পারি'র এই প্রতিবেদনটি পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতা বিভাগে ২০১৯ সালের রামনাথ গোয়েঙ্কা পুরস্কার প্রাপ্ত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সিরিজের অংশ।
‘হিমালয়ের ৩০০ চমরী গাইয়ের অনাহারে মৃত্যু সিকিমে’
‘বরফে অবরুদ্ধ প্রায় ৩০০ চমরী গাইয়ের অনাহারে মৃত্যু উত্তর সিকিমে’
‘গলতে থাকা বরফের কারণেই সিকিমের চমরী গাই ট্রাজেডি’
১২ মে-এর এই সংবাদ শিরোনামগুলি আমাকে বড়ো রকমের ধাক্কা দেয়। যে যাযাবর মেষপালকরা এই পশুদের লালনপালন করে থাকেন তাঁরা তাঁদের প্রাণীদের রক্ষা করতে শেষ অবধি চেষ্টা করেন তা চিত্রসাংবাদিক হিসাবে হিমালয় অঞ্চল ভ্রমণ করার সুবাদে আমার জানা। ওই সুবিশাল পর্বতের উল্লেখযোগ্য অঞ্চল জুড়ে যাযাবর পশুপালকরা চমরী গাই নিয়ে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের জন্য নির্দিষ্ট চারণভূমির মধ্যে যাতায়াত করেন — চমরী গাই-ই এঁদের জীবন। চমরী গাই এঁদের উপার্জনের মূল উপায় ও শীতকালে খাদ্যের অন্যতম উৎস।
উপরোক্ত শিরোনামের কিছু প্রবন্ধ চমরী গাইয়ের মৃত্যুর জন্য পৃথিবীর উষ্ণায়নকে দায়ী করেছে। ওই কষ্টসহিষ্ণু পশুগুলির যদি এমন দুরবস্থা হয়ে থাকে তাহলে তাদের পালকরাও যে সমূহ বিপদে আছেন তা সহজেই অনুমেয়। আমি লাদাখের হানলে উপত্যকার চাংপা পরিবারগুলির কাছে ফিরে গিয়ে তাঁদের এবং তাঁদের পোষ্যগুলির খোঁজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
তিব্বত মালভূমির পশ্চিমে বিস্তৃত ভারতবর্ষের চাংথাং অঞ্চলের চাংপারা ক্যাশমের পশমের প্রধানতম উৎপাদক ও তাঁরা চমরী গাই পালনও করেন। পশুপালক চাংপা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ডিক, খারলুগ, মাক ও রাক ও উল্পা-এর মতো বহু গোষ্ঠী লেহ্ জেলার হানলে উপত্যকার নিয়োমা ব্লকে বাস করেন। এঁদের মধ্যে ডিক এবং রাক-রা সম্ভবত সর্বাধিক দক্ষ ও পারঙ্গম চমরী গাই পালক।
“আমাদের বহু চমরী গাই মারা যাচ্ছে”, হানলে-এর ওস্তাদ ডিক পশুপালক ৩৫ বছর বয়সী ঝাম্পাল সেরিং বললেন। “এখন এখানকার (সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের) আবহাওয়া সম্বন্ধে কোনও পূর্বাভাস দেওয়া অসম্ভব।” হানলের ভারতীয় মানমন্দিরে কর্মরত খালদো গ্রামের সোনাম দোর্জির মাধ্যমে আমার সেরিংয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। ১৪,০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত তাঙ্কাপো চারণভূমিতে তাঁর বড়োসড় খুর-এ (লাদাখি ভাষায় যার অর্থ সেনা ছাউনি) বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন সেরিং।
২০১৯ সালের মে মাসে সিকিম দুর্ঘটনার তিন বছর আগে, নেপাল-ভিত্তিক সুসংবদ্ধ পার্বত্য উন্নয়ন কেন্দ্র তাদের প্রাকাশিত একটি গবেষণা পত্রে জানায়, “ভুটান, ভারত ও নেপালে চমরী গাইয়ের সংখ্যা বিগত কয়েক বছর ধরে কমছে।” গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে ভারতে চমরী গাইয়ের সংখ্যা ১৯৭৭ সালে ১৩২,০০০ থেকে ৫১,০০০-এ নেমে এসেছে — মাত্র তিন দশকের মধ্যেই শতকরা ৬০%-এর অধিক ঘাটতি হয়েছে।
স্থানীয় পশুপালন ও দুগ্ধ উৎপাদন বিভাগের তথ্য বলছে লেহ্ জেলার চমরী গাইয়ের সংখ্যা ১৯৯১ সালে ৩০,০০০ থেকে ২০১০ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৩,০০০-এ, অর্থাৎ দুই দশকে ঘাটতির লক্ষ্যণীয় হার শতকরা ৫৭%। স্থানীয় তথ্যের সঙ্গে ‘ওপরতলার’ সরকারি তথ্যের অমিল রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুসারে জেলার চমরী গাইয়ের সংখ্যা ২০১২ সালে ছিল ১৮,৮৭৭ (সেক্ষেত্রেও ঘাটতির হার ২১ বছরে ৩৭% - যা তত্যন্ত বেশি)।
ডিক বসতি এলাকায় পৌঁছানো মোটেই সহজ ছিল না। অন্যান্য পশুপালক গোষ্ঠীগুলির তুলনায় এঁদের (ব্যবহৃত) চারণভূমি অধিকতর উচ্চতায় অবস্থিত। তাছাড়া এঁরা এমন কিছু স্থানে তাঁবু ফেলেন যা ভারত-চীন সীমান্ত অঞ্চলের কাছে। অতএব সেখানে অসামরিক মানুষদের যাওয়ার অনুমতি থাকে না। সোনাম দোর্জির সাহয্য পেয়ে আমি সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিলাম, বসন্তকাল বলেই।
“চমরী গাইরা চমৎকার প্রাণী”, ঝাম্পাল সেরিং বলেন। “চমরী গাই নিদারুণ শীত সহ্য করতে পারে। মাইনাস ৩৫ থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তারা দিব্যি বেঁচে থাকে। কিন্তু তাপমান ১২ বা ১৩তে উঠলে ওদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়। শ্লথ বিপাকের কারণে চমরী গাই দেহের তাপ সংরক্ষণে সক্ষম। অতএব কঠিন শীতে তারা বেঁচে থাকতে পারে। ওরা ফাঁপরে পড়ে তাপমান দ্রুত ওঠা নামা করলে।”
কালা পারি (কালো পাহাড়) থেকে ৪০ কিমি দূরে আমার সাক্ষাৎ হয় সিরিং চোনচুম-এর সঙ্গে। হানলে উপত্যকার স্বল্প সংখ্যক নারী চমরী গাইয়ের মালিকদের মধ্যে সেরিং চোনচুম একজন। “গরম বেড়ে যাওয়ার কারণে ভেড়া, পশমিনা ছাগল ও চমরী গাইদের গায়ে আগের মতো আর ঘন লোম হয় না”, তিনি জানালেন। “আগের চেয়ে ওরা দুর্বলও হয়ে গেছে। দুর্বল চমরী গাই মানেই আমদের উৎপাদন কমে যাওয়া। দুধ কমে যাওয়া মানেই রোজগার কমে যাওয়া। বিগত পাঁচ বছরে চমরী গাই থেকে আমাদের আয় ভীষণভাবে কমে গেছে।” চোনচুম রাক পশুপালক গোষ্ঠীর যাযাবর রাখালিয়া মেষপালক। স্বাধীন গবেষণা দেখায় যে একটি পশুপালক পরিবারের সমস্ত আয়ের উৎস থেকে অর্জিত মাসিক গড় উপার্জন ২০১২ সালের হিসেবে ৮,৫০০ টাকা।
চমরী গাই পালন করে পশুপালকরা যে আয় করেন তার ৬০% আসে চমরী গাইয়ের দুধ থেকে। অতএব এটি তাঁদের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। চাংপারা বাকি রোজগার করেন খুলু (চমরী গাইয়ের লোম) ও পশম থেকে। ফলে চমরী গাইয়ের সংখ্যা ও দুধ উৎপাদন কমে গেলে তাঁদের আয়ে আঁচ পড়বেই। সব মিলিয়ে চমরী গাই-নির্ভর অর্থনীতি এখন সংকটের সম্মুখীন।
“এখন বৃষ্টিপাত বা তুষারপাত কোনোটাই সময় মতো হয় না” বললেন সেরিং চোনচুম। সুতরাং পাহাড়ে ঘাস অপ্রতুল এবং সে কারণে এখানে আগত যাযাবর পশুপালকদের সংখ্যাও কমে গেছে। এইসব পরিবর্তনের ফলে ও ঘাস কমে যাওয়ায় এবং তার থেকে জন্মানো সমস্যার জন্য আমার মনে হয়, পশুপালক পরিবারের [আগে যে আন্দাজ ২৯০টি পশুপালক পরিবার ছিল] সংখ্যা কমে মাত্র ৪০%-এ এসে ঠেকেছে।
“আমার ছেলে স্থানীয় মানমন্দিরে কাজ করে বলে আমি খানিক বেঁচে গেছি। চাংপা পরিবারের যুবকরা অনেকে এখন বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন বা জেনারেল রিসার্ভ ইঞ্জিনিয়ার ফোর্সের সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে দিনমজুর হিসাবে কাজ করেন।” অনেকেই কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছেন।
সোনাম দোর্জিই মানমন্দিরে কর্মরত তাঁর সেই ছেলে যিনি আমাকে এই পরিভ্রমণে সাহায্য করেছেন। সোনাম নিজেও পাহাড়ে এই পরিবর্তনগুলির উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন।
‘আবহাওয়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমার যখন ১৫ বছর বয়স ছিল তখন এখানে অনেক বেশি ঠান্ডা ছিল…যাঁরা জানেন তাঁরা বলেন তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেত”
“আবহাওয়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে”, তিনি জানালেন। “আমার যখন ১৫ বছর বয়স (এখন আমার ৪৩, মানে আমি ৩০ বছর আগের কথা বলছি) তখন অনেক বেশি ঠান্ডা ছিল। আমি তাপমাত্রা মাপিনি কিন্তু যাঁরা জানেন তাঁরা বলেন যে তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এ নেমে যেত। সুতরাং মানুষের পোশাকও সেই ঠান্ডার সঙ্গে মানানসই ছিল। এখন যেমন সিন্থেটিক কাপড়ের জ্যাকেট ব্যবহৃত হয়, তখন এমন ছল না। টুপি, জামা বা আর যা কিছু তাঁরা পরতেন তা পশমিনা ছাগলের পশম দিয়েই বোনা হত। জুতোর শুকতলার ভিতরের দিকে চমরী গাইয়ের চামড়ার একফালি চ্যাপ্টা টুকরো লাগানো থাকত। ফালি কাপড় দিয়ে হাঁটু অবধি বাঁধা জুতোগুলি স্থানীয় কাপড়েই তৈরি হত। এখন আর এই সব জিনিস দেখা যায় না।”
টুনডুপ আংমো ও এস এন মিশ্র তাঁদের ২০১৬ সালের গবেষণাপত্র — পশ্চিম হিমালয়ের লাদাখ, লাহুল এবং স্পিতি অঞ্চলে জলবায়ু বিবর্তনের ফলাফল -এ দেখিয়েছেন যে উষ্ণায়ন ঘটেই চলেছে। “আবহাওয়া দপ্তর (বায়ু সেনা স্টেশন লেহ্) থেকে প্রাপ্ত তথ্য দেখাচ্ছে যে লেহ্-তে গোটা শীতকাল জুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি ও গ্রীষ্ণকালের মাসগুলিতে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বেড়ে চলেছে বিগত ৩৫ বছর ধরে।” নভেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে তুষারপাতও স্পষ্টতই কমেছে।
তাঁরা আরও জানান, “বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান ছাপ লেহ্ লাদাখ ও স্পিতিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৃষ্টি ও তুষারপাতের ধাঁচ বদলে যাচ্ছে। হিমবাহ ও স্থায়ী তুষারক্ষেত্র গলে যাচ্ছে। ফলে নদী/ঝরনার জলপ্রবাহ প্রভাবিত হচ্ছে, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ার সম্ভনাও তৈরি হচ্ছে।”
ঝাম্পাল সেরিং-এর তাঁবুতে বসে তাঁর বন্ধু, সাংদা দোর্জি প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি এবার কটি রেবো লক্ষ্য করেছেন?”
চাংপারা যে তাঁবুতে থাকেন তাকে রেবো বলে। রেবো বানাতে পরিবারগুলি চমরী গাইয়ের পশম পাকিয়ে, বুনে সেলাই করে। এই কাপড় যাযাবর মানুষদের চরম শীত ও হিম শীতল বাতাস থেকে রক্ষা করে।
“বেশিরভাগ পরিবারের আর এখন নিজস্ব রেবো নেই”, সাংদা বললেন। “ রেবো সেলাই করার পশম কোথায়?” চমরী গাই থেকে প্রাপ্ত পশমের পরিমাণ গত কয়েক বছরে ভীষণ রকম কমে গেছে। রেবো না থাকা মানে আমাদের যাযাবর জীবনধারার একটা বড়ো অংশ বাদ চলে যাওয়া। আর এর জন্য শীতকালীন তাপমান বৃদ্ধিকেই আমি দায়ি করি।”
আমি উপলব্ধি করতে শুরু করি যে সিকিমে মে মাসের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এর চেয়েও খারাপ কিছু আগামীদিনে হতে পারে। আবহাওয়ার পরিবর্তন কথাটি এই পশুপালকরা ব্যবহার না করলেও পুরো বিষয়টি তাঁরা স্পষ্টভাবে বর্ণানা করতে পারেন। সোনাম দোর্জি আর সেরিং চোনচুম-এর কথা থেকেই বোঝা যায় যে বড়ো ধরনের পরিবর্তনগুলি তাঁদের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাঁরা এও বোঝেন যে বহু রকমফের, এমনকি স্থায়ী পরিবর্তনের পিছনেও মানুষের হাত আছে। ৬০ বছর বয়সী, বয়োজ্যেষ্ঠ পশুপালক গুম্বু তাশি বোধহয় সেইজন্যই বললেন, “হ্যাঁ আমি জানি পার্বত্য আবহাওয়া খুবই ছলনাময়। চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিত। আমরা বোধহয় পর্বত দেবতাকে রুষ্ট করেছি।”
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
অনুবাদ: চিল্কা
#ladakh #global-warming #yaks #climate-change #changing-weather-patterns #changthang #changpa