“আমাদের গ্রামে মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নেই। রাত আটটা নটা বেজে গেলে তারা ঘরের বাইরে যায় না,” বলছেন শুক্লা ঘোষ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় তাঁর গ্রাম। নাম কুয়াপুর। “মেয়েরা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু তারা এটাও বুঝতে পারছে যে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।”

শুক্লা ঘোষ-সহ তাঁর গ্রামের অন্য মেয়েরা কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার প্রতিবাদে গত সপ্তাহে পথে নেমেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হাজার হাজার কৃষক, খেতমজুর এবং শ্রমিকদের সঙ্গে।

ঘটনার ৪৪ দিন পর ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪-এর এই মিছিল ছিল কলেজ স্কোয়ার থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত – হাঁটা পথে প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার।

মিছিলের দাবি – দ্রুত বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এছাড়াও কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ (জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের এই দাবি সরকার মেনে নিয়েছে) এবং স্বাস্থ্য ও পুলিশ মন্ত্রীর পদত্যাগ – অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং।

PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya
PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya

বাঁদিকে: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আই সি ডে এস ইউনিয়নের জেলা সম্পাদিকা শুক্লা ঘোষ জানাচ্ছেন তাঁর গ্রামে মেয়েরা নিরাপদ বোধ করে না। ডানদিকে: মিতা রায় একজন খেতমজুর। হুগলির নাকুন্দা থেকে তিনি এই প্রতিবাদ মিছিলে এসেছেন

“তিলোত্তমা তোমার নাম, জুড়ছে শহর, জুড়ছে গ্রাম,” – এই স্লোগান বারবার শোনা গেল প্রতিবাদ মিছিলে। তিলোত্তমা নগরী তারই নাম দিয়েছে ৩১ বছরের সেই তরুণীকে। আবার দুর্গারও আরেক নাম তিলোত্তমা।

“পুলিশ আর প্রশাসনের তো দায়িত্ব নেওয়া উচিত যাতে মেয়েরা নিরাপদ বোধ করে,” আরো বললেন শুক্লা। “মেয়েরা যদি দেখে যে তাঁরা অভিযুক্তকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তাহলে তারা নিরাপদ বোধ করবে কী করে?” প্রশ্ন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আই সি ডে এস ইউনিয়নের জেলা সম্পাদিকার।

“আমাদের খেতমজুরদের নিরাপত্তার জন্য ওরা [রাজ্য] কী করেছে?” জিজ্ঞেস করলেন মিতা রায়। “গ্রামে মেয়েরা রাতে বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পায়। তাই আমি এখানে এসেছি। মেয়েদের সুরক্ষার জন্য আমাদের লড়াই করতে হবে,” বলছেন হুগলি জেলার নাকুন্দা গ্রামের এই খেতমজুর।

৪৫ বছর বয়সি মিতা বলছেন খোলা মাঠের থেকে পাকা বাথরুম পেলে অনেক ভালো হত। তাঁর নিজের দু’বিঘা জমি আছে যেখানে তিনি আলু, ধান আর তিল চাষ করেন। কিন্তু এই সেপ্টেম্বরের বন্যায় চাষের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। “আমরা কোনও ত্রাণ পাইনি,” জানাচ্ছেন মিতা। দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজ করে ২৫০ টাকা উপার্জন হয় তাঁর। কাঁধে লাল পতাকা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিতা বললেন যে তিনি বিধবা ভাতাও পাচ্ছেন না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের এক হাজার টাকা পেলেও সংসার টানার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়, বললেন তিনি।

PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya
PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya

ন্যাশনাল মেডিকাল কলেজে দেওয়াল লিখন

PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya
PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya

*****

“আমি একজন মেয়ে, তাই আমি এখানে এসেছি।”

মালদা জেলার চাঁচল গ্রামের বাসিন্দা বানু বেওয়া সারা জীবন কাজ করেছেন। ৬৩ বছরের বানু দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর গ্রামের অন্য মেয়েদের সঙ্গে। শ্রমজীবী মহিলাদের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত।

“মেয়েদেরও রাত্রিবেলা কাজ করতে পারা উচিত,” বলছেন নমিতা মাহাতো। রাজ্য সরকার জানিয়েছিল যে হাসপাতালে মহিলা কর্মীদের রাতে ডিউটি দেওয়া হবে না। পরে সুপ্রিম কোর্টে এই নির্দেশিকা সমালোচিত হয়েছে।

পঞ্চাশের কোঠায় বয়স নমিতার। পুরুলিয়া থেকে আসা আরও অনেক মেয়েদের সঙ্গে তিনিও দাঁড়িয়ে আছেন কলেজ স্কোয়ারের গেটের সামনে। এই কলেজ স্কোয়ারের আশপাশের ব্যস্ত অঞ্চলে রয়েছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, অজস্র বইয়ের দোকান এবং কফি হাউজ।

গৌরাংডি গ্রামের বাসিন্দা নমিতা কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ (রাজ্যে ওবিসি তালিকাভুক্ত)। পেশায় রং মিস্ত্রি। ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ পান। দৈনিক আয় ৩০০-৩৫০ টাকা। “আমি জানলার গ্রিল, কপাট রং করি,” বললেন নমিতা, যিনি বিধবা ভাতাও পাচ্ছেন।

PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya
PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya

বাঁদিকে: মালদা থেকে এসেছেন খেতমজুর বানু বেওয়া (সবুজ শাড়ি)। তিনি বলছেন, ‘আমি মেয়ে, তাই আমি এখানে এসেছি।’ ডানদিকে: পুরুলিয়া থেকে আগত দিনমজুর নমিতা মাহাতোর (গোলাপি শাড়ি) মতে কর্মক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঠিকাদারের

PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya
PHOTO • Sarbajaya Bhattacharya

বাঁদিকে: মিছিলে এক আন্দোলনকারী গান গাইছেন বিচারের দাবিতে। ডানদিকে: ‘আর জি করের ঘটনার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হচ্ছে, তাতে শ্রমজীবী মেয়েদের প্রতিদিনের সমস্যার কথাও উঠে আসা উচিত,’ বলছেন পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তুষার ঘোষ

নমিতার সঙ্গে থাকেন তাঁর ছেলে, বৌমা এবং নাতনি। ছেলে কাজ করেন একটি লোহার কারখানায়। নমিতার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। “জানেন, ও সব পরীক্ষা পাশ করেছিল। সব ইন্টারভিউ। কিন্তু জয়েনিং লেটার এল না,” অভিযোগের সুর ঝরে পড়ে নমিতার গলায়। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে নমিতার পরিবার। বছরে একবার। সেচের জন্য বৃষ্টির জলই ভরসা।

*****

আর জি করে, নিজের কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা এবং খুনের শিকার হন জুনিয়র ডাক্তার। এই ঘটনা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে শ্রমজীবী মেয়েদের সমস্যাও। যে মেয়েরা মাছ বেচেন বাজারে, কাজ করেন ইটভাটায়, যাঁরা এমএনরেগা কর্মী, তাঁদের জন্য কাজের জায়গায় শৌচালয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। নেই ক্রেশের ব্যবস্থাও। এছাড়াও রয়েছে পুরুষদের সঙ্গে আয়ের তারতম্য। এই সমস্যাগুলির কথাই বলছিলেন তুষার ঘোষ। তিনি পশ্চিমবঙ্গের খেতমজুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। “আর জি করের ঘটনার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হচ্ছে, তাতে শ্রমজীবী মেয়েদের প্রতিদিনের সমস্যার কথাও উঠে আসা উচিত,” বলছেন তিনি।

২০২৪ সালের অগস্ট মাসের ৯ তারিখ ঘটেছে এই ঘটনা। তারপর গোটা রাজ্য নানাভাবে জানিয়েছে প্রতিবাদ। শহর থেকে মফস্বল থেকে গ্রাম – সাধারণ মানুষ, তাঁদের অনেকেই মহিলা, পথে নেমেছেন রাত দখল করতে, গণপরিসরের দখল নিতে। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সামনে এসেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং হুমকি সংস্কৃতির চিত্র। এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। কিন্তু প্রতিবাদ থামার কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না।

Sarbajaya Bhattacharya

Sarbajaya Bhattacharya is a Senior Assistant Editor at PARI. She is an experienced Bangla translator. Based in Kolkata, she is interested in the history of the city and travel literature.

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya
Editor : Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David