ধারাভাষ্যের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছেন তিনি – কুস্তি প্রতিযোগিতায় তাঁর ধারাবিবরণী একটানা দশ বারো ঘণ্টা পার করে যাওয়াটা খুব সাধারণ ব্যাপার। রেডিও বা টিভিতে নয়, তাঁর পছন্দ জনতার নিজস্ব চোঙা মাইকে। বর্তমানে কুস্তির ধারাভাষ্যের ক্ষেত্রে যে রীতিটি প্রচলিত, সেই ঘরানার প্রবর্তক শঙ্কররাও পূজারী। তাঁকে নিয়ে আসার জন্য মহারাষ্ট্রের কুস্তি প্রতিযোগিতার দিনক্ষণ অবধি পালটে ফেলা হয়। দর্শকদের সঙ্গে স্রেফ কথা না বলে তিনি তাঁদের বরং কুস্তির আঙিনায় টেনে আনেন।
“শঙ্কর পূজারী আর তাঁর ধারাভাষ্যের ঘরানা – দুটি মিলে পড়ন্ত সময়ের চক্র থেকে কুস্তিকে বের করে এনে তাতে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছে,” সাঙ্গলি জেলার বেনাপুর গ্রামের প্রাক্তন বিখ্যাত কুস্তিগির এবং এখন কুস্তি প্রশিক্ষক রাজেন্দ্র শিণ্ডে বলছিলেন। পূজারীর ধারাভাষ্যের প্রাঞ্জল, শিক্ষামূলক ধারা কুস্তি প্রতিযোগিতায় অনেক বেশি মানুষকে টেনে আনতে শুরু করে। “আর তার ফলে কুস্তি পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। মানুষ জন্মদিনের জন্যেও কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে শুরু করে। আরও বেশি, আরও বড়ো করে প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু হয়।”
অভিনব বটে, এই ধারাভাষ্য শুধু কুস্তির ময়দানে উপস্থিত দর্শকের জন্যেই। তাই বড়ো বড়ো ময়দান জুড়ে একাধিক মাইক লাগিয়ে ধারাভাষ্যের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু তাহলে রেডিওতেই বা নয় কেন? কোলাপুর জেলার কোঠালি গ্রামে নিজের বাড়িতে বসে পূজারী বলছেন, “ও বেশ কঠিন কাজ। আমরা যেভাবে কথা বলি, আমাদের গোটা ব্যবস্থাপনা রেডিওর নিরিখে বানানো নয়। বিশেষত গ্রাম স্তরে। ধরুন, স্থানীয় কোনও বড়ো মাথা হাজির হলে আমরা ধারাভাষ্য থামিয়ে তাঁদের আগমনের কথা মাইকে ঘোষণা করে দিই।” এই হোমড়াচোমড়া কোনও বিখ্যাত প্রাক্তন কুস্তিগির হতে পারেন, বা কোনও স্থানীয় বিধায়কও। “আর তা ছাড়াও গোটা ব্যাপারটা বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে।”
ওয়ারাননগরে পূজারী একবার বিশাল সংখ্যায় দর্শককে টানা বারো ঘণ্টা মাঠে ধরে রেখেছিলেন। এ নিয়ে তাঁর নিজের খানিক গর্বও আছে বৈকি। পাকিস্তান থেকে কুস্তিগিররা আসতে দেরি করায় মানুষজন অস্থির হয়ে পড়তে শুরু করে। পূজারী তখন তাঁর ধারাভাষ্য দিয়ে দর্শকদের ধরে রাখতে এগিয়ে আসেন। পূজারীর কথাবার্তা যৌক্তিক, তথ্যনিষ্ঠ, কুস্তির ইতিহাস, সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর জ্ঞান অগাধ। তিনি নিজেও কুস্তিগির ছিলেন, কুস্তির নানা মারপ্যাঁচ ধরে ফেলতে তাঁর জুড়ি নেই। “আমি আট বছর বয়সে কুস্তি শুরু করি। কিন্তু ১৯৭২ সালে, যেবার বিশাল খরা হয়ে চাষাবাদে চরম দুর্দশা নেমে আসে, তখনই কুস্তি ছেড়ে দিই। কৃষিতে সংকট দেখা দিলে কুস্তিও সমস্যায় পড়ে।”
আমাদের সামনেই দুই মিনিটের একটা সংক্ষিপ্ত নমুনা দিয়ে পূজারী কুস্তির ধারাভাষ্যকে প্রাণবন্ত করে তুললেন। আদতে তাঁর গলাটাই স্বভাবজাত ঘোষকের। “আমার গুরু বাপুসাহেব রাদের কাছে আমি প্রথম ধারাভাষ্য শিখি।” কিন্তু তারপরে বলার ধরন আর বিষয় দুটোতেই রদবদল ঘটান। তাঁর নিজস্ব ধারাভাষ্যের রীতি কেমন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে গিয়ে পূজারী জানালেন, “বলার ধরন হবে এমন যাতে দর্শক বুঝতে পারেন কুস্তির মূল বিষয়টা কী। শুধু তথ্য দিলে চলবে না, দর্শককে জানাতে হবে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি আর ইতিহাসে কুস্তির জায়গা কোথায়। আবার খেলার মারপ্যাঁচ, পাঁয়তারা, নানা কৌশল সম্পর্কেও দর্শককে বলতে হবে।”
পাশাপাশি কুস্তিগিরদের প্রতিও ধারাভাষ্যকারের দায়িত্ব আছে। “দেখতে হবে তারা যাতে নিজেদের শক্তির অপব্যবহার না করে। এত শক্তি যাদের, বড়োলোকরা যদি টাকা দিয়ে তাদের সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তাহলে খুব বিপদ। সুতরাং কুস্তিগিরদের মধ্যে ন্যায়ের প্রতি নিষ্ঠা, সৌজন্যবোধ, অন্যের প্রতি সম্মানবোধ যাতে থাকে সেই মর্মে চেষ্টা করা জরুরি।” পূজারী তাই গামা পালোয়ানের মতো কিংবদন্তীদের গল্পে জোর দেন।
পূজারী ধারাভাষ্য শুরু করেন ১৯৮৫ সালে। “ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে আমার এই চিন্তাটা মাথায় খেলে যায়। কুস্তির প্রতিযোগিতা দেখতে যে বিশাল সংখ্যক লোক আসে, বা অন্তত আসত, তাদের জন্য ধারাভাষ্যের ব্যবস্থা করে কুস্তিকে আরও জনপ্রিয় করলে কেমন হয়? কথা বলতে বলতে দর্শকদের মধ্যে কুস্তি ক্রীড়ার নানান সূক্ষ্ম দিক, শৃঙ্খলা, মারপ্যাঁচ, ইতিহাস জানালে কেমন হয়? তাহলে কুস্তি নিয়ে জানতে আরও বেশি বেশি লোক ময়দানে আসবে। কমবয়সি ছেলেপিলেরা কুস্তি করতে অনুপ্রাণিত হবে।”
১৯৮৫ সালে “বিনামূল্যে নিজের প্রথম ধারাভাষ্যটি দেওয়ার পর,” আজ তিনি প্রতি বছর কমবেশি দেড়শটা প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকেন। “শুধু ধারাভাষ্য দিয়েই আমি দিন গুজরান করতে পারি।” তাঁর জীবনের “প্রথম বিরাট প্রতিযোগিতাটি ২০০০ সালে সাঙ্গলিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।”
গতবছর জলসংকটের সময় যখন একের পর এক কুস্তি প্রতিযোগিতা বন্ধ হতে শুরু করে, পূজারী তখন রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন: “আপনারা গবাদি পশু বাঁচাতে তাদের খাবারের বন্দোবস্ত করেছেন, খুব ভালো কথা। আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার পাশাপাশি আপনারা কুস্তির পালোয়ানদের বাঁচানোর জন্যেও কিছু শিবিরের বন্দোবস্ত করতে পারেন, খানিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারেন তো? চাষাবাদ আর বৃষ্টির জলের সঙ্গে তো তাদের জীবন জীবিকাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।”
এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয়: http://psainath.org/kushtis-voice-of-social-commentary/
অনুবাদ: শাশ্বত গাঙ্গুলী