টাক্-টাক্-টাক্!

কান পাতলে বেশ শোনা যায়, কোড়াভাটিপুড়ির ত্রিপল ঢাকা কুঁড়েটা থেকে তালে তালে শব্দ উঠছে। মৌলমপাকা ভদ্ররাজু মাটির পাত্র গড়ছেন সাবেকি চাক্কা সুত্তি দিয়ে। ছোটো প্যাডেল সদৃশ কাঠের হাতুড়ির মতো এই চাক্কা সুত্তি মৃৎপাত্রে নিখুঁত গোল আকার এনে দিতে কাজে আসে।

“পাত্রের তলা বুজিয়ে দিতে মোটা চাক্কা সুত্তিখানা কাজে লাগে। আর সাধারণভাবে ব্যবহার হওয়া এইটা দিয়ে তলদেশ মসৃণ হয় আরও। শেষে গোটা পাত্রটাকেই মসৃণ করার জন্য থাকে এক্কেবারে পাতলা এই চাক্কা সুত্তিটা,” বৃদ্ধ ভদ্ররাজু যথাসম্ভব সহজ করে বুঝিয়ে দিতে থাকেন। যখন যেমন দরকার সেই অনুযায়ী হাতুড়ি বদলে নেন এই কারিগর। তিনি এও জানালেন যে তাল (বোরাসুস ফ্ল্যাবেল্লিফার) গাছের শাখা থেকে সাধারণ আকারের পাতলা গোছের চাক্কা সুত্তিটা তৈরি হয় আর সবচেয়ে পুরু সুত্তিটার জন্য লাগে অর্জুন (টারমিনালিয়া অর্জুনা) গাছের ডাল। বলতে বলতেই একেবারে সরু সুত্তিটা দিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি, লক্ষ্যণীয়ভাবে হালকা হাতে আঘাত পড়তে থাকে পাত্রের গায়ে।

২০ ইঞ্চি ব্যাসের একটা বড়োসড়ো পাত্রকে আকার দিতে মিনিট পনেরো লেগে যায় তাঁর। গড়ার সময় একটা দিক কোনওভাবে ভেঙে গেলে বা ফাটল ধরলে তড়িঘড়ি মাটি লেপে হালকা ঠোকা দিয়ে দিয়ে মেরামত করে নেন আবার।

Mulampaka Bhadraraju uses a chekka sutti (left) to smoothen the pot.
PHOTO • Ashaz Mohammed
The bowl of ash (right) helps ensure his hand doesn't stick to the wet pot
PHOTO • Ashaz Mohammed

পাত্র মসৃণ করতে চাক্কা সুত্তি (বাঁদিকে) ব্যবহার করেন মৌলমপাকা ভদ্ররাজু। ভেজা পাত্রে যাতে হাত আটকে না যায় তাই ওই বাটিতে ছাই (ডানদিকে) রাখা থাকে

পনেরো বছর বয়স থেকে মাটির কাজ করেন ভদ্ররাজু। বর্তমানে তাঁর নিবাস ও কর্মস্থল দুইই অনাকাপল্লি জেলার কোড়াভাটিপুড়ি গ্রাম। অন্ধ্রপ্রদেশে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) হিসেবে তালিকাভুক্ত কুম্মার গোষ্ঠীর লোকজনের বাস এই গ্রামে।

পনেরো বছর আগে দেড় লাখ টাকা দিয়ে যে আধ একর জমি কিনেছিলেন, তারই পুকুর থেকে মাটি নেন সত্তরোর্ধ্ব এই কারিগর। তাছাড়াও পাশের গ্রামের মাটি ও বালি-সুড়কি সরবরাহকারীকে সারা বছরে হাজার টাকা দিলে ৪০০ কেজি এররা মিট্টি (লাল মাটি) তাঁর জমিতে পাঠিয়ে দেন তিনি।

নারকোল গাছের শাখা আর ছাদ হিসেবে ত্রিপল ব্যবহার করে নিজের জমিতে দুটো ঝুপড়ি বানিয়েছেন ভদ্ররাজু। ঢাকা জায়গা বলে সারাবছর সেখানে কাজ করতে পারেন, বর্ষাকালেও কাজে ব্যাঘাত ঘটে না। একটা ঝুপড়িতে পাত্র বানিয়ে তাকে আকার দেওয়ার কাজটা করেন আর ছোটোটায় সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে নেন। “আমাদের মোটামুটি ২০০-৩০০টা পাতিল গড়া হয়ে গেলে, [শুকনো কাঠের আঁচে] পোড়াই সবগুলোকে,” জানাচ্ছেন তিনি। কাছেই একটা মাঠ থেকে এসব জ্বালানি সংগ্রহ করা হয়। “তারপর ঝুপড়িতেই ওদের [পাত্রগুলোকে] শুকোতে রেখে দিই,” গোটা পদ্ধতিটাই তিনি ব্যাখ্যা করে চলেন।

নিজের জমানো টাকা থেকেই এ জমি খরিদ করতে হয়েছিল তাঁকে। “ওরা [স্থানীয় ব্যাংক] কিছুতেই আমায় টাকা কর্জ দেয় না। এর আগে কতবার বলেছি কিন্তু কেউ কক্ষনো একটা পয়সা পর্যন্ত দেয়নি।” এই ব্যাপারে মহাজনদের সঙ্গে কারবার করতে খুব একটা উৎসাহী নন অভিজ্ঞ মানুষটি, যেহেতু তাঁর কাজের ফলাফলটা অনিশ্চিত – দশটা করে পাত্র বানালে, বানাতে বানাতেই একটা দুটো ভেঙে যায়। “সব পাত্রগুলো ভালো করে শুকোয় না, এক একটা অংশ ভেঙে পড়ে শুকোনোর সময়েই,” ছাউনির এক প্রান্তে পড়ে থাকা প্রায় এক ডজন ফাটল ধরা পাত্রের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন শিল্পী।

The master potter can finish shaping about 20-30 pots a day
PHOTO • Ashaz Mohammed
The master potter can finish shaping about 20-30 pots a day
PHOTO • Ashaz Mohammed

দক্ষ এই কারিগরের হাতে দিনে প্রায় কুড়ি-তিরিশটা পাত্র আকার পায়

প্রতিদিন ঘণ্টাদশেক খেটেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাত্র বানানোর কাজটা করতে সাধারণত প্রায় এক মাস লেগে যায় তাঁর। “আমার স্ত্রীও হাত লাগালে, একসঙ্গে ২০-৩০টা পাত্রও [আকার] গড়ে দিতে পারি দিনে,” পাত্রের গায়ে একমনে আলতো টোকা দিতে দিতেই এসব কথা চলতে থাকে। মাঝেমাঝে শুধু কোনওকিছু আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিতে থামেন শিল্পী। মাসের শেষে সবমিলিয়ে মোটামুটি সংখ্যাটা দাঁড়ায় গিয়ে প্রায় ২০০-৩০০ পাত্রে।

তিন মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে মোট ছয় সদস্যের সংসারে উপার্জনের এইটাই একমাত্র উৎস। তাঁর নিজের কথায়, “কেবল এটুকু দিয়েই” সংসারের সব খরচা, মায় ছেলেমেয়েদের বিয়ের বন্দোবস্ত পর্যন্ত হয়েছে। প্রতিসপ্তাহে গ্রামের প্রায় জনা তিরিশেক কুমোরের কাছ থেকে মাটির জিনিসপত্র কিনতে বিশাখাপত্তনম আর রাজামুন্দ্রি থেকে যে পাইকারি বিক্রেতারা আসেন, তাঁদের কাছেই নিজের পাত্রগুলোও বেচেন ভদ্ররাজু। সেগুলো আবার বাজারে বিকোয় হরেক কাজের দাবি মেটাতে, “নিজেদের রান্নাবান্না ছারাও বাছুরদের জল খাওয়ানো – দরকার মতো সবই চলে,” বলছেন প্রবীণ কারিগর।

“বিশাখাপত্তনমের পাইকিরি কারবারিরা পাত্র পিছু ১০০ টাকা করে দেয়, যেখানে রাজামুন্দ্রির কারবারিদের কাছে এক একটা বিকোয় ১২০ করে,” ভদ্ররাজু জানান, “সব ঠিকঠাক চললে, [মাসে] মোটামুটি ৩০,০০০ হাজার টাকাও হাতে আসতে পারে।”

দশ বছর আগে গোয়ার এক শিল্প ও কারিগরির দোকানে মৃৎশিল্পী হিসেবে কাজ করতেন ভদ্ররাজু। “অন্যান্য আরও কয়েকটা রাজ্য থেকেও লোকজন ছিল, সকলেই ব্যস্ত থাকত আলাদা আলাদা কারিগরির কাজে,” স্মৃতিচারণ করেন তিনি। তখন পাত্র পিছু পেতেন ২০০-২৫০ টাকা করে। “কিন্তু ওখানকার খাবারদাবার পোষালো না বলেই ছ’মাস পর সব ছেড়েছুড়ে চলে এলাম,” তিনি বলেন।

Manepalli switched to a electric wheel five years ago
PHOTO • Ashaz Mohammed

পাঁচ বছর আগে বিদ্যুৎচালিত কুমোর চাকা ব্যবহার শুরু করেন মানেপল্লি

‘গত ছয়-সাত বছরে পেটের আলসারে ভুগছি,’ বলছেন মানেপল্লি। হাতে চালিত চাকাটা ঘোরানোর সময় ব্যথা করত। স্বয়ংক্রিয় চাকায় আর সে বালাই নেই। কুম্মার গোষ্ঠীর বছর ছেচল্লিশের এই শিল্পী কিশোর বয়স থেকেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত

কয়েক মিটার দূরেই আরেক মৃৎশিল্পী কামেশ্বররাও মানেপল্লির বাড়ি। এখন এ বাড়িতে চাক্কা সুত্তির দুমদুম শব্দের বদলে ধীর ঘূর্ণির শব্দ আসে। এ সেই যন্ত্রচালিত চাকার শব্দ যার ওপর পাত্র বসালে আপনা থেকেই তার আকার গড়ে দেয় চাকাটা।

এ গ্রামের সমস্ত মৃৎশিল্পীর ঘরেই এখন পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে যন্ত্রচালিত এই চাকা। ভদ্ররাজুই বোধহয় একমাত্র কারিগর, যন্ত্রচালিত চাকার ব্যবহারে যাঁর তেমন আগ্রহ নেই, হাতেই তিনি চাকা ঘোরান। “পনেরো বছর বয়স থেকে তো এই করে আসছি।” ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগাতার শ্রমেও তিনি অভ্যস্ত বলে জানালেন। তাছাড়া, যন্ত্রচালিত চাকাগুলো তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোটো পাত্র বানানোর উপযোগী হিসেবে। ভদ্ররাজুর মতো সাবেকি দশ লিটারের পাত্র গড়তে পারবে না এই চাকা।

অন্য আরও মৃৎশিল্পীদের মতো মানেপল্লিও স্বাস্থ্যের অবনতি ও অপারেশনের জেরে যন্ত্রচালিত চাকার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছেন। “গত ছয়-সাত বছরে পেটের আলসারে ভুগছি,” বলছেন তিনি। হাতে চালিত চাকাটা ঘোরানোর সময় ব্যথা করতো। স্বয়ংক্রিয় চাকায় আর সে বালাই নেই। “১২,০০০ টাকা দিয়ে একটা যন্ত্রওয়ালা চাকা কিনে এনেছিলাম। এইটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বিনে পয়সায় আরেকটা পেয়েছি খাদি গ্রামীণ সভা থেকে। ওইটা দিয়ে এখন বানাই।”

Left: Manepalli’s batch of pots being baked.
PHOTO • Ashaz Mohammed
Right: He holds up a clay bottle he recently finished baking
PHOTO • Ashaz Mohammed

বাঁদিকে: মানেপল্লির বানানো পাত্রগুলো পোড়ানো হচ্ছে আঁচে। ডানদিকে: সম্প্রতি তৈরি করা মাটির বোতলটি দেখাচ্ছেন মানেপল্লি

“সাধারণ [ছোটো] পাতিলগুলো ৫ টাকা করে পড়ে। এর ওপরে নকশা করা থাকলে, তখন দাম উঠবে ২০ টাকায়,” বলতে বলতে মানেপল্লি একথাও জানালেন যে এসব মূলত সাজিয়ে রাখার কাজেই লাগে। কুম্মার গোষ্ঠীর বছর ছেচল্লিশের এই শিল্পী কিশোরবয়স থেকেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। তখন বাবার সঙ্গেই হাত লাগাতেন। পনেরো বছর আগে বাবা মারা যাবার পর এখন একার দায়িত্বেই চলছে কারিগরি।

তিন সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে মানেপল্লির সংসারেও সদস্য ছ’জন। তাঁর আয়েই ভরণপোষণ হয় সকলের। “প্রতিদিন খাটলেও [মাসে] দশ হাজার [টাকা] মতো রোজগার হয়। তার মধ্যে পাতিল পোড়ানোর কয়লা কিনতেই ২,০০০ বেরিয়ে যায়। থাকে মোটে ৮,০০০। তা দিয়ে কি হয়!”

শরীরটা ভালো থাকে না বলে নিয়মিত কাজ করতে পারেন না এই দক্ষ কারিগর। মাঝেমাঝে গোটা কাজের দিনটাই নষ্ট হয়ে যায়। “আর কি করব?” অন্য কোনও কাজ করতে পারেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তরে তাঁর পাল্টা সওয়ালে হতাশা স্পষ্ট, “আর তো কোনও কাজ হাতে নেই আমার।”

অনুবাদ: রম্যাণি ব্যানার্জী

Student Reporter : Ashaz Mohammed

Ashaz Mohammed is a student of Ashoka University and wrote this story during an internship with PARI in 2023

Other stories by Ashaz Mohammed
Editor : Sanviti Iyer

Sanviti Iyer is Assistant Editor at the People's Archive of Rural India. She also works with students to help them document and report issues on rural India.

Other stories by Sanviti Iyer
Translator : Ramyani Banerjee

Ramyani Banerjee is a first-year postgraduate student in the department of Comparative Literature at Jadavpur University, Kolkata. Her areas of interest include Gender and Women's Studies, Partition Studies, oral narratives, folk traditions, and culture and literature of the marginalised communities .

Other stories by Ramyani Banerjee