সাহারিয়া আদিবাসী গুট্টি সমন্যাকে যখন মধ্যপ্রদেশের বনদপ্তর ‘চিতা মিত্র’ হিসেবে নথিভুক্ত করে, তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছিল, “বাঘ দেখলে ফরেস্ট রেঞ্জারকে খবর দেবে।”

সবেতন না হলেও কাজটা গুরুত্বপূর্ণই মনে হয়েছিল তখন। আফ্রিকা থেকে চিতা আসছে বলে কথা! ৮ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, পাহাড়-সমুদ্র পেরিয়ে, কার্গো আর মিলিটারি উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টারে চেপে কুনো জাতীয় উদ্যানে এসে নামবে তারা। তাদের আনার ব্যবস্থাতে ভারত রাষ্ট্র কত বিদেশি মুদ্রা খরচ করেছে তার কোনও হিসেব দেওয়া হয়নি, আর তাদের বসবাসের জন্য সংরক্ষণ খাতে দেশি রাজকোষ ফাঁকা করে টাকা ঢালা হয়েছে।

এই চিতা মিত্রদের কাজ হবে চোরাশিকারীদের হাত থেকে, এবং চিতারা কোনওভাবে গ্রামে ঢুকে পড়লে গ্রামবাসীদের রোষের হাত থেকে চিতাদের রক্ষা করা। অতএব দেশের কাজের জন্য কোমর বাঁধলেন স্থানীয় প্রায় ৪০০-৫০০ চিতা মিত্র – অরণ্যবাসী, ক্ষুদ্র চাষি, দিনমজুর – কুনো-পালপুর অভয়ারণ্যের আশপাশের ছোটো বসতি ও গ্রামের বাসিন্দা সবাই।

কিন্তু চিতারা যবে থেকে এসে পৌঁছেছে, বেশিরভাগ সময়টাই তারা কাটিয়েছে খাঁচাঘেরা এলাকায়। কুনোর জঙ্গলে স্থানে স্থানে মাথা উঁচিয়েছে বেড়া, চিতাদের ভিতরে রাখার, এবং অন্যদের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যে। “আমাদের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। সেসাইপুরা আর বাগচায় নতুন গেট বানিয়েছে,” জানালেন শ্রীনিবাস আদিবাসী – চিতা মিত্র হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন তিনিও।

Left: The new gate at Peepalbowdi .
PHOTO • Priti David
Right: The Kuno river runs through the national park, and the cheetah establishment where visitors are not allowed, is on the other side of the river
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: পিপলবাওড়ির নতুন গেট। ডানদিকে: জাতীয় উদ্যানের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে কুনো নদী, সাধারণের অপ্রবেশ্য যে এলাকায় চিতাদের রাখা হয়েছে সেটি নদীর ওপারে

Gathering firewood (left) and other minor forest produce is now a game of hide and seek with the forest guards as new fences (right) have come up
PHOTO • Priti David
Gathering firewood (left) and other minor forest produce is now a game of hide and seek with the forest guards as new fences (right) have come up
PHOTO • Priti David

জ্বালানি কাঠ (বাঁদিকে) আর ছোটোখাটো জঙ্গল থেকে আসা জিনিস সংগ্রহ করা ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ নতুন নতুন জায়গায় বেড়া (ডানদিকে) বসে গেছে এখন

গুট্টি এবং তাঁর মতো সহস্রাধিক সাহারিয়া আদিবাসী ও দলিতরা একসময়ে কুনোর জঙ্গলে চিতাবাঘ এবং অন্যান্য বন্যজন্তুর পাশাপাশিই বাস করতেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে হাই-প্রোফাইল চিতা প্রকল্পের কারণে বাগচা গ্রামের শেষ যে ক’জন বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করে ৪০ কিলোমিটার দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হল তাদের একজন ছিলেন তিনি। “জঙ্গল থেকে এত দূরে পাঠিয়ে দিলে চিতা মিত্রর কাজই বা করব কী করে?” প্রশ্ন তুলছেন তিনি।

চিতাদের ঘিরে যে বিপুল নিরাপত্তা আর গোপনীয়তার বলয় তৈরি করা হয়েছে তাতে আদিবাসীদের পক্ষে চিতাদের চর্মচক্ষে দেখা প্রায় অসম্ভব। গুট্টি আর শ্রীনিবাস দু’জনেই জানালেন, বনদপ্তরের দেখানো “ভিডিওতেই খালি চিতা দেখেছি।”

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আট চিতার প্রথম দল ভারতে আসে, ২০২৩-এ আরও ১২টি, ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬ মাস হল চিতা প্রকল্প উদ্বোধনের। আমদানি হয়ে আসা চিতাদের সাতটি মারা গেছে, আর ভারতের মাটিতে জন্ম নেওয়া ১০টি চিতাদের মধ্যে তিনটি – অর্থাৎ এই প্রকল্পের অধীনে এখনও পর্যন্ত মোট ১০টি চিতা মারা গেছে।

কিন্তু চিন্তার কোনও কারণ নেই, আশ্বস্ত করছে বনদপ্তরের চিতা আনয়ন-সম্পর্কিত ‘ অ্যাকশন প্ল্যান ’, কারণ প্রকল্পের সাফল্যের জন্য ৫০ শতাংশ বাঁচার হারই যথেষ্ট। কিন্তু সেটা মুক্ত, সর্বত্রগামী চিতাদের জন্য প্রযোজ্য। কুনোর চিতাদের মূলত রাখা হয়েছে ‘বোমা’ বা ঘেরাটোপে, যাদের আয়তন ৫০ x ৫০ মিটার থেকে ০.৫ x ১.৫ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত, তাদের প্রয়োজনীয় পৃথকীকরণ, আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, কোনওরকম অসুস্থতা থাকলে তার উপশম এবং সম্ভব হলে শিকার করার সময়-সুযোগ দিতে – আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা অর্থব্যয়ে। খোলা অরণ্যে ইচ্ছামতো ঘোরার, জীবনধারণ, শিকার ও মৈথুন করার বিশেষ সুযোগ এখনও ঘটেনি তাদের, যদিও এই প্রকল্পের অন্যতম ঘোষিত উদ্দেশ্য সেটাই।

তার বদলে চিতারা এখন শিকার করছে তাদের নির্দিষ্ট ঘেরাটোপের ভিতরে। কিন্তু, “এভাবে চিতাদের পক্ষে নিজেদের এলাকা চিহ্নিত করা এবং মৈথুন শুরু করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মাদি চিতাদের একজনেরও মদ্দা চিতাদের সঙ্গে যথেষ্ট জান-পহ্‌চানের সুযোগ ঘটেনি। কুনোয় জন্ম নেওয়া সাতটি চিতার মধ্যে ছ’টিরই বাবা একজন, পবন,” জানাচ্ছেন ড. অ্যাড্রিয়ান টর্ডিফ। দক্ষিণ আফ্রিকার পশু চিকিৎসক টর্ডিফ প্রজেক্ট চিতা-র অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন, কিন্তু তাঁর দাবি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করায় তাঁকে প্রথমে দমিয়ে দেওয়া এবং শেষে প্রকল্প থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।

A map of the soft release enclosures (left) for the cheetahs and quarantine bomas (right)
PHOTO • Photo courtesy: Project Cheetah Annual Report 2022-2023
A map of the soft release enclosures (left) for the cheetahs and quarantine bomas (right)
PHOTO • Photo courtesy: Project Cheetah Annual Report 2022-2023

চিতাদের নিয়ন্ত্রিত মুক্তির জন্য নির্ধারিত জায়গার ম্যাপ (বাঁদিকে) এবং পৃথকীকরণের ঘেরাটোপ ‘বোমা’ (ডানদিকে)

একদা ৩৫০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট অভয়ারণ্য কুনোর আয়তন প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়েছিল যাতে বন্যজন্তুরা নিরাপদে মুক্ত অরণ্যে চলাফেরা ও শিকার করতে পারে। ১৯৯৯ সাল থেকে ১৬ হাজারেরও বেশি আদিবাসী মানুষকে এই এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বাঘজাতীয় প্রাণীদের ঘোরাফেরার জায়গা করে দিতে।

“হাম বাহার হ্যায়, চিতা অন্দর [আমরা বাইরে আছি, আর চিতারা ভিতরে]!” বিস্ময় বাধ মানে না মাঙ্গিলাল আদিবাসীর, বাগচার বাসিন্দা এক সাহারিয়া আদিবাসী। সদ্যই উচ্ছেদ হয়েছেন ৩১ বছর বয়সি মাঙ্গিলাল, শেওপুর তেহসিলের চাকবামুলিয়ায় তাঁর নতুন বাড়ি ও জমি আবার আয়দায়ক করে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গুট্টি, শ্রীনিবাস  ও মাঙ্গিলাল সাহারিয়া আদিবাসী, মধ্যপ্রদেশে অতিবিপন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত এবং উপার্জনের জন্য গঁদের আঠা, জ্বালানি কাঠ, ফলমূল, শিকড়বাকড় ইত্যাদি অরণ্যসম্পদের উপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল।

“বাগচায় [যেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে] আমরা জঙ্গলে ঢুকতে পারতাম। আমার ১৫০০টিরও বেশি চির গঁদ গাছ আমি ছেড়ে এসেছি ওখানে, যাদের উপর আমার পরিবারের কয়েক প্রজন্ম ধরে অধিকার আছে,” জানালেন মাঙ্গিলাল। পড়ুন: কুনো অরণ্যে চিতার আগমনে আদিবাসীরা উৎখাত । এখন তিনি ও তাঁর গ্রাম তাঁর গাছগুলোর থেকে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে; জঙ্গলে ঢুকতেই পারেন না এখন – বেড়া দিয়ে বাইরে করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের।

“আমাদের বলা হয়েছিল ১৫ লক্ষ টাকা পাব [উচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে]। কিন্তু আমাদের শুধু দিয়েছে বাড়ি বানানোর তিন লক্ষ, খাবার কেনার ৭৫ হাজার, আর বীজ-সার ইত্যাদির জন্য ২০ হাজার টাকা,” জানালেন মাঙ্গিলাল। বাকি ১২ লক্ষ টাকা নাকি তাঁদের নতুন নয় বিঘা (তিন একরের কাছাকাছি) জমির পাট্টা, বিজলি, রাস্তাঘাট, জল আর নিকাশি এইসব তৈরিতে লেগেছে, তাঁকে জানিয়েছে বনদপ্তরের উচ্ছেদ কমিটি থেকে।

নতুন বাগচা গ্রামের পটেল বা মোড়ল হলেন বাল্লু আদিবাসী – উৎখাত হওয়া মানুষরা চেয়েছিলেন পুরনো নামটা অন্তত থেকে যাক। শীত সন্ধ্যার মরা আলোয় চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বাড়ি তৈরির জঞ্জাল, কালো ত্রিপলের তাঁবু, হিম হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো প্লাস্টিকের ছেঁড়া টুকরোর দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। যতদূর চোখ যায় আধা-কাজ-হওয়া ইট-সিমেন্টের বাড়ির সারি, শেওপুর টাউনগামী ব্যস্ত রাজপথের ধার ধরে বিছিয়ে আছে। “বাড়িগুলো শেষ করব, কী খাল কেটে, ঢাল বানিয়ে চাষের ক্ষেত প্রস্তুত করব, তার পয়সাই নেই,” বলছেন তিনি।

The residents of Bagcha moved to their new home in mid-2023. They say they have not received their full compensation and are struggling to build their homes and farm their new fields
PHOTO • Priti David
The residents of Bagcha moved to their new home in mid-2023. They say they have not received their full compensation and are struggling to build their homes and farm their new fields
PHOTO • Priti David

বাগচার বাসিন্দারা ২০২৩ সালের মাঝামাঝি তাঁদের নতুন জায়গায় আসেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, পুরো ক্ষতিপূরণ এখনও মেলেনি, এবং নতুন জায়গায় বাড়ি বানাতে আর চাষের জমি তৈরি করতে প্রবল সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা

'We don’t have money to complete our homes or establish our fields with channels and slopes,' says headman, Ballu Adivasi
PHOTO • Priti David
'We don’t have money to complete our homes or establish our fields with channels and slopes,' says headman, Ballu Adivasi
PHOTO • Priti David

‘বাড়িগুলো শেষ করব, কী খাল কেটে, ঢাল বানিয়ে চাষের খেত প্রস্তুত করব, তার পয়সাই নেই’, বলছেন মোড়ল বাল্লু আদিবাসী

“এখানে যা দেখছেন সেগুলো আমাদের বোনা ফসল নয়। স্থানীয় লোককে জমি বাটাই [ভাড়া] করে দিতে হয়েছে। যে টাকা দিয়েছে তাতে আমাদের পক্ষে চাষ করা সম্ভব নয়,” জানালেন বাল্লু। তিনি আরও জানাচ্ছেন, স্থানীয় উচ্চবর্ণ গ্রামের ভালো করে চষা, সমান সরেস জমির সঙ্গে তাঁরা যে ঝড়তি-পড়তি জমি পেয়েছেন তার কোনও তুলনাই হয় না।

২০২২ সালে পারি যখন বাল্লুর সাক্ষাৎকার নেয় তিনি জানিয়েছিলেন, ২০ বছর আগে যারা উচ্ছেদ হয়েছিল তারা এখনও রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের মুখ দেখেনি: “আমরা এই অবস্থায় পড়তে চাই না,” উচ্ছেদের বিরোধিতায় তখন বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। পড়ুন: কুনো অভয়ারণ্য: পড়ে রইল বঞ্চনার সিংহভাগ

কিন্তু এখন তিনি এবং তাঁর গ্রামবাসীরা ঠিক সেই অবস্থাতেই পড়েছেন।

“যখন আমাদের কুনো থেকে বার করার দরকার ছিল, তখন যা বলছিলাম ফটাফট মেনে নিচ্ছিল। এখন চেয়ে দেখ, পাত্তাও দেবে না,” চিতা মিত্র হয়েও বলছেন গুট্টি সমন্যা।

*****

শেষতম আদিবাসীটিকেও বার করে দিয়ে এখন জাতীয় উদ্যানের গোটা ৭৪৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাই চিতাদের জন্য সংরক্ষিত – এক বিরল সুযোগ যা ভারতীয় সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। তাঁরা বলছেন ভারতের নিজস্ব বন্যপ্রাণ অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৭-২০৩১ অনুসরণ করলে গাঙ্গেয় শুশুক, গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড পাখি, সামুদ্রিক কচ্ছপ, এশীয় সিংহ, তিব্বতি নীলগাই এবং অন্যান্য একাধিক দেশজ প্রজাতি “অত্যন্ত বিপন্ন… এবং সর্বাধিক গুরুত্বপ্রাপ্ত” হিসেবে চিহ্নিত। এই তালিকায় চিতা কোথাও নেই।

কুনোয় চিতা আনতে ভারত সরকারকে একাধিক আইনি ও কূটনৈতিক বাধা টপকাতে হয়েছে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট ভারতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এশীয় চিতার (Acinonyx jubatus venaticus) পরিবর্ত হিসেবে আফ্রিকান চিতা নিয়ে আসার (Acinonyx jubatus) নিয়ে আসার পরিকল্পনা “খারিজ” করে দিয়েছিল।

কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ সর্বেক্ষণের (এনটিসিএ) দাখিল করা নতুন প্লি পিটিশনে সুপ্রিম কোর্ট বলে পরীক্ষামূলক ভাবে চিতাদের আনা যেতে পারে। আরও বলা হয়েছিল যে এনটিসিএ একা এই পরিকল্পনার বাস্তব কার্যকারিতা নির্ধারণ করতে পারবে না, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

The cheetahs came in special chartered flights and were moved in to Kuno in Indian Air Force helicopters
PHOTO • Photo courtesy: Project Cheetah Annual Report 2022-2023
The cheetahs came in special chartered flights and were moved in to Kuno in Indian Air Force helicopters
PHOTO • Photo courtesy: Project Cheetah Annual Report 2022-2023

চিতাদের আনা হয়েছিল বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটে, আর কুনোয় নিয়ে যাওয়া হয় ভারতীয় বায়ুসেনার হেলিকপ্টারে করে

সেইমতো কম-বেশি ১০ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রজেক্ট চিতা স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কমিটির প্রাক্তন বৈজ্ঞানিক টর্ডিফ বলছেন, “আমায় কখনও ডাকা হয়নি [কোনও বৈঠকে]।” এই চিতা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক বিশেষজ্ঞ পারি-কে বলেছেন যে তাঁদের সুপারিশ পদে পদে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং, “উপরমহলের এ বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই, কিন্তু তাঁরা আমাদের নিজেদের মতো করে কাজও করতে দেবেন না।” যেটা জলের মতো স্পষ্ট তা হল, খুব উচ্চপদস্থ কেউ একজন এই প্রকল্পকে সফল হিসেবে দেখাতে অত্যন্ত উদ্‌গ্রীব এবং যে কোনও রকমের ‘নেতিবাচক’ খবর রুষ্ট নজরে দেখা হত।

সুপ্রিম কোর্টের তরফে একটা ফাঁক পাওয়ামাত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে চিতা প্রকল্প মাঠে নামানো হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন এটা সংরক্ষণ প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একটা বড়ো জয়, এবং নিজের ৭২তম জন্মদিন পালন করেন কুনোয়, বিদেশি চিতাদের প্রথম দলটির আগমনের মধ্যে দিয়ে।

প্রধানমন্ত্রীর সংরক্ষণ নিয়ে এই নব উদ্যমের সঙ্গে তাঁর অতীত ভাবমূর্তি খুব একটা মেলে না – ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সেখানকার সিংহদের রাজ্য থেকে সরানোর উদ্যোগ আটকে দেওয়া হয়েছিল তারা ‘গুজরাটের অহঙ্কার ’ বলে, এবং সেই সিদ্ধান্তের পিছনে তাঁর হাত ছিল বলে মনে করা হয়। এই উদ্যোগ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, কারণ এশীয় সিংহ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসার্ভেশন অফ নেচার বা আইইউসিএন ঘোষিত বিপন্ন প্রজাতির লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী।

তারপর দু’দশক পেরিয়ে গেছে; এশীয় সিংহদের জন্য দ্বিতীয় একটি বাসস্থান তৈরি এখনও সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ – ভারত একমাত্র দেশ যেখানে এশীয় সিংহ (Panthera leo ssp persica) এখনও আছে এবং তারা সবাই একটিই জায়গায় থাকে – গুজরাটের সৌরাষ্ট্র উপদ্বীপ অঞ্চল। কুনোতে নিয়ে আসার কথা ছিল এই সিংহদেরই – যে সংরক্ষণ উদ্যোগের ভিত্তি বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক নয়।

চিতাদের নিয়ে আসার জন্য এত চাপ ছিল যে দ্বিতীয় কিস্তিতে চিতা রপ্তানিকারক দেশ নামিবিয়াকে তুষ্ট করতে হাতির দাঁতের বাণিজ্য বিষয়ে নিজেদের কড়া বিরোধিতাতেও সুর নরম করেছে ভারত। ভারতের বন্যপ্রাণ (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৭২ -এর ৪৯বি ধারা বলে আমদানি-সহ যে কোনও ধরনের হাতির দাঁত বেচাকেনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নামিবিয়া হাতির দাঁত রপ্তানিকারক দেশ। কাজেই ২০২২ সালে পানামায় আয়োজিত বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক সম্মেলনে হাতির দাঁতের বাণিজ্যিক বিপণন বিষয়ে ভোটদান থেকে বিরত থাকে ভারত। স্পষ্টতই এটা একধরনের কূটনৈতিক লেনদেন।

Prime Minister Narendra Modi released the first cheetah into Kuno on his birthday on September 17, 2022
PHOTO • Photo courtesy: Project Cheetah Annual Report 2022-2023

২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নিজের জন্মদিনে কুনোয় প্রথম চিতাটিকে ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

শেষ আদিবাসীরাও বেরিয়ে যাওয়ার পর জাতীয় উদ্যানের পুরো ৭৪৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাই এখন চিতাদের জন্য ছেড়ে রাখা আছে। কিন্তু আমাদের জাতীয় সংরক্ষণ প্রচেষ্টার লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত গাঙ্গেয় শুশুক, গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড পাখি, সামুদ্রিক কচ্ছপ, এশীয় সিংহ, তিব্বতি নীলগাই, এবং অন্যান্য দেশীয় বিপন্ন ও লুপ্তপ্রায় প্রজাতি – বিদেশ থেকে আমদানি করা চিতা নয়

বাগচায় বসে মাঙ্গিলাল কিন্তু বলছেন, চিতা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই – তাঁর চিন্তা হল ছয়জনের পরিবারে ভাত আর জ্বালানি জোটাবেন কীভাবে। “শুধু চাষ করে সংসার টানা যাবে না,” নিশ্চিত গলায় বলেন তিনি। কুনোর ভিতরে নিজেদের বাড়িতে তাঁরা জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, ডাল এবং নানারকম শাকসবজি ফলাতেন। “এখানকার মাটি ধানের জন্য ভালো। কিন্তু জমি প্রস্তুত করতে খরচ অনেক, আর আমাদের হাতে টাকা নেই।”

শ্রীনিবাস জানাচ্ছেন তাঁকে কাজের খোঁজে জয়পুর যেতে হবে। “এখানে আমাদের জন্য কোনও কাজ নেই, আর জঙ্গল বন্ধ করে দিয়েছে, তাই অন্য রোজগারেরও পথ নেই,” বলছেন তিন সন্তানের বাবা; ছোটোটির মাত্র আট মাস বয়স।

২০২১ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (MoEFCC) প্রকাশিত ভারতে চিতা আনয়ন অ্যাকশন প্ল্যানে স্থানীয় মানুষদের জন্য কর্মসংস্থানের উল্লেখ ছিল। কিন্তু চিতাদের দেখভাল আর পর্যটন ঘিরে শ’খানেক চাকরি ছাড়া বেশিরভাগ স্থানীয় মানুষেরই কোনও সুবিধা হয়নি।

*****

প্রথমে সিংহ, এখন চিতা – কেন্দ্র-রাজ্য রাজনীতিতে সবাই এখন দাবার ঘুঁটি, রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি গঠনের হাতিয়ারমাত্র। সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা শুধুই ফাঁকি।

চিতা অ্যাকশন প্ল্যান একটি ৪৪ পাতার নথি যাতে দেশের পুরো সংরক্ষণ উদ্যোগের মধ্যমণি করে তোলা হয়েছে চিতাদের। চিতারা নাকি ‘ঘাসজমি পুনরুদ্ধার করবে… কৃষ্ণসার হরিণদের রক্ষা করবে… জঙ্গলকে মানুষমুক্ত করবে…’, পরিবেশবান্ধব পর্যটনে উৎসাহ দেবে, আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও পালিশ করে দেবে – ‘ভারতকে চিতা সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক উদ্যোগে অবদানকারী হিসেবে দেখা হবে।’

এই প্রকল্পের টাকা এসেছে এনটিসিএ-এর আনুমানিক ১৯৫ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট (২০২১), কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল-এর কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি তহবিল থেকে। আর কোনও পশু বা পাখি দিল্লির তখত থেকে এত অর্থবল, লোকবল, এবং সহায়তা বার করে আনতে পারেনি!

সমস্যাটা হল, কেন্দ্রের এহেন গভীর উৎসাহই চিতা প্রকল্পকে খাদের মুখে ঠেকে দিচ্ছে। “রাজ্য সরকারি কর্মীদের উপর ভরসা করার বদলে কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিকরা পুরো প্রকল্পটা দিল্লিতে বসে চালানোর চেষ্টা করছেন। এর কারণে বহু সমস্যাই অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে,” বলছেন জে. এস. চৌহান।

চিতারা যখন আসে তখন মধ্যপ্রদেশের মুখ্য বন্যপ্রাণ ওয়ার্ডেন ছিলেন চৌহান। “আমি ওঁদেরকে অনুরোধ করে বলি, কুনোতে ২০টিরও বেশি চিতাকে রাখার জায়গা নেই, কয়েকটিকে যেন অন্যত্র পাঠানোর অনুমতি আমাদের দেওয়া হয়, সেইসব জায়গা চিতা অ্যাকশন প্ল্যানের সুপারিশ অনুযায়ীই স্থির করা হবে।” চৌহানের ইঙ্গিত পার্শ্ববর্তী রাজস্থানের মুকান্দ্রা হিলস্‌ ব্যাঘ্র প্রকল্পের দিকে, যেখানে ৭৫৯ বর্গকিলোমিটার ঘেরা অরণ্য আছে।

The hundreds of square kilometres of the national park is now exclusively for the African cheetahs. Radio collars help keep track of the cat's movements
PHOTO • Photo courtesy: Project Cheetah Annual Report 2022-2023
The hundreds of square kilometres of the national park is now exclusively for the African cheetahs. Radio collars help keep track of the cat's movements
PHOTO • Photo courtesy: Adrian Tordiffe

জাতীয় উদ্যানের কয়েকশো বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন শুধু আফ্রিকান চিতাদের জন্য সংরক্ষিত। রেডিও কলার দিয়ে চিতাদের গতিবিধির উপর নজরদারি চালানো হয়

বর্ষীয়ান ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস অফিসার চৌহান বলছেন, তিনি এনটিসিএ-র সদস্য-সচিব এস. পি. যাদবকে একাধিক চিঠি লিখেছেন “উক্ত প্রজাতির প্রয়োজন মাথায় রেখে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার” অনুরোধ করে। তার কোনও উত্তর আসেনি। উলটে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক মাস পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

চিতাদের যারা নিয়মিত দেখাশোনা করছিলেন তাঁদের বলা হয়েছিল সরকারের চোখের মণি এই পশুগুলিকে বিরোধী দল কংগ্রেস শাসিত কোনও রাজ্যে [রাজস্থান] পাঠানো সম্ভব নয়। “অন্তত নির্বাচন অবধি তো নয়ই [২০২৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সংঘটিত]।”

চিতার মঙ্গল যে অগ্রাধিকার নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।

“আমরা বোকার মতো ভেবেছিলাম এটা একটা সাধারণ সংরক্ষণ প্রকল্প,” হতাশ টর্ডিফ বলছেন, যিনি এখন নিজেকে এই প্রকল্প থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চান। “এর রাজনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে সেটা আমরা ভাবিনি।” তিনি জানাচ্ছেন, এর আগে বহু চিতা স্থানান্তকরণ প্রকল্পে যুক্ত থেকেছেন তিনি, কিন্তু সেগুলির উদ্দেশ্য ছিল সংরক্ষণ, এমন সাংঘাতিক রাজনৈতিক টানাহেঁচড়া ছিল না।

ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় ফেরার পর একটি মিডিয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় মধ্যপ্রদেশের গান্ধী সাগর অভয়ারণ্যকে (ব্যাঘ্র প্রকল্প নয়) চিতাদের পরবর্তী দলের আগমনের জন্য প্রস্তুত করা হবে।

কিন্তু চিতাদের এই তৃতীয় দলটি কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা চিতা পাঠাতে আর উৎসাহী নয় কারণ ভারতে পাঠিয়ে শুধু শুধু দেশের চিতাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য সে দেশের সরকার সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রভূত সমালোচিত হয়েছে। “কেনিয়া থেকে চাওয়ার একটা কথা উঠেছিল, কিন্তু কেনিয়াতে এখন চিতার সংখ্যা কমতির দিকে,” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ জানালেন।

*****

“জঙ্গল মে মঙ্গল হো গয়া [জঙ্গলের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে],” ব্যঙ্গের সুরে বলেন মাঙ্গিলাল।

সাফারি পার্কে তো আর বুনো চিতার দরকার নেই, খাঁচাবন্দি চিতা দিয়েই দিব্যি কাজ চলে যাবে।

চিতাদের পিছনে আছে ভারত সরকারের সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা – পশুচিকিৎসকের গোটা দল, নতুন হাসপাতাল, ৫০টিরও বেশি ট্র্যাকার, ১৫টি ক্যাম্পার ভ্যনের চালক, ১০০ জন ফরেস্ট গার্ড, ওয়্যারলেস অপারেটর, ইনফ্রা-রেড ক্যামেরা অপারেটর, আর গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের জন্য একাধিক হেলিপ্যাড পর্যন্ত আছে। এটা শুধু কোর এলাকার জন্য। বাফার এলাকার জন্য আছে আলাদা গার্ড ও রেঞ্জারের দল।

রেডিও কলার গলায় বাঁধা, ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে থাকা চিতারা ‘বনে মুক্ত’ নেই, তাই মানুষের সঙ্গে তাদের মোলাকাতও হয়নি এখনও। স্থানীয় মানুষজন কেউ আনন্দধ্বনি করতে যাননি, কারণ চিতা আসার কয়েক হপ্তা আগে রাইফেলধারী গার্ডেরা অ্যালসেশিয়ান স্নিফার কুকুর নিয়ে কুনোর নিকটবর্তী গ্রামে-গ্রামে হানা দেয়। কুকুরের দাঁত আর রাইফেলের ডগায় বার্তা চলে যায় – চিতাদের সঙ্গে ‘চালাকি’ করলে কুকুরদের লেলিয়ে দেওয়া হবে খুনের অর্ডার দিয়ে।

Kuno was chosen from among many national parks to bring the cheetahs because it had adequate prey like chitals ( Axis axis ) (right)
PHOTO • Priti David
Kuno was chosen from among many national parks to bring the cheetahs because it had adequate prey like chitals ( Axis axis ) (right)
PHOTO • Priti David

বহু জাতীয় উদ্যানের মধ্যে থেকে কুনোকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে শিকার পশুর উপস্থিতি, যেমন চিতল হরিণ (Axis axis) (ডানদিকে)

কুনোকে বেছে নেওয়া হয়েছিল “পর্যাপ্ত শিকার পশুর জোগান” আছে বলে, বলছে ভারতে চিতা আনয়ন বিষয়ে ২০২৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট । কিন্তু হয় সেই তথ্য ভুল, নয়তো সরকার কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না। “কুনোতে শিকারের জোগান তৈরি করা দরকার,” এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন মধ্যপ্রদেশের প্রিন্সিপল মুখ্য অরণ্য সংরক্ষক অসীম শ্রীবাস্তব। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি, এবং জানালেন যে কুনোর লেপার্ড বা চিতাবাঘের সংখ্যা ১০০-র কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তাই শিকারের সংখ্যাতেও চাপ পড়ছে।

“আমরা একটা ১০০ হেক্টর ঘেরাটোপ তৈরি করছি চিতল হরিণ ব্রিড করার জন্য, কারণ শিকারের বাড়তি জোগান তৈরি করা খুব জরুরি,” যোগ করলেন শ্রীবাস্তব – বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইএফএস অফিসার যদি প্রায় দু’দশক ধরে পেঞ্চ, কানহা ও বান্ধবগড় ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলি সামলেছেন।

চিতাদের ক্ষেত্রে তহবিল কোনও সমস্যা নয় – সম্প্রতি প্রকাশিত এই রিপোর্ট বলছে, “চিতা আনয়ন ফেজ ১-এর সময়কাল পাঁচ বছর, বরাদ্দ তহবিল ৩৯ কোটি টাকা (৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।”

“সবচেয়ে প্রচারিত এবং ইতিহাসের অন্যতম ব্যয়বহুল সংরক্ষণ প্রকল্প,” চিতা আনয়নের প্রকল্পকে এভাবেই বর্ণনা করছেন সংরক্ষণ বিজ্ঞানী ড. রবি চেল্লাম। চিতাদের জন্য বাড়তি শিকার পশু আনাটা একটা ভয়াবহ উদাহরণ তৈরি করছে বলে তাঁর মত। “এটাকে যদি সংরক্ষণের দৃষ্টিতে দেখি, তবে আমরা একটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নাক গলাচ্ছি পরিণাম কী হতে পারে না বুঝেই। এই চিতাগুলোকে বন্যজন্তু হিসেবেই দেখা উচিত,” যোগ করলেন এই বন্যপ্রাণ জীববিজ্ঞানী – সারাজীবন সিংহ নিয়ে কাজ করেছেন, এবং এখন চিতা প্রকল্পটিকে খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি।

দীর্ঘসময়ে চিতাদের বন্দি করে রেখে এবং তুলনামূলকভাবে ছোটো এলাকার মধ্যে বাড়তি শিকার পশু ছেড়ে আমরা আসলে দীর্ঘমেয়াদে ওদের শারীরিক সক্ষমতার হানি ঘটাচ্ছি, বলছেন চেল্লাম। ২০২২ সালেও তিনি সাবধান করেছিলেন: “এটা একটা প্রচুর অর্থসাপেক্ষ সাফারি পার্ক ছাড়া আর কিছুই হবে না।” তাঁর কথাই সত্যি হতে চলেছে: ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাঁচ দিনের উৎসবের মাধ্যমে কুনোয় আনুষ্ঠানিকভাবে চিতা সাফারি শুরু হয়ে গেছে, আর ইতিমধ্যেই অন্তত ১০০-১৫০ জন ৩,০০০-৯,০০০ টাকা খরচ করে কুনোয় জিপ সাফারি করে এসেছেন।

Kuno was cleared of indigenous people to make way for lions in 1999 as Asiatic lions are on the IUCN  Red List  of threatened species
PHOTO • Photo courtesy: Adrian Tordiffe

১৯৯৯ সালে কুনো থেকে মূলনিবাসী মানুষদের উৎখাত করা হয়েছিল সিংহদের নিয়ে আসার জন্য, যেহেতু এশীয় সিংহ আইইউসিএন-এর বিপন্ন প্রজাতির লাল তালিকায় উঠে গেছে

লাভের আশায় মাঠে নেমে পড়েছে হোটেল আর সাফারি পরিচালক সংস্থাগুলিও – চিতা সাফারি-সহ ‘ইকো’ রিসর্টে এক রাত্রিবাসের ভাড়া যাচ্ছে দু’জনের জন্য ১০,০০০ থেকে ১৮,০০০ টাকার মধ্যে।

বাগচা গ্রামে অবশ্য টাকা নেই, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। “চিতা এসে আমাদের কোনও লাভ হয়নি,” বলছেন বাল্লু। “যদি আমাদের পুরো ১৫ লক্ষ টাকাটা দিত, তবে আমরা ভালো করে খাল কেটে, মাটি সমান করে চাষের জমি তৈরি করতে পারতাম, বাড়িগুলো শেষ করতে পারতাম।” মাঙ্গিলালের গলায় দুশ্চিন্তা ঝরে পড়ে, “হাতে কোনও কাজ নেই, খাব কী?”

প্রভাব পড়েছে সাহারিয়াদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য দিকগুলিতেও। পুরনো স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত দীপি, নতুন বসতিতে এসে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। “কাছাকাছি কোনও স্কুল নেই,” জানাচ্ছে সে। সবচেয়ে কাছের স্কুলটা এখান থেকে অনেক দূর। আরেকটু ছোটো বাচ্চাদের ভাগ্য কিঞ্চিৎ সদয় – রোজ সকালে একজন শিক্ষক আসেন খোলা আকাশের তলায় তাদের পড়াতে – স্কুলবাড়ি তৈরি হয়নি। “ওরা কিন্তু সবাই যায়,” আমার বিস্মিত মুখ দেখে হেসে ফেলেন মাঙ্গিলাল। মনে করান, এখন জানুয়ারির শুরু, ছুটি চলছে, তাই শিক্ষক আসেননি আজ।

পানীয় জলের জন্য একটা নলকূপ খোঁড়া হয়েছে, বড়ো বড়ো জলের ট্যাংক এদিক-সেদিক পড়ে আছে। নিকাশি ব্যবস্থার অভাব মেয়েদের জন্য একটা মস্ত সমস্যা। “আপনিই বলুন আমরা [মেয়েরা] কী করব?” বলছেন ওমবতী। “কোনও শৌচাগার নেই। আর জমি এমন চেঁছেপুছে সাফ করে দিয়েছে যে একটা গাছও নেই যার পিছনে মেয়েরা যেতে পারে। খোলা জায়গায়, কিংবা আশপাশের ফসলের মধ্যে গিয়ে তো আর ঢুকতে পারি না।”

The cheetah action plan noted that 40 per cent of revenue from tourism should be ploughed back, but those displaced say they are yet to receive even their final compensation
PHOTO • Priti David
The cheetah action plan noted that 40 per cent of revenue from tourism should be ploughed back, but those displaced say they are yet to receive even their final compensation
PHOTO • Priti David

চিতা অ্যাকশন প্ল্যানে বলা হয়েছিল পর্যটন থেকে আসা রাজস্বের ৪০ শতাংশ জনসাধারণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু উৎখাত হওয়া মানুষরা বলছেন পূর্ণ ক্ষতিপূরণ এখনও হাতে আসেনি তাঁদের

৩৫ বছর বয়সি পাঁচ সন্তানের মা বলছেন, ঘাস আর ত্রিপলের যে তাঁবুতে এখন মাথা গুঁজছেন তার চেয়েও বড়ো সমস্যা তাঁদের আছে: “জ্বালানি কাঠ আনতে বহু দূর যেতে হয়। জঙ্গল এখন অনেক দূর। [ভবিষ্যতে] কী করে চালাব?” অন্যরা বলছেন আসার সময়ে যেটুকু কাঠ নিয়ে আসতে পেরেছেন তাতেই কোনওমতে চালাচ্ছেন, আর জমি থেকে যা শিকড়বাকড় টেনে তুলতে পারেন। কিন্তু সেসব শীঘ্রই ফুরোবে।

এনটিএফপি-র বিপুল ব্যর্থতা ধীরে ধীরে কুনোর সর্বস্তরেই অনুভূত হতে শুরু করছে, আর চিতা প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বেড়া। পরের প্রতিবেদনে এবিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকবে।

চিতা অ্যাকশন প্ল্যানে বলা হয়েছিল, পর্যটন থেকে আসা রাজস্বের ৪০ শতাংশ এলাকার জনসাধারণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তৈরি হবে “চিতা সংরক্ষণ ফাউন্ডেশন, উৎখাত হওয়া মানুষদের জন্য। প্রতি গ্রামের চিতা নজরদারদের অর্থমূল্য দেওয়া হবে, রাস্তা, নিকাশি ব্যবস্থা, স্কুল এবং অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হবে আশপাশের গ্রামগুলিতে।” ১৮ মাস পেরিয়ে সেইসব প্রতিশ্রুতি এখনও শুধু কাগজকলমেই আছে।

“আর কতদিন আমরা এভাবে বাঁচব?” সওয়াল ওমবতী আদিবাসীর।

প্রচ্ছদ চিত্র: অ্যাড্রিয়ান টর্ডিফ

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David

P. Sainath is Founder Editor, People's Archive of Rural India. He has been a rural reporter for decades and is the author of 'Everybody Loves a Good Drought' and 'The Last Heroes: Foot Soldiers of Indian Freedom'.

Other stories by P. Sainath
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee