“আমি ট্র্যাক্টর চালাতে জানি,” ঘোষণা করলেন সর্বজিৎ কৌর। অতএব তিনি সাদা পরিবারিক ট্র্যাক্টরটিতে চেপে প্রায় দুমাস আগে, পঞ্জাবের জসরাউর গ্রাম থেকে হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তের, মোটামুটি ৪৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সিংঘুতে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বলেন, “আমি নিজেই এসেছি,” - সবাই সেসময় কৃষক সংগঠনগুলির ব্যবস্থা করে দেওয়া ট্রলিতে করে আন্দোলনস্থলে আসছিলেন।

জসরাউর থেকে রওনা দেওয়ার আগে থেকেই ৪০ বছর বয়সী সর্বজিৎ সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে পাশ হওয়া কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। অমৃতসর জেলার অঞ্জলা তেহসিলের ২,১৬৯ জনসংখ্যা বিশিষ্ট গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে তিনি প্রচার করেছেন। তারপর তিনি জমহুরি কিষান সভার (২০০টি কৃষক সংগঠনের সর্বভারতীয় একতা মঞ্চ, সর্বভারতীয় কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত) পরিচালনায় জসরাউর ও সন্নিহিত গ্রামগুলি থেকে ২৫শে নভেম্বর সকাল সকাল যে ট্র্যাক্টর-ট্রলিগুলি কাফেলা যাত্রা শুরু করে তিনিও তাদেরই সঙ্গে রওনা দেন এবং ২৭শে নভেম্বর সিংঘু এসে পৌঁছন।

এইবার সিংঘু থেকে আন্দাজ তিন কিলোমিটার উত্তরে, হরিয়ানার সোনিপতে অবস্থিত, কুণ্ডলি সীমান্ত থেকে ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের অভূতপূর্ব ট্র্যাক্টর মিছিলে অংশ গ্রহণের জন্য তিনি প্রস্তুত হয়েছেন। “আমি নিজের ট্র্যাক্টর নিয়ে এতে যোগ দেব,” তিনি জানিয়ে দিলেন।

তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে, ২৬শে নভেম্বর থেকে যে অন্দোলন চলছে তার প্রধান কেন্দ্রগুলির মধ্যে আছে হরিয়ানা’র সিংঘু ও টিকরি ও উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর—এই স্থানগুলিতে কয়েক লক্ষ কৃষক ও বহু কৃষক সংগঠনের সেই দিন থেকেই জমায়েত শুরু হয়েছে। “কৃষি আইন তিনটি প্রত্যাহার না হওয়া অবধি বয়স নির্বিশেষে নারী পুরুষ এই জায়গা ছেড়ে যাবে না,” জানিয়ে দিলেন সর্বজিত কৌর।

“কেউ আমাকে এখানে আসতে বলেনি। কেউ আমাকে এখানে ধরেও রাখেনি,” নিজের ট্র্যাক্টরের কাছে দাঁড়িয়ে জানাতে ভুললেন না তিনি। “কত পুরুষও তো আমার ট্র্যাক্টরে করে এখানে এসেছেন। আপনি কি বলবেন নাকি যে আমি তাঁদের নিয়ে এসেছি?” ভারতের প্রধান বিচারপতি যে বলেছেন মহিলা ও বয়জ্যেষ্ঠদের প্রতিবাদস্থলে ‘রেখে দেওয়া’ হয়েছে সুতরাং তাদের ‘বুঝিয়ে ফেরত পাঠানো’ দরকার — সেই মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে দিলেন তিনি।

Sarbjeet Kaur: 'Women are the reason this movement is sustaining. People in power think of us as weak, but we are the strength of this movement'
PHOTO • Tanjal Kapoor
Sarbjeet Kaur: 'Women are the reason this movement is sustaining. People in power think of us as weak, but we are the strength of this movement'
PHOTO • Tanjal Kapoor

সর্বজিৎ কৌর: ‘মহিলাদের কারণেই এই আন্দোলন টিকে আছে। ক্ষমতাসীনরা আমাদের দুর্বল ভাবে কিন্তু এই আন্দোলনের মূল শক্তি আমরা মেয়েরাই’

“মহিলাদের কারণেই এই আন্দোলন টিকে আছে। ক্ষমতাসীনেরা আমাদের দুর্বল ভাবে কিন্তু এই আন্দোলনের মূল শক্তি আমরা। আমরা, মহিলারা চাষবাসের দেখাশুনা করি। আমাদের দুর্বল ভাবেই বা কেমন করে কেউ? আমার খেতে আমি বীজ বুনি, ফসল তুলি, ঝাড়াই-মাড়াই করে তা বাজারে পাঠাই। আমার খেত আর পরিবার দুয়েরই দেখাশুনা করি আমি।”

সর্বজিতের মতোই গ্রামীণ ভারতের মোট ৬৫ শতাংশ মহিলা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকর্মের সঙ্গে যুক্ত।

সর্বজিতের শ্বশুরকূলের পাঁচ একর জমি আছে জসরাউরে — জমিটি তাঁর স্বামীর পরিবারের নামে নথিভুক্ত করা আছে — তাতে তাঁরা গম আর ধান চাষ করেন। স্থানীয় মাণ্ডিতে সেই ফসল বিক্রি করে বছরে তাঁরা ৫০,০০০-৬০,০০০ হাজার টাকা আয় করেন। খেতে কঠোর শ্রম দেওয়া সত্ত্বেও সর্বজিতের এই জমির মালিকানা স্বত্ব নেই — যে জমিতে কাজ করেন, ভারতে ২ শতাংশেরও কম মহিলার তাতে মালিকানা স্বত্ব রয়েছে। (এম এস স্বামীনাথন দ্বারা প্রস্তাবিত ২০১১ সালের নারী কৃষক অধিকার বিল , এই অভাব সহ কৃষি অর্থনীতিতে আরও কিছু ফাঁক পূরণের চেষ্টা করলেও তা আজ অবধি আইনের চেহারা পেলো না।)

তাঁর স্বামী নিরঞ্জন সিং, আন্দোলনস্থলে যাওয়া আসা করছেন, কিছুদিন আগে গ্রামে ফিরে গেছেন। সর্বজিতের মন পড়ে থাকে ওঁর দুই ছেলে আর দুই মেয়ের কাছে — কিন্তু তিনি বলেন যে ওদের ভবিষ্যতের জন্যই তিনি আন্দোলন করছেন ফলে আন্দোলনের শেষ অবধিই তিনি সেখান থাকবেন। “মাণ্ডিগুলি বন্ধ হয়ে গেলে আমরা ফসল বেচে আয় করব কী ভাবে আর কী ভাবেই বা আমার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে?” যে আইনটির বলে সরকার পরিচালিত মাণ্ডিগুলিকে দুর্বল করে দেওয়া হবে সে প্রসঙ্গে এই তাঁর প্রশ্ন। তিনি আরও বললেন, “আমি চাই আমার বাচ্চারা ভালো করে লেখাপড়া শিখুক। আজ আমরা বুঝতে পারছি না কিন্তু ক্রমে মাণ্ডিগুলি বন্ধ হয়ে যাবে আর তখন আমরা ফসল বেচবো কোথায়?”

কৃষকরা যে আইনগুলির প্রতিবাদ করছেন: কৃষিপণ্য ব্যবসা – বাণিজ্য (উৎসাহ ও সুযোগসুবিধা দান) আইন, ২০২০ ; মূল্য নিশ্চয়তা ও কৃষি পরিষেবা বিষয়ে কৃষক (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি আইন, ২০২০ ; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০ । আইনগুলি প্রথমে অধ্যাদেশ হিসেবে পাশ হয় ৫ জুন, ২০২০, তারপর কৃষিবিল হিসেবে লোকসভায় পেশ করা হয় ১৪ই সেপ্টেম্বর এবং সেই মাসের ২০ তারিখ, যাবতীয় বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে দ্রুততার সঙ্গে সেটিকে আইনে পরিণত করে বর্তমান সরকার।

কৃষকরা মনে করেন এই আইনগুলি তাঁদের জীবন জীবিকা ধ্বংস করে দেবে কারণ এই আইন কৃষক ও কৃষির ওপর বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থার শক্তি আরও বৃদ্ধি করবে। এছাড়াও, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, কৃষি উৎপাদন বিপণন কমিটি, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা সহ কৃষকদের সহায়তাকারী মূল নীতিগুলিকে লঙ্ঘন করবে এই আইন। এরই পাশাপাশি, ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদকে উপেক্ষা করে ভারতীয় নাগরিকের আইনি লড়াইয়ের পথে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্যও সমালোচনার মুখে পড়েছে এই আইন।

Sometimes, Sarbjeet gives children an others at the protest site a ride on her tractor, which she learnt to drive four years ago
PHOTO • Tanjal Kapoor
Sometimes, Sarbjeet gives children an others at the protest site a ride on her tractor, which she learnt to drive four years ago
PHOTO • Tanjal Kapoor

চার বছর আগে সর্বজিৎ ট্র্যাক্টর চালাতে শিখেছেন — আন্দোলনস্থলে উপস্থিত শিশুদের এবং অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের তিনি নিজের ট্র্যাক্টরে করে ঘুরতে নিয়ে যান

আন্দোলনস্থলে সামাজিক সেবা কাজ করতে সর্বজিৎ লঙ্গরে রান্না করেন, রাস্তা পরিষ্কার করেন, কাপড় কাচেন। তিনি ট্র্যাক্টর-ট্রলিতেই ঘুমান আর আশপাশের দোকানের শৌচাগার ব্যবহার করেন। “চারপাশের মানুষজন বড়ো ভালো, তাঁরা আমাদের এতো বিশ্বাস করেন যে দোকানের চাবি দিয়ে দেন যাতে আমরা যখন দরকার তখনই বাথরুম ব্যবহার করতে পারি। এখানে বিনামূল্যে ওষুধ আর স্যানিটারি প্যাডও দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন,” তিনি জানালেন। এক একদিন সর্বজিৎ কারও কাছ থেকে সাইকেল ধার করে গোটা অঞ্চলটা চক্কর দেন।

“আমি এখানে দিব্যি আছি। একটা গোটা পরিবারের মতো সবাই এখানে সঙ্গে আছি। আমরা নানান গ্রাম থেকে এসেছি, ফলাই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফসল কিন্তু সবাই এক হয়েছি একটাই কারণে। এই আন্দোলন আমাকে একটা বৃহত্তর পরিবার দিয়েছে। এখানে আমরা যেভাবে এক হয়েছি যা আগে কখনো হয়নি। এই একতা পঞ্জাব হরিয়ানায় সীমাবদ্ধ নেই। আজ দেশের সর্বোত্র কৃষকরা এক হয়েছেন আর কেউ আমাদের পরিচালনা করছে না। আমরা সবাই নেতা।”

যে ট্র্যাক্টর সর্বজিৎ চার বছর আগে চালাতে শিখেছেন তাতে এখানকার বাচ্চাদের মাঝে মাঝে তিনি বেড়াতে নিয়ে যান। “আমার স্বামীই ট্র্যাক্টর চালাতেন আর আমার চিরকালই আগ্রহ ছিলো চালাতে শেখার। তাই আমি তাঁকে বলি শিখিয়ে দিতে আর তিনিও বেশ শিখিয়ে দিলেন। শেখার সময়ে, বা যখন আমি চালিয়ে বেড়াই তখন আমার বাড়িতে বা গ্রামে কেউ কিচ্ছু বলেনি,” তিনি বললেন।

তিনি আরও জানালেন, “চালাবার সময়ে মনে হয় আমি যেন ডানা মেলে উড়ছি। মহিলারা সারা জীবন নিজের অধিকারের লড়াই চালিয়ে করে। লোকে মনে করে তাদের লড়াই লড়ে দেওয়ার জন্য অন্য কেউ এগিয়ে আসবে। এইবার আমাদের লড়াই (রক্ষণশীল) সমাজের বিরুদ্ধে নয়, এইবারে লড়তে হবে সরকারের বিরুদ্ধে।”

অনুবাদ - চিলকা

Snigdha Sony

ਸਨਿਗਧਾ ਸੋਨੀ ਪਾਰੀ ਐਜੂਕੇਸ਼ਨ ਨਾਲ਼ ਇੰਟਰਮ (ਸਿਖਲਾਈ ਅਧੀਨ) ਹਨ ਅਤੇ ਦਿੱਲੀ ਯੂਨੀਵਰਸਿਟੀ ਤੋਂ ਪੱਤਰਕਾਰਤਾ ਦੀ ਬੈਚਲਰ ਡਿਗਰੀ ਦੀ ਪੜ੍ਹਾਈ ਕਰ ਰਹੀ ਹਨ।

Other stories by Snigdha Sony
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka