"আমার মনে আছে চালা থেকে মরা ইঁদুরগুলো কেমন করে ঝরে পড়ত ঘরের মধ্যে। এমন অলুক্ষুনে জিনিস আর কক্ষনো দেখিনি। আজ হয়ত এসব কথা শুনে হাসবেন, কিন্তু চালা থেকে মরা ইঁদুর টপকানো মানেই জান হাতে করে ঘরদুয়ার ছেড়ে পালানো, কবে যে ফিরব সেটা কেউই জানতাম না।"
ভয়াবহ এই দৃশ্যকল্পটি যিনি তুলে ধরলেন তিনি কোয়েম্বাটোরের কালাপট্টির বাসিন্দা কুরনধাইয়াম্মাই। ১৯৪০এর গোড়ার দিকে তামিলনাড়ুর এই শহরটি যখন শেষবারের মতো প্লেগের কবলে পড়েছিল, তখন সদ্য সদ্য কৈশোরে পা রেখেছিলেন তিনি। আজ তাঁর বয়স আশির কোঠায়।
গুটিবসন্ত থেকে প্লেগ, সঙ্গে দোসর কলেরা তো আছেই – সমগ্র দুনিয়া মহামারির এই উদীয়মান ইতিহাসের সাক্ষী হলেও কোয়েম্বাটোর অঞ্চলটির কথা যেন বিশেষভাবে নজর কাড়ে। এই কারণেই 'প্লেগ মারিআম্মানের' ('কালো মারিআম্মান' নামেও পরিচিত) মন্দিরের ছড়াছড়ি এখানে। ১৬টি মন্দির তো এই শহরেই রয়েছে।
হ্যাঁ, কোভিড-১৯ অতিমারির হাতে গড়া 'করোনা দেবীর' দেউলও আছে বটে, তবে প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরের মতো ভক্তের এমন বিপুল সমাগম অন্য কোথাও দেখতে পাবেন না চট করে। পাশের জেলা তিরুপ্পুরেও অনুরূপ দেবালয় রয়েছে গুটিকয়েক, দর্শনার্থীর ভিড় এবং পালা-পার্বণ লেগে থাকে সেখানেও।
১৯০৩ থেকে ১৯৪২ সালের মাঝে দশ-দশবার প্লেগের কবলে ছারখার হয়ে গিয়েছিল কোয়েম্বাটোর, প্রাণ যায় হাজার হাজার মানুষের। প্লেগ ছেড়ে যাওয়ার পর বহু দশক কেটে গেলেও সমাজের মননে তার শিকড় গেঁথে আছে। কুরনধাইয়াম্মাইয়ের মতো অসংখ্য বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের মনে 'প্লেগ' শব্দটির উচ্চারণ রেখে যায় হিমশীতল এক অনুরণন, এ শহর যে কী নারকীয় ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে তার শিরাউপশিরায়, আজও দগদগে তার স্মৃতি।
জমজমাট টাউন হল মহল্লায় রয়েছে প্লেগ মারিআম্মানের সবচাইতে বিখ্যাত মন্দিরটি। সন্ধের ব্যস্ততার জন্য পসরা সাজিয়ে নিতে নিতে বছর চল্লিশের ফুলবিক্রেতা কানাম্মল জানালেন: "আজ শুক্রবার। প্রচুর লোক আসতে চলেছে।" কথা বলছিলেন বটে, তবে এক মুহূর্তের জন্যও কিন্তু মালা-গাঁথা হাতদুটির থেকে নজর সরেনি তাঁর।
"তিনি সর্বশক্তিমান, বুঝলেন? করোনা দেবীর মন্দির আছে বটে, তবে তাতে কিস্যু যায় আসে না, কালো মারিআম্মান আমাদেরই একজন। তাঁর আরাধনা আমরা করবই, শরীর-টরির খারাপ হলে তো বটেই, তবে এছাড়াও আরও অনেক ধরনের পুজোআচ্চা আছে।" এই 'অনেক ধরনের পুজোআচ্চা' বলতে তিনি সুখ-সমৃদ্ধি-দীর্ঘায়ু কামনার কথা বোঝাতে চাইছিলেন, মানে ঈশ্বরের কাছে ভক্তকূল সাধারণত যা-যা চেয়ে থাকে। প্লেগের যুগ শেষ হওয়ার প্রায় চার দশক পর কানাম্মলের জন্ম হয়েছে ঠিকই, তবে সত্যিই 'তাতে কিস্যু যায় আসে না', তাঁদের প্রজন্মের অসংখ্য মানুষ দলে দলে এসে আজও হাত পাতেন মারিআম্মানের দরবারে।
কোয়েম্বাটোরের এই যে সাংস্কৃতিক জনজীবন, এতে গভীরভাবে ছাপ রেখে গেছে প্লেগ। "শহরের আদি বাসিন্দারা শুধুই যে সে মড়কের সাক্ষী তা নয়, তাঁরা তার শিকারও বটে। প্লেগের কবলে ভালোবাসার মানুষকে হারায়নি, হাজার ঢুঁড়লেও এমন একটি পরিবার খুঁজে পাবেন না এখানে," জানালেন কোয়েম্বাটোর নিবাসী লেখক সি. আর. এলানগোভান।
১৯৬১ সালের জেলা জনগণনা পুস্তিকা অনুযায়ী প্লেগের প্রকোপে ১৯০৯ সালে ৫,৫৮২ জন এবং ১৯২০ সালে ৩,৮৬৯ জনের মৃত্যু হয় কোয়েম্বাটোরে। অন্য একটি সূত্র বলছে যে ১৯১১ সালে প্লেগের খপ্পরে পড়ার এক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ৪৭,০০০ জনে। পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন, ১৯০১ সালে যে শহরের জনসংখ্যা ছিল ৫৩,০০০, সে শহরের উঠোনে চরতে থাকা বাস্তু ঘুঘু যে আদতে প্লেগ, সেটা বলাই বাহুল্য।
এলানগোভান জানালেন কেমন করে তাঁর নিজের পরিবার প্লেগের হাত থেকে বাঁচতে কোয়েম্বাটোর ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে "বাসা বেঁধেছিল", আশা ছিল একটাই, যাতে শহরে ফেরার আগেই "কোনও ক্ষতি না হয়ে যায়।" এ হেন আশা যে আজ কেবলই ডুমুরের ফুল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
"তখনকার ওই ভয়াবহ দিনগুলোয় না ছিল ওষুধপথ্যি, না ছিল ডাক্তারবদ্যি, মানুষজন তাই অসহায় হয়ে দেবতার শরণাপন্ন হত," যুক্তি সাজিয়ে বললেন কোয়েম্বাটোর-নিবাসী পতঙ্গবিজ্ঞানী পি. শিব কুমার। এ জেলার জাতিতত্ত্ব বিষয়ে তিনি সবিশেষ আগ্রহী।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই 'আশার' সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল ভয় এবং হতাশা। সালটা ১৯২৭, প্লেগের সূর্য তখন এ শহরের মধ্যগগনে, দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ঘোষণা করেন যে ধর্ম "মূলত এবং আদতে ভয়ের মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। একাধারে রয় অজানার আতঙ্ক, অন্যদিকে থাকে এমন এক জ্যেষ্ঠভ্রাতার আকাঙ্খা যে কিনা সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পাশে এসে দাঁড়াবে।"
এই যে ১৬টি মন্দির রয়েছে মহামারির দেবীর, এর পিছনে লুকিয়ে আছে সেই একই মনস্তত্ত্ব। তবে জনমানসে দেবীর নামটাও কিন্তু পাল্টেছে দিনে দিনে। "প্লেগ মারিআম্মানের নামটা মুখে মুখে কালো মারিআম্মান হয়ে গেছে," জানালেন এলানগোভান, "এবং যেহেতু তামিল ভাষায় 'মারি' বলতে 'কালো'-কেও বোঝায়, তাই খুব একটা অসুবিধা হয়নি এই বদলে।"
প্লেগের থাবা ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে স্মৃতি, বাস্তবের আয়নায় ফুটে ওঠে তার নানান রূপ।
"শরীর খারাপ হলেই মা-বাবা আমায় ওই মন্দিরটায় নিয়ে যেত, এ কথা মনে আছে আমার," জানালেন কোয়েম্বাটোর নিবাসী নিকিলা সি. (৩২), "ঠাম্মা তো হামেশাই যেত ওখানে। এমন কোনও রোগ নেই যেটা মন্দিরের পবিত্র জল খেলে সারবে না, এমনটা বিশ্বাস ছিল বাবা-মায়ের, পুজো-টুজো দিত তাই। মেয়ের অসুখ করলে আমিও ঠিক তেমনটাই করি আজ। ওকে নিয়ে গিয়ে পুজো দিই, চরণামৃত খাওয়াই। মা-বাবার মতো রোজ রোজ যাই না বটে, তবে একদমই যে যাই না তা নয়। এটাই তো এ শহরের রীতি গো।"
*****
টাউনহল মহল্লার প্লেগ মারিআম্মান মন্দিরে বসে এম. রাজেশ কুমার (৪২) বললেন: "আজ চার-চারটে প্রজন্ম ধরে এ মন্দিরের পুরোহিত আমরা। জলবসন্ত, চর্মরোগ, কোভিড-১৯, ভাইরাল জ্বর, সে যা-ই হোক না কেন, নিরাময়ের জান্য লোকে আজও মানত করতে আসে এখানে। সমস্ত অসুখবিসুখ সারিয়ে তুলতে পারে এই দেবী-মা, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সবাই।"
"১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মন্দিরটা রয়েছে। কোয়েম্বাটোরে প্লেগের মড়ক লাগলে [১৯০৩-১৯৪২] অন্যান্য মূর্তির পাশে আমার ঠাকুরদার বাবা এখানে প্লেগ মারিআম্মানকেও স্থাপন করেন। তারপর সে পুজোর দ্বায়িত্ব একে একে সামলেছে আমার ঠাকুরদা আর বাবা। আজ আছি আমি। সেদিন থেকে আজ অবধি, দেবীর মহিমার ছত্রছায়ায় থাকা এ অঞ্চলের ত্রিসীমানাও মাড়াতে পারেনি প্লেগ। সেই কারণেই লোকজনের মনে ভক্তি আজও অটুট।"
কোয়েম্বাটোরের সাইবাবা কলোনিতে যে মন্দিরটি রয়েছে, তাকে ঘিরেও রয়েছে অনুরূপ কিংবদন্তী। "এটা আদতে ১৫০ বছর আগে বানানো হয়েছিল," জানালেন ৬৩ বছর বয়সী ভি. জি. রাজাশেখরন, এই মহল্লার প্লেগ মারিআম্মান মন্দিরের প্রশাসনিক সমিতির সদস্য তিনি। তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে এই মন্দিরটিও প্লেগের আগেকার যুগে তৈরি।
মজার কথা হল এই মন্দিরগুলো এমনিতেই মারিআম্মানের ছিল, তবে অন্যান্য রূপ তথা অবতারে পুজো পেতেন দেবী। প্লেগের মড়ক এসে এই অঞ্চলটি ছারখার হয়ে গেলে অতিরিক্ত মূর্তি স্থাপন করা হয় – প্রত্যেকটিই পাথরের, প্রত্যেকটিই প্লেগ মারিআম্মানের রূপে।
রাজাশেখরন যে মন্দিরটির সেবাইত, সেটি গড়ে ওঠার তিন দশক পর মড়ক লেগেছিল এ শহরে: "প্রতিটি পরিবারে জনা পাঁচ-ছয় করে মানুষ মারা গিয়েছিল। আত্মীয়স্বজনদের হারানোর পর, কিংবা ছড়াতে থাকা প্লেগের কারণে যখন চালা থেকে মৃত ইঁদুর পড়তে শুরু করল, তখন ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই। চার-পাঁচ মাসের আগে বাড়িতে পা রাখার কোনও প্রশ্নই ছিল না।"
আজকের সাইবাবা কলোনি তখন ছিল ছোট্ট একটি গ্রাম, প্লেগের হাত থেকে রক্ষা পেতে গ্রামবাসীরা আলাদা একটি মূর্তি স্থাপন করে তার নাম দেন 'প্লেগ মারিআম্মান'। "আমাদের বাড়িতে দু'জন মারা যায়। কাকা অসুস্থ হলে ঠাম্মা তাঁকে মন্দিরে নিয়ে এসে প্লেগ মারিআম্মানের সামনে শুইয়ে রেখে নিম আর হলুদ বাটা মাখিয়ে দেয়। যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিল মানুষটা।"
সেদিন থেকে ওখানকার মানুষজন তথা আশেপাশের বহু গ্রামবাসীর (এই জায়গাগুলি আজ কোয়েম্বাটোর শহরের অংশবিশেষ) মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে মারিআম্মানের পুজো করলে তবেই প্লেগের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এলানগোভান মনে করেন যে এই কারণেই প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরের এমন ছড়াছড়ি আজ, রীতিমতো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে তারা। "সাইবাবা কলোনি, পীলামেডু, পাপ্পানাইক্কেনপালায়ম, টাউন হল, এই মহল্লাগুলো আদতে আলাদা আলাদা গ্রাম ছিল একশো বছর আগে। সবকটা আজ কোয়েম্বাটোর নগরের মধ্যে ঢুকে গেছে।"
তামিল সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পণ্ডিত তথা কাহিনিকার স্ট্যালিন রাজঙ্গমের মতে প্লেগ মারিআম্মানের প্রতি এই ভক্তির পিছনে লুকিয়ে আছে "নিতান্তই প্রাকৃতিক কিছু কার্যকারণ, গাঁ-কে-গাঁ উজাড় করে দেওয়া রোগের ত্রাস থেকে নির্গত একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তা-আতঙ্ক, এসবের থেকে মুক্তি দেবে দেব-দেবী: এর থেকেই তো জন্ম নেয় ধর্মবিশ্বাস। অসুখবিসুখের মতো শত্রু আর দুটি নেই মানব সভ্যতার পাঁজিতে। ফলত রোগের থেকে বাঁচার আশা ভক্তির জন্ম দেবে, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে?"
"খ্রিস্টধর্ম বা ইসলামের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা খাটে," বলছিলেন রাজঙ্গম, "মসজিদে গিয়ে দেখুন বাচ্চাকাচ্চাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। খ্রিস্টধর্মে আরোগ্য মাতার (রোগহর দেবী-মা) পুজো করা হয় এখানে। ওষুধপথ্য নিয়ে চর্চা করার ব্যাপারে তো বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিখ্যাত। তামিলনাড়ুর সিদ্ধারেরা আদি যুগে ডাক্তারিবিদ্যায় পণ্ডিত ছিলেন। সেই কারণেই তো চিকিৎসাশাস্ত্রে সিদ্ধ ঘরানার মতো একটা জিনিস রয়েছে এখানে।"
তামিলনাড়ুর প্রায় প্রতিটা গ্রামেই একটা করে মন্দির আছে মারিআম্মানের। একেক জায়গায় হয়ত একেক রকমের নাম, তবে দেবালয় তাঁর সর্বত্র বিরাজমান। দেবী যে একাধারে উগ্রচণ্ডা এবং রোগহর দয়াময়ী, এ সহাবস্থানের দেখা মেলে সব ধর্ম ও সব দেশেই। প্লেগ তথা মহামারির প্রতি এই যে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া, সাম্প্রতিককালে এ ব্যাপারটা নজর কাড়েনি এমন গবেষক দুনিয়াতে কোত্থাও নেই।
২০০৮ সালে প্রকাশিত 'ধর্ম ও মহামারি' নামক গবেষণাপত্রটিতে ইতিহাসবিদ ডুয়েইন জে. অসহাইম বলেছেন যে: "মহামারির থেকে একক বা বাঁধাধরা কোনও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয় না। এবং অনুরূপ ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া যে প্রলয়াত্মক হবেই, এমনটা হলফ করে বলা যায় না। ফলত ধর্ম যে লিঙ্গ, শ্রেণি, কিংবা জাতির মতোই বিশ্লেষণের একটি বিভাগ, এটা মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়। অসুখবিসুখের প্রতি মানুষের প্রতিস্পন্দন মাপতে গেলে মহামারির প্রতি ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া একটি পটভূমিকা হিসেবে উঠে আসে – এই পটভূমিকা জঙ্ঘম নয়, নিয়ত পরিবর্তনশীল।"
*****
আম্মান তিরুভিইয়া, অর্থাৎ মারিআম্মানের বাৎসরিক পুজো তামিলনাড়ুতে আজও জনপ্রিয়। রাজঙ্গমের মতে এ সকল উৎসব থেকে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের যে সম্পর্কটি উঠে আসে, সেটি বোঝার চেষ্টা করা উচিত আমাদের। আম্মানের মন্দিরে মন্দিরে এই উৎসবটি সাধারণত তামিল বর্ষপঞ্জিকার আদি মাসে (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য অগস্ট) পালিত হয়।
"এর আগের মাসগুলো জুড়ে – চিত্থিরাই, ভাইগাসি এবং আনি (যথাক্রমে মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে, মধ্য মে থেকে মধ্য জুন, এবং মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাই) – গ্রীষ্মের দাবদাহ চলতে থাকে তামিলনাড়ুতে," জানালেন রাজঙ্গম, "শুখার মরসুমে জমি-মাটি, শরীর সবকিছু যেন শুকিয়ে যায়। এই শুষ্কতার থেকে জন্ম নেয় আম্মাই অসুখ (জলবসন্ত/গুটিবসন্ত)। শরীর ঠান্ডা রাখাটাই একমাত্র পথ্য এই দুটো রোগের। তিরুভিইয়ার অস্তিত্ব এটাকে ঘিরেই।"
মুথু মারিআম্মানের (উক্ত দেবীর আরেক রূপ) পুজোর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে জলবসন্ত ও গুটিবসন্তের কবল থেকে তাৎক্ষণিক উপশম লাভের ইচ্ছা। "এই রোগদুটো হলে সারা শরীরে গুটি গুটি ফুসকুড়ি দেখা দেয়, এই কারণেই তো দেবীর নাম মুথু মারিআম্মান। আরে বাবা, তামিল ভাষায় 'মুথু' মানে মুক্তো তো! বসন্তের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে হাজার একটা পথ্যি আবিষ্কার হয়েছে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভক্তের দল ভিড় জমায় এই মন্দিরগুলোয়।"
রাজঙ্গমের মতে এ সকল উৎসবে প্রচলিত পুজোআচ্চার বিভিন্ন রীতিনীতির পিছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাক, চিকিৎসা-সংক্রান্ত কিছু মূল্য তো আছেই। "তিরুভিইয়ার লগ্ন পড়লে গাঁয়ে গাঁয়ে কাপ্পু কাট্টুথল নামক একটি রেওয়াজ শুরু হয়ে যায়। গাঁয়ের বাইরে বেরোনো বারণ তখন। গাঁয়ের মধ্যে, রাস্তাঘাটে, মায় বাড়ির ভিতরেও নিয়ম মেনে সাফসুতরো থাকতে হয়। সবাই জানে যে রোগবীজাণু মেরে ফেলতে নিমপাতার জুড়ি নেই, উৎসবের সময় তাই সবকিছুতেই নিমপাতার ব্যবহার দেখা যায়।"
কোভিড-১৯ অতিমারির জন্য যখন বিধিনিষেধ জারি করা হয়, বিজ্ঞানীরা তখনও হিমশিম খাচ্ছেন এ রোগের হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে, অথচ রাজঙ্গমের মতে সে বিধিনিয়মের সঙ্গে কাপ্পু কাট্টুথলের আশ্চর্য মিল রয়েছে। "পরিচ্ছন্নতার জন্য সানিটাইজার ব্যবহার করার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বলা হয়েছিল। কোভিডের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোকে সেই নিমপাতাকেই বেছে নিয়েছিল শেষমেশ," জানালেন তিনি।
তবে মড়কের সময় সামাজিক দূরত্ব মানা এবং এটাসেটা বিভিন্ন ধরনের সানিটাইজার ব্যবহার করার বুদ্ধিটা কিন্তু সর্বজনীন। কোভিড-১৯এর বাড়বাড়ন্তের সময় মানুষের মননে একঘরে হয়ে থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রয়োজন গেঁথে দিতে পুরী জগন্নাথের অকাট্য উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন ওড়িশার জনস্বাস্থ্য আধিকারিকেরা। বাৎসরিক রথযাত্রার আগে খোদ জগন্নাথ দেব নিজেকে কীভাবে অনসর ঘরে (একান্তবাসের কক্ষ) বন্দি করে রাখেন, এই কথাটাই জোর গলায় বলে বেড়িয়েছিল প্রশাসন।
অসুখবিসুখের সঙ্গে দেবীর এই লড়াইয়ের কাহিনি "এতটাই সর্বজনীন যে কর্ণাটকে এইডস্ রোগের জন্যও একটা আম্মান মন্দির আছে," জানালেন লেখক তথা নিউ ইয়র্কের সিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মবিদ্যা বিভাগের সহ-অধ্যাপক এস. পেরুনদেবী।
পেরুনদেবীর মতে মারিআম্মানের পুজো একটি "আদ্যন্ত সর্বাঙ্গীন ধারণা... তামিল ভাষায় 'মারি' বলতে বৃষ্টিকেও বোঝানো হয়। মুলাইপারির মতো পার্বণে মারিআম্মান শস্যজ্ঞানে পূজিত হয়ে থাকেন। অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে মণিমাণিক্যরূপে দেখা হয় মারিআম্মানকে। সুতরাং মারিআম্মান একাধারে রোগদাত্রী, রোগ এবং রোগহরা। প্লেগের ক্ষেত্রেও এই একই জিনিস দেখা গেছে।" তবে এই রোগটিকে রোমান্টিকতার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়, জানালেন পেরুনদেবী, "মারিআম্মানকে ঘিরে বেড়ে ওঠা কিংবদন্তী আদতে জীবনের নিরিখে দেখা অসুখ এবং সে অসুখের হাত থেকে বাঁচার উপায় খোঁজার এক গাথা বই আর কিছু নয়।"
*****
কে এই মারিআম্মান?
দ্রাবিড়ীয় এই দেবীকে ঘিরে গবেষক, ইতিহাসবিদ ও লোকসাহিত্যিকদের জল্পনার শেষ নেই।
গ্রামীণ তামিলনাড়ুর সবচাইতে জনপ্রিয় লোকদেবী এই মারিআম্মান। লোকায়ত জীবনে রক্ষাকর্ত্রী রূপে পূজিত হন তিনি। তাঁকে ঘিরে কিংবদন্তীর পসরা ততটাই বিচিত্র যতটা সে লোকগাথার উৎস।
কিছু কিছু ইতিহাসবিদের মতে মারিআম্মান আদতে নাগপট্টিনম থেকে আগত একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুণী যিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত মানুষদের সেবা করতেন। বৌদ্ধ পরম্পরা অনুযায়ী তিনি রোগীদের বুদ্ধের উপর আস্থা রাখার উপদেশ দিতেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং দানধ্যান করার নিদান দেওয়ার পাশাপাশি নিমপাতা ও প্রার্থনার দ্বারা অসুস্থের চিকিৎসা করাতে পটু ছিলেন এই ভিক্ষুণী। বৌদ্ধ জনশ্রুতি বলে যে তিনি নির্বাণ লাভ করার পর তাঁর মূর্তি বানিয়ে পুজো শুরু হয়, আর এভাবেই নাকি জন্ম নেয় মারিআম্মানের কাহিনি।
তবে এছাড়াও আরও বিভিন্ন বর্ণন রয়েছে সে লোকদেবীর। অনেকের ধারণা পর্তুগিজরা নাগপট্টিনমে আসার পর তাঁর নাম মেরিআম্মান হয়ে যায় এবং অচিরেই তিনি খ্রিস্টধর্মের অন্দরে স্থান পান।
অনেকে বলে যে মারিআম্মান নাকি উত্তর ভারতের গুটিবসন্ত তথা অন্যান্য সংক্রামক রোগের দেবী শীতলার এক রূপবিশেষ। শীতলা (সংস্কৃতে যার অর্থ 'যিনি শৈত্য দান করেন'), যাঁকে শিবজায়া পার্বতীর এক অবতার হিসেবেও দেখা হয়।
তবে বিগত কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা নিরন্তর গবেষণায় দেখা গেছে যে মারিআম্মান আদতে দলিত ও অন্যান্য অন্ত্যজ জাতির দ্বারা পূজিতা গ্রামীণ এক লোকদেবী। দলিত সমাজেই লুকিয়ে আছে তাঁর আদি উৎস।
সবর্ণরা যে এ হেন বহুজনবন্দিত দেবীকে তাঁর অপার জনপ্রিয়তার জন্য যুগে যুগে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে এসেছে, এটাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই তেমন।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত 'তামিলনাড়ুর মারিআম্মান অর্চনা' শিরোনামের একটি গবেষণাপত্রে ইতিহাসবিদ ও লেখক কে. আর. হনুমন্থন লিখেছিলেন: "তামিলনাড়ুর আদিতম অধিবাসীদের দ্বারা পূজিতা মারিআম্মান যে প্রাচীন একজন দ্রাবিড়ীয় লোকদেবী...সেটা পারিয়াহদের [পারাইয়ার, একটি তফসিলি জাতি] সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র থেকে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। তামিলনাড়ুতে বসবাসকারী দ্রাবিড়ীয় জনজাতির মানুষদের মধ্যে প্রাচীনতম এই সম্প্রদায়টি একদা 'অস্পৃশ্য' রূপে গণ্য হত।"
হনুমন্থনের মতে এই লোকদেবীর একাধিক দেবালয়ে পারাইয়ার জাতির মানুষেরাই "পুরোহিত রূপে নিযুক্ত ছিলেন বহুযুগ ধরে। উদাহরণস্বরূপ চেন্নাইয়ের কাছে থিরুভেরকাডুর কারুমারিআম্মান মন্দিরের কথা বলা যেতে পারে। পুজোআচ্চার দ্বায়িত্বে আদিতে পারাইয়ার-রাই ছিলেন। তারপর ধর্মীয় বৃত্তিদান আইন [১৮৬৩] জারি হওয়াতে পৌরহিত্যের ভূমিকাটি ব্রাহ্মণদের কুক্ষিগত হয়ে যায়।" প্রান্তিক জনজাতির মন্দিরগুলি এমনিতেই সবর্ণের দখলে চলে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, তবে ঔপনিবেশিক এই ব্রিটিশ আইনটির দ্বারা সে প্রক্রিয়াটি আইনের চোখে বৈধতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর তামিলনাড়ুর মতো অনেক রাজ্যেই নিত্যনতুন আইন পাশ করে এই অন্যায়টি লাঘব বা প্রশমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
*****
সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু তাই বলে 'করোনা দেবীর' মন্দির? সত্যি?
হ্যাঁ, কোয়েম্বাটোরের শহরতলি ইরুগুরে অবস্থিত এমনই একটি মন্দিরের অধ্যক্ষ আনন্দ ভারতী জানালেন: "প্লেগ মারিআম্মানের পুজোর সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যায় ব্যাপারটা। করোনা দেবীর মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত যখন নিই, অতিমারির তরঙ্গ তখন তুঙ্গে। পুজো না করলে মুক্তি নেই, এটাই দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের।"
তাই কোভিড-১৯ অতিমারির ঢেউ ভারতের মাটিতে আছড়ে পড়ার পর যে কটি স্থানে দেবরূপে এ রোগের পুজো করা শুরু হয়, তার মধ্যে জ্বলজ্বল করছে কোয়েম্বাটোরের নাম।
কিন্তু 'দেবী' কেন? করোনা মারিআম্মান কেন নয়? প্রশ্নটা যে খুব একটা বেআক্কেলে ছিল না এটা হলফ করে বলা যায়। এই শব্দ দুটো একত্রে আনলে আভিধানিক ও অর্থগত সমস্যা তৈরি হবে, জোর গলায় জানালেন ভারতী। "মারিআম্মান শব্দটা প্লেগের সঙ্গে খাপে খাপে বসে যায়, করোনার সঙ্গে নৈব নৈব চ। তাই ঠিক করলাম যে 'দেবী' বলাটাই ভালো।"
তামিলনাড়ুর প্রায় প্রতিটা গ্রামেই একটা করে মন্দির আছে মারিআম্মানের। একেক জায়গায় হয়ত একেক রকমের নাম, তবে দেবালয় তাঁর সর্বত্র বিরাজমান
চিকিৎসা শাস্ত্রে হাজারো উন্নতি সত্ত্বেও অসুখবিসুখের প্রতি জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ায় এ হেন লোকদেবতার পুজোআচ্চার স্থান আজও অটুট।
তবে লকডাউনের কারণে প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরের মতো করোনা দেবীর থানে ভক্তের এমন উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় না। মানুষখেকো এই জীবাণু ঘিরে তৈরি হওয়া মন্দিরে যে ঈশ্বরের পাশাপাশি অতিমারির বিধিনিষেধগুলিও দেবরূপে পূজিত হবে, এটা তো বলাই বাহুল্য! মন্দির সমিতির দাবি – একটানা নাকি ৪৮ দিন ধরে যজ্ঞ করার পর মাটির তৈরি করোনা দেবীর মূর্তি নিমজ্জিত করা হয়েছে নদীর জলে। ভক্তকূলের নিমিত্তে মন্দিরের দরজা আজ অবারিত থাকলেও দেবমূর্তির এমন বেবাক অনুপস্থিতি অনেকেই হজম করতে পারছেন না।
তবে কোয়েম্বাটোরের জনজীবনে প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরের যে স্থান, সেটা করোনা দেবী আদৌ কোনদিন দখল করতে পারবেন বলে মানতে নারাজ এলানগোভানের মতো লেখকেরা। "এটা নিতান্তই একটা লোক-দেখানো হুজুগে ব্যাপার। প্লেগ মারিআম্মানের ধারেকাছেও আসতে পারবে না। তুলনা করাটাই অবান্তর। কোয়েম্বাটোরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়ে বেঁচে আছে প্লেগ মারিআম্মানের এই দেউলগুলি।"
প্লেগ হয়তো আজ কেবলই সময়ের গহ্বরে ঝাপসা এক স্মৃতি, কিন্তু এ শহরে প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরে মন্দিরে আজও লেগে থাকে ভক্তির জোয়ার। সালটা ২০১৯, কোভিড-১৯ অতিমারি এই শুরু হল বলে, পাপ্পানাইক্কেনপালায়মের প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরে উৎসব চলাকালীন হঠাৎই একটি টিয়াপাখি উড়ে এসে দেবীমূর্তির উপরে বসে। অমনি পলক ফেলতে না ফেলতেই হুলুস্থুলু কাণ্ড! ভক্তিরসে ডুবে একাল ওকাল ত্রিকালে গিয়ে ঠেকে ভক্তবৃন্দের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে এই 'ঘটনার ঘনঘটা-টি' ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলেছিল, ভক্তের জোয়ার অচিরেই রূপান্তরিত হয় সুনামিতে। এলানগোভানের কথায়: "মারিআম্মান আদতে গ্রামদেবী। যুগ যুগান্তর পেরিয়েও তাঁর মন্দিরগুলি জনসাধারণের মাঝে প্রাসঙ্গিক থাকবে। টাউন হল মহল্লার ওই যে কোনিয়াম্মান মন্দিরটা? ওখানকার উৎসবের কথাই ধরুন, মাটি খুঁড়ে যে পবিত্র অগ্নিকুণ্ডটা বানানো দরকার, সেটা কিন্তু হয় ওই একই পাড়ার প্লেগ মারিআম্মানের মন্দিরে। পুজোআচ্চার রীতিনীতি সব জড়িয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। কোনিয়াম্মানকে কোয়েম্বাটোরের রক্ষাকর্ত্রী বলে মনে করা হয়।"
তবে বর্তমান প্রজন্মের সব্বাই যে এই সূক্ষ্ম তথা নিবিড় ইতিহাস ও কিংবদন্তীর ব্যাপারে অবগত, তা মোটেও নয়। অথচ এই মন্দিরগুলির ভূমিকা তাদের জীবনে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। "বিশ্বাস করুন, এই মন্দিরগুলোর ইতিহাস যে এমন বিচিত্র, তা ঘুণাক্ষরেও জানতাম না," বললেন কোয়েম্বাটোর-নিবাসী ব্যবসায়ী আর. নারাইন (২৮), "মায়ের সঙ্গে আমিও রোজ পুজো দিতে আসি এখানে, ভবিষ্যতেও আসব। এসব কথা জানা বা না-জানার সঙ্গে এর কোনও সংযোগ নেই। বরং, উল্টে ভক্তিটা হয়ত বাড়লেও বাড়তে পারে এত সব সাতপাঁচ শুনে!"
ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশান থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে কবিতা মুরলীধরন জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)