জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংগ্রহে যাঁর ওভির সংখ্যা সবচাইতে বেশি, তিনি পুণে জেলার দাপোডি গ্রামের সারুবাই কাদু। দুই খণ্ডে প্রকাশিত গল্পের এই প্রথম কিস্তিটিতে তি নি ১০টি দোহার মা ধ্যমে তুলে ধরেছেন হাতছাড়া হওয়া ছেলে, শত সোহাগ সত্ত্বেও পরের ঘরে চলে যাওয়া মেয়ে ও লম্পট স্বামীর কথা
"একে তো আজকাল আর কিছুই মনে পড়ে না, তার উপর এমনিতেও আমি গাইতে-টাইতে পারি না," জানালেন সারুবাই কাদু। মুখচোখ বাঁকিয়ে বারান্দার দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিলেন সত্তর পেরোনো মানুষটি, হাঁটুতে বেজায় ব্যথা, ক্রমাগত তাই আঙুল বুলোচ্ছিলেন। প্রথমটায় আশাহত হলেও কাকুতি-মিনতি করতে ছাড়িনি, ভাবলাম বারবার বললে যদি তিনি রাজি হন।
আমরা তখন পুণে শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে দৌন্ড তালুকে। জাঁতাপেষাইয়ের গানের সংগ্রহে যাঁর অবদান ৫,০০০ ওভিরও অধিক, সেই গায়িকার খোঁজেই এখানে এসেছিলাম জুলাই মাসে। একক পরিবেশক হিসেবে এত সংখ্যক গান আর কারোরই নেই, এরপরে যিনি রয়েছেন, তাঁর অবদান এর অর্ধেক। উপরন্তু এই ওভিগুলির সিংহভাগই সারুবাইয়ের নিজের লেখা।
সারুবাইয়ের গাওয়া ৫,০০০টি গান হাতে করে লিপিবদ্ধ করেছিল জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পের আদি দলটির সদস্যরা, এর জন্য ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ অবধি মুলশি তালুক ও পুণের একাধিক গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাঁরা বারবার দেখা করেছিলেন সারুবাইয়ের সঙ্গে। অচিরেই এই গানগুলি স্থান পায় মোট সংগৃহীত ১১০,০০০ ওভির মাঝে। আজ এই প্রকল্পটির দ্বায়িত্ব তুলে নিয়েছে পারি, গায়কবৃন্দের সঙ্গে মোলাকত করতে আবারও সেই গ্রামগুলোয় ফিরে যাচ্ছি আমরা, ছবি ও ভিডিওর দ্বারা সুদূরপ্রসারী হচ্ছে আমাদের প্রচেষ্টা। জুলাই মাসে, অর্থাৎ জাঁতাপেষাইয়ের আদি দলটি এখানে আসার প্রায় ২০ বছর পর আমরা সারুবাইয়ের কিছু গান ওডিও ও ভিডিওবদ্ধ করতে সক্ষম হলাম।
সারুবাই ছিলেন গরিব ডোঙ্গরি সংগঠনের সদস্য, এই দলটি মুলশি তালুকের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদের জন্য কাজ করে। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও এই দলটির হয়ে একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে একাধিক স্বশিক্ষামূলক কর্মশালায় অংশ নিতেন তিনি।
আদতে তিনি মুলশি তালুকের ওয়াডাভালি গ্রামের মানুষ, তবে মোসে নদীর উপর ১৯৯৪ সালে ওয়াসারগাঁও বাঁধটি বানানোর ফলে এই গ্রামটির সলিল সমাধি ঘটে। এই বাঁধ তথা জলাধার একটি জনপ্রিয় চড়ুইভাতির স্থান, সেই সঙ্গে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুণে নগরীর জন্য এটি জলের একটি উৎসও বটে। যে গ্রামবাসীরা ওয়াসারগাঁও জলাধারের হাতে ভিটেমাটি হারিয়েছিলেন, তাঁদের পুনর্বাসিত করা হয় মুলশি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে দৌন্ড তালুকে।
দাপোডি গ্রামে পৌঁছে দেখলাম, সরু একখান গলির মুখে এক মহিলা বসে আছেন মাটি দিয়ে ইঁট গাঁথা জরাজীর্ণ একটি চালার বাইরে। আদি জাঁতাপেষাইয়ের গানের দলটির সদস্য জিতেন্দ্র মেইদ ছিলেন সেদিন পারির দলটির সঙ্গে, তিনি জানালেন যে ওই মহিলার নাম সারুবাই কাদু। তা ওই মহিলা এবার পথ দেখিয়ে গলির ভিতর আরেকটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন আমাদের। সামনে ফটক ও খোলামেলা বারান্দা। "আমি এখানেই থাকি।" তাহলে অন্য একটা বাড়ির দুয়ারে ওমন বসেছিলেন কেন, এটা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। "ও, ওটা তো অন্য লোকের ঘর, আমি পাহারা দিচ্ছিলুম। কারণ যে মহিলা ওখানে থাকে, সে কি একটা কাজে বাইরে বেরিয়েছে।" বুঝিয়ে বললেন বটে, তবে কেমন যেন খটকা লাগল শুনে, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
যে ৫,০০০টি গান গেয়েছিলেন, সেগুলোর কথা মনে করালাম তাঁকে। কিন্তু তাঁর নাকি একটা ওভিও মনে নেই, জোর গলায় জানালেন। উপরন্তু মাসকয়েক আগে হাল্কা একটা পক্ষাঘাত হয়েছিল, তাই মুখের বাঁদিকটা একটু অসাড় হয়ে গেছে তাঁর, মোটেও উপর সুস্থ হয়ে উঠলেও গান গাইতে বড্ড কষ্ট হয়।
ঠিক তক্ষুনি তাঁর পড়শি তারাবাই মারগালেকে সেখান দিয়ে যেতে দেখে ডেকে নিলেন সারুবাই। তাঁর উপস্থিতিটা সত্যিই দরকার ছিল, নতুবা এই দশটা ওভি রেকর্ড করা আর হত না, এর মধ্যে বেশ কয়েকটা তো ওখানে বসে বসেই বেঁধে ফেলেছিলেন সারুবাই, এক্কেবারে টাটকা আনকোরা গান।
এক ছেলে তার মা-কে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সারুবাই তাঁর দোহার মাধ্যমে তাকে আগন্তুক হয়ে উঠতে বারণ করলেন। এরপরের চারটি ওভি এক কন্যাসন্তানকে ঘিরে, যেখানে তিনি বলছেন: "সাতরাজা ধন সোহাগ দিতে বাধ্য রে আর করিসনে...যাইবি তো সেই শ্বশুরবাড়ি, নাড়ির টানে বাঁধিসনে।" আদুরে সে মেয়ে তার বাপের কাছে এটাসেটা কিনে দেওয়ার বায়না ধরে। তখন তার মায়ের হয়ে সারুবাই গেয়ে ওঠেন: "মাইয়া আমার, ময়না আমার, আদর করা আমার কাজ...ঝুমকো দুলে মুক্তা ঢেলে সাতরাজা তোর রূপের সাঁঝ।" এর ঠিক পরের দোহাটিতে সে মেয়ে তার বাবার হাত ধরে জেদ ধরেছে, তাকে একখানা রুপোর কাঁকন কিনে দিতেই হবে।
এর পরের তিনটি ওভি পুরুষের লাম্পট্য ঘিরে। সারুবাই বলছেন: আমরা মুখ্যুসুখ্যু নারী, আমরা জল নিয়ে ঝগড়া করি, ওদিক বর বাবাজির মোরগপানা হালচাল, পরস্ত্রীর দুয়ারে মাথা কুটে মরে লালসায়। জীবনযুদ্ধে সহায় যে স্ত্রী, লোহার তাওয়ায় সেঁকে নেওয়া টাটকা পোলির (হাতরুটি) মতো নরম স্বভাবের যে স্ত্রী, তাকে উপেক্ষা করে অন্য এক নারীর তরে পকেটে ব্লাউজ গুঁজে রওনা দেয় মাথামোটা বর – এ দৃশ্যে ফুটে ওঠে গুপ্তপ্রেমের লালসা। স্বামীর তৃষ্ণা মেটায় তার সহধর্মিনী, যেন সুমিষ্ট জলে ভরা মাটির কুঁজো, অথচ চোখমুখ ভেংচে তাকিয়ে থাকে বর বাবাজি, মনে মনে পরস্ত্রীর প্রতি তীব্র প্রণয়।
শেষ দুটি দোহায় বর্ণিত রয়েছে পুত্রসন্তানের বিয়ে, বিশেষ করে গায়ে-হলুদের কথা। দেহমন পবিত্র করে তুলতে তার স্নানের জলে মেশানো হয়েছে নিমপাতা, গায়ের হলুদ ধুয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, হরিদ্রাভ সে জল যেন বন্যা হয়ে বইছে বিয়ের মণ্ডপের বাইরে। আঙুল থেকে হাতের তালু হলুদে মাখামাখি, মা তাঁর ছেলেকে জানাচ্ছেন সে কথা। একইসঙ্গে আশীর্বাদ করছেন, ছেলে যাতে দীর্ঘায়ু লাভ করে।
গানের পালা মিটতে না মিটতেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লেন তারাবাই, আগাছা নিড়োতে খেত-খামারে যেতে হবে তাঁকে। গায়ক হিসেবে হয়ত জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পে তাঁর নাম নেই, তবে সারুবাই যে শেষমেশ তাঁর আড়ষ্টতা কাটিয়ে দোহাগুলি গাইলেন, সেটা তারাবাই না থাকলে সম্ভব হত না। গানের মাঝে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে রক্তমাংসের জীবন – কথাটা এই দুজনের ক্ষেত্রে সমানভাবে খাটে। সন্তানের প্রতি স্নেহ, গুপ্তপ্রেমে লিপ্ত স্বামী, বৃদ্ধ বয়সে সহায় না জোটা সত্ত্বেও পুত্রকে আশীর্বাদ করে যাওয়া। তারাবাইকে ছেড়ে দ্বিতীয়পক্ষের বউ নিয়ে ঘর বেঁধেছেন তাঁর স্বামী। আজ দুই বছর হতে চলল স্বামীহারা সারুবাইও। চারটি পুত্র ছিল তাঁর, যাঁদের মধ্যে আজ দুই ছেলে জীবিত।
আড্ডার মাঝে এসে পড়লেন সারুবাইয়ের ছেলে দিলীপ, অতিথিদের কথা শুনে তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে এসেছেন তিনি। দিলীপের কাছে জানা গেল: ওয়াডাভালিতে যতটা জমিজমা ছিল তাঁদের, সরকার প্রদত্ত পুনর্বাসনে তার সমপরিমাণ তো মেলেইনি, উপরন্তু যেটা পেয়েছেন সেটাও বেশ ঊষর। এককাঁড়ি পয়সা খসিয়ে এ মাটি চাষযোগ্য করে তুলেছে তাঁর পরিবার, সেই সঙ্গে ছিল হাড়ভাঙা খাটুনি। চাষের পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি, এছাড়া একটি মুদিখানাও রয়েছে যেটা স্ত্রীর সঙ্গে চালান। "পেটের ভাত জোগাতে সে নানান কাজ করতে হয় আমাদের," বলে উঠলেন দিলীপ।
তবে আসল কথাটা জানা গেল দিলীপ চলে যাওয়া পর, সারুবাই বললেন: এই তো কয়েক সপ্তাহ আগেই বাড়িতে বিশাল ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, তারপর থেকে ছেলের বাড়িতে আর ঠাঁই জোটে না তাঁর। গ্রামে ঢোকার মুখে যে কুঁড়েঘরটিতে বসে থাকতে দেখেছিলাম তাঁকে, ওখানেই আপাতত মাথা গুঁজেছেন সারুবাই। এটাই তাঁর বৃদ্ধবেলার আশ্রয়। সেই ঘরে যাওয়ার পর আরও অনেকগুলি গান শুনিয়েছিলেন তিনি। সেগুলি প্রকাশিত হবে জাঁতাপেষাইয়ের গানের প্রকল্পের এই কিস্তিটির দ্বিতীয় খণ্ডে।
খোকা রে আমার গেলি
পড়শি সে গাঁয়, আয় রে মায়ের কাছে আয় ফিরে আয়,
অভাব জীবনভর যা যা আছে
তোর, পড়শি ব্যাটার কাছে বলিসনে হায়।
সাতরাজা ধন সোহাগ দিতে
বাধ্য রে আর করিসনে
যাইবি তো সেই
শ্বশুরবাড়ি, নাড়ির টানে বাঁধিসনে।
বাপের কাছে বায়না ধরে
মাইয়া সে তার বড্ড ঝোঁক,
বলছি রে সই, চুলের
কিলিপ একটা না হয় দশটা হোক।
মাইয়া আমার, ময়না
আমার, আদর করা আমার কাজ,
ঝুমকো দুলে মুক্তা
ঢেলে সাতরাজা তোর রূপের সাঁঝ।
ময়না আমার, গুড়িয়া
আমার, বাপের আঙুল পাকড়েছে,
দ্যাখ্ দেখি সই, হাতের
মুঠোয় রুপোর কাঁকন চাইছে সে।
মুখ্যু গাঁয়ের সুখ্যু
নারী, জল নিয়ে ক্যান লড়েই মরি? ভাঙল সুখের ঘর...
পড়শি বিবির চৌকাঠে
হায়, মোরগপানা পেখম নাচায় মুখপোড়া মোর বর।
ধুনকি তাওয়ায় ফুলকি
রুটি বউখানা তোর খুঁটছে ঘাস,
ডান পকেটে ব্লাউজ
গুঁজে পড়শি বালার ঘরকে যাস?
গোলচে কলসপানা সোহাগি চাঁদের কণা বউ তোর
যেন,
পড়শি বিটির তরে
কাঁচুমাঁচু মুখ করে যাস তবে কেন?
মণ্ডপে কার বিয়ের
গানে বানভাসি ওই হলুদ জানে
বর হবে মোর খোকনসোনা, নিমপাতা জল অঙ্গে তার।
মণ্ডপে কার বিয়ের
গানে একমুঠি মোর হলুদ জানে
বর হবি তুই খোকনসোনা,
সাতরাজা ধন জীবন তোর।
পরিবেশক/গায়ক : সারুবাই কাদু
গ্রাম : দাপোডি
তালুক : দৌন্ড
জেলা : পুণে
জাতি : মারাঠা
বয়েস : ৭০
সন্তান : ৪ ছেলে (২জন জীবিত)
পেশা : চাষি, খেতমজুর
তারিখ: গানের কথাগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালের মাঝে। পরবর্তীকালে, ২০১৭ সালের ২৪শে জুলাই এই গানগুলি রেকর্ড করা হয় অডিও ও ভিডিও মাধ্যমে।
পোস্টার: শ্রেয়া কাত্যায়নী
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)