গণেশ ওয়াড়ন্দ্রের জমিতে একটা নিস্তেজ তুলো গাছের সবুজ শুঁটির গায়ে কালো কালো ফুটকি দাগগুলো ‘সাদা সোনা’র ওপর গবেষণারত বিজ্ঞানীদের বার্তা দিচ্ছে: এবার নতুন দাওয়াইয়ের সন্ধানে উঠেপড়ে লাগতে হবে।

“ওই ফুটোগুলোই আসলে ঢোকার রাস্তা,” বলছিলেন ওয়াড়ন্দ্রে ভাউ। ওয়ার্ধা জেলার আমগাঁও (খুর্দ) গ্রামে বেশ নামডাক আছে পাঁচ একর জমির মালিক এই কৃষকের। তাঁর মতে, নির্ঘাত এই ছিদ্রপথেই শুঁটির ভেতর গর্ত কেটে পোকাটা সেঁধিয়ে যায়।

“যদি ফাটিয়ে খুলি, দেখবেন একটা গোলাপি কেন্নো ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে,” যুগপৎ রাগ ও ভয় ফুটলো তাঁর কথায়। যেই না তিনি শুঁটিটা ফাটালেন, অমনি একটা গোলাপি রঙের পোকা, লম্বায় বুঝি এক সেন্টিমিটারও হবে না, কিলবিলিয়ে মাথা তুললো, এক্ষুনি যেন বলে উঠবে– 'কি হে! খবর কী?'। তুলোর সাদা রোঁয়া ধরার আগেই শুঁটিটাকে কুরে খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছেন বাছাধন, ওটা আর কোনও কাজেই লাগবে না।

২০১৭ সালের নভেম্বরে আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের। “একটা পোকা,” স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন বছর বিয়াল্লিশের এই কৃষক, "হাজারখানেক ডিম পাড়ে আর কয়েকদিনেই নিজেদের সংখ্যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লক্ষ লক্ষ কীটের আমদানি করে ফেলে।”

যেহেতু পোকাটা শুঁটির ভেতরে থাকে, তাই সেগুলো না ফাটা পর্যন্ত কৃষকের জানার কোনও উপায় থাকে না কী সর্বনাশ ঘটেছে। এইজন্য ফসল তোলার সময় অথবা সোজা বাজারচত্বরে এসে মাথায় বাজ পড়ে, এই শুঁটিপোকা-খাওয়া তুলো অনেক কম পয়সায় বিকিয়ে যায় তখন।

ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের কথাগুলো যেন সারা মহারাষ্ট্রের তুলো চাষিদের বয়ান হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যে সময়টায় ফসল কাটার ধুম লেগে যায়, ২০১৭-১৮-এর সেই শীতের মরসুম জুড়ে পশ্চিম বিদর্ভর তুলো বলয়ের কৃষকদের হালহকিকত মালুম পড়ে তা থেকে। এ অঞ্চলে জুলাই-অগস্ট মাসের মধ্যে তুলোর বীজ রোয়া হয় এবং ফসল তোলা হয় অক্টোবর থেকে মার্চের মধ্যে।

ঝাঁক ঝাঁক গোলাপি কীটবাহিনীর আক্রমণে বহু হেক্টর তুলো জমি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। গত তিরিশ বছরেও এমন বেহাল দশা দেখা যায়নি। ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের জমির আশপাশের খেতজুড়ে সেই গোলাপি কীট চড়াও হবার নিশানগুলো স্পষ্ট: কালো শুঁটি, নিস্তেজ আর দাগে ভরা। তার মধ্যে থেকে ফুটে উঠছে শুকনো, কালচে, নিম্নমানের ও কম দামি রোঁয়া।

এই পোকার জ্বালাতেই ২০১৭ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে মহারাষ্ট্র জুড়ে তুলোর ফসল বাঁচাতে মরিয়া কৃষকেরা প্রচুর পরিমাণে কীটনাশকের প্রাণঘাতী ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদিও তাঁরা জানতেন এসব দিয়ে ওই গোলাপি-কীটের ঝাঁককে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যাবে না। (দেখুন মারণ কীট, প্রাণঘাতী কীটনাশক )

“কোনও কীটনাশকই কাজ দেয় না এতে,” ক্ষুব্ধকণ্ঠে ওয়াড়ন্দ্রে ভাউ বললেন। “এ এমনই মারাত্মক। এখন আর বিটি-তুলো দিয়ে হবেটা কী?”

A man in cotton farm
PHOTO • Jaideep Hardikar
a man showing pest-infested boll of cotton
PHOTO • Jaideep Hardikar

আমগাঁওয়ের (কেএইচ) গণেশ ওয়াড়ন্দ্রে তাঁর খেতে পোকায় ধরা শুঁটি পরীক্ষা করছিলেন: ‘কোনও কীটনাশকই কাজ দেয় না এতে। এ এমনই মারাত্মক। এখন আর বিটি-তুলো দিয়ে হবেটা কী?’

তাঁর তুলোখেতের এক একরে, খনন-কুয়োর জল দিয়ে সেচকাজ করে, ওয়াড়ন্দ্রে ভাউ গড়ে ১৫ কুইন্টাল তুলো উৎপাদন করতে পারতেন— এইবারে তা ৫ কুইন্টালে এসে ঠেকেছে। প্রাজ্ঞ এই কৃষকের হিসেবমতো প্রতি একরে তাঁর অন্তত ৫০,০০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে— টাকার যে অঙ্কটা তাঁর কাছে আদতেই দিশেহারা হয়ে যাওয়ার মতো।

গ্রামের যে জমিগুলোয় কুয়োর জলে সেচ কাজের সুবিধে নেই, বৃষ্টির জলই ভরসা— সেসব খেতে কৃষকরা ৩ কুইন্টাল তুলোও উৎপাদন করতে পারেননি এই মরসুমে। রাজ্য সরকার কিছুটা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা অবশ্য ঘোষণা করেছে— সর্বাধিক দুই হেক্টরের জন্য হেক্টর পিছু প্রায় ১০,০০০টাকা। এই টাকাটা পেলে তবু খানিক স্বস্তি মিলবে ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের।

নভেম্বর এবং তারপর আবার ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ গ্রাম তালাথি এবং কৃষিসেবক সংগঠনগুলির (রাজ্য খাজনা ও কৃষি বিভাগের অন্তর্গত) ফসল জরিপের হিসেব অনুযায়ী গোটা রাজ্যের ৪২ লক্ষ হেক্টর তুলোখেতের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি জমি ছারখার হয়ে গেছে গোলাপি-কীটের হানায়। প্রত্যেক কৃষকেরই ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা পরিণত ফসল নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মহারাষ্ট্রের কৃষিমন্ত্রক তুলোর উৎপাদন আর গাঁট বাঁধার কাজ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নিম্নগামী হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল, ফলত কীটজনিত এই বিশাল-মাপের ক্ষয়ক্ষতির কথাও স্বীকার করে নিয়েছিল ঠারেঠোরে। এ রাজ্য থেকে বার্ষিক গড়ে ৯০ লাখ তুলোর গাঁট (গাঁট পিছু ১৭২ কিলো তন্তু) উৎপাদিত হয়। ১ কুইন্টাল তুলোয় ৩৪ কিলো তন্তু, ৬৫ কিলো তুলোবীজ (তেল নিষ্কাশনে, এবং গবাদি পশুর খাদ্য তেল-নিষ্কাশিত খইল বানাতে যা কাজে লাগে) এবং কিছু শতাংশ নোংরা বা বর্জ্য থাকে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিদর্ভের বাজারে ১ কুইন্টাল তুলো বেচে ৪,৮০০-৫,০০০ টাকা ঘরে আসত।

২০১৭-১৮ সালে ভারতবর্ষে প্রায় ১৩০ লক্ষ হেক্টর জমিতে তুলো চাষ হয় আর বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাওয়া সংবাদসূত্রে জানা যায় মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা জুড়ে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে গোলাপি-কীটের দৌরাত্ম্য । দু’বছর আগে এই একই পোকার হামলায় অতিষ্ঠ গুজরাট প্রদেশ সমস্যাটার খানিক মোকাবিলা করেছিল তুলোর প্রথমদিকের প্রজাতিগুলোকে বুনে, যাতে করে এই কীটের বংশবৃদ্ধির মরসুম অর্থাৎ কিনা শীতকাল আসার আগেই বেশিরভাগ ফসল তুলে নেওয়া যায়।

ভারত সরকারের কৃষিমন্ত্রক এই সমস্যার কথা কবুল করলেও, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য রাজ্যের তরফ থেকে উঠে আসা বিটি-তুলোকে পৃথকভাবে চিহ্নিত না করার দাবি মানতে চায়নি। কারণ ওই দাবি মতো পদক্ষেপ নিলে, বিটি তুলোর বিশেষ গুণ লোপ পাওয়ার দরুণ এই তুলোর কদর সাধারণ তুলোর স্তরেই নেমে আসত। (এর ফলস্বরূপ শস্যবীজের মূল্য, বীজ কোম্পানিগুলোর স্বত্ব ও লাভের ওপর প্রভাব পড়ত। পারির অন্য একটি প্রতিবেদনে এই ব্যাপারে আলোচনা থাকবে।) তার বদলে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্র সমস্ত তুলো উৎপাদনকারী রাজ্যকে নির্দেশ দেয় যাতে তারা "নানান অংশীজনকে এইকাজে সঙ্গে নিয়ে" নিজেরাই এই বিভীষিকার মোকাবিলায় তৎপর হয়ে ওঠে।

গোলাপি পোকার প্রত্যাবর্তন

গোলাপি পোকার এই প্রত্যাবর্তন আবার প্রথম বিপদ-ঘন্টি বাজিয়ে দেয় ২০১৫ সালে। ওই বছর ভারতীয় তুলো গবেষণা সংস্থা জেনেটিকালি মডিফায়েড (জি এম) বা জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট উন্নততর প্রজাতির বিটি-তুলোর ভেঙে পড়া নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। গুজরাট এবং মহারাষ্ট্র-সহ সমস্ত প্রধান তুলো-উৎপাদনকারী রাজ্য থেকে শস্যখেতে গোলাপি শুঁটি-পোকার ফিরে আসা নিয়ে নানান প্রতিবেদন আসতে থাকে।

২০১০ সালে বিটি-তুলোর ওপর এই গোলাপি পোকা প্রথম বিক্ষিপ্তভাবে দেখা দিলেও, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে গুজরাটের কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত কার্পাসের ওপর শুঁটিপোকার ব্যাপক হামলার কথা তুলে ধরেন। ভেতর থেকে শুঁটিগুলোকে কুরে খেয়ে এক ইঞ্চি লম্বা পোকাটার দিব্যি দুধে-আলতা, নিটোল, তরতাজা হয়ে ওঠা সুরতখানা যেন বিশেষ ক্ষমতাশালী, মহা মূল্যবান জিএম তুলোর একেবারে ঝাঁঝরা, ক্ষয়াটে দশার দিকে ইঙ্গিত করতে থাকে। অথচ এই বিশেষ প্রজাতির মহার্ঘ্য কার্পাসেরই কিনা গোলাপি-কীটের উপদ্রব রুখে দেওয়ার কথা ছিল!

২০১৫ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, পরিদর্শক হিসেবে আসা তুলো বিশেষজ্ঞদের একটি দলকে অবস্থাটা দেখানোর জন্য গুজরাটের ভাবনগর জেলার এক কৃষক তাঁর খেতের একটি গাছ থেকে গোটাকয়েক তুলোশুঁটি তুলে ফাটিয়ে এনে সামনে ধরেন। “রাগে ফুঁসছিলেন ভদ্রমহিলা,” বেশ মনে করতে পারেন সেই দলের মাথা প্রধান গবেষক ডক্টর কেশব ক্রান্তি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যাই তখনই এসব কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। সেসময় ডক্টর ক্রান্তি ছিলেন নাগপুরে দেশের সর্বোচ্চ সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ কটন রিসার্চের (সিআইসিআর) অধিকর্তা, আর এখন তিনি ওয়াশিংটনে অবস্থিত ইন্টারন্যাশানাল কটন অ্যাডভাইসরি কমিটির (আন্তর্জাতিক তুলো উপদেষ্টা সমিতি) অধিকর্তা‌র (প্রযুক্তিগত) পদে আসীন।

গুজরাটের ওই কৃষক আরও ক্ষেপে উঠেছিলেন তাঁর আসন্ন ক্ষতির কথা ভেবে: একরত্তি ওই সাংঘাতিক পোকাটা তাঁর কার্পাস উৎপাদনে ভাগ তো বসিয়েছিলই, তুলোর গুণমানেরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গোলাপি কীটগুলোকে সবুজ তুলোশুঁটি ভেতর থেকে কুরে খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে দেখে হকচকিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার আরও বড়ো কারণ ছিল।

Farmer spraying pesticide in the cotton farm
PHOTO • Jaideep Hardikar
The worm on the cotton ball
PHOTO • Jaideep Hardikar

গতবছরে শুঁটিপোকার দাপুটে প্রত্যাবর্তনের জন্য কীটনাশকের প্রাণঘাতী স্প্রে করতে হয়েছিল। ডানদিকে: তুলোর শুঁটির গায়ে গোলাপি কীট চড়াও হবার ক্ষতচিহ্নগুলো স্পষ্ট

গোলাপি বোলওয়ার্ম বা শুঁটিপোকা বলেই পরিচিত পেক্টিনোফোরা গস্সিপিলা (সন্ডার্স) তিনদশক পর ফিরে এসেছে ভারতবর্ষে– প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই যেন আটঘাঁট বেঁধে ফিরেছে একেবারে। মহানন্দে পেটপুরে খাচ্ছে বোলগার্ড-২ বিটি-তুলোর শুঁটি, যে সর্বশক্তিধারী দ্বিতীয় প্রজন্মের জিএম-তুলো সংকরের নাকি আবার এই কীটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ছিল। ক্রান্তি আশঙ্কা করছিলেন এ বুঝি এক অশনিসংকেত, আমেরিকান শুঁটিপোকাও (এর পূর্বসূরীদের জন্য এমন নামকরণ) হয়তো দেখতে দেখতে এমনি করেই ফের হানা দেবে একদিন (যদিও এখনও তা ঘটেনি)।

গোলাপি পোকা (সিআইসিআর ও তুলো গবেষকরা যার ইন্দো-পাকিস্তানি উৎপত্তির কথা অনুমান করেন) এবং আমেরিকান শুঁটিপোকা সবচেয়ে প্রাণঘাতী সেই কীটগুলোর মধ্যে অন্যতম, গত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশকে যারা ভারতীয় কৃষকদের একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। এদের প্রবল উৎপাতের জেরে ১৯৯০ সালের মধ্যে উচ্চ-উৎপাদনকারী সংকর বীজের জন্য নতুন কীটনাশক আসে। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ভারতে যখন প্রথম সংকর বীজে বিটি-জিন-সহ বিটি-তুলো আনা হয়, মনে করা হতে থাকে উপরোক্ত দুরকম ফসলনাশী কীটকেই উচিত শিক্ষা দিতে পারবে এই নতুন প্রজাতি।

কিন্তু ২০১৫-১৬ সালের তুলোর মরসুমে, একরের পর একর কার্পাস আবার গোলাপি পোকার হামলায় ছারখার হয়ে যেতে থাকে। সিআইসিআরের জরিপে পাওয়া তথ্যমতে সেবার উৎপাদনে ৭-৮% ঘাটতি দেখা যায়।

তুলো, ঢ্যাঁড়স, জবা ও পাটের মতো গুটিকয়েক শস্য খেয়েই বেঁচে থাকে গোলাপি পোকার লার্ভা। এটি ফুল, নবীন শুঁটি, কাণ্ডের পর্ব, পাতার বোঁটা, এবং কচিপাতার তলার দিকে ডিম পাড়ে। ডিম ফোটার দু’দিনের মধ্যে শিশুলার্ভা ফুলের ডিম্বাশয় অথবা কচি শুঁটিগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে। তিন-চার দিনের মধ্যে লার্ভাগুলো গোলাপি রঙের হয়ে যায় এবং এই রঙের আভা তাদের খাদ্যের ওপর নির্ভর করে- গাঢ় গোলাপি রংটা যেমন আসে পাকা বীজ খেলে। পোকায় খাওয়া শুঁটি হয় সময়ের আগেই খুলে যায়, নয়তো পচে যেতে থাকে। তন্তুর দৈর্ঘ্য বা শক্তপোক্ত হওয়ার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোতেও এর কোপ পড়ে। আক্রান্ত শুঁটির ভেতরে তুলোর তন্তুতে আনুষঙ্গিক ছত্রাক সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনাও থেকে যায়।

বাজার চত্বরে নিয়ে যাওয়া বীজ তুলো থেকে পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই গোলাপি শুঁটিপোকা হাজির হয়, আর যতদিন ফুল ও শুঁটি থাকে ততদিন ওই শস্যের ওপর নির্ভর করেই বেশ টিকে যায়। দীর্ঘমেয়াদি তুলোয় পোকাগুলো অনেকগুলো চক্র জুড়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকতে পায়, ফলত পরবর্তী শস্যের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধারক-শস্যের অনুপস্থিতি ঘটলে এই পোকা জিনের নানান কারসাজিতে দিব্যি শীতঘুমে চলে যায় অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এর ফলে এটি ৬-৮ মাস অবধি সুপ্ত থাকতে পারে, একেবারে সেই পরের মরসুম না আসা পর্যন্ত।

নিরন্তর উদ্বেগ তবু বিকল্প অধরা

২০১৬ সালের মে মাসের মধ্যে, শুঁটিপোকার দাপুটে প্রত্যাবর্তনের কথা সিআইসিআরের রিপোর্টে বিবৃত হওয়ার পর, নিউ দিল্লিতে আয়োজিত দেশের প্রধান দুই কৃষি ও বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচার রিসার্চ (আইসিএআর) এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ (আইসিএস আর)-এর দুটি উচ্চস্তরের বৈঠকে এ বিষয়ে স্পষ্ট উদ্বেগ ধরা পড়ে। জিএম শস্যের ওপর কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নিজস্ব কোনও প্রকল্পের মাধ্যমে সত্বর এক বিকল্প উপায়ের বন্দোবস্ত কর পারবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করেন আধিকারিকেরা।

“শুঁটিপোকা যে ফিরে এসেছে, তা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ নেই,” কটন অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার তরফে প্রকাশিত কটন স্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড নিউজ পত্রিকার জন্য ২০১৬ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে এমনটাই জানিয়েছেন ড. ক্রান্তি। "২০২০ সাল পর্যন্ত বিটি-তুলোর শুঁটিপোকা নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা আমরা কতখানি বজায় রাখতে পারব সেটাই এখন প্রধান চিন্তা,” লিখেছেন তিনি।

২০২০ সাল পর্যন্ত, ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলোর আনা আর কোনও নতুন জিএম তুলোর প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর বৈষয়িক অনুমোদন মিলতে বাকি নেই। জিএম বীজের বাজারগুলোয় এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কোনও উপস্থিতিই নেই, যদিও কিছু কৃষি সংস্থা গম, সোয়াবিন, বেগুন, ধান জাতীয় নানান শস্যের ওপর জিনগত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

আইসিএআর ও আইসিএসআরের বৈঠকে শুঁটিপোকা নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন বিজ্ঞানীরা। “এক্ষেত্রে ভারতবর্ষের জন্য সেরা দীর্ঘমেয়াদি পন্থা হচ্ছে স্বল্প সময়ের বিটি-তুলো হাইব্রিড অথবা এমন বিভিন্ন প্রকারভেদ উৎপাদন করা যার আবাদকাজ জানুয়ারি না পেরোতেই সারা হয়ে যাবে,” ২০১৬ সালে ক্রান্তি আমার কাছে এমন মতামতই ব্যক্ত করেছিলেন। ক্রান্তির ভাবনা মতো কাজ করলে শুঁটিপোকা এড়িয়ে যাওয়া যেত, কারণ এরা মূলত শীতকালে তুলোর ওপর চড়াও হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ভারতীয় বীজ কোম্পানি যে বিটি-হাইব্রিড বানায় তা দীর্ঘমেয়াদি শস্য হিসেবে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলন দিতে পারে।

সে বছরে কিন্তু, ২০১৭-১৮ সালের তুলনায় ফসলের ওপর কীটের আক্রমণের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম ছিল।

Rotten cotton on the tree
PHOTO • Jaideep Hardikar

২০১৭-১৮ সালের শীতকালে ফসল সংগ্রহের সময় নিস্তেজ তুলোগাছ আর জরাজীর্ণ শুঁটি, সেবার বাম্পার ফলন আশা করলেও গোলাপি পোকার সঙ্গে যুঝতে হয় ওয়াড়ন্দ্রে ভাউকে

ভাঙন ধরছে বিটি-তুলোয়

“সকলের নজরে থাকা এই প্রযুক্তিও [বিটি-তুলো অথবা বিজি-১ এবং তার দ্বিতীয় প্রজন্ম বিজি-২] এখন অচল হয়ে পড়েছে,” ২০১৬ সালেই এসব কথা আমায় জানিয়েছিলেন ক্রান্তি। “তার মানে কৃষকদের এখন কম শক্তিধর বিজি-১ ও বিজি-২ প্রযুক্তির [জিএম বীজের ক্ষেত্রে] সঙ্গেই মানিয়ে নিতে হবে এবং অন্য কয়েক প্রজাতির কীট দমন করার পাশাপাশি শুঁটিপোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফের কীটনাশকেরই শরণাপন্ন হতে হবে।”

বিটি-তুলোর নামকরণ হয়েছে মাটিতে বসবাসকারী এক ব্যাকটেরিয়া, ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়েনসিস-এর নাম থেকে। বিটি বীজ ওই ব্যাকটেরিয়াম থেকে পাওয়া ক্রাই (স্ফটিক) জিন বহন করে আর শুঁটিপোকার থেকে গাছকে রক্ষা করার জন্য ওই জিনকে তুলো গাছের জিনোমে (কোষের জেনেটিক বস্তু) প্রবেশ করিয়ে দেয়।

বিটি-তুলোর উদ্দেশ্য ছিল শুঁটিপোকা নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু কৃষকেরা এখন বিটি-তুলোর খেতেও পোকাগুলোকে দিব্যি টিকে থাকতে দেখছেন, বিভিন্ন শিল্প পত্রিকাগুলোতে পাঠানো পর্যায়ক্রমিক ভাবে লেখা একগুচ্ছ প্রবন্ধ এবং তাঁর নিজের সিআইসিআর ব্লগে এমনটাই জানান ক্রান্তি জি। আইসিএআর অথবা কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক কারওরই তখন আসন্ন বিপর্যয় নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তারপর থেকে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার গোলাপি পোকার ধ্বংসলীলা বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকলেও কেউই কোনও সমাধান বাতলাতে পারেননি।

আমেরিকান বীজ জৈবপ্রযুক্তির বহুজাতিক সংস্থা মনস্যান্টোর ভারতীয় বিটি-তুলো বীজ বাজারের ওপর আদতে একরকম একচেটিয়া দখলদারি আছে। ভারত সরকার ২০০২-০৩ সালে বিটি-তুলোর বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়ের বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছিল। প্রযুক্তি সহায়ক মনস্যান্টোর বিক্রয় হওয়া প্রতি বীজ ব্যাগ পিছু প্রায় ২০ শতাংশ রয়্যালটির বিনিময়ে ভারতীয় বীজ সংস্থাগুলোর কাছে ‘প্রযুক্তি হস্তান্তরিত’ করে। এর প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল কীটনাশকের ব্যবহার কমানো এবং তুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি করা– এই দুই উদ্দেশ্য সাধনের ধন্বন্তরি দাওয়াই হিসেবেই জিএম প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত হয়।

প্রথম বছরে বিটি-তুলো হাইব্রিড বীজের একটা ৪০০ গ্রামের থলে বিকোত ১৮০০ টাকায়। পরবর্তীকালে রয়্যালটি অথবা ট্রেট মূল্য তথা বিটি-তুলো বীজের দাম নিয়ন্ত্রণের কাজে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করে। তবুও বীজ বাজার পর্যবেক্ষণকারীদের মতে, প্রথম কয়েক বছর বিটি-তুলো বীজের ৪০০ গ্রামের থলের দাম কমে ১০০০ টাকা হলেও মনস্যান্টোর রয়্যালটি খুচরো মূল্যের ২০ শতাংশই থেকে যায়। ২০১৬ সালে ড. ক্রান্তির লেখা থেকে জানা যায়, ভারতের বিটি-তুলো বীজ বাজারের মূল্য প্রায় ৪,৮০০ কোটি টাকা।

বিশ্বজুড়ে বিটি-তুলোর ব্যবসা ২২৬ লক্ষ হেক্টর তুলো-আবাদি জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যার মধ্যে মাত্র ১৬০ লক্ষ হেক্টর বেসরকারি প্রযুক্তিদাতাদের জন্য খোলা। ২০১৪-১৫ সালে ভারতে ১১৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে বিটি-তুলোর আবাদ হত। ২০০৬-০৭ সালে মনস্যান্টো বিজি-২ হাইব্রিড বার করে এই বলে, যে নতুন প্রযুক্তি আরও কর্মক্ষম ও টেকসই হবে। এই প্রজাতিই ধীরে ধীরে বিজি-১ এর জায়গা নেয়। বর্তমানে সরকারি হিসেব মতে দেশের তুলোখেতের ১৩০ লক্ষ হেক্টরের ৯০ শতাংশই বিজি-২ হাইব্রিড দখল করেছে।

ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়েনসিস থেকে ক্রাই১এসি এবং ক্রাই২এসি জিনকে তুলোগাছে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম শুঁটিরক্ষক বিজি-২ প্রযুক্তি তিনটে পোকার আক্রমণ রুখতে পারে বলে দাবি করা হয়: আমেরিকান শুঁটিপোকা (হেলিকোভারপা আর্মিগেরা), গোলাপি শুঁটিপোকা এবং ছিটযুক্ত শুঁটিপোকা (ইয়ারিয়াস ভিট্টেলা)। প্রথম প্রজন্মের হাইব্রিডগুলি তথা বিটি-তুলো বীজের মধ্যে কেবলমাত্র একটিই ক্রাই১এসি জিন বহন করত।

অন্য একটি প্রবন্ধে ড. ক্রান্তি লেখেন, ভারতবর্ষে বিটি প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহারের কোনও এমন কোনও পথনির্দেশিকা আগাগোড়াই নেই যাতে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করা যায়। পরিবেশ মন্ত্রকের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রুভাল কমিটির তরফে অন্তত ছ’টি ভিন্ন ভিন্ন      বিটি-সংঘটনকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাদের টিকে থাকার জন্য নেওয়া কোনওরকম স্বতন্ত্র সংঘটন-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই।

ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়েনসিস ব্যাকটেরিয়ামের একটি জিন এমন এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে, যা শুঁটিপোকা-রোধী বিষ হিসাবে কার্যকর। বিজ্ঞানীরা এমন নানা জিনগত গঠন বানান যাকে তুলোবীজে স্থানান্তরিত করলে গাছ শুঁটিপোকার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে। এই হল জিএম তুলো। যখন এরকম কোনও জিনগত গঠনকে উদ্ভিদ জিনোমের একটি ক্রোমোজমের ওপর বসানো হয়, তখন তাকে একটি ‘সংঘটন’ (ইভেন্ট) বলে।

এমনকি যখন প্রতিরোধ নিয়েও নানান সমস্যার কথাও বলা হয়েছে, কোনও সতর্কবার্তাকেই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়নি বলে লিখেছিলেন ক্রান্তি। প্রতিরোধ একটি অভিযোজনমূলক প্রক্রিয়া। কৃষিক্ষেত্রে কীটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তখনই গড়ে ওঠে যখন আগেকার কার্যকরী প্রযুক্তিগুলো আর ওই নির্দিষ্ট কীটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার বদলে, ভারতে বেসরকারি সংস্থাগুলির হাজারেরও বেশি হাইব্রিড বিটি-তুলোর প্রজাতি – যা কিনা বীজগুলোর নিজেদের মধ্যেই বিটি-সংঘটনের সংকরায়ণ ঘটিয়ে তৈরি – মাত্র চার-পাঁচ বছরের মধ্যে অনুমোদন পেয়ে গিয়েছিল বলে তাঁর লেখায় জানান ক্রান্তি। আর এসবের জেরে কৃষিবিদ্যা ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ কীটপতঙ্গর সঙ্গে মোকাবিলায় ভারতীয় তুলো কৃষক যে আরওই দিশেহারা হয়ে যেতে থাকবেন সেকথা বলাই বাহুল্য।

Women working in cotton farm
PHOTO • Jaideep Hardikar
A man with cotton in hand
PHOTO • Jaideep Hardikar

ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের নিষ্প্রাণ তুলোখেতের শ্রমিকেরা জানান, গোলাপি পোকার উৎপাতে শুঁটি থেকে তন্তু বের করাও দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে আর তন্তুর গুণমানও নিতান্তই খারাপ

২০১৭ সালে বিপুল সংখ্যক আগাছানাশক-সহনশীল (এইচ টি) তুলো বীজের বপনের সাক্ষী ছিল এ দেশ। এইচটি-তুলো হল মনস্যান্টোর নতুন তুলো বীজ। সরকার এখনও বাণিজ্যিকভাবে এর বিক্রির অনুমোদন না দিলেও বীজ সংস্থাগুলি এবং অনিবন্ধিত কৃষিপ্রতিষ্ঠানগুলি কৃষকদের কাছে এগুলো বিক্রি করেছিল। কিন্তু এইচটি-তুলো শুঁটিপোকা অথবা অন্য পোকার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে না। তুলো গাছের কোনও ক্ষতি না করেই আগাছা ও বন্য গাছগাছড়া মারতে পারঙ্গম ছিল যে সমস্ত রাসায়নিক, তাদেরই বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার কথা এইচ-টি বীজ থেকে জন্ম নেওয়া তুলো গাছগুলির।

এখন, ২০১৮ সালে, ড. ক্রান্তির আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। ২০১০ সালে যখন গুজরাটে প্রথম গোলাপি পোকার সংক্রমণের বিবরণ পাওয়া গেছিল, তখন সেটা বিজি-১ তুলোর ওপর এবং তা খুবই ছোটো এলাকা জুড়ে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে আরো বিস্তৃত জায়গা জুড়ে এ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে আর এবার আক্রান্ত হয় বিজি-২।

সিআইসিআরের সমীক্ষা অনুসারে ২০১৫-১৬-সালের মরসুমে বিজি-২ তুলোর ওপর গোলাপি পোকার লার্ভার বেঁচে থাকার হার তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি ছিল গুজরাট জুড়ে, এবং বিশেষত আম্রেলি ও ভাবনগর জেলায় এই পোকা ক্রাই১এসি, ক্রাই২এবি এবং ক্রাই১এসি+ক্রাই২এবি (তিনটি ভিন্ন প্রকার) -এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

গোলাপি পোকা-সহ, বিশেষত রস শোষণকারী আরও নানান পোকা দমনের জন্য কৃষকেরা ইতিমধ্যেই কীটনাশক ব্যবহার শুরু করে দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সিআইসিআর-এর ব্যাপক ক্ষেত্র সমীক্ষা অনুযায়ী দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার তোলার পর্যায়ে সবুজ শুঁটিতে অনেক বেশি পরিমাণ ক্ষতি নজরে আসে। সাধারণত, অক্টোবর থেকে মার্চ মাস জুড়ে কখনও চার কখনও আবার পাঁচ মাস পরিসরের বিভিন্ন ধাপে শুঁটিতে যখন যখন ফুল ধরে, চাষিরা শুঁটি থেকে সাদা তুলো সংগ্রহে লেগে পড়েন।

সিআইসিআর-এর সমীক্ষায় গোলাপি পোকার মাথাচাড়া দেওয়া ও বিজি-২ তুলোর ব্যর্থতার নানান কারণ দর্শানো হয়। তার মধ্যে একটা ছিল: দীর্ঘমেয়াদি হাইব্রিডের চাষ যা ক্রমাগত গোলাপি শুঁটিপোকার পোষক হিসেবে কাজ করে চলে।

ড. ক্রান্তি বলেন ভারতে বিটি-তুলো কেবলমাত্র মুক্ত পরাগায়িত (অথবা সোজাসুজি নিষিক্ত দেশি তুলো) প্রকারে ছাড় পাওয়া উচিত ছিল, হাইব্রিডে নয়। ভারতই একমাত্র দেশ যারা বিটি-জিনকে সাধারণ ভাবে নিষিক্ত করার বদলে হাইব্রিড প্রকারে নিষেক ঘটাতে অনুমোদন দিয়েছে। সোজাসুজি নিষেকজাত তুলো গাছ বপন করলে কৃষকদের আর বাজার থেকে বীজ কিনতে হয় না, কিন্তু হাইব্রিডের ক্ষেত্রে প্রতি বছর বীজ কেনার পেছনে টাকা গচ্চা দেন তাঁরা।

“বিজি-২ -এর দীর্ঘমেয়াদি হাইব্রিডে অনুমোদন পাওয়াই উচিত নয়,” স্পষ্ট ক্ষোভপ্রকাশ করেন ক্রান্তি জি। “আর আমরা করেছি তার ঠিক উল্টোটা।”

গোলাপি শুঁটিপোকার প্রত্যাবর্তন ও তার ফলে গত তিন বছরে কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণই যেন বিজি-১ ও বিজি-২ তুলো প্রযুক্তির আমদানিকারী মনস্যান্টোর বিরুদ্ধে প্রায় ৫০টি ভারতীয় বীজ সংস্থাকে সাবধান করে দেওয়ার কাজটা করেছে। অন্তত ৪৬টি সংস্থা ২০১৬-১৭ সালে মনস্যান্টোকে রয়্যালটি দিতে অস্বীকার করে – সে আবার এক অন্য কাহিনি।

বিজি-২ তুলোর জায়গা নিতে পারে এমন কোনও নতুন জিএম প্রযুক্তি এখন কিংবা অদূর ভবিষ্যতেও চোখে পড়ছে না। আরও কার্যকরী কীটনাশকের ব্যবস্থা করার মতো কোনও প্রযুক্তিও হাতে নেই। যে শস্য তার বিঘার পর বিঘা জমি ফলনে ভরিয়ে দেয়, গ্রামাঞ্চলের লক্ষাধিক কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করে, নিজের সেই তুলোর খেতেই এখন প্রবল বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে ভারতবর্ষ।

A man walking through cotton trees
PHOTO • Jaideep Hardikar

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তাঁর একদা সুফলনের সম্ভাবনায় পূর্ণ তুলো ফসলের মায়া ত্যাগ করেন ওয়াড়ন্দ্রে ভাউ। তাঁর কথায়, ‘...এই বছরটাই সর্বনাশা’

‘শিগগিরই হয়তো সব গাছ মুড়িয়ে জমি সমান করে দেব এবার'

আমগাঁও (খুর্দ) গ্রামের সেই বিপর্যস্ত তুলোকৃষক ওয়াড়ন্দ্রে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তাঁর ফসলের মায়া ত্যাগ করেন। ক্ষুব্ধকণ্ঠে আমায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই ছিবড়ে হওয়া তুলো বেচে যা হাতে পাবেন তাতে ফসল তোলার খরচটুকুও উঠবে না। “এই গাছগুলো দেখুন না, দেখে মনে হবে যেন একেবারে জবরদস্ত ফলন পাব। কিন্তু এই বছরটাই যে সর্বনাশা ,” খাড়া রাখার জন্য বাঁশ কাঠির ঠেকনা দেওয়া বেশ লম্বা আর মজবুত চেহারার সারি সারি গাছের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

মহারাষ্ট্রের বহু তুলো কৃষকই আরও একটা বিধ্বংসী মরসুম ধরে লড়াই চালানোর পর, অনেকটা ফসল না তোলা অবস্থাতেই রেখে গাছ মুড়িয়ে জমি সমান করে দিয়েছেন। তৈরি ফসলের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছেন ইয়াভতমল জেলার কেউ কেউ, অনেকে আবার বরফসাদা জমির ওপর এতখানি করে জায়গা জুড়ে পোকার ঝাঁকের তাণ্ডব দেখে বিরক্তিতে-হতাশায় জমিতেই ফেলে রেখে গেছেন পোকায় খাওয়া সাধের ফসলটুকু।

ফসল কাটার সময় আসার খানিক আগেই আরও এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সাক্ষী থাকে পশ্চিম বিদর্ভ। দুর্ঘটনাক্রমে অনেকের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে কীটনাশক প্রবেশ করে শরীরে: প্রায় ৫০ জন কৃষক মারা যান, গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় ১ হাজার কৃষক, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন দৃষ্টিশক্তি হারান ২০১৭ সালের জুলাই-নভেম্বর মাসে।

জানুয়ারি মাসে শীত জাঁকিয়ে বসলে যখন বহাল-তবিয়তে খেতের ওপর মৌরসিপাট্টা চালায় গোলাপি পোকার দল, আসন্ন ক্ষতির আশঙ্কায় দীর্ণ হতে থাকেন তুলো চাষিরা।

জানুয়ারিতে যখন ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের সঙ্গে দেখা হয়, হতাশ কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, “শিগগিরই হয়তো সব গাছ মুড়িয়ে জমি সমান করে দেব এবার,” দেখিয়েছিলেন কীভাবে ক্ষুদ্র অথচ প্রাণঘাতী এই পোকা শুঁটিগুলোর ওপর চড়াও হচ্ছে। এর আগে তাঁর সঙ্গে আরোও দু’বার দেখা হয়েছিল আমার, কিন্তু এবারে শুঁটিগুলোর গোলাপি পোকার হামলার চিহ্ন গত কয়েকবারের চেয়ে বেশি প্রকট, আগাগোড়াই বরবাদ হয়ে গিয়েছে সেগুলো। এই পোকাগুলো শুঁটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে নিজেদের রাসায়নিক স্প্রের থেকে বাঁচায়, আর ভীষণ তাড়াতাড়ি সংখ্যায় বাড়ে, তাই যতই কীটনাশক দেওয়া হোক না কেন এদের সামলানো অসম্ভব, এসবই আমায় বলেছিলেন তিনি।

যেন বা ভারতের তুলোখেতের ওপর ঘনিয়ে ওঠা আশঙ্কার কালো মেঘেরই দ্যোতক হয়ে ওঠে ওয়াড়ন্দ্রে ভাউয়ের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজগুলো।

অনুবাদ: মৈত্রেয়ী মুখার্জ্জী
অনুবাদ সম্পাদনা: রম্যাণি ব্যানার্জী

Jaideep Hardikar

Jaideep Hardikar is a Nagpur-based journalist and writer, and a PARI core team member.

Other stories by Jaideep Hardikar
Editor : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Maitrayee Mukherjee

Maitrayee Mukherjee is a project assistant at the Institute of Language Studies and Research (ILSR), Kolkata. A postgraduate in Comparative Literature from Jadavpur University, her research interests include postcolonial literature, feminist writings, digital humanities, cultural studies and South Asian studies.

Other stories by Maitrayee Mukherjee