“পশ্চিম বাংলার লোকজন মোটে ডুলি বানাতে পারে না।”
ধান সঞ্চয়ের জন্য, তাঁর নিজের হাতে তৈরি ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা আর চার ফুট চওড়া দৈত্যাকার “ধান ধরার ডুলি” নিয়ে বলতে গিয়ে রাখঢাক না করেই কথাটা জানিয়ে দেন বাবন মাহাতো।
পাছে প্রথমবারে আমরা বুঝে উঠতে না পারি, তাই প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের এই কারিগর আরেকটু খোলসা করে দেন ব্যাপারটা, “ডুলি বানানোর কাজটা নেহাত সহজ নয়।” কাজটার নানান ধাপের কথা পরপর বলে যেতে থাকেন তিনি: কান্দা সাধনা, কাম সাধনা, টাল্লি বিঠানা, খাড়া করনা, বুনাই করনা, তেরি চড়ানা [আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি বাঁশের চিলতেগুলো তৈরি করা, গোল কাঠামোটা রাখা, ঝুড়িটা দাঁড় করানো, শেষ পর্যন্ত বোনা, আর চূড়ান্ত বুনুনি দেওয়া]।”
গত চার দশক ধরে এই কাজই করে আসছেন বছর বাহান্নর বাবন। “ছেলেবেলা থেকে মা-বাপ তো এই একটা কাজই শিখিয়েছেন। তাঁরাও এইটেই করতেন। সব বিন্দরাই ডুলি বানায়। তাছাড়া টোকরি [ছোটো ঝুড়ি] বানানো, মাছ ধরা কিংবা নৌকো বাওয়ার মতো কাজকম্মও ভালোই পারে তারা।”
বাবন বিহারের বিন্দ গোষ্ঠীর মানুষ। রাজ্যে চূড়ান্তভাবে অনগ্রসর জাতি (ইবিসি বা এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) হিসেবে তালিকাভুক্ত এই জনগোষ্ঠী (জাতি সমীক্ষা ২০২২-২৩)। তিনি জানাচ্ছেন বেশিরভাগ ডুলি কারিগরই বিন্দ গোষ্ঠীর মানুষ হলেও কানু আর হালওয়াই গোষ্ঠীর লোকজনও (এঁরাও ইবিসি) একাজ করেন। দীর্ঘকাল বিন্দ সমাজের সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে এই কাজ তাঁরাও শিখে নিয়েছেন।
“আমি তো হাতের মাপ ধরেই কাজ করি। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়, কিংবা বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার থাকলেও হাতের বুদ্ধিই দিব্যি এগিয়ে নিয়ে যায় আমায়,” বলছেন তিনি।
বাঁশটাকে আড়াআড়ি ভাবে চিরে একটা প্রস্থচ্ছেদ বের করে নেন প্রথমে তারপর সেটা থেকেই ১০৪ খানা নমনীয় চিলতে ফালি করে বের করেন। ভীষণ কুশলী হাতে করতে হয় সবটুকু। ঠিকঠাক হিসেব করে নিয়ে তারপর যেরকম আয়তনের ঝুড়ি চাইবেন তার ওপর নির্ভর করে “ছে ইয়া সাত হাথ” (মোটামুটি ৯ কি ১০ ফুট) ব্যাস মেপে বাঁশের গোল কাঠামো বসানো হয়। এক ‘হাথ’ মানে মোটামুটি হাতের মাঝের আঙুলের ডগা থেকে কনুই পর্যন্ত মাপ, যা কিনা ভারত জুড়ে বিভিন্ন কারিগর গোষ্ঠীর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হয় মাপের একক হিসেবে; সংখ্যার হিসেবে সেটা কমবেশি ১৮ ইঞ্চি।
পারি’র সঙ্গে বাবনের এইসব কথাবার্তা হচ্ছে যেখানে, সেটা আলিপুরদুয়ার জেলা (পূর্বতন জলপাইগুড়ি)। এখান থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটারের দূরে বিহারের ভগওয়ানি ছাপড়ায় তাঁর বাড়ি, যেখান থেকে প্রতি বছর কাজের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের সমতলের উদ্দেশে পাড়ি জমান আর শেষমেশ এসে পৌঁছন কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসে খারিফ শস্য তোলার সময়। পরের দু'মাস এখানেই কাটিয়ে যান তিনি। সেসময়টায় ডুলি বানানো আর বিক্রি করার কাজ করেন।
একাজে তিনি একা নন অবশ্য। “বাংলার আলিপুরদুয়ার আর কুচবিহার জেলার প্রতিটা হাটে [সাপ্তাহিক বাজার] ঘুরে দেখুন, আমাদের ভগওয়ানি ছাপড়া জেলার ডুলি কারিগরদের একজন অন্তত থাকবেই থাকবে,” বলছেন পুরণ সাহা। তিনি নিজেও একজন ডুলি কারিগর যিনি বছর বছর বিহার থেকে কুচবিহার জেলার খাগড়াবাড়ি শহরের দোদিয়ার হাটে আসেন। এই কাজ করতে আসা বেশিরভাগ পরিযায়ী কারিগররা পাঁচ বা দশ জন করে দল বেঁধে নেন আর একটা হাট নির্বাচন করে সেখানেই থিতু হন। শুরু হয় অস্থায়ী ছাউনিতে দিন যাপন।
মাত্র তেরো বছর বয়সে, বাবন প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গে আসেন গুরু রাম পরবেশ মাহাতোর সঙ্গে। “পনেরো বছর ধরে গুরুর সঙ্গে কত জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। তারপরেই তো আগাগোড়া (একটা ডুলি বানানোর) বিদ্যেটা মাথায় ঢুকেছে,” বলছেন বাবন। ডুলি কারিগরি তাঁদের পরিবারগত পেশা।
*****
একটু আগুন জ্বালানোর বন্দোবস্ত করতে করতেই দিন শুরু হয় বাবনের। প্রবল শীতে অস্থায়ী ছাউনিটার মধ্যে শুয়ে থাকা যায় না। তার চেয়ে তাই বাইরে রাস্তায় আগুনের পাশে বসতেই যেন সুবিধে হয় খানিক। “প্রতিদিন ভোর তিনটেয় উঠে পড়ি। রাতে বড়ো ঠান্ডা লাগে। ঠান্ডার চোটেই বিছানা ছেড়ে উঠে, বাইরে একটু আগুন জ্বেলে তার পাশে বসে থাকি।” এক ঘণ্টা পর অবশ্য কাজে লেগে পড়েন তিনি। বাইরে অন্ধকার থাকলেও রাস্তার মিটমিটে আলোটুকুই তাঁর কাজ শুরুর জন্য যথেষ্ট তখন।
তিনি জানাচ্ছেন ডুলি ঝুড়ি বানানোর পদ্ধতির সঙ্গে ঠিকঠাক বাঁশ নির্বাচন করার কাজটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। “বছর তিনেক বয়স, এমন বাঁশই একাজে সবচেয়ে ভালো যেহেতু সেগুলো সহজে চিরে ফেলা যায় আর বাঁশগুলো পুরুও হয় মানানসই রকম,” মত বাবনের।
সঠিক হিসেব করে গোল কাঠামোটা বসানো বেশ শক্ত কাজ, ‘দাও’ (কাস্তে) বলে একটা হাতিয়ার এইসময় ব্যবহার করেন তিনি। পরের পনেরো ঘণ্টায় শুধু খাবার আর একটা বিড়ি খাওয়ার ফাঁকেই যা একটু রেহাই মেলে।
একটা সাধারণ ডুলি উচ্চতায় ৫ ফুট আর ব্যাসে ৪ ফুট মতো হয়। তাঁর ছেলেও হাত লাগালে দিনে দুটো ডুলি ঝুড়ি বানিয়ে ফেলতে পারেন বাবন আর সোমবার করে আলিপুরদুয়ার জেলার সাপ্তাহিক মথুরা হাটে বেচতেও পারেন সেগুলো। “হাটে যাওয়ার সময় নানান মাপের ঝুড়ি নিয়ে যাই: কোনওটায় ১০ মণ ধান আঁটে, কোনওটায় ১৫ মণ, কোনওটায় আবার ২০ কিংবা ২৫ মণ।” এক মণ মানে মোটামুটি ৪০ কিলোগ্রাম। সুতরাং ১০ মণের ডুলি ৪০০ কিলো ধান রাখতে পারে। খদ্দেররা যতটা পরিমাণ রাখতে চান সেই অনুযায়ী ডুলির আকার ঠিক করেন বাবন। আয়তনের ওপর নির্ভর করে ডুলির উচ্চতা ৫ কিংবা ৮ ফুটের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে।
‘ছেলেবেলা থেকে মা-বাপ তো এই একটা কাজই শিখিয়েছেন। তাঁরা নিজেরাও শুধু এইটেই করতেন’
ফসল কাটার মরসুম শুরু হলে একটা ডুলির জন্য ৬০০-৮০০ টাকা পাওয়া যায়। মরসুম শেষ হলে যখন চাহিদাও কমে যায় তখন ওই একই জিনিস সস্তায় বেচতে হয়। আরও ৫০ টাকা রোজগারের আশায়, ঝুড়িটা বাড়িতে দিয়েও আসি,” বুঝিয়ে দিতে থাকেন তিনি।
একটা ডুলির ওজন পড়ে আট কিলো আর বাবন মোটামুটি একেবারে তিনটে ডুলিও (২৫ কিলো মতো ওজন পড়ে) বয়ে ফেলতে পারেন। “মোটে এই অল্পক্ষণের জন্য ওই ২৫ কিলোর বোঝা মাথায় বইতে পারব না?” জিজ্ঞেস করেন। তাঁর মতে এটা কোনও ব্যাপারই নয়।
সাপ্তাহিক হাটের মধ্যে দিয়ে নিজের দোকানটার দিকে যাওয়ার রাস্তায় বিহার থেকে আসা সহ-গ্রামবাসীদের সঙ্গে মাথা নেড়ে কুশল বিনিময় করেন তিনি, দেখান কোনগুলো তাঁর গোষ্ঠীর লোকজনের দোকান আবার প্রয়োজনে সাহায্য করেন এমন কয়েকজন স্থানীয় বাঙালিকেও বাবন চিনিয়ে দেন। “সব জান পহেচান কে হ্যায় [সবাই তো এখানে চেনাজানা],” হালকা সুর তাঁর গলায়, “আমার কাছে যদি একটা পয়সাও না থাকে কিন্তু চাট্টি ভাত-ডাল-রুটির দরকার পড়ে যায়, ওরাই সব দিয়ে দেবে ঠিক। আমার কাছে পয়সাকড়ি আছে কি না সেই পরোয়া করবে না।”
এই যাযাবর জীবন, মাতৃভাষা ভোজপুরির বাইরেও অন্য ভাষায় সরগড় করে তুলেছে তাঁকে। হিন্দি, বাংলা, অহমিয়া তো তিনি বলেনই, এমনকি বুঝতে পারেন মেচিয়াও – আলিপুরদুয়ার জেলার (পূর্বতন জলপাইগুড়ি) দক্ষিণ চাকোয়াখেতিতে বাবনের আশেপাশের এলাকাতে যে মেচ সম্প্রদায়ের বাস তাঁদেরই ভাষা এটা।
দক্ষ এই শিল্পী স্পষ্ট জানালেন দিনে দশ টাকা দিয়ে কয়েক গ্লাস মদ তিনি কেনেন, কারণ “সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে গায়ে তো ব্যথা ধরে যায়। মদ খেলে ওই ব্যথাটা মরে তাও।”
যদিও তাঁর বিহারী সঙ্গীসাথীরা সবাই মিলে একসঙ্গে থাকেন, বাবনের কিন্তু একা নিজের মতো থাকতেই ভাল্লাগে বেশি, “যদি আমায় ৫০ টাকার খাবার খেতে হয় আর সঙ্গে অন্য লোকজন থাকে, সবাই বলবে, ‘আমাকেও খানিক ভাগ দাও!’ তাই আমি একাই খাই, একাই থাকি। তাতে করে, আমি নিজে যা খাই তাও আমার, আবার রোজগার করা টাকাটাও সেই আমারই।”
তাঁর কথায় জানা গেল বিহারে বিন্দ গোষ্ঠীর মানুষজনের জন্য জীবিকার সুযোগ হাতেগোনা। সুতরাং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা এভাবে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বাবনের তিরিশ বছরের ছেলে অর্জুন মাহাতোও কাঁচা বয়সে বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন। এখন তিনি মুম্বইয়ে রংমিস্ত্রির কাজ করেন। “ঠিকঠাক একটা রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সঙ্গতি রাখে না আমাদের নিজেদের রাজ্য। এখানে বালি খননই একমাত্র শিল্প…আর তার ওপর তো আর গোটা বিহার নির্ভর করে থাকতে পারে না।”
বাবনের সবচেয়ে ছোটো ছেলে চন্দন এবারে (২০২৩) বাবার সঙ্গে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসাম পর্যন্ত যে ১৭ নং জাতীয় সড়ক টানা চলে গেছে চা বাগানের পাশ দিয়ে, তারই কাছে একটা অস্থায়ী ঘর পেতেছেন তাঁরা। ঘর বলতে তিনদিকে ঢিলেঢালা ত্রিপল দেওয়া, টিনের চালের গ্যারেজ যেন। সেখানে জিনিসপত্র বলতে একটা মাটির চুলহা (উনুন), একটা খাট আর ডুলি ঝুড়ি রাখার একটু জায়গা।
প্রাতঃকৃত্যের জন্য রাস্তার ধারের ফাঁকা জায়গাই ভরসা বাবা-ছেলের। স্নানের জন্য তাঁরা জল নেন কাছের একটা হ্যান্ড পাম্প থেকে। বাবনের কথায়, “এরকম অবস্থায় মানিয়ে নিতে আমার কিন্তু কোনও মুশকিল হচ্ছে না। ম্যায় হমেশা আপনে কামকে সুর মে রহতা হুঁ [আমি সারাক্ষণ নিজের কাজের সুরেই বুঁদ হয়ে থাকি]।” বাইরে বসে ডুলি তৈরি আর বিক্রিবাটার কাজটা করেন তিনি আর ভেতরে রান্না-খাওয়া-শোওয়া এইসব চলে।
যখন সব গুটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আসে, বড়ো কষ্ট হয়: “মা, মানে আমাদের বাড়িওয়ালি, নিজের বাগানের এক গোছা তেজপাতা তখন সঙ্গে দিয়ে দেন বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য,” ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন বাঁশের কাজের এই কারিগর।
*****
ধান জমা রাখতে প্লাস্টিকের থলের আবির্ভাব, প্রক্রিয়াকরণ আর মজুত রাখার পদ্ধতিতে নানান বদল, ডুলি প্রস্তুতকারকদের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। “এই এলাকায় নতুন সব চালকল হচ্ছে বলে শেষ পাঁচ বছরে আমাদের ব্যবসা খুব মার খেয়েছে। আগের মতো গোলাজাত করার বদলে চাষিরা তাদের ধান মাঠ থেকে নিয়ে সোজা এই কারখানাগুলোয় বিক্রি করে দেয় চাল তৈরির জন্য। জমা করার কাজে লোকজন আজকাল প্লাস্টিকের থলেও খুব ব্যবহার করছে,” বিহারের এক দল ডুলি কারিগর স্পষ্ট আশঙ্কা প্রকাশ করলেন পারি’র কাছে।
অন্য ধাঁচের, একটু ছোট ঝুড়ি (টোকরি) অবশ্য বানানো যেতে পারে কিন্তু স্থানীয় মানুষজন যাঁরা এসব বানান তাঁদের সঙ্গেও তো শান্তি বজায় রাখতে হয়। তাঁরা এই কারিগরদের অনুরোধ করেই রেখেছেন, “দেখো ভাই, ইয়ে মত বানাও, আপনা বড়া ওয়ালা ডুলি বানাও…হামলোগ কা পেট মে লাথ মত মারো” [“এইসব ছোটো ঝুড়ি বানিও না, ভাই! তোমাদের ওই বড়ো ডুলিই বানাও। আমাদের ভাত মেরো না।”]
কুচবিহার আর আলিপুরদুয়ার জেলার হাটে একটা প্লাস্টিকের বস্তা বিকোয় ২০ টাকায়। যেখানে একটা ডুলিরই দাম পড়ে যায় ৬০০-১০০০ টাকা। এক বস্তায় ৪০ কিলো চাল ধরে, যেখানে একটা সাধারণ ডুলিতে ৫০০ কিলো চাল মজুত রাখা যায়।
ধান চাষি সুশীলা রাইয়ের কিন্তু ডুলিই পছন্দ। আলিপুরদুয়ারের দক্ষিণ চাকোয়াখেতির বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের মানুষটি জানাচ্ছেন, “প্লাস্টিকের বস্তায় চাল রাখলে তাতে কালো গুবরেজাতীয় পোকা [রাইস উইভিলস] ধরে। তাই আমরা ডুলিই ব্যবহার করি। বছর জুড়ে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অনেকটা পরিমাণ চাল জমা রাখি আমরা।”
কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুসারে, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই চালের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি (ভারতের মোট উৎপাদনের ১৩ শতাংশ), ২০২১-২২ সালে বার্ষিক উৎপাদন সেখানে ১৬.৭৬ মিলিয়ন।
*****
অক্টোবরের মাঝমাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কাটাবেন বাবন তারপর স্বল্প সময়ের জন্য আবার ফিরে যাবেন বিহারে। ফেব্রুয়ারি এলেই আবার আসামের চা বাগানের উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি আর চা পাতা তোলার মরসুমের ছয়-আট মাস ওখানেই কাটাবেন। “আসামের হেন জায়গা নেই যেখানে যাইনি আমি…ডিব্রুগড়, তেজপুর, তিনসুকিয়া, গোলাঘাট, জোড়হাট, গুয়াহাটি,” গড়গড় করে ছোটো-বড়ো শহর-নগরের নাম আউড়ে যান তিনি।
আসামে যে বাঁশের ঝুড়িগুলো তিনি বানান, তাকে বলে ধোকো। ডুলির তুলনায় ধোকো উচ্চতায় অনেক ছোটো – সব মিলিয়ে তিন ফুট। চা পাতা তোলার সময় ব্যবহার হয় এগুলো। মাসে ৪০০টা মতো ঝুড়িও বানান তিনি, প্রায়শই যার ফরমাশ দেয় চা-বাগানগুলো আর সেক্ষেত্রে তাঁর কাজের সময় এস্টেট থেকেই থাকার জায়গা আর কাঁচামাল হিসেবে বাঁশের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়।
বাঁশ কা কাম কিয়া, গোবর কা কাম কিয়া, মাটি কা কাম কিয়া, খেতি মে কাম কিয়া, আইসক্রিম কা ভি কাম কিয়া…[বাঁশ দিয়ে কাজ করেছি, মাটি দিয়ে কাজ করেছি, মায় গোবর দিয়ে কাজ করতেও ছাড়িনি। খেতে যেমন কাজ করেছি আইসক্রিম বেচার কাজেও তেমনি পিছপা হইনি।] সারা বছর জুড়ে তাঁর পেশা নিয়ে বলতে গিয়ে এমনই সরস উক্তি করলেন নানান কাজে দক্ষ বাবন।
আসামে ঝুড়ির ফরমাশে ঘাটতি পড়লে তিনি রাজস্থান কিংবা দিল্লি চলে যান আর সেখানে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম ফিরি করার কাজে লেগে পড়েন। তাঁর গ্রামের অন্যান্য লোকজনও একই পেশায় জুটলে, তিনি যখন যে কাজের চাহিদা সেই কাজেই ভিড়ে পড়েন দরকার মতো। “রাজস্থান, দিল্লি, আসাম, বাংলা – আমার গোটা জীবনটাই এই জায়গাগুলোর মধ্যে ঘুরেঘুরে কেটে গেল,” বলছেন তিনি।
দশকের পর দশক ধরে একাজে যুক্ত থাকার পরেও বাবনের কারিগর হিসেবে নাম নথিভুক্ত হয়নি। (বস্ত্রবয়ন মন্ত্রকের অধীনে) কারিগরি শিল্প উন্নয়ন অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে যে কারিগর পরিচয় পত্র (পেহচান কার্ড) দেওয়া হয়, মেলেনি তাও। এটা মূলত কারিগরকে একটা সরকারি পরিচিতি দেয় যা নানান সরকারি যোজনা, ঋণ কিংবা পেনশন পেতে কাজে আসে, নিপুণ কারিগরিবিদ্যার জন্য প্রস্তাবিত সম্মাননা পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতানির্ধারণে বিচার্য হয়, তাছাড়া দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা কিংবা পরিকাঠামোগত সহায়তাও পাওয়া যায় এর ফলে।
“আমাদের মতো অনেক [কারিগর] আছে, কিন্তু গরিবদের কথা আর ভাবেই বা কে? নিজেদের পকেট ভরাতেই ব্যস্ত সবাই,” বাবন বলে চলেন। তাঁর একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত নেই। “আটটা ছেলেপুলেকে বড়ো তো করেছি। এখন যদ্দিন শক্তি সামর্থ্য আছে কাজ করব, খাব। এর বেশি আর কি চাইতে পারি? [এছাড়া] আর কী বা করা যায়?”
মৃণালিনী মুখার্জি ফাউন্ডেশন (এমএমএফ) প্রদত্ত একটি অনুদানের সহায়তায় এই প্রতিবেদন রচিত হয়েছে।
অনুবাদ: রম্যাণি ব্যানার্জী