“যত আমরা কিনছি, ততই আমরা ধারে ডুবে যাচ্ছি।” কুনারি শবরী, চল্লিশের কোঠায় বয়স, একজন কৃষক, তাঁর নিজের সাওরা আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রাম খাইরায় দাঁড়িয়ে আমাদের বলছিলেন তিনি।
“ গোবরখাটাচাষ, হালহাষ (গোবর এবং লাঙল দিয়ে চাষ), যেগুলি আমাদের ছিল, সেগুলি এখন আর কেউ করে না”– বলেন তিনি। “এখন আমরা সবকিছুর জন্যই বাজারে দৌড়ই। বীজ, কীটনাশক, সার। এমনকি এখন আমরা যা খাই, তাও কিনতে হয়। আগে এটা ছিল না।”
উড়িষ্যার বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদনশীল রায়গড়া জেলা জুড়ে যেভাবে তুলো চাষ শিকড় ছড়াচ্ছে, এবং এই এলাকার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র, কৃষকদের সংকট এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব ফেলছে (দেখুন উড়িষ্যায় বোনা হচ্ছে জলবায়ু সংকটের বীজ ), তারই প্রতিফলন কুনারির কথায়। যতই আমরা দক্ষিণ-পূর্বে রায়াগড়ার গুনুপুর ব্লকের সমতলে নামছি, যেখানে প্রথম তুলো এসেছিল, বিষয়টা পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করল। অন্ধ্রপ্রদেশের সীমানায়, এখানকার এই এলাকার খেতগুলিতে শুধুমাত্র তুলোরই চাষ চলে, যতদূর চোখ যায়। আর একটা জিনিস গোচর হল - গভীর সংকট।
“আমরা ১০-১২ বছর আগে তুলোর দিকে মন দিয়েছি। আমরা এখনও তুলো চাষ করি, কারণ আমাদের আর কোনও উপায় নেই।”– গুনুপুর ব্লকের খাইরা গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ আমাদের এই কথাই বলেছেন। বহু কৃষক জানিয়েছেন, তাঁরা যত পুঁজি-নিবিড় তুলো চাষের দিকে ঝুঁকেছেন, ততই তাঁরা নিজেদের শস্য এবং নানাবিধ শস্য ফলানোর চিরাচরিত পদ্ধতিটিকে হারিয়ে ফেলেছেন।
“আমাদের নিজেদের শস্য ছিল, নিজেদের চাষ ছিল”– আক্ষেপ সাওরা কৃষক ক্ষেত্র শবরের - “অন্ধ্র ওয়ালারা এল আর আমাদের বলল তুলো চাষ করতে, আর আমাদের সব শিখিয়ে দিয়ে গেল।” সন্তোষকুমার দণ্ডসেনা, এখানকার আর একজন স্থানীয় চাষির সংযোজন, লাভের সম্ভাবনা গ্রামবাসীদের কাপ্পা বা তুলোর দিকে টেনে এনেছে। “প্রাথমিকভাবে এটা ভালোই ছিল, আমরা টাকা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন, এটা শুধু ঝামেলা আর লোকসানের ব্যাপার”, তিনি বলেন। “আমরা শেষ হয়ে গেছি আর সাহুকাররা (মহাজনরা) এখন খুশি।”
আমরা যখন কথা বলছি তখন ঘন সবুজ জন ডিয়ার ট্রাক্টরগুলি গ্রামের রাস্তায় শব্দ করে যাচ্ছে আসছে। স্থানীয় মন্দিরের দেওয়ালগুলি বীজ কোম্পানির পোস্টারে ভর্তি, ওড়িয়ায় বিটি তুলোর বিজ্ঞাপন তাতে। সেগুলি বোনার এবং চাষের যন্ত্রপাতি গ্রামের আম চত্বরে শোয়ানো রয়েছে।
“বেশির ভাগ তুলো চাষি ঋণে ডুবে আছেন, কারণ বীজ এবং চাষের আনুষঙ্গিক খরচ বাড়ছে এবং উৎপন্ন ফসলের দাম ওঠানামা করে; এবং দালালরা সব লাভ নিয়ে চলে যায়”, অঞ্চলে কর্মরত একজন সংরক্ষণকর্মী দেবল দেবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী - “রায়গড়ায় বহু চাষি বাজারের দামের মাত্র ২০ শতাংশ পান (তাঁদের উৎপাদিত ফসলের জন্য)।”
এত ক্ষতি সত্ত্বেও তুলো চাষ চালিয়ে যাওয়ারই বা কী দরকার? “আমরা সাহুকারদের কাছে দেনার জালে আটকে আছি”, বক্তব্য শবরের। “আমরা তুলো চাষ না করলে সেও আমাদের আর ধার দেবে না।” দণ্ডসেনার বক্তব্য, “ধরুন আমি যদি ধান চাষ করতে চাই, কোনও ঋণ পাব না। শুধু তুলো।”
দেবল দেবের সহকর্মী দেবদুলাল ভট্টাচার্য বলেন, “চাষিরা যে ফসল ফলাচ্ছে, সেটা তারা ভালো বোঝেই না। তারা প্রতিটি পদে বাজারের উপর নির্ভরশীল... বীজ বোনা থেকে চাষ করা, এবং তারা কোনও সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না (অথচ)... তারা জমির মালিক। তাদের আমরা কী বলব, চাষি, নাকি নিজেদের জমিতেই কাজ করা মজুর?”
দেবল দেব ও তাঁর সহকর্মী জানান, তুলো চাষের এই প্রসারেরর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব হল, স্থানীয় জীববৈচিত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার জনগোষ্ঠী, যাঁরা এটার মধ্যে কাজ করেন, এটিকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁদের জ্ঞানও নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং পরিবেশ বৈচিত্রে ভরপুর একটা জায়গাকে রক্ষা করতে না পারা। আবহাওয়ার সংক্রান্ত চূড়ান্ত বিপর্যয় এবং ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তাকে হার মানাতে সক্ষম এমন জলবায়ু-সহনশীল চাষের ব্যাপারে তাঁরা দুজনেই সন্দিগ্ধ।
দেব বলেন, “জলবায়ু বিবর্তন স্থানীয় আবহাওয়ায় অদ্ভুত, ব্যাখ্যাতীত কিছু পরিবর্তন এনেছে। উড়িষ্যার কৃষকরা এর মধ্যেই দীর্ঘ খরা, অসময়ের বৃষ্টি এবং বারবার ঘটতে থাকা খরার (যা এখনও চলছে) সম্মুখীন হচ্ছেন।” তুলো এবং আধুনিক নানা ধরনের ধান ও সবজি পুরনো শস্যবৈচিত্রের জায়গা নিচ্ছে। কিন্তু “এগুলি কোনোভাবেই স্থানীয় পরিবেশের আকস্মিক পরিবর্তন সহ্য করতে পারবে না। তার অর্থ ফসলি গাছের অস্তিত্ব, পরাগ সংযোগ, উৎপাদনশীলতা এবং সব শেষে খাদ্য নিরাপত্তা ঘিরে ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা।”
এলাকার বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত তথ্য এবং কৃষকদের বক্তব্য, সকলই আবহাওয়ার ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার দিকেই অঙ্গুলিনির্দশ করছে। ২০১৪-১৮ পর্যন্ত, জেলায় গড়ে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৩৮৫ মিমি। সেটা ১৯৯৬-২০০০ - এই পাঁচ বছরের গড় ১০৩৪ মিমির থেকে ৩৪ শতাংশ বেশি (ভারত আবহাওয়া বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তথ্য দেখুন)। এছাড়াও, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, ভুবনেশ্বরের গবেষকদের করা ২০১৯ সালের একটি রিপোর্টেও দেখা গেছে- “উড়িষ্যায় ভারি থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং শুকনো দিনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, এবং একই সঙ্গে কমছে অল্প থেকে সাধারণ বৃষ্টিপাত ও আর্দ্র দিনগুলির সংখ্যা।”
“গত তিন বছরে... বর্ষা এসেছিল দেরিতে”, পাশের কোরাপুট জেলার একজন কৃষক এবং সমাজকর্মী শরণ্য নায়েক বললেন আমাদের। তাঁর কথায়, “মরশুমের প্রথম পর্যায়ে কম বৃষ্টি হয়েছে, মধ্য পর্যায়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে, তারপর ভারি বৃষ্টি হয়েছে”, মরশুমের শেষ দিকে। এর অর্থ, বীজ বুনতে দেরি হবে, অতিরিক্ত বৃষ্টি মানে মরশুমের মাঝখানে কোনও রোদ নেই, এবং শেষের দিকে ভারি বৃষ্টি মানে চাষের ক্ষতি।
এলাকার একটি বেসরকারি সংস্থা, যেটি এলাকার খাদ্য ও কৃষি নিয়ে কাজ করে, সেখানকার দেবজিত সারঙ্গী বলেন, “এই এলাকায় আগে জুনের মাঝখান থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষা থাকত। গত কয়েক বছরে সেটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে।” সারঙ্গী এবং নায়েক - দুজনেরই বক্তব্য, উড়িষ্যার বহু ফসলের ধারা, বিশেষ করে দেশজ শস্যের চাষ আবহাওয়ার এমন আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে তুলোর চেয়ে অনেক বেশি জুঝতে পারত। সারঙ্গীর কথায়, “আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, যে চাষিরা বহুফসলি চাষে অভ্যস্ত, তাঁরা এমন অনিশ্চিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেশি পারেন। যে চাষিরা শুধুমাত্র বিটি তুলোর চাষ করেছেন, এবং সেটার মাধ্যমেই বাজারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা টাইম-বোমার উপর বসে আছেন।”
*****
নতুন ধারার চাষের দিকে ঝুঁকলেও, শুধুমাত্র বিটি কটনের একমাত্রিক চাষের কারণে খাদ্যনিরাপত্তা ও চাষের স্বয়ংসম্পূর্ণতা যে বিপন্ন, তা আঁচ করতে পারছেন বহু চাষিই। তবে, অনেকেই, বিশেষ করে মহিলারা, চাপ দিচ্ছেন, যাতে তাঁরা তাঁদের পুরনো চাষ ছেড়ে না দেন। নিয়মগিরির সামনে কেরান্দিগুড়া গ্রামে, কুনুজি কুলুসিকা নামে এক কোন্ধ আদিবাসী মহিলার দেখা পেয়েছিলাম আমরা, তিনি তাঁর ছেলে সুরেন্দ্রকে এ বছর তুলো চাষ করতে নিষেধ করছিলেন।
পাহাড়ের কোলে এক টুকরো জমিতে ঝুমচাষে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। খালি পা, কঠোর পরিশ্রমী। তাঁর পরনে ছিল হাঁটু অবধি শাড়ি, গায়ে কোনও ব্লাউজ ছিল না, চুল পিছন দিকে আঁট করে বাঁধা। সরকারি, বা বেসরকারি সংস্থা বা বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর বিজ্ঞাপনে আদিবাসী মহিলাদের ‘পশ্চাদপদতা’ থেকে টেনে তোলার শপথ নেওয়ার বিজ্ঞাপনগুলিতে, তাঁদের যেমন চেহারা দেখানো হয়, ঠিক তেমনই দেখতে লাগছিল তাঁকে। কিন্তু তবুও দেবের ইঙ্গিত, কুনুজির মতো মানুষদের দক্ষতা এবং পরিণত জ্ঞান নষ্ট হয়ে গেলে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা পৃথিবীর জন্য তা খুবই বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তুলোর চাষে উৎসাহের ব্যাপারে তাঁর আশঙ্কা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কুনুজি বলেন, ‘যদি আমরা বছরখানেকের জন্যও আমাদের (নিজেদের) শস্য ফলানো ছেড়ে দিই, তাহলে আমরা বীজ পাব কোথা থেকে? সেক্ষেত্রে বীজ হারানোর ভয় থাকবে। যেখানে আমরা মক্কা (ভুট্টা) চাষ করি গতবছর, সুরেন্দ্র কিছুটা তুলো চাষ করেছিল। এভাবেই চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কোনও ভুট্টার বীজই থাকবে না।”
তুলোর চাষে উৎসাহের ব্যাপারে তাঁর আশঙ্কা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কুনুজি বলেন, ‘ যদি আমরা বছরখানেকের জন্যও আমাদের (নিজেদের) শস্য ফলানো ছেড়ে দিই, তাহলে আমরা বীজ পাব কোথা থেকে ? সেক্ষেত্রে বীজ হারানোর ভয় থাকবে ’
আমরা যখন তাঁদের বংশ পরম্পরায় সংগৃহীত বীজগুলির কথা তাঁকে বলছিলাম, তখন দৃশ্যতই খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন কুনুজি। দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেন তিনি, আর হাজির হলেন তাঁর পরিবারের সংগ্রহে রাখা নানা ধরনের শস্য নিয়ে। সেগুলি সবই তিনি বেতের বাক্সে, প্লাস্টিকের জারে বা কাপড়ের ব্যাগে যত্ন করে রেখেছিলেন। প্রথম: দুধরনের অড়হর ডালের বীজ, “যেগুলি জমির ঝোঁক অনুযায়ী বোনা হবে।” পরে: উঁচু জমির ধান, সর্ষে, মুগ , বিরি বা কলাই এবং দুই ধরনের বিন। তারপরে: দুই ধরনের বাজরা, ভুট্টা এবং রামতিল বীজ। শেষে: একটা বস্তা ভর্তি সিয়ালি বীজ (এক ধরনের বনজ খাদ্য)। বললেন, “খুব বৃষ্টি পড়লে যখন আমরা ঘরবন্দি হয়ে পড়ি, তখন এই বীজগুলো সেঁকে খাই।” আমাদের জন্যও এক মুঠো বীজ সেঁকে দিলেন তিনি।
লিভিং ফার্মের প্রদীপ পাত্র বলেন, “এখানকার কোন্ধ এবং অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের কৃষি-বাস্তুতন্ত্র সংক্রান্ত জ্ঞান এতই সূক্ষ্ম যে এই পরিবারগুলি একটা জায়গাতেই বছরে ৭০-৮০ রকম ফসল ফলাতে পারত - খাদ্যশস্য, ডাল, কন্দ, বাজরা এমন নানা কিছু। এখনও কিছু কিছু জায়গায় এ সবের চল আছে, কিন্তু গত ২০ বছরে তুলোর প্রসার এই বীজবৈচিত্রের জন্য যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা প্রমাণিত।”
রাসায়নিকের প্রভাব নিয়েও আশঙ্কায় কুনুজি। অথচ তুলো চাষের জন্য সেটা অপরিহার্য, যদিও পুরনো শস্য চাষের জন্য আদিবাসী পরিবারগুলি প্রায় কখনওই এটা ব্যবহার করেনি। কুনুজি বলেন, “ওই কীটনাশক, সার - সুরেন্দ্র সব কিছু তুলো গাছে ঢালবে। তাতে আমাদের মাটিটা নষ্ট হয়ে যাবে না? মাটির ভিতরে থাকা সব কিছু মরে যাবে না? আমি নিজের চোখে আমার পাশের জমিতে এটা হতে দেখেছি - যখন ওরা আবার মান্দিয়া (বাজরা) চাষ করতে শুরু করল, ভালো হয়নি, ভালো করে বেড়েই ওঠেনি।”
ভেষজনাশক-সহিষ্ণু তুলো বীজ ভারতে অনুমোদিত নয়, কিন্তু রায়গড়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে গ্লাইফোসেটের মতো রাসায়নিক যা সম্ভবত “ ক্যানসার-প্রবণ ” একটি ভেষজনাশক। দেবল দেব বলেন, “নিয়মিত এই ভেষজনাশক ব্যবহার করার ফলে জমির গাছগাছালি, নানান ঝোপঝাড়, ঘাস জাতীয় বিভিন্ন উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে প্রজাপতি ও মথের সংখ্যাও কমছে, কারণ সেগুলি অফসলি উদ্ভিদের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।”
“এই এলাকার (এবং এখানকার জীববৈচিত্র) বাস্তুতান্ত্রিক জ্ঞান খুব উল্লেখযোগ্যভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। চাষিরা আরও বেশি বেশি সংখ্যায় তাঁদের বহু ফসলি চাষ ও কৃষি-বন সৃজনের ধারা ছেড়ে একফসলি চাষের দিকে ঝুঁকছেন, যার জন্য প্রয়োজন বহু পরিমাণে কীটনাশক। তুলো চাষিরাও ভেষজনাশক ব্যবহার করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই... জানেন না, কোন পতঙ্গটি ক্ষতিকারক কীট আর কোনটা নয়। ফলে কীটনাশক ছড়িয়ে তাঁরা সব কীটপতঙ্গকেই নষ্ট করে ফেলছেন।”
শরণ্য নায়ক বলেন, “তুলোয় ঝোঁকার পর প্রতিটি কীটপতঙ্গ, পাখি, পশুকে একই চোখে দেখা হয় - শস্যের শত্রু হিসেবে। ফলে এটা যথেচ্ছ হারে কৃষি-রাসায়নিক ব্যবহারের পক্ষে উপযুক্ততম।”
কুনুজি মেনে নেন, লোকে তুলোর খারাপ প্রভাবটা বোঝা সত্ত্বেও এর দিকে ঝুঁকছে। হাতদুটো ছড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “একবারে অনেক টাকা করার সুযোগ হিসেবে ওরা এটাকে দেখে। আর সেই প্রলোভনেই ওরা পা দিচ্ছে।”
পাত্র বলেন, “বীজ-ভাগ করে নেওয়া, বিনিময় করা, গবাদি পশুর সংস্থান এবং চাষের জন্য পরিশ্রমের সামাজিক রীতিগুলি” সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তুলো এসে পুরনো শস্যকে সরিয়ে দেওয়ায়। তাঁর কথায়, “এখন চাষিরা মহাজন আর ব্যবসায়ীদের মুখাপেক্ষী।”
জেলার এক কৃষি আধিকারিক (যিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি) পাত্রের কথার সঙ্গে সহমত। তিনি স্বীকার করেন, ১৯৯০-এর দশকে এখানকার গ্রামগুলিতে এই রাজ্য তুলোর চাষটা শুরু করে, এবং তা যাতে বেশি করে চাষ করা হয়, তার বন্দোবস্ত করে। প্রতিবেশী রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও বেসরকারি বীজ এবং কৃষি-রাসায়নিক কেনার জন্য চাপ দেওয়া শুরু হয়। সরকার চিন্তিত হলেও আধিকারিক স্বীকার করে নিয়েছেন, এই বেআইনি ও কৃত্রিম বীজ ও কৃষি-রাসায়নিকের ব্যবহার আটকাতে সরকারের তরফে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁর কথায় “তুলো এখন মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তবু টাকার টোপ অনেক বেশি শক্তিশালী, বিশেষত তরুণ কৃষকদের জন্য। সন্তানদের জন্য ইংরেজি শিক্ষার আশা, তার সঙ্গে স্মার্টফোন, মোটরবাইক - এইগুলি পাওয়ার তাড়না, এবং বাবা-মায়ের চাষপদ্ধতি নিয়ে বিরক্তির ফলে তুলোর ব্যাপারে ঝুঁকি নিতেও তাদের আপত্তি নেই। যদি এক বছর বাজার খারাপ থাকে, পরের বছর ভালো হতেও পারে।
যাই হোক না কেন, বাস্তুতন্ত্র কিন্তু অতটাও ক্ষমাশীল নয়।
দেবল দেব বলেন, “এখানে ক্রমশই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রকোপ বাড়ছে। যা এখনও অপ্রকাশিত সত্য। স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এবং কিডনির সমস্যা বেশ বেশি। আমার সন্দেহ, এগুলি সবই অর্গ্যানফসফেট কীটনাশক এবং ভেষজনাশক গ্লাইফোসেটের সরাসরি প্রভাব, যা এই জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।”
৫৪ বছরের ড. জন উম্মেন বিষমকটক ক্রিশ্চান হসপিটালের চিকিৎসক। তাঁর মতে, ঠিকঠাক তদন্তের অভাবে এমন কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। তাঁর কথায়, “রাজ্যের এখনও মূল লক্ষ্য ম্যালেরিয়ার মতো ছোঁয়াচে রোগ। কিন্তু আমরা দেখছি, আদিবাসীদের মধ্যে দ্রুতহারে হৃদরোগ এবং কিডনির অসুখ ছড়াচ্ছে... বস্তুত দীর্ঘস্থায়ী কিডনির অসুখ এবং তার সংখ্যাও খুব বেশি।”
তিনি এটাও জানান, “এলাকার সব বেসরকারি হাসপাতাল ডায়ালিসিস সেন্টার চালু করে দিয়েছে, এবং এটা খুব ভালো ব্যাবসাও। আমাদের এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে হবে - এই হারে কিডনি নষ্ট হওয়ার কারণটা কী?” তাঁর উদ্বেগ, যে জনগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে নিজেদের রক্ষা করে, বাঁচিয়ে চলেছে, এই পরিবর্তনের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য কোনও প্রস্তুতি না থাকায় তারা পিষে মরছে।
*****
ওই সপ্তাহেই নিয়মগিরি পাহাড়ের দিকে যেতে, এক উষ্ণ সকালে আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওবি নাগের। তিনি এক মধ্যবয়স্ক কোন্ধ-আদিবাসী কৃষক, তাঁর জমির দিকে যাচ্ছিলেন, হাতে ছিল এক ধাতব পাত্র এবং তরলীকৃত গ্লাইফোসেট - গ্লাইসেলের এক লিটারের বোতল, প্রস্তুত করেছে মহারাষ্ট্রের এক্সেল ক্রপ কেয়ার লিমিটেড।
পিঠে একটা নীল রঙের হাতে-চালানো পিচকিরি নিয়ে চলছিলেন তিনি। নিজের জমি লাগোয়া ছোটো এক পাহাড়ী ঝর্নার ধারে দাঁড়িয়ে তিনি পিঠের বোঝা নামান। ওই পাত্রটায় করে তিনি পিচকিরিটায় জল ভর্তি করবেন। তার সঙ্গে মেশালেন দুই ছিপি গ্লাইফোসেট, “দোকানদারের নির্দেশ মতো।” তারপরে বেশ করে ঝাঁকালেন, পিচকিরিটি বাঁধলেন আবার, এবং তার জমির সব উদ্ভিদের উপর ছড়াতে শুরু করলেন। তাঁর কথায়, “তিন দিনের মধ্যে এগুলো সব মরে যাবে। তুলো বোনার জন্য জমি তৈরি হয়ে যাবে।”
গ্লাইফোসেটের বোতলগুলিতে হিন্দি, ইংরেজি এবং গুজরাটিতে যে সতর্কবার্তা লেখা রয়েছে সেগুলির মধ্যে রয়েছে: খাবারদাবার, খাবারের খালি পাত্র এবং পশুখাদ্য থেকে দূরে রাখুন; মুখ, চোখ ও চামড়ার সঙ্গে ছোঁয়া এড়িয়ে চলুন; স্প্রে-কণা যাতে নাকে না ঢোকে; হাওয়ার গতি যে দিকে সে দিক ধরে স্প্রে করুন; স্প্রে করার পরে যে পোশাক পরেছিলেন এবং শরীরের খোলা অংশগুলি ভালোভাবে ধোবেন; মেশানো এবং স্প্রে করার সময়ে শরীর ঢাকা, নিরাপদ পোশাক পরুন।
কোমরে একটুকরো কাপড় ছাড়া, নাগ খালি গায়েই ছিলেন। যখন তিনি স্প্রে করছিলেন, তার ফোঁটাগুলি তাঁর পা ও পায়ের পাতায় পড়ছিল। হাওয়ায় ভেষজনাশকের কণাগুলি উড়ে আসছিল আমাদের দিকে, জমির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছের দিকে এবং পাশের জমিগুলিতে। এমনকি তাঁর জমির পাশে বয়ে চলা ঝোরাটিতেও, যার জল অন্য জমিগুলিতেও পড়ছে, এবং চারপাশে অন্তত ১০টি বাড়ি ও তাদের হাতে চালানো পাম্প রয়েছে।
তিন দিন বাদে আমরা আবার নাগের জমির কাছে এলাম, দেখলাম একটা ছেলে সেখানে গরু চরাতে এসেছে। আমরা নাগকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি যে গ্লাইফোসেট স্প্রে করেছিলেন, তাতে গরুগুলির ক্ষতি হতে পারে কি না, এবং খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন: “না, তিনদিন তো হয়ে গেছে। যেদিন আমি স্প্রে করেছিলাম, সেদিনই যদি খেত, তাহলে নির্ঘাৎ অসুস্থ হত, মারাও যেতে পারত।”
আমরা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, গবাদি পশুর ক্ষতি এড়াতে কোন কোন জমিতে সদ্য গ্লাইফোসেট ছড়ানো হয়েছে তা সে কেমন করে বুঝতে পারে। কাঁধ নাচিয়ে সে বলল, “ভেষজনাশক ছড়ালে চাষিরা বলে দেয়।” ছেলেটির বাবা আমাদের বলেছিলেন, গতবছর সদ্য ভেষজনাশক ছড়ানো জমিতে ঘাস খেয়ে পাশের গ্রামের কিছু গবাদি পশু মারা গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে নাগের জমির বেশিরভাগ ঘাসই নেতিয়ে পড়েছে। তুলো বোনার জন্য জমি এখন প্রস্তুত।
কভারচিত্র : রায়গড়ার গুনুপুর ব্লকের এক সাওরা আদিবাসী বর্গাচাষি মোহিনী শবর বলেন, তাঁরা কয়েক বছর আগে অবধিও খাদ্যশস্য চাষ করতেন, এবং এখন শুধুই বিটি তুলো চাষ করেন। (ছবি : চিত্রাঙ্গদা চৌধুরী)
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ, যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : রূপসা