্য আচ্ছাদনও ধ্বংস করতে বসেছে রাজ্য সরকার, জানাচ্ছেন গনি। তাঁর কথায়, “ম্যানগ্রোভ উপকূল রক্ষা করে এবং মাছেদের ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ আস্তানা জোগায়। কিন্তু গুজরাট উপকূলে যেখানে যেখানে বাণিজ্যিক শিল্প উঠে এসেছে, ম্যানগ্রোভ কাটা পড়েছে। ম্যানগ্রোভ না থাকলে মাছেরা উপকূলের কাছাকাছি আর আসবেও না।”

Jeevanbhai Shiyal on a boat parked on Jafrabad's shore where rows of fish are set to dry by the town's fishing community (right)
PHOTO • Parth M.N.
Jeevanbhai Shiyal on a boat parked on Jafrabad's shore where rows of fish are set to dry by the town's fishing community (right)
PHOTO • Parth M.N.

জাফরাবাদ উপকূল, যার কাছে সার দিয়ে জেলেরা মাছ শুকোতে দিয়েছেন (ডানদিকে), সেখানে দাঁড় করানো এক নৌকার উপর জীবনভাই শিয়াল

২০২১ সালের ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সাল থেকে গুজরাটের ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদন প্রায় ২ শতাংশ কমে গিয়েছে, যেখানে দেশ জুড়ে একই সময়কালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ শতাংশ।

রিপোর্ট আরও জানাচ্ছে যে গুজরাটের ৩৯টি উপকূলবর্তী তালুকের মধ্যে ৩৮টিতেই বিভিন্ন মাত্রায় উপকূল ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছে। সাধারণভাবে ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদন এই ক্ষয় প্রতিহত করে।

“গুজরাট উপকূলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদন রক্ষায় ব্যর্থতা। যে কারখানা বর্জ্য আমরা সমুদ্রে ঢেলে দিই, সমুদ্র এখন তা ফিরিয়ে আনছে,” বলছেন প্রজাপতি। “দূষণ এবং [তৎপরবর্তী] ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের কারণে উপকূলের কাছাকাছি সমস্ত জল দূষিত হয়ে থাকছে।”

উপকূল থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে বাধ্য জেলেদের এখন লড়াই করতে হচ্ছে আরও জোরালো স্রোত, উত্তাল হাওয়া, আর অনিশ্চিত আবহাওয়ার সঙ্গে। দরিদ্র জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি, কারণ তাঁরা মূলত ছোটো জেলেনৌকা চালান যা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট শক্তপোক্ত নয়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে মাঝসমুদ্রে নৌকা ভেঙে যায় সানাভাই শিয়ালের। একটা জোরালো স্রোত নৌকার গায়ে ছোটো একটা ফাটল খুলে দেয় আর নৌকায় থাকা আট জেলের সব প্রচেষ্টা ভাসিয়ে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকে পড়ে। সাহায্য চেয়ে লাভ ছিল না, কারণ আশপাশে কেউ ছিল না। ওঁরা একাই ছিলেন সেখানে।

নৌকা ভেঙেচুরে ডুবে যায়, জেলেরা প্রাণ বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দেন। হাতের কাছে যা কাঠকুটো পান আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করেন সবাই। ছয়জন প্রাণে বাঁচেন। ৬০ বছর বয়সি সানাভাই-সহ দুজন তলিয়ে যান।

প্রাণে বেঁচেছিলেন যাঁরা, সমুদ্রে প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে ভেসে থাকার পর আর একটি মাছধরা ট্রলার তাঁদের দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে।

Jamnaben's husband Sanabhai was on a small fishing boat which broke down in the middle of the Arabian Sea. He passed away before help could reach him
PHOTO • Parth M.N.

যমনাবেনের স্বামী সানাভাই একটি ছোটো মাছধরা নৌকায় ছিলেন যেটা আরব সাগরের মাঝদরিয়ায় তলিয়ে যায়। সহায়তা পৌঁছনোর আগেই মারা যান সানাভাই

“তিন দিন পরে ওঁর শব পাওয়া যায়,” জানান সানাভাইয়ের স্ত্রী, জাফরাবাদ-নিবাসী ৬৫ বছরের যমনাবেন। “স্পিডবোট ওঁকে বাঁচাতে পারত কিনা জানি না। কিন্তু অন্তত প্রাণরক্ষার একটা সুযোগ পেতেন। নৌকায় কিছু গন্ডগোল আছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি সহায়তা চাইতে পারতেন। সবচেয়ে খারাপ হল কী হতে পারত সেটা আমাদের কাছে অপরিষ্কারই থেকে গেছে।”

তাঁর দুই ছেলে দীনেশ, ৩০, এবং ভূপাদ, ৩৫, দুজনেই পেশায় জেলে, উভয়েই বিবাহিত, এবং দুটি করে সন্তানের পিতা। সানাভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে আশঙ্কায় আছেন তাঁরাও।

“দীনেশ এখনও নিয়মিত মাছ ধরতে যায়, ভূপাদ যতটা পারে দূরে থাকে,” বলছেন যমনাবেন। “কিন্তু আমাদের তো পরিবারের দেখভাল করতে হবে, আর আয়ের উৎস সেই একটাই। আমাদের জীবন সমুদ্রের পায়ে উৎসর্গ করা আছে।”

*****

৫৫ বছরের জীবনভাই শিয়াল একটি মাছধরা ট্রলারের মালিক। জানালেন, সমুদ্রে যাওয়ার আগে মনে মনে প্রার্থনা করে নেন মৎস্যজীবীরা।

“বছরখানেক আগে নৌকায় আমার একজন মজুরের হঠাৎ বুকে ব্যথা আরম্ভ হয়,” মনে করছেন তিনি। “সঙ্গে সঙ্গেই উপকূলে ফিরতে শুরু করি আমরা।” টানা পাঁচ ঘণ্টা ধরে বুক চেপে ধরে হাঁপান ওই শ্রমিক, আর ট্রলার শম্বুকগতিতে এগোয় কূলের দিকে। শিয়াল বলছেন ওই পাঁচ ঘণ্টা পাঁচ দিনের মতো মনে হচ্ছিল। প্রতিটা সেকেন্ড আগেরটার চেয়ে লম্বা যেন, প্রতিটা মিনিট আগেরটার চেয়ে বেশি শঙ্কাপূর্ণ। উপকূলে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করা গেছিল বলে সে যাত্রা প্রাণে বাঁচেন ওই শ্রমিক।

গোটা যাত্রাটায় শিয়ালের ৫০ হাজার টাকারও বেশি লোকসান হয়, কারণ তাঁকে একদিনের মধ্যে ফিরে আসতে হয়েছিল। “যাওয়া-আসা নিয়ে একটা ট্রিপে ৪০০ লিটার জ্বালানি লাগে,” জানাচ্ছেন তিনি। “একটাও মাছ না ধরেই আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।”

When one of Jeevanbhai Shiyal's workers suddenly felt chest pains onboard his trawler, they immediately turned back without catching any fish. The fuel expenses for that one trip cost Shiyal over Rs. 50,000
PHOTO • Parth M.N.

জীবনভাইয়ের ট্রলারে এক শ্রমিকের হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁরা তড়িঘড়ি মাছ না ধরেই তীরে ফিরে আসেন। শিয়ালের ওই একটা যাত্রার খেপে জ্বালানির খরচ পড়েছিল ৫০ হাজার টাকা

'We bear the discomfort when we fall sick on the boat and get treated only after we are back home,' says Jeevanbhai Shiyal
PHOTO • Parth M.N.

‘নৌকায় অসুস্থ হয়ে পড়লে সহ্য করে নিই, তীরে এসে তবেই চিকিৎসা করানো যায়’, বলছেন জীবনভাই শিয়াল

শিয়াল জানাচ্ছেন, মাছধরার সার্বিক খরচ এত বেড়ে গেছে যে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত কোনও সমস্যা দেখা দিলে প্রথম প্রবণতাটাই হয় এড়িয়ে যাওয়া। “আমরা অনেক সময়েই অসুস্থ অবস্থাতেও টেনে যাই, যেটা একদম অনুচিত। “এটা খুব বিপজ্জনক। কিন্তু আমাদের সাদামাটা জীবন, টাকাও জমে না। পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যকে অবহেলা করতে বাধ্য হই আমরা। নৌকায় অসুস্থ হয়ে পড়লে সহ্য করে নিই, তীরে এসে তবেই চিকিৎসা করানো যায়।”

শিয়াল বেটের বাসিন্দাদের আবার তীরে এসেও স্বাস্থ্য পরিষেবা মেলে না। দ্বীপে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় হল ১৫ মিনিটের ফেরি; আর তাতেও টলোমলো নৌকা থেকে উঠতে-নামতে আরও পাঁচ মিনিট বেরিয়ে যায়।

নৌকা অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া, শিয়াল বেটের হাজার পাঁচেক বাসিন্দা – যাঁরা সবাই জীবনধারণের জন্য মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল – তাঁদের জন্য একটা ঠিকঠাক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করার দাবিও তুলেছিল বালধিয়ার আবেদনটি।

তার উত্তরে হাইকোর্টের আদেশনামায় বলা হয় জেলা ও জেলা-সংলগ্ন এলাকাগুলি থেকে মেডিক্যাল অফিসারদের ওখানকার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বসার নির্দেশ দেওয়া হবে।

অথচ বাস্তবে এই নির্দেশের রূপায়ণ একেবারেই হয় না, জানাচ্ছেন বাসিন্দারা।

Kanabhai Baladhiya outside a Primary Health Centre in Shiyal Bet. He says, 'I have to get on a boat every time I need to see a doctor'
PHOTO • Parth M.N.

শিয়াল বেটের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে কানাভাই বালধিয়া। বলছেন, ‘যতবার ডাক্তার দেখাতে গেছি, নৌকা চাপতে হয়েছে আমায়’

Hansaben Shiyal is expecting a child and fears she won’t get to the hospital on time
PHOTO • Parth M.N.

গর্ভবতী হংসাবেন শিয়াল আশঙ্কায় আছেন যে সময়মতো হাসপাতালে হয়তো পৌঁছতেই পারবেন না

অবসরপ্রাপ্ত মৎস্যজীবী কানাভাই বালধিয়া জানাচ্ছেন দীর্ঘদিনের হাঁটুর সমস্যার জন্য তাঁকে প্রায়ই জাফরাবাদ বা রাজুলায় যেতে হয়। “এখানকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র হামেশাই বন্ধ থাকে,” জানাচ্ছেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধ। “কেন কে জানে, আদালত বলে দিয়েছে এখানে সপ্তাহে পাঁচ দিন ডাক্তার বসবে। যেন শনি-রবিবারে কেউ অসুস্থ হয় না। কিন্তু হপ্তার বাকি দিনেও অবস্থা তেমন কিছু ভালো হয় না। যতবার ডাক্তার দেখাতে গেছি, নৌকা চাপতে হয়েছে আমায়।”

গর্ভবতী মেয়েদের জন্য সমস্যাটা আরও গভীর।

২৮ বছরের হংসাবেন শিয়াল বর্তমানে আট মাসের গর্ভবতী এবং এই সময়কালের মধ্যে নানান সমস্যা নিয়ে তাঁকে তিনবার জাফরাবাদের এক হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে। ছয় মাসের গর্ভাবস্থায় হঠাৎ প্রচণ্ড পেট ব্যথা শুরু হয় তাঁর, মনে করছেন হংসাবেন। তখন রাত অনেক, ফেরিও বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। স্থির করলেন রাতটা কোনওমতে কাটিয়ে ভোরের অপেক্ষা করবেন। দীর্ঘ, শঙ্কাকুল ছিল সে রাত।

ভোর চারটে নাগাদ আর সহ্য করতে পারলেন না হংসাবেন। এক মাঝিকে ডেকেছিলেন, যিনি দয়াপরবশ হয়ে সাহায্যও করলেন। “গর্ভাবস্থায় অতটা যন্ত্রণা নিয়ে নৌকায় ওঠা-নামা করা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা,” জানাচ্ছেন তিনি। “নৌকা কখনও স্থির থাকে না। সারাক্ষণ নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হয়। একটু এদিক-ওদিক হলেই সোজা জলে পড়ে যাবেন। জীবন যেন একটা সুতোর ভরে ঝুলছে মনে হয় তখন।”

কোনওমতে নৌকার চড়ার পর তাঁর শাশুড়ি, ৬০ বছর বয়সি মঞ্জুবেন অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবায় ফোন করেন। “ভেবেছিলাম আগে থেকে ফোন করে রাখলে একটু হয়তো সময় বাঁচবে,” বলছেন তিনি। “কিন্তু ওরা বলল জাফরাবাদ বন্দরে নেমে তারপর ফোন করতে।”

অর্থাৎ ফেরি থেকে নামার পরেও তাঁদের আরও ৫-৭ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল অ্যাম্বুল্যান্স এসে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

Passengers alighting at Shiyal Bet (left) and Jafrabad ports (right)
PHOTO • Parth M.N.
Passengers alighting at Shiyal Bet (left) and Jafrabad ports (right)
PHOTO • Parth M.N.

শিয়াল বেট (বাঁদিকে) ও জাফরাবাদ (ডানদিকে) ফেরিঘাটে ওঠানামা করছেন যাত্রীরা

এই অভিজ্ঞতার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে হংসাবেনের। “ভয় করে, বাচ্চা যখন হবে ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে পারব না,” বলছেন তিনি। “ভয় করে প্রসববেদনার সময় হয়তো নৌকা থেকে পড়ে যাব। আমাদের গ্রামেরই মেয়েদের কথা জানি যারা হাসপাতালে ঠিক সময় পৌঁছতে না পেরে মারা গেছে। বাচ্চাকে বাঁচানো যায়নি এমন ঘটনাও শুনেছি।”

পূর্বোক্ত পিটিশনের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী-আন্দোলনকর্মী অরবিন্দভাই জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছর ধরে শিয়াল বেট থেকে বাসিন্দাদের দেশান্তরে পাড়ি দেওয়ার পিছনে একটা বড়ো কারণ স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব। “এখানে এমন একাধিক পরিবার পাবেন যারা নিজেদের সমস্ত কিছু বিক্রিবাটা করে দিয়েছে,” বলছেন তিনি। “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবারগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবা মজুদ না থাকার দরুণ কোনও না কোনও মর্মান্তিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন তারা সবাই উপকূলের দিকে চলে গেছে আর কোনওদিনও না ফেরার শপথ নিয়ে।”

শপথ নিয়েছেন উপকূলবাসিনী গাভিবেনও: পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম চোদ্দপুরুষের পেশায় আর নামবে না। জীবনভাইয়ের মৃত্যুর পর এখন বিভিন্ন জেলের জন্য মাছ শুকানোর কাজ করেন তিনি। যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ, অথচ মজুরি দিনপ্রতি ২০০ টাকা। আয় করা এক একটা পয়সা জমিয়ে রাখছেন ১৪ বছরের ছেলে রোহিতের পড়াশোনার জন্য; জাফরাবাদের এক সরকারি স্কুলে পড়ে সে। গাভিবেন চান ছেলে বড়ো হয়ে ওর যা ইচ্ছে তাই হোক – শুধু যেন জেলে না হয়।

তাতে যদি বৃদ্ধা গাভিবেনকে একলা ফেলে রোহিতকে জাফরাবাদ ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাও সইবেন তিনি। নিজেদের ভয়াবহতম আশঙ্কার সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাস করছেন, এমন অসংখ্য মানুষ আছেন জাফরাবাদে। গাভিবেন আর কিছুতেই তাঁদের একজন হয়ে থাকতে চান না।

ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে পার্থ এম. এন. জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Parth M.N.

पार्थ एम एन, साल 2017 के पारी फ़ेलो हैं और एक स्वतंत्र पत्रकार के तौर पर विविध न्यूज़ वेबसाइटों के लिए रिपोर्टिंग करते हैं. उन्हें क्रिकेट खेलना और घूमना पसंद है.

की अन्य स्टोरी Parth M.N.
Editor : Sangeeta Menon

संगीता मेनन, मुंबई स्थित लेखक, संपादक और कम्युनिकेशन कंसल्टेंट हैं.

की अन्य स्टोरी Sangeeta Menon
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

की अन्य स्टोरी Dyuti Mukherjee