আর. কৈলাসম ব্যাঙ্কে গেলেই তাজ্জব বনে যান। তিনি বলছিলেন, "যখনই পাসবই আপডেট করাতে যাই আমাকে ভাগিয়ে দেয়, বলে যে মেশিন খারাপ, মেরামত করা হচ্ছে, অন্যদিন এসো।"

অথচ কে. জি. কান্ডিগাই শহরের এই ব্যাঙ্কে পৌঁছতে গেলে তাঁকে বাঙ্গালামেডু থেকে প্রায় দু'ঘন্টা হাঁটতে হয়। (বছরটাক আগেও আধা রাস্তা বাসে করে যাওয়া যেত, কিন্তু সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন)।

তবে, আসল যুদ্ধটা শুরু হয় তিনি ব্যাঙ্কে পৌঁছনোর পর। তামিলনাড়ুর থিরুভাল্লুর জেলায় অবস্থিত এই যে কানাড়া ব্যাঙ্কের কে. জি. কান্ডিগাই শাখা, এখানে পাসবই আপ-টু-ডেট করানোর জন্য রয়েছে একটি স্বচালিত মেশিন। তবে আজ অবধি কৈলাসম এটা কোনদিনও চালাতে পারেননি ঠিকঠাক। "আমার দ্বারা এসব হবে না," অসহায় কণ্ঠে জানালেন তিনি।

ব্যাঙ্কে গেলেই তাঁর কপালে থাকে এন্তার ভোগান্তি, একদিন সকালবেলা তিনি সেই গল্পই শোনাচ্ছিলেন আমায়। কাছেই একটা ভেলিকাথান গাছের নিচে কয়েকজন মহিলা বসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন: "ও দাদু, ওই মেশিনটা চালাতে গেলে বইয়ে একটা স্টিকার লাগাতে হবে তো!" ঠিক কথা, যে বারকোডটা না থাকলে মেশিন কাজ করে না সেটা সত্যিই কৈলাসামের পাসবইয়ে সাঁটা নেই। "বাবুরা কেন যে আমাকে এই স্টিকারটা দেননি তা আমি জানি না। এইসব ভজকট জিনিস মাথায় ঢোকে না আমার," বললেন কৈলাসম। ওই মহিলারাও এই সমস্যার তল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অনেক ভেবেচিন্তে তাঁদের একজন বললেন, "আপনাকে একটা [এটিএম] কার্ড বানাতে হবে তো দাদু, তবেই ওই স্টিকারটা পাবেন।" সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলে উঠলেন, "আপনাকে ৫০০ টাকা দিয়ে একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।" ফুট কাটলেন তৃতীয়জন, "বিনেপয়সার অ্যাকাউন্ট হলে ওসব স্টিকার পাবেনই না।"

তবে ব্যাঙ্ককে ঘিরে এই যুদ্ধে তিনি একা নন। অ্যাকাউন্ট চালু রাখা, টাকা তোলা বা আয়ব্যয়ের হিসেব রাখা, এসব জিনিস বাঙ্গালামেডুর একাধিক মানুষের কাছে অত্যন্ত প্যাঁচালো একটি বিষয়। তিরুত্তানি ব্লকে রয়েছে রুখুসুখু জঙ্গলাকীর্ণ একটি অঞ্চল, তার মাঝ বরাবর চলে গেছে একটা রাস্তা, সেখানেই এই অসহায় মানুষগুলোর জনপদ – পোশাকি নাম যার চেরুক্কানুর ইরুলার কলোনি। রাস্তার দুই ধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িঘর, অল্প কয়েকটি পাকা দালান আর বাদবাকি সব অপরিসর কুঁড়েঘর। সর্বসাকুল্যে ৩৫টি ইরুলা পরিবারের নিবাস এখানে। (সরকারি নথিতে যদিও এই জনজাতির নামের বানান 'ইরুলার' লেখা হয় আজকাল)।

এই জনপদেই রয়েছে মাটি দিয়ে বানানো চারটি দেওয়াল এবং জরাজীর্ণ এক খড়ের ছাউনির তলায় কৈলাসম (৬০) এবং কে. সঞ্জয়াম্মার (৪৫) সংসার। আপনজন বলতে চারটি ছাগল যাদের দেখভাল করেন সঞ্জয়াম্মা। এঁদের চার সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়েথা করে আলাদা ঘর বেঁধেছেন। দিনমজুর কৈলাসম জানালেন, "মাঠে কাজ করতে গেলে সারাটা দিন নুয়ে থাকতে হয় তো। পিঠটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় যেন, হাড়গোড়ে বড্ড ব্যথা হয়। তার চেয়ে পুকুর কাটার কাজ [অর্থাৎ এমজিএনআরইজিএর অধীনে ১০০ দিনের কাজ] অনেক ভালো।" মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট ২০০৫এর দ্বায়িত্ব প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের জন্য বছরে ১০০ দিন মজুরি কাজ বরাদ্দ করা – তবে বাঙ্গালামেডুর ইরুলাদের কপালে ১০০ দিনের শিকে ছেঁড়ে কস্মিনকালে।

On R. Kailasam'a visits to the bank, attempts to update his passbook are often unsuccessful; the passbook is his only way to keep track of his money
PHOTO • Smitha Tumuluru
On R. Kailasam'a visits to the bank, attempts to update his passbook are often unsuccessful; the passbook is his only way to keep track of his money
PHOTO • Smitha Tumuluru

ব্যাঙ্কে গিয়ে পাসবই আপডেট করানোটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার আর. কৈলাসমের কাছে; টাকাপয়সার হিসেব রাখার জন্য এই পাসবইটিই একমাত্র সম্বল তাঁর

বিশেষভাবে বিপন্ন জনজাতি (পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ, পিভিটিজি) হিসেবে চিহ্নিত তামিলনাড়ুর ইরুলাদের কাছে দিনমজুরি করাটাই জীবনধারণের একমাত্র ভরসাযোগ্য উপায়। বাঙ্গালামেডুর পুরুষেরা মরসুমি কাজের উপর বেঁচে আছেন। ইটভাটা, ধানখেত কিংবা ইমারতির কাজকর্ম, এভাবেই কুড়িয়ে বাড়িয়ে দিনে ৩৫০-৪০০ টাকা রোজগার হয় তাঁদের। আর যেদিনগুলোয় কোনও কাজই জোটে না তখন ফলমূল খুঁজতে ওই রুখুসুখু বনভূমিতে যান তাঁরা। এছাড়াও তাঁরা শিকার করেন। মেঠো ইঁদুর, খরগোশ, কাঠবেড়ালি, পাখি, এসব দিয়েই জঠরের জ্বালা জুড়ায় ইরুলা জনজাতি। (দেখুন: বাঙ্গালামেডুর মাটির তলায় নিহিত সম্পদের সন্ধানে এবং ইঁদুরের সঙ্গে অন্য পথ বেয়ে বাঙ্গালামেডুতে )।

এই জনপদের মহিলাদের কাছে ইটভাটায় ওই মরসুমি মজুরি ছাড়া এমজিএনআরইজিএর অধীনে ১০০ দিনের কাজই উপার্জনের একমাত্র উপায়। ( বাঙ্গালামেডুর মেয়েরা : ‘ আমাদের কাজ কোথায় গেল ?’ দেখুন)

খাল-বিল সাফ করা, মাটি খোঁড়া কিংবা এমজিএনআরইজিএ'র অধীনে চিহ্নিত কর্মস্থলে বৃক্ষরোপণ – এভাবেই দৈনিক ১৭৫ টাকা উপার্জন করেন ইরুলারা। আর এই টাকাটা সরাসরি জমা পড়ে যায় তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।

"এ হপ্তার কাজ করলে তার টাকা ঢুকতে ঢুকতে দুই হপ্তা কেটে যায়," বলছিলেন কৈলাসম। মাসের শেষে কতটা কি সাশ্রয় হচ্ছে সেই ব্যাপারে কোনও হিসেব থাকে না তাঁর। "[সংসারের দৈনন্দিন খরচার জন্য] মাসে ওই ৫০০ টাকা হলেই চলে যায় আমাদের। বাকিটা ব্যাঙ্কেই থাকে। একবার তো ৩,০০০ টাকা জমে গেছলো জানেন! সেটা আমি খোকার হাতে দিয়ে বললাম যে যা বাবা ভালোমন্দ কিছু একটা কেন নিজের জন্য।"

ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গেলে কৈলাসমকে একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে হয়। "বাবুরা বলে চালান লিখে দিতে। আমি থোড়াই জানি ওসব কীভাবে করতে হয়?" তিনি কিংবা সঞ্জয়াম্মা - দুজনের কেউই লিখতে-পড়তে জানেন না। তাঁর কথায়, "ব্যাঙ্কের লোকজন সাফ জানিয়ে দেয় যে তেনারা আমাদের হয়ে ওসব লিখতে টিখতে পারবেন না। তাই বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করে থাকি কখন অন্য কেউ এসে দয়া করে এসব লিখে টিখে দেবে আমার জন্য। তাছাড়া ওখানে গেলে আমি ১,০০০ টাকার বেশি তুলিওনা [প্রতি ২-৩ মাসে একবার]।"

জি. মণিগন্ধন সেই দয়ালু মানুষগুলির মধ্যে একজন। কৈলাসমকে ব্যাঙ্কের কাজে সাহায্য করা ছাড়াও তিনি ইরুলা জনজাতির অন্যান্যদের হাতে ধরে দেখিয়ে দেন যে কীভাবে আধার কার্ড, সরকারি যোজনা এবং বার্ধক্য ভাতার জন্য আবেদন করতে হয়।

Most of the families in the single-steet Bangalamedu hamlet have accounts in a bank branch in K. G. Kandigai town. Right: Manigandan, who runs after-school classes, helps people in the hamlet with their bank-related work
PHOTO • G. Manigandan
Most of the families in the single-steet Bangalamedu hamlet have accounts in a bank branch in K. G. Kandigai town. Right: Manigandan, who runs after-school classes, helps people in the hamlet with their bank-related work
PHOTO • Smitha Tumuluru

বাঙ্গালামেডু জনপদে রয়েছে একটিমাত্র রাস্তা, এখানে বসবাসকারী বেশিরভাগ পরিবারেরই অ্যাকাউন্ট আছে কে. জি. কান্ডিগাই শহরের ব্যাঙ্কে। ডানদিকে: মণিগন্ধন, ইস্কুল ছুটি হয়ে গেলে শুরু হয় তাঁর ক্লাস, এখানে তিনি জনপদের মানুষজনকে হাতে ধরে শেখান ব্যাঙ্ক-সংক্রান্ত কাজের খুঁটিনাটি

"আমি যখনই ব্যাঙ্কে গেছি তখনই ৫-৬ জনকে পেয়েছি যাঁরা সাহায্যের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। চালানগুলো সব ইংরেজিতে লেখা তো আসলে। আমি একটু আধটু ইংরেজি পড়তে পারি, তাই সাধ্যমতো সাহায্য করি তাঁদের," জানালেন ৩৬ বছরের মণিগন্ধন। তিনি ক্লাস ৯ অবধি পড়েছেন। মণিগন্ধন স্থানীয় একটি অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত যেটি ইস্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পর বাচ্চাদের জন্য বিশেষ ধরনের ক্লাস করায়। "প্রথম প্রথম ভয় পেতাম, পাছে কিছু ভুল করে ফেলি। চালানে বেশি কাটাকুটি করলে বাবুরা ছিঁড়ে ফেলে দেন তো, তখন আবার নতুন করে সব লিখতে হয়," জানালেন তিনি। তবে গত কয়েক মাস ধরে তামিল ভাষায় লেখা চালানও পাওয়া যাচ্ছে ব্যাঙ্কে।

গোভিন্দাম্মাল কোনদিনও ইস্কুলের মুখদর্শন করেননি। কৈলাসমের এই ৫৫ বছরের পড়শি তাঁর এমজিএনআরইজিএ'র মজুরি এবং হাজার টাকার বার্ধক্য ভাতা তুলতে গেলে প্রায়শই মুশকিলে পড়েন। একা বিধবা মানুষ, তাঁর মেয়ে এবং দুই ছেলে যদিও ওই একই জনপদে থাকেন, তবে তাঁদের বাড়ি আলাদা। "আমি বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে কাজ চালাই। তাঁরা [ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা] আমায় বলেন যে চালান জমা দিতে গেলে একজন সাক্ষীর সই লাগবে। তাই যাঁরা দয়া করে চালান লিখে দেন আমি তাঁদেরকেই বলি সই করে দিতে," বললেন তিনি।

যাঁরা এভাবে অন্যের চালান লিখে দেন নিয়মানুযায়ী তাঁদের নিজেদের অ্যাকাউন্টের ক্রম লিখতে হয়। একগাল হাসি নিয়ে মণিগন্ধন একটা পুরনো ঘটনার কথা মনে করছিলেন, "একবার কী হয়েছিল জানেন? সাক্ষী হিসেবে একজনের চালানে সই করে নিজের অ্যাকাউন্টের ক্রম লিখেছিলাম। তাজ্জব ব্যাপার, ব্যাঙ্কের বাবুরা আমার অ্যাকাউন্ট থেকেই টাকাটা কেটে নেন! তবে বিশাল ভাগ্যি আমার যে তেনারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, টাকাটাও তাই ফেরত পেয়ে গেছিলাম।"

তবে নিজের ক্ষেত্রে মণিগন্ধন এটিএম কার্ড ব্যবহার করেন এবং লেনদেনের যান্ত্রিক মাধ্যম হিসেবে তামিল ভাষাকেই বেছে নেন। কার্ডটা যদিও বছর তিনেক আগেই হাতে পেয়েছিলেন, তবে সড়গড় হতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল তাঁর। "শুরুতে বার কুড়ি গোত্তা খাওয়ার পর বুঝতে পারি যে কীভাবে টাকা তুলতে হয় বা কীভাবেই বা দেখতে হয় অ্যাকাউন্টে কতটা টাকা রয়েছে।"

তাহলে কৈলাসম বা গোভিন্দাম্মাল এটিএম কার্ড ব্যবহার করেন না কেন? মণিগন্ধন জানালেন যে আঙ্গুঠা ছাপ যাঁরা, অর্থাৎ শিক্ষার অভাবে সই করতে অক্ষম, তাঁদেরকে এই কার্ড দেওয়া হয় না। অথচ কে. জি. কান্ডিগাইয়ের কানাড়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বি. লিঙ্গামাইয়া আমাদের জানালেন যে ব্যাঙ্ক থেকে এখন সব্বাইকেই এটিএম কার্ড দেওয়া হচ্ছে, শুধু আবেদন করতে হবে এই যা। "তাঁরা আঙ্গুঠা ছাপ হোক বা অ্যাকাউন্টটি জনধন যোজনার অধীনস্থ হোক, কিচ্ছু ফারাক পড়বে না তাতে," জানালেন তিনি। তবে মুশকিলটা হল যে বাঙ্গালামেডুর বেশিরভাগ মানুষই অবগত নন এই পরিষেবা বিষয়ে।

The bank has set up a small unit in Cherukkanur panchayat village
PHOTO • Smitha Tumuluru

চেরুক্কানুর পঞ্চায়েত গ্রামে ব্যাঙ্কের একটি ছোট্ট শাখা খোলা হয়েছে

'আমি বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে কাজ চালাই। তাঁরা [ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা] আমায় বলেন যে চালান জমা দিতে গেলে একজন সাক্ষীর সই লাগবে। তাই যাঁরা দয়া করে চালান লিখে দেন আমি তাঁদেরকেই বলি সই করে দিতে,' জানালেন গোভিন্দাম্মাল

গ্রাহকের সুবিধার্থে কানাড়া ব্যাঙ্ক বাঙ্গালামেডু থেকে তিন কিলোমিটার হাঁটাপথের দূরত্বে একটি বা 'অতি ক্ষুদ্র শাখা' খুলেছে চেরুক্কানুর গ্রামে। গাঁয়ের মানুষের কাছে 'পুঁচকে ব্যাঙ্ক' (মিনি ব্যাঙ্ক) বলে পরিচিত এই শাখাটিতে মোটে একজন চুক্তিতে নিযুক্ত কর্মী কাজ করেন। ৪২ বছরের এই বিজনেস করেস্পন্ডেন্ট (ব্যাবসায়িক তথ্যাদি আদানপ্রদানকারী) একটি বায়োমেট্রিক যন্ত্রের মাধ্যমে গ্রাহকদের সাহায্য করেন যাতে তাঁরা লেনদেন করতে পারেন এবং অ্যাকাউন্টে কত টাকা রয়েছে সেটা দেখতে পান।

বিজনেস করেস্পন্ডেন্ট ই. কৃষ্ণাদেবী এই বহনযোগ্য বায়োমেট্রিক যন্ত্রটি ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত করেন তাঁর ফোনের মাধ্যমে। তারপর সেখানে গ্রাহকের আধারের ক্রম প্রবেশ করেন তিনি। তারপর এই যন্ত্রটিতে গ্রাহক তাঁর আঙুলের ছাপ দিলেই লেনদেন করতে পারেন সহজেই। "ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধারের ক্রম যুক্ত করাটা জরুরি, টাকাপয়সা তো আমার হাতের কাছেই থাকে," জানালেন তিনি। প্রতিদিন বেলা ৩:৩০এর মধ্যে ব্যাঙ্কের যাবতীয় কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে হয় তাঁকে।

তবে যাঁদের পক্ষে আঙুলের ছাপ দেওয়াটা কোনও কারণে সম্ভবপর নয়, বা যাঁদের আধার কার্ড নেই কিংবা যাঁরা পাসবই আপডেট করাতে চান তাঁরা কে. জি. কান্ডিগাইয়ে স্থিত মূল শাখায় যেতে বাধ্য হন।

"মাঝে মাঝেই তিনি [বিজনেস করেস্পন্ডেন্ট] বলেন যে টাকা ফুরিয়ে গেছে। তখন তিনি আমাদের একটা করে চিরকুট দিয়ে বলেন যে কাজের শেষে কিংবা তার পরেরদিন তাঁর বাড়িতে আসতে। তাই করি তখন আমরা," জানালেন গোভিন্দাম্মাল। তিনি তখন তাঁর কয়েকজন সইয়ের সঙ্গে গ্রামের পাশে অবস্থিত হ্রদের তীর বরাবর তিন কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে চেরুক্কানুরের দিকে রওনা দেন। "আমরা আপিসের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। কোনও কারণে তিনি সেদিন না এলে আমরা তাঁর বাড়িতে যাই তখন।"

সাধারণত বিজনেস করেস্পন্ডেন্টরা নিজেদের বাড়ি থেকেই কাজ করেন। তবে কৃষ্ণাদেবী একটি পুরনো, অধুনা বন্ধ গ্রন্থাগারকেই নিজের আপিস বানিয়ে নিয়েছেন। এখানে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা অবধি থাকেন তিনি। তবে যেদিন যেদিন বার্ধক্য ভাতা কিংবা এমজিএনআরইজিএর টাকা দেওয়া হয় সেদিন তাঁকে আরো অনেকক্ষণ কাজ করতে হয়। তিনি বেশ জোর দিয়েই বললেন যে এই সময়টুকু ছাড়াও গ্রাহকদের জন্য তিনি সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকেন। "যাঁরা বাইরে বাইরে কাজ করেন তাঁরা তো আমার বাড়িতেই আসেন লেনদেন করতে," জানালেন কৃষ্ণাদেবী।

প্রত্যেক মঙ্গলবারে কৃষ্ণাদেবী তাঁর বায়োমেট্রিক যন্ত্রটি নিয়ে কে. জি. কান্ডিগাইয়ের প্রধান শাখায় যান। অন্যান্য চারটি পঞ্চায়েতে কর্মরত বিজনেস করেস্পন্ডেন্টরা এই একই জিনিস করেন, তবে পালা করে আলাদা আলাদা দিনে আসেন তাঁরা। যেসব গ্রাহকেরা আধার কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করতে চান তাঁদের জন্য এই যন্ত্রটি সোম থেকে শুক্র দুপুর দুটো অবধি প্রস্তুত থাকে। তবে কৈলাসম একটা ভুল করে বসেছিলেন, তিনি জানতেন যে এই যন্ত্রটির সুবিধা পেতে হলে তাঁকে কে. জি. কান্ডিগাইয়ে যেতে হবে এবং শুধুমাত্র মঙ্গলবারেই সেটা পাওয়া যায়। "চেরুক্কানুর থেকে ওই বিজনেস করেস্পন্ডেন্ট ম্যাডাম শুধু ওইদিনটাতেই আসেন তো," বলছিলেন তিনি।

The ‘mini bank’ is one person – in Cherukkanur, it's Krishnadevi, who helps customers check their account balance and withdraw or deposit cash, using a biometric device Right: S. Sumathi, who runs a small shop in her one-room house, was stunned when she learnt about the overdraft facility
PHOTO • G. Manigandan
The ‘mini bank’ is one person – in Cherukkanur, it's Krishnadevi, who helps customers check their account balance and withdraw or deposit cash, using a biometric device Right: S. Sumathi, who runs a small shop in her one-room house, was stunned when she learnt about the overdraft facility
PHOTO • G. Manigandan

চেরুক্কানুরের কৃষ্ণাদেবী একলা হাতেই চালান এই 'পুঁচকে ব্যাঙ্কটি'। একটি বায়োমেট্রিক যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি গ্রাহকদের সাহায্য করেন লেনদেন করতে এবং অ্যাকাউন্টে কতটা কি টাকা আছে সেটা দেখতে। ডানদিকে: নিজের এক-কামরার বাড়িতে একটি ছোট্ট দোকান চালান এস. সুমতি, ওভারড্রাফ্ট পরিষেবার ব্যাপারে শুনে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন

বছর দশেক ধরে এই অঞ্চলে ব্যাঙ্ক বলতে শুধু কানাড়া ব্যাঙ্কই ছিল, তাই কৈলাসমের মতো অন্যান্য ইরুলা পরিবারের সব্বার অ্যাকাউন্ট এখানেই। (বছর দুই আগে কে. জি. কান্ডিগাইয়ে অন্ধ্র ব্যাঙ্ক একটি শাখা খোলে, এছাড়াও আজ এ শহরে চারখানা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাঙ্কের এটিএম আছে)। কয়েকটিতে কেবলমাত্র সাধারণ সেভিংস্ অ্যাকাউন্টই খোলা যায়, বাদবাকি ব্যাঙ্কগুলোয় জনধন যোজনার ভিত্তিতে বিনেপয়সার অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব, অর্থাৎ যে অ্যাকাউন্টে টাকাপয়সা রাখাটা বাধ্যতামূলক নয়।

অথচ আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তাঁদের অনেকেই জানিয়েছিলেন যে ব্যাঙ্ক থেকে তাঁদের বলা হয়েছে বিনেপয়সার অ্যাকাউন্টেও ন্যূনতম কিছুটা করে টাকা রাখতে হবে। এরকম একটি অ্যাকাউন্ট গোভিন্দাম্মালেরও আছে, তিনি জানালেন, "কে. জি. কান্ডিগাইয়ের বাবুরা বলেন যে ৫,০০০-১০,০০০ টাকা না রাখলে নাকি ১০০ দিনের কাজের [এমজিএনআরইজিএ] টাকা ঢুকবে না। তাই তো আমি চেরুক্কানুরের ওই পুঁচকে ব্যাঙ্কটায় যাই, ওখানে গেলে পরে পাসবইয়ে মোটে ২০০-৩০০ টাকা রাখলেই হয়ে যায়।"

২০২০ সালের শেষের দিকে আমি এইটা নিয়ে কে. জি. কান্ডিগাইয়ের তৎকালীন ম্যানেজার কে. প্রশান্তের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি জানিয়েছিলেন যে জনধন অ্যাকাউন্টে সত্যিই একটা পয়সাও না রাখলে চলে। "গ্রাহকেরা যদি চান যে কেওয়াইসি জমা দিয়ে এমন একটা অ্যাকাউন্ট বানাবেন যেখানে সকল প্রকারের সুযোগ সুবিধা রয়েছে, একমাত্র সেক্ষেত্রেই তাঁদেরকে বলা হয় ন্যূনতম ৫০০ টাকা জমা রেখে একটা সাধারণ সেভিংস্ অ্যাকাউন্ট বানাতে।"

তবে হ্যাঁ, এখানকার ম্যানেজার বি. ম্যানেজার স্বীকার করলেন যে এমনটা হওয়া সত্ত্বেও ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা অনেক সময় গ্রাহকদের টাকা রাখতে জোর করেন। এটাও জানালেন যে গ্রাহকেরা যদি আলাদা করে জনধন যোজনার বিনেপয়সার অ্যাকাউন্টের কথা না বলেন তাহলে ব্যাঙ্ক নিজের থেকেই সাধারণ সেভিংস্ অ্যাকাউন্ট চালু করে দেয়।

এছাড়াও গোভিন্দাম্মাল আরেকটি গণ্ডগোলের কথা জানালেন আমায়, "প্রথমটায় ওরা [ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ] আমায় বলে যে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে কোনও টাকা লাগে না, অথচ এখন ওরা প্রত্যেক বছর কখনও ৫০০ কখনও ১০০০ টাকা কেটে নেয় দুমদাম। টাকা তুলতে গেলেই দেখেছি যা থাকার কথা তার চেয়ে কম আছে।"

কে. প্রশান্তের মতে এই গণ্ডগোলের জন্য দায়ী ওভারড্রাফ্ট পরিষেবা যেটি সল্প মূল্যের বিনিময়ে জনধন অ্যাকাউন্টেও চালু করা যায়। "ধরুন গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ২,০০০ টাকা পড়ে আছে, কিন্তু তিনি ৩,০০০ টাকা তোলার জন্য চালান জমা করলেন, তখন এই ওভারড্রাফ্ট পরিষেবার কারণে টাকাটা তিনি পাবেন বটে তবে পরবর্তী সময়ে টাকাপয়সা জমা পড়লেই সেই অনাদায়ী ১,০০০ টাকা কেটে নেওয়া হবে। আমার কী মনে হয় বলুন তো? গ্রাহকেরা এটার ব্যাপারে একেবারেই অবগত নন।"

R. Vanaja with M. Ankamma and her child. In 2020, Vanaja and her husband R. Johnson (right) , lost money from their account in a phone scam
PHOTO • Smitha Tumuluru
R. Vanaja with M. Ankamma and her child. In 2020, Vanaja and her husband R. Johnson (right) , lost money from their account in a phone scam
PHOTO • G. Manigandan

শিশুক্রোড়ে আর. বনজা, সঙ্গে এম. অঙ্কম্মা। ২০২০ সালে ফোনের মাধ্যমে হওয়া একটি জালিয়াতির কারণে বনজা এবং তাঁর স্বামী আর. জনসনের (ডানদিকে) অ্যাকাউন্ট থেকে অনেকটা টাকা খোওয়া যায়

গোভিন্দাম্মালের বাড়ির উল্টোদিকে থাকেন ২৮ বছরের এস. সুমতি। এই ওভারড্রাফ্ট পরিষেবার ব্যাপারে জানতে পেরে গতবছর তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। "যাহ্ বাবা! এটা তো কেউ আমাদের বুঝিয়ে বলতে পারতো! আমরা তো ভেবেছিলাম যে ব্যাঙ্ক আমাদের টাকাপয়সা চুরি করে নিচ্ছে।"

দুমদাম টাকাপয়সা কেটে নেওয়ার আরেকটি কারণ হল এসএমএস পরিষেবা যেটার জন্য ত্রৈমাসিক ১৮ টাকা মাশুল গুনতে হয় গ্রাহকদের। কিন্তু বাঙ্গালামেডুর সবার কাছে ফোন যেমন নেই, তেমনই অ্যাকাউন্টে টাকা শেষ হয়ে গেলে এসএমএস আসাও বন্ধ হয়ে যায়। উপরন্তু এসএমএস শুধুমাত্র টাকা তোলার ক্ষেত্রেই পাঠানো হয়, সুমতি এমনটাই জানালেন। "অ্যাকাউন্টে টাকাপয়সা জমা পড়লে ওরা এসএমএস পাঠায় না কেন? করলে তো আমাদের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমতো, নাকি?"

ডিজিটাইজেশনের ফলে আরও নানান ধরনের উটকো ঝামেলার উৎপত্তি হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে মণিগন্ধনের ২৩ বছর বয়েসের ভাইপো আর. জনসনের ১,৫০০ টাকা খোওয়া যায় এক জালিয়াতির কারণে। তাঁর ২২ বছর বয়সী স্ত্রী আর. বনজার অ্যাকাউন্টে ২,০০০ টাকা ছিল, যেটা কিনা ওঁদের দুজনের এমজিএনআরইজিএর মজুরি থেকে জমানো পুঁজি। এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ব্যাঙ্কের কর্মচারী সেজে তাঁদের ফোন করে আর সরল মনের জনসন তাঁর স্ত্রীর এটিএম কার্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বলে দেন ভুলবশত। "গলা শুনে মনে হয়েছিল যে সত্যিই ব্যাঙ্কের কোনও বাবু। লোকটা বললো যে কার্ডটা অচল হয়ে পড়েছে আর সেটাকে আবার চালু করতে কার্ডের নম্বরটা লাগবে। আমি যা যা নম্বর জানতাম সব বলে দিয়েছিলাম। ওই যে, কি যেন একটা গোপন নম্বর [ওটিপি] আসে না ফোনে? সেটাও দিয়েছিলাম লোকটাকে। ৫০০ টাকা বাদে বাকিটা পুরো চুরি করে নিল," দুঃখ করছিলেন তিনি।

সেই জালিয়াত তারপর জনসনের কাছ থেকে তাঁর কাকু মণিগন্ধনের কার্ডের তথ্যও হাতিয়ে নিয়েছিল এটা বলে যে জনসনের কার্ডটি পুনরায় চালু করতে গেলে ওটাও দরকার। একাধিক সন্দেহজনক লেনদেন হচ্ছে এটা বুঝতে পেরে ব্যাঙ্ক থেকে মণিগন্ধনকে সাবধান করা হয়, কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। একটি আবাসন যোজনার মাধ্যমে নতুন বাড়ি বানানোর জন্য মণিগন্ধন অনেক কষ্টেসৃষ্টে কিছুটা টাকা জোগাড় করেছিলেন, তার থেকে ১৭,০০০ টাকা চলে যায় এই ফেরেববাজির কারণে।

এই ডিজিটাল দুনিয়ার দশচক্রে জনসন এবং ইরুলা জনজাতির অন্যান্য মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই। রয়েছে এমন এক ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, যেটি তাঁদের নালিশ কিংবা অভিযোগের ব্যাপারে এক মিনিটের জন্যও মাথা ঘামায় না, এ যেন ইরুলাদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ানক কিছু। ওদিকে কৈলাসমের পাসবই আজও আপ-টু-ডেট হয়নি। তবে একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন, "যাক বাবা, ওই ছাপ-নেওয়া [বায়োমেট্রিক] যন্তরটা ব্যবহার করলে কোনও চালান টালান লিখতে হবে না আর।"

অনুবাদ : জশুয়া বোধিনেত্র ( শুভঙ্কর দাস )

Smitha Tumuluru

Smitha Tumuluru is a documentary photographer based in Bengaluru. Her prior work on development projects in Tamil Nadu informs her reporting and documenting of rural lives.

Other stories by Smitha Tumuluru
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra