কমলার গর্ভে যখন তাঁর চতুর্থ সন্তানটি এলো এবং তিনি সেটি রাখবেন না বলে ঠিক করলেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গন্তব্য হওয়ার কথা ছিল তাঁদের জনপদ থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেনুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু তা হল না। বাড়ি থেকে কয়েক পা হেঁটে সাপ্তাহিক হাট অবধিই তাঁর দৌড়, তিনি বললেন, “আমি জায়গাটার কথাই জানতাম না। আমার স্বামীও পরে জানতে পারে।”
গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৩০ ছুঁই ছুঁই কমলা ও তাঁর স্বামী, ৩৫ বছর বয়সী রবি (নাম পরিবর্তিত) প্রথমে যান তাঁদের জনপদের কাছে একজন স্থানীয় ‘ডাক্তার’-এর কাছে। “এক বন্ধু আমাদের তাঁর কথা বলেন”, কমলা বললেন। কমলা নিজের বাড়ির কাছে ছোট্ট এক টুকরো জমিতে সবজি চাষ করে হাটে বিক্রি করেন আর রবি কাজ করেন স্থানীয় মান্ডিতে এবং তিন একর জমিতে নিজের দুই ভাইয়ের সঙ্গে গম আর ভুট্টা চাষ করেন। যে চিকিৎসা কেন্দ্রের কথা তাঁরা বললেন সেটি বড়ো রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ‘হাসপাতাল’ বলা হলেও এরা ‘ডাক্তার’ লেখা কোনো নামফলক প্রবেশদ্বারে রাখেনি অথচ বাড়িটির উঠোনকে ঘিরে রাখা দেওয়ালের সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকা ফ্লেক্সগুলিতে ঐ ব্যক্তির নামের আগে ডাক্তার লেখা রয়েছে।
‘ডাক্তার’বাবুটি, ৫০০ টাকার বিনিময়ে কমলাকে পাঁচটি ওষুধের বড়ি দিয়ে তিন দিন খেতে বলে পরের রুগিকে ডেকে নিলেন। ওষুধগুলি সম্বন্ধে কোনও তথ্য দেওয়া হল না, এর সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও কিছু বলা হল না আর সবচেয়ে জরুরি কথা, কবে নাগাদ তাঁর গর্ভপাত হতে পারে তাও জানানো হল না।
ওষুধ খাওয়ার ঘন্টা কয়েকের মধ্যে কমলার রক্তস্রাব শুরু হয়। “কটা দিন অপেক্ষা করেও যখন রক্তপাত বন্ধ হল না তখন আমরা যে ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিল তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমাদের বললেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সাফাই করে আসতে।” এর অর্থ গর্ভাশয়ের সাফাই ।
শীতের নরম রোদে বেনূর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাইরে একটি বেঞ্চে বসে কমলা অপেক্ষা করছেন গর্ভপাত (মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি) করার জন্য কখন তাঁর ডাক আসবে। এই প্রক্রিয়ায় সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট, কিন্তু আগে ও পরে তিন থেকে চার ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এরজন্য প্রয়োজনীয় রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা আগেরদিনই করা হয়েছে।
ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর জেলার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ২০১৯ সালে ঝাঁ-চকচকে করে তোলা হয়েছে। উজ্জ্বল রঙে হাসিখুশি মা আর স্বাস্থ্যবান বাচ্চার ছবি আঁকা প্রসূতিকক্ষ আছে, আছে ১০ শয্যা বিশিষ্ট ওয়ার্ড, ৩ শয্যা বিশিষ্ট প্রসবকক্ষ, অটোক্লেভ যন্ত্র, প্রসবের জন্য অপেক্ষারত মায়েদের থাকার ব্যবস্থা এমন কি একটি ছোটো শাকসবজির বাগানও। মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত বস্তারের এই এলাকায় জনস্বাস্থ্য পরিষেবার বেশ উজ্জ্বল ছবি তৈরি হয় এইসব বন্দোবস্ত দেখে।
বেনূর স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি (নারায়ণপুর ব্লক) এই জেলার মধ্যে সর্বাধিক সুব্যবস্থা ও উন্নত পরিষেবাযুক্ত,” বললেন রাজ্যের প্রাক্তন প্রসূতি-স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা ডঃ রোহিত বাঘেল। “এখানকার ২২ জন কর্মীর মধ্যে আছেন একজন ডাক্তার, একজন আয়ুষ (দেশীয় চিকিৎসাপদ্ধতির জন্য), একজন চিকিৎসা আধিকারিক, পাঁচজন নার্স, দুজন ল্যাবরেটারি পরিচালক, এবং একজন কম্পিউটার চালক।
৩০-কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বসবাসকারী সব রোগীকে পরিষেবা দেওয়ার কথা এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির — এলাকার অধিকাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। এই জেলার মোট জনসংখ্যার ৭৭.৩৬ শতাংশই গোণ্ড, আভূজ মারিয়া, হালবা, ধুরবা ও মারিয়া ইত্যাদি তফশিলি জনজাতিভুক্ত।
কিন্তু একটি পলকা ডট ছাপ পাতলা শালে মুখ ঢেকে কমলা জানালেন, “আমরা তো জানতামই না এখানে এসব করানো যায়।” তাঁর তিন সন্তান - ১২ ও ৯ বছর বয়সী দুই মেয়ে এবং ১০ বছরের একটি ছেলে সবাই গোণ্ড সমাজের দাইয়ের হাতে বাড়িতেই হয়েছে। কমলা সন্তান জন্মের আগে বা পরের কোনও যত্নই পাননি। এটিই হল তাঁর প্রজনন সম্বন্ধীয় প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার প্রথম অভিজ্ঞতা। “আমি এই প্রথম হাসপাতালে এলাম,” তিনি বললেন। “শুনেছি অঙ্গনওয়াড়িতে ওরা ওষুধের বড়ি দেয়, কিন্তু আমি কখনও সেখানে যাইনি।” কমলা বলছিলেন গ্রামীণ স্বাস্থ্য সংগঠকদের কথা যাঁরা গ্রামে আসেন ফলিক অ্যাসিডের বড়ি দিতে আর সন্তানসম্ভবা মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে।
জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কমলার মতো অসন্তোষ এখানে অনেকেরই আছে। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৪ (২০১৫-১৬) দেখায় যে গ্রামীণ ছত্তিশগড়ে ৩৩.২ শতাংশ মহিলা প্রসব করেন বাড়িতে — কোনও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নয়। এই রিপোর্ট এটাও দেখায় যে কমলার মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এমন গ্রামের মহিলাদের মধ্যে মাত্র ২৮ শতাংশ, স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৪ আরও বলছে, ‘অপরিকল্পিত গর্ভসঞ্চার এখানে তুলনায় বেশি’, এবং ‘গর্ভপাত করিয়েছেন এমন মহিলাদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশের কিছু না কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে।’
নারায়ণপুরের নিম্নমানের যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পন্ন গ্রামে বসবাসকারী ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে প্রজনন স্বাস্থ্য পরিষেবা অতি দুর্লভ। নারায়ণপুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অধীনে আটটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৬০টি সহ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও এখানে অভাব চিকিৎসকের। “জেলার ৬০ শতাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ খালি। জেলা হাসপাতালের বাইরে কোনও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নেই,” বললেন ডঃ বাঘেল। ওরছা ব্লকের গার্পা এবং হান্ডাওয়াড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুটিই একটি ঘর থেকে চলে। তিনি আরও বললেন যে এগুলির জন্য না আছে নির্দিষ্ট কোনও বাড়ি না আছে কোনও তালিকাভুক্ত চিকিৎসক।
এর ফলেই কমলার মতো আরও অনেক মহিলাকে অযোগ্য ‘ডাক্তার’-দের দ্বারস্থ হতে হয় প্রজনন স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য। “আমাদের আদিবাসী মহিলারা অনেকেই জানেন না কে অ্যালোপ্যাথ আর কে নয়। আমাদের ‘ঝোলা ছাপ ডাক্তার’ আছে কিছু যারা একেবারে হাতুড়ে (ওষুধ দেওয়ার যোগ্যতা এদের নেই) কিন্তু এরা ইঞ্জেকশন, ওষুধ, স্যালাইন সব দেয়, কেউ কোনও প্রশ্ন তোলে না এই নিয়ে,” ইউনিসেফ-এর সাহায্যপ্রাপ্ত একটি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক প্রকল্পের সহ সমন্বয়কারী হিসাবে বস্তারের, সাথী সমাজ সেবী সংস্থার হয়ে কর্মরত, গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়েরই মানুষ প্রমোদ পোটাই জানালেন।
এই অভাব দূর করতে রাজ্য সরকার, গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহায়কের পদ সৃষ্টি করেছে। ২০০১ সালে যখন ছত্তিশগড় রাজ্য গঠিত হয় তখন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্তরে, অনুমোদিত ১,৪৫৫টি স্বাস্থ্য আধিকারিক পদের মধ্যে মাত্র ৫১৬ টি ভর্তি ছিল। ২০০১ সালে ছত্তিশগড় চিকিৎসা মণ্ডল আইনের লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ এলাকার জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা। তিন বছরের যে পাঠক্রমটির নাম ছিল ‘আধুনিক ঔষধ ও অস্ত্রোপচার প্রয়োগকারী’, সেই নাম তিন মাসের মধ্যে বদলে করা হয় ‘বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থায় ডিপ্লোমা’। ভারতীয় চিকিৎসা পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই কাজ করা হয়েছিল এবং ‘আধুনিক ঔষধি ব্যবস্থা’ এবং ‘অস্ত্রোপচার’-এর মতো কথা ব্যবহার করায় আইনগত জটিলতা দেখা দেয়। এই পাঠক্রমের অন্তর্গত ছিল বায়োকেমিক চিকিৎসা, ভেষজ-খনিজ চিকিৎসা, আকুপ্রেসার, ফিসিওথেরাপি, চৌম্বক-থেরাপি এবং ফুল ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসা। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহায়কদের কেবলমাত্র গ্রামীণ ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ‘সহকারী চিকিৎসা আধিকারিক’ হিসাবে নিয়োগ করার কথা ছিল।
ভারতীয় চিকিৎসা পরিষদ অবশ্য এই ডিপ্লোমা পাঠক্রমের প্রস্তাব এই বলে খারিজ করে দেয় যে এই পাঠক্রম চিকিৎসা পরিষেবার মান নামিয়ে দেবে। ছত্তিশগড়ের বিলাসপুরে উচ্চ ন্যায়ালয়ে তিনটি রিট পিটিশন দায়ের হয় (প্রথমটি করে চিকিৎসা পরিষদের ছত্তিশগড় শাখা ২০০১ সালে, অন্যগুলি করে স্বাস্থ্যকর্মী সংঘ, নার্স সংঘ ও অন্যান্যরা)। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে উচ্চ ন্যায়ালয় লক্ষ্য করে যে রাজ্য ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘সহ চিকিৎসা আধিকারিক’ বলার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। ন্যায়ালয় নির্দেশ দেয় যে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের নামের আগে ডঃ জুড়তে পারবেন না, কোনও এমবিবিএস চিকিৎসকের অধীন না হলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না এবং প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান/ রোগীর স্থিতাবস্থা ফেরানো/ আপতকালীন পরিস্থিতি/ জরুরি অবস্থা ছাড়া হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অভাব পূরণ করেছিলেন। “চিকিৎসকের অভাবজনিত কারণে যাঁরা হাতুড়েদের কাছে যেতেন তাঁরা এখন অন্ততঃ গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে যেতে পারেন,” তিনি বললেন। “তাঁদের যেহেতু চিকিৎসা বিদ্যায় কিছুটা প্রশিক্ষণ আছে তাঁরা খানিক চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে কিছু কথা বুঝিয়ে বলতে পারেন — এর বেশি কিছু অবশ্য তাঁরা পারেন না। একজন এমবিবিএস চিকিৎসকই কেবল জন্মনিয়িন্ত্রণ বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে গর্ভপাত সম্পর্কিত ওষুধ লিখে দিতে পারেন।”
বাঘেল জানালেন যে ২০১৯-২০ সালে রাজ্যে ১,৪১১ জন গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী কর্মরত আছেন। “প্রসূতি মৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমার জন্য কিছু কৃতিত্ব অন্তত তাঁদের প্রাপ্য,” বললেন তিনি। ছত্তিশগড়ে শিশুমৃত্যুর হার ২০০৫-০৬ সালে ৭১ শতাংশ থেকে ২০১৫-১৬ সালে ৫৪ শতাংশে নেমে এসেছে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসবের হার ওই সময়কালের মধ্যে ৬.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫.৯ শতাংশ (জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৪)।
কমলা একথা জানেনই না যে তিনি যে ‘চিকিৎসকের’ কাছে গিয়েছিলেন তিনি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী না কি কোনও হাতুড়ে। গর্ভপাত করার জন্য যে মাইসোপ্রোস্টল বা মিফপ্রোস্টন — ওষুধ দেওয়া হয়েছিল তা এদের কারোরই দেওয়ার এক্তিয়ার নেই। “এমবিবিএস চিকিৎসকদেরও এমন কি এইসব ধরনের ওষুধ লিখে দেওয়ার আগে সরকারি হাসপাতালে একটি ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়,” বললেন ২৬ বছর বয়সী অ্যালোপ্যাথ, ডঃ পরমজিৎ কাউর, যিনি বেনূর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত। “রোগীদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হয় যাতে তাঁদের অধিক রক্ত ক্ষরণ না হয় বা তাঁদের গর্ভপাত যাতে অসম্পূর্ণ না থাকে — এমন হলে প্রাণনাশের ভয় থাকে।
যে দুবছর তিনি বস্তারে নিযুক্ত আছেন তার মধ্যে কমলার মতো বহু জাল চিকিৎসার শিকারকে পেয়েছেন বলে জানালেন কাউর। তাঁর বহির্বিভাগের রোগীদের তালিকা দেখায় যে প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন রোগী তাঁর কাছে আসেন নানা রোগ নিয়ে আর শনিবার (হাটবারে) এই সংখ্যা ১০০তে পৌঁছায়। “এমন অশিক্ষিত চিকিৎসকদের হাতে নাকাল অনেক ‘মেরামতির’ কেস (প্রজনন সম্বন্ধীয়) আমি বহির্বিভাগে দেখি। গর্ভপাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে রোগ সক্রমণ থেকে বন্ধাত্ব, মারাত্মক রোগ থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি হতে পারে,” তিনি বললেন। তিনি আরও বললেন, “যে মহিলারা আসেন তাঁদের বেশিরভাগ এসব জানেনই না।” রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ ও শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা না করেই এরা একটা ওষুধের বড়ি দিয়ে ছেড়ে দেয় — এই পরীক্ষাগুলি ছাড়া ওষুধ দেওয়াই উচিত নয়।”
হালবি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সীতা (নাম বদলে দেওয়া হয়েছে) বেনূর থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ধোবাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন তাঁর দুবছরের বাচ্চাকে নিয়ে। তাঁর কথায়, “আমার সন্তান আমি বাড়িতেই প্রসব করেছি এবং প্রসবের আগে বা পরে কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নিইনি।” প্রসবের আগে ও পরে পরীক্ষা করানোর জন্য যে অঙ্গনওয়াড়িতে স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যায় তা তাঁর বাড়ি থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। সীতা আরও বললেন, “ওঁর কথা আমি কিছুই বুঝি না।”
যে সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি তাঁদের মধ্যে অনেকেই জানালেন যে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা একটি বড়ো অন্তরায়। বস্তারের গ্রামে বেশিরভাগ আদিবাসী গোণ্ড ও হালবি ভাষা বোঝেন, আর বোঝেন সামান্য ছত্তিশগড়ি। স্বাস্থ্যকর্মীরা স্থানীয় মানুষ নাও হতে পারেন বা এর মধ্যে যে কোনও একটি ভাষাই কেবল জানতে পারেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে আর এক সমস্যা। ধোবাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ৪৭টি গ্রামকে পরিষেবা দিলেও তার মধ্যে ২৫টির কোনো বাইরে বেরোবার উপযুক্ত পথ নেই বলে জানালেন ধোবাই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী ৩৮ বছর বয়সী এল কে হরজপাল। “প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছানো এক সমস্যা তার উপর আছে ভাষার সমস্যা, ফলে আমরা আমাদের কাজ (অন্তঃসত্ত্বাদের উপর নজর রাখা) করে উঠতে পারি না,” বললেন তিনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে আমাদের সহায়ক দাই নার্সরা (এএনএম) সব বাড়িতে পরিষেবা পৌঁছে দিতেও পারেন না।” রাজ্য সরকার বেশি সংখ্যক মহিলার কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে ২০১৪ থেকে বাইক অ্যাম্বুলেন্স চালু করেছে, বর্তমানে জেলায় এমন অ্যাম্বুলেন্স আছে পাঁচটি।
এই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারকারীদের মধ্যে আছেন ২২ বছর বয়সী দশমতী যাদব। তিনি এবং তাঁর স্বামী প্রকাশের একটি দেড় মাসের কন্যা সন্তান আছে; তাঁরা দুজনে মিলে পাঁচ একর জমি চাষ করেন। “আমি যখন প্রথমবার গর্ভধারণ করলাম সিরহা (গ্রামের প্রথাগত চিকিৎসক) আমাকে অঙ্গনওয়াড়ি অথবা হাসপাতাল, কোথাও যেতে বারণ করেছিলেন। তিনিই দেখবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার পুত্র সন্তানটি বাড়িতে জন্মাবার কিছুকালের মধ্যেই মারা যায়,” বললেন দশমতী। “সেইজন্যই এইবার আমার স্বামী অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আমাকে বেনূর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান প্রসব করাতে।” তাঁর বাড়ি থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির মাহাতারি এক্সপ্রেস (ছত্তিশগড়ি ভাষায় মাহাতারি মানে মা) নামের একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে — ১০২-এ ফোন করে তা ডাকা যায়। দশমতীর মেয়ে বেশ ভালো আছে আর দশমতীর মুখেও এখন হাসি লেগে আছে।
“অধিক সংখ্যক মহিলাকে হাসপাতালে প্রসব করতে উৎসাহ দিতে (কেন্দ্রীয় সরকার) জননী শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে; এই যোজনায় হাসপালে যাওয়ার খরচ সহ বিনামূল্যে হাসপাতালে থাকা খাওয়া ও ওষুধপথ্যের বন্দোবস্ত আছে,” জানালেন নারায়ণপুরের জেলা স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শদাতা ডঃ মীনাল ইন্দুরকর। তিনি আরও বললেন, “তাছাড়া যে মা সন্তান জন্মানোর আগে চারটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেন এবং শিশুর টিকাকরণ সম্পূর্ণ করান, তাঁকে ৫,০০০ টাকা দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনার অধীনে।”
বেনূর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, কমলা তার গর্ভপাতের জন্য অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় রয়েছেন, ইতিমধ্যে রবি তাঁর স্ত্রীর জন্য এক কাপ চা নিয়ে হাজির। লম্বা হাতাওয়ালা শার্ট এবং নীল জিন্স পরিহিত রবি জানান তাঁরা যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছেন সেকথা পরিবারের লোকজনকে জানাননি। তাঁর কথায়, “পরে তাঁদের জানাব, তিন তিনটি বাচ্চা মানুষ করতে হবে; আর সন্তান আনার সামর্থ্য আমাদের নেই।”
কমলা খুব অল্প বয়সে পিতা মাতাকে হারান এবং তাঁর কাকার কাছে তিনি বেড়ে ওঠেন, এই কাকাই তাঁর বিয়ের ব্যবস্থাও করেছিলেন। বিয়ের আগে তিনি তাঁর স্বামীকে দেখেননি। “মাসিক শুরু হওয়ার অল্পসময়ের মধ্যেই আমার বিয়ে হয়েছিল। আমাদের সমাজে এমনটাই ধারা। বিয়ে বলতে ঠিক কী বোঝায় সে বিষয়ে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। পিরিয়ড সম্পর্কে আমার পিসি কেবল বলেছিলেন ‘ ডেট আয়েগা’ [‘তারিখ’ অর্থাৎ পিরিয়ড আসবে]। আমি স্কুলে যাইনি এবং আমি লিখতে-পড়তে পারি না, তবে আমাদের তিন সন্তানের সকলেই স্কুলে পড়ছে,” সগর্বে বলেন কমলা।
কমলার ইচ্ছা কয়েক মাস পর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ফিরে গিয়ে টিউবাল লাইগেশন (বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি) করিয়ে আসবেন কারণ পৌরুষ চলে যাওয়ার আশংকায় তাঁর স্বামী ভাসেক্টমি করাতে চান না। যদিও হাসপাতালে গিয়ে কমলা এই সবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও বন্ধ্যাত্বকরণের কথা শুনেছেন, তবে তিনি চটপট বিষয়গুলি বুঝে নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “চিকিৎসক আমাকে জানিয়েছেন যে আমি যদি বারবার অন্তঃসত্ত্বা না হতে চাই তাহলে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।” মধ্য তিরিশে পৌঁছে তবে কমলার জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে শিক্ষার শুরু হল ইতিমধ্যেই যখন তিনি কিনা তিন সন্তানের মা হয়ে গেছেন এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজের সন্তান ধারণের ক্ষমতা পুরোপুরি বিনষ্ট করতে চলেছেন।
লেখক ভূপেশ তিওয়ারি , অবিনাশ অবস্থী এবং বিদুষী কৌশিককে এই প্রতিবেদনে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ।
প্রচ্ছদ চিত্র: নিউ -মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অভিব্যক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন । তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম আর কাগজের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ ।
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা